নদী: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
ট্যাগ: মোবাইল সম্পাদনা মোবাইল ওয়েব সম্পাদনা
ট্যাগ: মোবাইল সম্পাদনা মোবাইল ওয়েব সম্পাদনা
৬৭ নং লাইন: ৬৭ নং লাইন:


=== প্রক্রিয়া ===
=== প্রক্রিয়া ===
নদীর ক্ষয়কার্য – এর প্রক্রিয়া মূলতঃ পাঁচ প্রকার । যথা –
নদীর ক্ষয়কার্য – এর প্রক্রিয়া মূলত পাঁচ প্রকার । যথা –


'''১. জলপ্রবাহজনিত ক্ষয়''' (Hydraulic Action): নদীর প্রবল গতিসম্পন্ন জলপ্রবাহের আঘাতে নদীখাত ও নদীপার্শ্বস্থ অপেক্ষাকৃত কোমল ও আলগা শিলাখন্ডগুলি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ভেঙ্গে যায় ও জলপ্রবাহ দ্বারা বাহিত হয়ে এগিয়ে চলে । একে নদীর '''জলপ্রবাহজনিত ক্ষয়''' (Hydraulic Action) বলে ।
'''১. জলপ্রবাহজনিত ক্ষয়''' (Hydraulic Action): নদীর প্রবল গতিসম্পন্ন জলপ্রবাহের আঘাতে নদীখাত ও নদীপার্শ্বস্থ অপেক্ষাকৃত কোমল ও আলগা শিলাখন্ডগুলি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ভেঙ্গে যায় ও জলপ্রবাহ দ্বারা বাহিত হয়ে এগিয়ে চলে । একে নদীর '''জলপ্রবাহজনিত ক্ষয়''' (Hydraulic Action) বলে ।
৭৩ নং লাইন: ৭৩ নং লাইন:
'''২. ঘর্ষণজনিত ক্ষয়''' (Attrition): নদীবাহিত প্রস্তরখন্ডগুলি (Boulders) একটি অপরটির সাথে সংঘর্ষের ফলে ভেঙ্গে গিয়ে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রস্তরখন্ডে এবং অবশেষে বালুকণায় পরিনত হয় । একে নদীর '''ঘর্ষণজনিত ক্ষয়'''(Attrition) বলে ।
'''২. ঘর্ষণজনিত ক্ষয়''' (Attrition): নদীবাহিত প্রস্তরখন্ডগুলি (Boulders) একটি অপরটির সাথে সংঘর্ষের ফলে ভেঙ্গে গিয়ে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রস্তরখন্ডে এবং অবশেষে বালুকণায় পরিনত হয় । একে নদীর '''ঘর্ষণজনিত ক্ষয়'''(Attrition) বলে ।


'''৩. অবঘর্ষজনিত ক্ষয়''' (Corrasion): নদীবাহিত প্রস্তরখন্ডগুলি চলতে চলতে নদীখাতের সাথে সংঘর্ষে সৃষ্টি করে । ফলে নদীবক্ষ ভীষণভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় । নদীর এরূপ ক্ষয়কে '''বঘর্ষজনিত ক্ষয়''' (Corrasion) বলে ।
'''৩. অবঘর্ষজনিত ক্ষয়''' (Corrasion): নদীবাহিত প্রস্তরখন্ডগুলি চলতে চলতে নদীখাতের সাথে সংঘর্ষে সৃষ্টি করে । ফলে নদীবক্ষ ভীষণভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় । নদীর এরূপ ক্ষয়কে '''অবঘর্ষজনিত ক্ষয়''' (Corrasion) বলে ।


'''৪. দ্রবণজনিত ক্ষয়''' (Solution): স্থানীয় শিলাস্তরের বিশেষ প্রকৃতি (যেমন – চুনাপাথর, লবণশিলা প্রভৃতি) অথবা নদীর জলের বিশেষ প্রকৃতি (যেমন – অত্যাধিক অম্লত্ব বা ক্ষারত্ব) জনিত কারণে অনেকসময় নদীর গতিপথে অবস্থিত শিলা দ্রুত গলে গিয়ে বা দ্রবীভূত হয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় । নদীর এরূপ ক্ষয়কে '''দ্রবণজনিত ক্ষয়''' (Solution) বলে ।
'''৪. দ্রবণজনিত ক্ষয়''' (Solution): স্থানীয় শিলাস্তরের বিশেষ প্রকৃতি (যেমন – চুনাপাথর, লবণশিলা প্রভৃতি) অথবা নদীর জলের বিশেষ প্রকৃতি (যেমন – অত্যাধিক অম্লত্ব বা ক্ষারত্ব) জনিত কারণে অনেকসময় নদীর গতিপথে অবস্থিত শিলা দ্রুত গলে গিয়ে বা দ্রবীভূত হয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় । নদীর এরূপ ক্ষয়কে '''দ্রবণজনিত ক্ষয়''' (Solution) বলে ।


'''৫. বুদবুদজনিত ক্ষয়''' (Bubble Erosion): নদীর জলস্রোতের মধ্যে বুদবুদ সৃষ্টি হয় । এই বুদবুদ্গুলি জলপ্রবাহের মধ্যে চাপা পড়ে থাকলে তার মধ্যে বাতাসের চাপ প্রচন্ড থাকে । পরবর্তীতে এই বুদবুদ্গুলি মুক্ত হলে তা নদীপার্শ্বস্থ বা নদীমধ্যস্থ শিলাস্তরের গাত্রে ফেটে যায় । এইভাবে অজস্র বুদবুদ ক্রমাগত শিলাগাত্রে ফাটতে থাকলে শিলাগাত্রে ক্রমশঃ মৌচাকের ছিদ্রের মত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গর্ত সৃষ্টি হয় । একে নদীর '''বুদবুদজনিত ক্ষয়''' (Bubble Erosion) বলে।
'''৫. বুদবুদজনিত ক্ষয়''' (Bubble Erosion): নদীর জলস্রোতের মধ্যে বুদবুদ সৃষ্টি হয় । এই বুদবুদ্গুলি জলপ্রবাহের মধ্যে চাপা পড়ে থাকলে তার মধ্যে বাতাসের চাপ প্রচন্ড থাকে । পরবর্তীতে এই বুদবুদ্গুলি মুক্ত হলে তা নদীপার্শ্বস্থ বা নদীমধ্যস্থ শিলাস্তরের গাত্রে ফেটে যায় । এইভাবে অজস্র বুদবুদ ক্রমাগত শিলাগাত্রে ফাটতে থাকলে শিলাগাত্রে ক্রমশঃ মৌচাকের ছিদ্রের মত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গর্ত সৃষ্টি হয় । একে নদীর '''বুদবুদজনিত ক্ষয়''' (Bubble Erosion) বলে।
===নদীর ক্ষয়কার্যে সৃষ্টি হওয়া ভূমিরূপ===
নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্টি হওয়া বিভিন্ন ভূমিরূপঃ- উচ্চগতিতে নদীর গতিপথের ঢাল খুব বেশি থাকে ( সাধারণভাবে 22°-35°  ) ।  ফলেনদীর জলধারা প্রবলবেগে নিচের দিকে বয়ে চলে । এই অংশে নদীর প্রবল স্রোতের জন্য নদী উপত্যকা ভীষণভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় । ক্ষয়প্রাপ্তশিলাখণ্ডগুলিকে নদী নিচের দিকে বহন করে নিয়ে যায়  । তাই উচ্চগতিতে নদীর প্রধান কাজ ক্ষয় করা এবং ক্ষয়িত দ্রব্য বহন করা এইঅংশে ঢালের  হঠাৎ পরিবর্তনের ফলে কিছু কিছু সঞ্চয় কাজও হয়ে থাকে । ব্যাপকভাবে ক্ষয় , বহন ও স্বল্প পরিমাণে সঞ্চয়ের ফলেউচ্চগতিতে নানাধরনের ভূমিরূপ গঠিত হয়ে থাকে । এগুলি হল –
উচ্চগতিতে নদীর গতিপথের ঢাল খুব বেশি থাকে ( সাধারণভাবে 22°-35°  ) ।  ফলেনদীর জলধারা প্রবলবেগে নিচের দিকে বয়ে চলে । এই অংশে নদীর প্রবল স্রোতের জন্য নদী উপত্যকা ভীষণভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় । ক্ষয় প্রাপ্ত শিলাখণ্ড গুলিকে নদী নিচের দিকে বহন করে নিয়ে যায়  । তাই উচ্চগতিতে নদীর প্রধান কাজ ক্ষয় করা এবং ক্ষয়িত দ্রব্য বহন করা। এই অংশে ঢালের  হঠাৎ পরিবর্তনের ফলে কিছু কিছু সঞ্চয় কাজও হয়ে থাকে । ব্যাপকভাবে ক্ষয় , বহন ও স্বল্প পরিমাণে সঞ্চয়ের ফলে উচ্চ গতিতে নানা ধরনের ভূমিরূপ গঠিত হয়ে থাকে । এগুলি হল –


=== ১. I– আকৃতির উপত্যকা – ===
=== ১. I– আকৃতির উপত্যকা – ===

১০:১৮, ২৫ জুন ২০১৯ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

সুরমা নদী

নদী (সমার্থক শব্দ - তটিনী, তরঙ্গিনী, সরিৎ ইত্যাদি) সাধারণত মিষ্টি জলের একটি প্রাকৃতিক জলধারা যা ঝরনাধারা, বরফগলিত স্রোত অথবা প্রাকৃতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্ট হয়ে প্রবাহ শেষে সাগর, মহাসাগর, হ্রদ বা অন্য কোন নদী বা জলাশয়ে পতিত হয় । মাঝে মাঝে অন্য কোন জলের উৎসের কাছে পৌঁছানোর আগেই নদী সম্পূর্ণ শুকিয়ে যেতে পারে। নদীকে তার গঠন অনুযায়ী শাখানদী, উপনদী, প্রধান নদী, নদ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা যায়। আবার ভৌগোলিক অঞ্চলভেদে ছোট নদীকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে প্রাচীন বাংলার অনেক শহর। সাধারণত নদীর নামকরণ করা হয়েছে মেয়েদের নামে। M.Moriswaএর মতে নদী হল খাতের মধ‍্য দিয়ে প্রবাহিত জলধারা।-River is a canal flow.

নদীর জন্ম ও তাত্ত্বিক ধারণা

গুয়াহাটির শুক্লেশ্বর ঘাট থেকে ব্ৰহ্মপুত্রের দৃশ্য

সাধারণত উঁচু ভূমি বা পাহাড় গিরিখাত থেকে সৃষ্ট ঝরণাধারা, বরফগলিত স্রোত কিংবা প্রাকৃতিক পরিবর্তন থেকে নদীর জন্ম। হাজার হাজার ফুট উঁচু পাহাড় থেকে তীব্র বেগে ধেয়ে আসা জলরাশিতে এক ধরণের প্রচন্ড গতি সঞ্চারিত হয়। ছুটে আসা এই দ্রুত গতিসম্পন্ন জলস্রোত স্থলভাগ অতিক্রম করার সময় নদী নামে পরিচিত হয়। নদী যখন পাহাড়ি এলাকায় প্রবাহিত হয় তখন তার যৌবনাবস্থা। এ সময় নদী ব্যাপক খননকাজ চালায় এবং উৎপত্তিস্থল থেকে নুড়ি, বালি, পলি প্রভৃতি আহরণ করে অতি সহজে সমুদ্রে নিক্ষেপ করে। নদী এভাবেই আবহমানকাল ধরে পৃথিবীপৃষ্ঠকে ক্ষয় করে চলেছে। তার এ কাজ শেষ হয় তখন, যখন সমস্ত নদী-অববাহিকা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে সমভূমি বা প্রায় সমভূমি অঞ্চলে পরিণত হয়। উৎস থেকে মোহানা অবধি নদীর এই কাজকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়।

নদীর যৌবন অবস্থা

এ অবস্থায় নদীর প্রধান কাজ হল ক্ষয় এবং বহন। সাধারণত পার্বত্য অবস্থাটিই নদীর যৌবনকাল। এ সময় নদী বড় বড় পাথর বহন করে নিয়ে আসে। এসব পাথরের ঘর্ষনে নদীর তলদেশ ক্ষয় পেয়ে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়। পার্বত্য অঞ্চলে নদীর ক্ষয়ক্রিয়ার ফলে গিরিখাত, ক্যানিয়ন এবং জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়।

নদীর পরিপক্ক অবস্থা

এ অবস্থায় নদী একটু স্তিমিত হয়। ফলে নদীর বেগ ও বোঝা বয়ে নেওয়ার ক্ষমতাও কমে যায়। সাধারণত নদী মধ্যস্থানে বা উপত্যকায় প্রবেশ করলে এই পরিপক্ক বা প্রৌঢ় অবস্থা বোঝায়। এই অবস্থায় গিরিখাত, খরস্রোত, জলপ্রপাত প্রভৃতি আর দেখা যায় না। পাহাড়গুলো এবং তার মধ্যবর্তী জলবিভাজিকার উচ্চতাও আগের চেয়ে কম দেখা যায়।

নদীর বৃদ্ধাবস্থা

এই অবস্থায় নদীর ক্ষয় করার ক্ষমতা একেবারেই কমে যায়। তবে ভাঙার কাজ অল্পস্বল্প চলে। সাধারণত সমতল ভূমিতে নদীর এই অবস্থা হয়। এতে কোথাও কোথাও উঁচু ভূমি থাকতে পারে। এ সময় নদীর গতিমাত্রা এত কমে যায় যে, সামান্য বাধা পেলেই নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে। নদী এই অংশে খুব এঁকেবেঁকে চলে। পথে পথে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় নদী বর্ষাকালে প্রায়ই দু’কূলে বন্যার সৃষ্টি করে। নদীর পানি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে বালি ও পলি দুই তীরে ছড়িয়ে পড়ে। নদীর বুকেও চর জাগে। তবে নদী সবসময় ঠিক এভাবে চলে না। মাঝে মাঝে ভূকম্পনের ফলে নদী আবার যৌবন পেতে পারে। এ ছাড়া অন্যান্য কারনেও নদীর তীব্রতা ও গতি বাড়তে পারে।
ভূ-আন্দোলন যদি ব্যাপক আকার ধারণ করে, তখন তা গিরিজনিতে পর্যবাসিত হয়। এর ফলে নতুন নতুন পাহাড় পর্বতের সৃষ্টি হয়। পৃথিবীতে এমন কিছুসংখ্যক বিরল নদী আছে, যারা উত্থিত পর্বতের শক্তিকে পর্যুদস্ত করে তাদের ক্ষয়কার্য অব্যাহত রেখেছে এবং পর্বতরাজির উত্থান সংঘটিত হবার পরও তাদের অস্তিত্ত বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। ঐ সমস্ত নদীকে বলা হয় প্রাকভূমিরূপ নদী। উদাহরণস্বরূপ কলরেডো, সিন্ধু ও ব্রহ্মপুত্রের নাম বলা যেতে পারে। কলরেডো রকি পর্বতের এবং সিন্ধু ও ব্রহ্মপুত্র নদ হিমালয় পর্বতের উজানের অনেক আগে থেকেই সেখানে প্রবাহমান ছিল।[১]

নদীর প্রকারভেদ

প্রধান নদী সাধারণত পাহাড় হতে সৃষ্ট ঝরণা, হিমবাহ থেকে সৃষ্টি হয়, যেমন পদ্মা গঙ্গোত্রী হিমবাহ হতে উৎপন্ন হয়েছে। শাখানদী অন্য কোন নদী হতে উৎপন্ন হয়। যেমন বুড়িগঙ্গা ধলেশ্বরীর শাখা নদী। উপনদী সাধারণত অন্য নদীতে গিয়ে মেশে এবং প্রবাহ দান করে, যেমন আত্রাই নদী। কোন প্রধান নদী অন্য নদীর উপনদীও হতে পারে। আবার পুরুষ ও স্ত্রীবাচক শব্দের ভিত্তিতে এই জলস্রোতকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যে সকল জলস্রোতের নাম স্ত্রীবাচক তাদের নদী বলা হয়। এদের নাম দীর্ঘস্বর কারান্ত হয়। যেমনঃ মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলী, কুশিয়ারা ইত্যাদি। যে সকল জলস্রোতের নাম পুরুষবাচক তাদের বলা হয় নদ। এদের নাম হ্রস্বস্বর কারান্ত হয়। যেমনঃ কপোতাক্ষ, ব্রহ্মপুত্র, নীল নদ ইত্যাদি নদ। তবে এই নিয়ম সেসকল নদীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য,যাদের নাম পৌরাণিক।

নদীর ভৌগোলিক জ্ঞান ও গাণিতিক সূত্র

নদীর উৎসমূল সাধারণত একটি সু-উচ্চ পার্বত্য অঞ্চল, যেখানে বরফগলা পানি ও বৃষ্টির পানি একটি ঢাল বেয়ে মাধ্যাকর্ষণজনিত প্রবল স্রোতস্বিনী সৃষ্টি করে। একাধিক ক্ষুদ্র জলধারার পর্যায়ক্রমিক সমন্বিত প্রক্রিয়াই পর্বতের গা ক্ষয় করে নদীনালার সৃষ্টি করে।
পর্যায়গুলো হচ্ছে (হোমস, ১৯৫১)
পাতপ্রবাহ-মিহিনালি-শিরানালি-গুহানালি-নদী উপত্যকা। কার্যত নদী উৎসমূলে ক্ষয়কার্য কয়েকটি নিয়ামক দ্বারা প্রবাহিত, যেমন-

E = F (S+,Q+,V+,R-); যখন-
E = ক্ষয়ক্রিয়ার মাত্রা
F = কার্যচিহ্ন
S = ভূমির ঢাল
Q = প্রবাহমান
V = প্রবাহগতি
R = বন্ধুরতা ও শিলাকাঠিন্য

সহজেই অনুমেয় যে একটি নদীর ধারা সৃষ্টির পেছনে ঐসব অনুকূল ও প্রতিকূল নিয়ামকের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব অপরিহার্য। আবার নদীর প্রবাহগতি ও ক্ষয়ক্রিয়া পরস্পর আনুপাতিক কিন্তু প্রবাহগতিমাত্রা, অববাহিকার ঢাল ভূমিরূপের উপর নির্ভরশীল, যা ভূবিজ্ঞানী চেজি’র সমীকরণ অনুযায়ী নিম্নরূপ-
V = CVRS; যখন-
V = প্রবাহগতি
S = ভূমির ঢাল
R = ভূমি বন্ধুরতা ও শিলাকাঠিন্য
C = ধ্রুব সংখ্যা

যে কোন নদীর গঠনরূপ, পর্যায়, প্রকৃতি ও ক্রিয়াকান্ড নিয়তই বিবর্তনশীল। এ রূপান্তর পর্যায়গুলো ‘অর্গানিসমিক কনসেপ্ট’ অনুসারে একটি জীবন্ত প্রাণীর সাথে তুলনীয়। আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত নদীর তিনটি প্রধান পর্যায়-

তরুণ → পরিণত → বৃদ্ধ
ক্ষয়ভবন → পরিবহণ → সঞ্চায়ন

বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত প্রধান নদীগুলোর উৎস হিমালয় পর্বত। বরফগলা পানি ও বৃষ্টির পানি প্রবলবেগে উত্তর থেকে দক্ষিণে সর্পিল গতিতে বইতে থাকে। এদের গন্তব্যস্থল বঙ্গোপসাগর।[১]

বাংলাদেশের নদ-নদী

বলা হয়ে থাকে হাজার নদীর দেশ বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশে ঠিক কত নদী আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান বাংলাদেশ নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের কাছে নেই। কোন নদী কোথা থেকে উৎপত্তি হয়ে কোথায় শেষ হয়েছে কিংবা একটি নদী আরেকটি নদীকে কোথায় অতিক্রম করেছে এসব যাবতীয় তথ্য-প্রমাণ এখনো মানুষের অজানা। অনেক গবেষকদের মতে বাংলাদেশে উপনদী ও শাখানদীর মোট সংখ্যা ২২৫। তবে নদী, উপনদী ও শাখানদীর সর্বমোট সংখ্যা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যথেষ্ট মতদ্বৈততা আছে। একটি নদী থেকে অসংখ্য নদী সৃষ্টি হয়েছে। আবার কোন কোন নদী থেকে খাল বা ছড়া উৎপন্ন হয়েছে। এগুলোও প্রাকৃতিক নদীর অন্তর্ভুক্ত। যেমন- কর্ণফুলী নদী। মোহনা থেকে কাপ্তাই বাঁধ পর্যন্ত এই নদীতে অন্তত ২৪-২৫টি ছোটবড় উপনদী এসে মিশেছে। এই হিসাব থেকে অনুমান করলে বাংলাদেশকে হাজার নদীর দেশ বলা যেতে পারে। যশোর, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালীতে রয়েছে অজস্র নদী। এসব নদীর নামকরণও ঠিকমত হয়নি। আবার কোন কোন নদীর বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন নাম। বাংলাদেশের প্রধান নদী পাঁচটি- পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, পশুর ও কর্ণফুলী। এরপর আসে তিস্তা, গড়াই, মধুমতী, রুপসা, আড়িয়াল খাঁ, কুমার, আত্রাই, কীর্তনখোলা, বিষখালী ইত্যাদি নদ-নদীর নাম। এসব নদীর মধ্যে কোনটা বড় কোনটা ছোট বলা কঠিন। তবে অনুমান ও হিসাব কষে বাংলাদেশে কমপক্ষে ৭০০ নদী আছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।[১]

জীবন ও জীবিকায় নদীর ভূমিকা

নদীকে ঘিরেই বিশ্বের প্রতিটি শহর, বন্দর, গঞ্জ, বাজার প্রভৃতি গড়ে উঠেছে। মালামাল পরিবহন ও যোগাযোগের সহজ উপায় হলো নৌকা। মালামাল পরিবহণে খুবই স্বল্প খরচে নৌকার জুড়ি মেলা ভার। যিনি নৌকা চালান তিনি মাঝি হিসেবে চিহ্নিত। একসময় নৌকায় পাল তোলা থাকত। সময়ের বিবর্তনে এর স্থান দখল করেছে ইঞ্জিন চালিত নৌকা। মাঝ নদীতে জেলেরা উত্তাল তরঙ্গের সাথে যুদ্ধ করে মাছ আহরণ করে। নদী পাড়াপাড়ে ইজারাদার কর্তৃক কর হিসেবে অর্থ আদায় করতে দেখা যায়।

নদীর ক্ষয়কার্য

নদীর তিনপ্রকার কার্যের (যথা – ক্ষয়কার্য, বহনকার্য ও অবক্ষেপণকার্য) মধ্যে ক্ষয়কার্যই হল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ । কারণ ক্ষয়কার্যের উপরেই নদীর অবশিষ্ট আর দুটি কার্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ – দুরকমভাবেই নির্ভর করে । নদী তার বিশেষ কয়েকটি ধর্ম যেমন – প্রবল গতিশক্তি, জলরাশির চাপ, দ্রবণ প্রভৃতি দ্বারা নদী উপত্যকাসংশ্লিষ্ট শিলাস্তরকে বিভিন্নমাত্রায় ও বিভিন্নভাবে ক্ষয় করতে করতে প্রবাহিত হতে থাকে । নদীর এরূপ কার্যকে নদীর ক্ষয়কার্য (Erosional Works of River) বলা হয় ।

বৈশিষ্ট্য

নদীর ক্ষয়কার্য – এর বৈশিষ্ট্যগুলি হলো নিম্নরূপ –

ক) নদীর ক্ষয়কার্যের পরিমান নির্ভর করে নদীর গতিবেগ, জলের পরিমান, স্থানীয় শিলাস্তরের গাঠনিক প্রকৃতি প্রভৃতি বিষয়ের উপর ।

খ) নদীর ক্ষয়কার্যই প্রকারান্তরে নদীর অপর দুটি কার্য যথা – বহন কার্য ও অবক্ষেপণ কার্যকে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রন করে ।

গ) নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সামগ্রিক উচ্চতা ও প্রশস্ততা হ্রাস পেতে থাকে ।

ঘ) নদী অববাহিকার পরিবর্তন সাধিত হয় ।

প্রক্রিয়া

নদীর ক্ষয়কার্য – এর প্রক্রিয়া মূলত পাঁচ প্রকার । যথা –

১. জলপ্রবাহজনিত ক্ষয় (Hydraulic Action): নদীর প্রবল গতিসম্পন্ন জলপ্রবাহের আঘাতে নদীখাত ও নদীপার্শ্বস্থ অপেক্ষাকৃত কোমল ও আলগা শিলাখন্ডগুলি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ভেঙ্গে যায় ও জলপ্রবাহ দ্বারা বাহিত হয়ে এগিয়ে চলে । একে নদীর জলপ্রবাহজনিত ক্ষয় (Hydraulic Action) বলে ।

২. ঘর্ষণজনিত ক্ষয় (Attrition): নদীবাহিত প্রস্তরখন্ডগুলি (Boulders) একটি অপরটির সাথে সংঘর্ষের ফলে ভেঙ্গে গিয়ে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রস্তরখন্ডে এবং অবশেষে বালুকণায় পরিনত হয় । একে নদীর ঘর্ষণজনিত ক্ষয়(Attrition) বলে ।

৩. অবঘর্ষজনিত ক্ষয় (Corrasion): নদীবাহিত প্রস্তরখন্ডগুলি চলতে চলতে নদীখাতের সাথে সংঘর্ষে সৃষ্টি করে । ফলে নদীবক্ষ ভীষণভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় । নদীর এরূপ ক্ষয়কে অবঘর্ষজনিত ক্ষয় (Corrasion) বলে ।

৪. দ্রবণজনিত ক্ষয় (Solution): স্থানীয় শিলাস্তরের বিশেষ প্রকৃতি (যেমন – চুনাপাথর, লবণশিলা প্রভৃতি) অথবা নদীর জলের বিশেষ প্রকৃতি (যেমন – অত্যাধিক অম্লত্ব বা ক্ষারত্ব) জনিত কারণে অনেকসময় নদীর গতিপথে অবস্থিত শিলা দ্রুত গলে গিয়ে বা দ্রবীভূত হয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় । নদীর এরূপ ক্ষয়কে দ্রবণজনিত ক্ষয় (Solution) বলে ।

৫. বুদবুদজনিত ক্ষয় (Bubble Erosion): নদীর জলস্রোতের মধ্যে বুদবুদ সৃষ্টি হয় । এই বুদবুদ্গুলি জলপ্রবাহের মধ্যে চাপা পড়ে থাকলে তার মধ্যে বাতাসের চাপ প্রচন্ড থাকে । পরবর্তীতে এই বুদবুদ্গুলি মুক্ত হলে তা নদীপার্শ্বস্থ বা নদীমধ্যস্থ শিলাস্তরের গাত্রে ফেটে যায় । এইভাবে অজস্র বুদবুদ ক্রমাগত শিলাগাত্রে ফাটতে থাকলে শিলাগাত্রে ক্রমশঃ মৌচাকের ছিদ্রের মত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গর্ত সৃষ্টি হয় । একে নদীর বুদবুদজনিত ক্ষয় (Bubble Erosion) বলে।

নদীর ক্ষয়কার্যে সৃষ্টি হওয়া ভূমিরূপ

উচ্চগতিতে নদীর গতিপথের ঢাল খুব বেশি থাকে ( সাধারণভাবে 22°-35°  ) ।  ফলেনদীর জলধারা প্রবলবেগে নিচের দিকে বয়ে চলে । এই অংশে নদীর প্রবল স্রোতের জন্য নদী উপত্যকা ভীষণভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় । ক্ষয় প্রাপ্ত শিলাখণ্ড গুলিকে নদী নিচের দিকে বহন করে নিয়ে যায়  । তাই উচ্চগতিতে নদীর প্রধান কাজ ক্ষয় করা এবং ক্ষয়িত দ্রব্য বহন করা। এই অংশে ঢালের  হঠাৎ পরিবর্তনের ফলে কিছু কিছু সঞ্চয় কাজও হয়ে থাকে । ব্যাপকভাবে ক্ষয় , বহন ও স্বল্প পরিমাণে সঞ্চয়ের ফলে উচ্চ গতিতে নানা ধরনের ভূমিরূপ গঠিত হয়ে থাকে । এগুলি হল –

১. I– আকৃতির উপত্যকা –

পার্বত্য অঞ্চলে প্রবল জলস্রোত ও বাহিত শিলাখণ্ডের সঙ্গে নদীখাতের ঘর্ষণের ফলে পার্শ্বক্ষয় অপেক্ষা নিম্নক্ষয় অধিক হয় । এর ফলে নদীউপত্যকা  সংকীর্ণ ও গভীর হয়ে ইংরেজি ‘I’ আকৃতির আকার ধারণ করে ।

২. V-আকৃতির নদী উপত্যকা –

পার্বত্য অঞ্চলে প্রবল জলস্রোত ও শিলাখণ্ডের  ঘর্ষণের সঙ্গে ভুমিক্ষয় ও ধসের ফলে নিম্নক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে সামান্য পার্শ্বক্ষয়ও ঘটে । ফলে নদীউপত্যকা অনেকটা ইংরেজি ‘V’ আকৃতির আকার ধারণ করে ।

৩.  গিরিখাত –

বৃষ্টিবহুল অতি উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে নদীর নিম্নক্ষয়ের মাত্রা অত্যন্ত বেশি হওয়ায় নদী উপত্যকা সংকীর্ণ ও অতি গভীর হয় । এই ধরনেরঅতি গভীর ও সংকীর্ণ নদী উপত্যকাকেই গিরিখাত বলে । কোন কোন গিরিখাতের তলদেশের সঙ্গে সঙ্গে পার্শ্ববর্তী পর্বতের চুড়ার উচ্চতারপার্থক্য প্রায় কয়েক হাজার মিটার হয় ।উদাহরণ – সাধারণত হিমালয় প্রভৃতি নবীন ভঙ্গিল পার্বত্য অঞ্চলে গিরিখাত দেখতে পাওয়া যায় ।দক্ষিণ পেরুর কল্কা নদীর গিরিখাতটি হল বিশ্বের গভীরতম গিরিখাত ( সর্বাধিক গভীরতা ৪৩৭৫ মিটার ) ।

৪. ক্যানিয়ন –

মরুপ্রায় শুষ্ক অঞ্চলের অতিসংকীর্ন ও অতি গভীর গিরিখাতকে ক্যানিয়ন বলা হয় । উদাহরণ – আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো নদীরগ্র্যান্ড ক্যানিয়ন হল পৃথিবীর বৃহত্তম গিরিখাত । এর দৈর্ঘ্য  ৪৮৩ কিমি , প্রস্থ ১২ কিমি এবং সর্বাধিক গভীরতা ১.৯ কিমি । দক্ষিণ পেরুরকল্কা নদীর গিরিখাত ( এল-ক্যানন দ্য কলকা ) হল পৃথিবীর গভীরতম গিরিখাত ।

৫. জলপ্রপাত –

নদীর প্রবাহগতির মধ্যে জলতলের প্রভেদকে জলপ্রপাত বলে । অর্থাৎ নদী তার প্রবাহপথে হঠাৎ খাড়া ঢাল বরাবর নিচে পড়লে জলপ্রপাতেরসৃষ্টি হয় ।

জলপ্রপাত নানা কারনে সৃষ্টি হতে পারে । যেমন –

ক. চ্যুতি  -

নদীর গতিপথে হঠাৎ কোন চ্যুতির সৃষ্টি হলে খাড়া ঢালের সৃষ্টি হয় । আফ্রিকার জাম্বেসী নদীর ওপর জাম্বেসী নদীর জাম্বেসী জলপ্রপাতএইভাবে সৃষ্টি হয়েছে ।

খ. লাভাপ্রবাহ  -

নদীর গতিপথে  কঠিন লাভাস্তর অবস্থান করলে জলতলের প্রভেদ ঘটে । ফলে জলপ্রপাত সৃষ্টি হতে পারে ।

গ. ভূ-আন্দোলোন-

ভূ-আন্দোলনের ফলে কোন স্থানে খাড়া ঢালের সৃষ্টি হতে পারে । এরুপ স্থানের মধ্য দিয়ে নদী প্রবাহিত হলে জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয় ।

ঘ. ঝুলন্ত উপত্যকা –

পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহের ক্ষয়কাজের ফলে ঝুলন্ত উপত্যকার সৃষ্টি হয় । ক্যালিফোর্নিয়ার য়োসেমিতি জলপ্রপাত এইভাবে সৃষ্টি হয়েছে ।

ঙ. মালভূমির প্রান্তভাগ –

মালভূমির প্রান্তভাগের খাড়া ঢালে জলপ্রপাত সৃষ্টি হয় । বিহারের সুবর্ণরেখা নদীর উপর হুড্রু জলপ্রপাত এইভাবে সৃষ্টি হয়েছে ।

চ. কঠিন ও কোমল শিলাস্তরের পাশাপাশি অবস্থান –

কঠিন ও কোমল শিলাস্তর পাশাপাশি অবস্থান করলে কোমল শিলাস্তর দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে খাড়া ঢালের সৃষ্টি হয় । আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রেরনায়াগ্রা জলপ্রপাত এইভাবে সৃষ্টি হয়েছে ।

উদাহরণ –

পৃথিবীতে প্রায় ১০০ টির মত বড় জলপ্রপাত আছে । পৃথিবীর সুন্দর জলপ্রপাতগুলির মধ্যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট লরেন্স নদীর ওপরনায়াগ্রা জলপ্রপাত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার জাম্বেসী নদীর উপর ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত উল্লেখযোগ্য । দক্ষিণ আমেরিকার ভেনিজুয়েলায়  রিওকরোনি নদীর এঞ্জেল জলপ্রপাত পৃথিবীর উচ্চতম জলপ্রপাত (৯৮০ মিটার )। ভারতের কর্নাটক রাজ্যের শরাবতী নদীর ওপর গেরসোপ্পা ওযোগ জলপ্রপাত দেশের সর্বোচ্চ জলপ্রপাত ( ২৭৫ মিটার ) ।

জলপ্রপাতের পশ্চাদপসরণঃ-

নরম শিলা ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হতে হতে একসময় অপসারিত হয় এবং কঠিন শিলাস্তরও ক্রমশ ক্ষয় পেতে থাকে । এরুপঅবস্থায় জলপ্রপাত পেছনের দিকে সরে যায় । একে জলপ্রপাতের পশ্চাদপসরণ বলে ।

৬. খরস্রোতঃ-

পার্বত্য অঞ্চলে কঠিন ও কোমল শিলাস্তর যদি পাশাপাশি উলম্বভাবে অবস্থান করে , তাহলে নরম শিলা দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ধাপযুক্ত প্রবলগতিসম্পন্ন জলস্রোতের সৃষ্টি করে । একে  খরস্রোত বলে । খার্তুম থেকে আসোয়ান পর্যন্ত নীল নদের গতিপথে ৬ টি বিখ্যাত খরস্রোত লক্ষ্যকরা যায় ।

৭. কর্তিত শৈলশিরাঃ-

পার্বত্য অঞ্চলে নদীপথের ঢাল হঠাৎ বৃদ্ধি পেলে তীব্র জলস্রোতের প্রভাবে শৈলশিরা ব্যাপকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং নদী সোজা পথে বয়ে চলে। তিস্তা , তোর্সা , মহানন্দা প্রভৃতি নদী এইভাবে শৈলশিরা কেটে প্রবাহিত হয়েছে ।

৮. আবদ্ধ অভিক্ষিপ্তাংশঃ-

পার্বত্য অঞ্চলে নদীর গতিপথে শৈলশিরার অভিক্ষিপ্তাংশ অবস্থান করলে নদী সামান্য বাক নিয়ে প্রবাহিত হয় । এরুপ অবস্থায় দূর থেকেদেখলে শৈলশিরাগুলিকে আবদ্ধ দেখা যায় এবং নদীর গতিপথ আড়াল হয়ে যায় । এরুপ অবস্থাকে আবদ্ধ অভিক্ষিপ্তাংশ বলে ।

৯. মন্থকূপ –

উচ্চগতিতে নদীর প্রবল স্রোতের টানে বাহিত শিলাখণ্ডগুলি নদীখাতের সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতে অগ্রসর হয় । জলপ্রপাত বা খরস্রোতেরপাদদেশে জলের ব্যাপক ঘুর্ণীর ফলে এই সমস্ত শিলাখণ্ড নদীখাতে গোলাকার গর্তের সৃষ্টি করে । এই সমস্ত গর্তগুলিকে মন্থকূপ বলে ।

১০. প্রপাতকূপ –

জলপ্রপাতের জলধারা সজোরে আছড়ে পড়ার ফলে জলপ্রপাতের নিচে প্রবল জলস্রোতের আঘাত ও জলঘুর্নির সৃষ্টি হওয়ায় বুদবুদ ক্ষয়েরমাধ্যমে প্রায় গোলাকার গর্তের সৃষ্টি হয় তাকে প্রপাতকূপ বলে ।

নদীর পার্বত্যগতি ও সৃষ্ট ভূমিরূপ

নদীর পার্বত্য গতি : নদীর ক্ষয়সাধন ও বহনের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ:

পার্বত্যঅঞ্চলে নদীর প্রাথমিক গতি । এখানে নদীর স্রোত খুব প্রবল ও গভীরতা খুব বেশি । নদী এখানে খুব বেশি চওড়া হয় না । পর্বতের গা দিয়ে আঁকা বাঁকা পথে নদী এখানে বইতে থাকে এবং নানা রকমের ভূমিরূপ গঠন করে থাকে ।


আড়াআড়ি পাড় বা  অন্তর্বদ্ধ শৈলশিরার অভিক্ষিপ্তাংশ [Interlocking Spur]: পার্বত্য অঞ্চলে নদীর ক্ষয়কাজের ফলে যে সমস্ত ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, আড়াআড়ি পাড় বা  অন্তর্বদ্ধ শৈলশিরার অভিক্ষিপ্তাংশ [Interlocking Spur] হল তাদের মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপ । পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহ বা নদীর প্রবাহ পথে, নদীর ঘর্ষণের ফলে ক্ষয়প্রাপ্ত  ও খাঁজ-কাটা শৈলশিরাগুলিকে অভিক্ষিপ্তাংশ বলে। পার্বত্য অঞ্চলে কোনও নদীর গতিপথে অনেক সময় পাহাড়গুলির অভিক্ষিপ্তাংশ এমন ভাবে বিন্যস্ত থাকে যে, নদীর প্রবাহপথের একটি অংশ আর একটি অংশ থেকে আড়াল হয়ে যায় এবং নদীটি সামান্য একটু বাঁক নিয়ে এঁকে বেঁকে প্রবাহিত হতে বাধ্য হয় । এই অবস্থায় দূর থেকে দেখলে নদীটির গতিপথ আড়াল হয়ে এবং মনে হয় শৈলশিরাগুলি যেন আবদ্ধ অবস্থায় আছে, একে তখন আড়াআড়ি পাড় বা অন্তর্বদ্ধ শৈলশিরার অভিক্ষিপ্তাংশ [Interlocking Spur] বলে।


কর্তিত স্পার [Truncated Spur]: পার্বত্য উপত্যকা দিয়ে যখন হিমবাহ অগ্রসর হয়, সে সময় এই হিমবাহের গতিপথে যেসব স্পার [Spur] বা পর্বতের অভিক্ষিপ্তাংশ হিমবাহের গতিপথে বাধা সৃষ্টি করে থাকে, হিমবাহ সেগুলিকে কেটে বা ক্ষয় করে সোজা পথে অগ্রসর হয় এবং খাড়া ঢালের সৃষ্টি করে । এর ফলে পর্বতশিরার অবতল ও উত্তল ঢালটি হঠাৎ খাড়াভাবে হিমবাহ উপত্যকায় নেমে আসে । এইভাবে হিমবাহ দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত এবং ত্রিভূজের মতো দেখতে শৈলশিরাগুলোকে কর্তিত স্পার [Truncated Spur] বা পল কাটা স্পার বলে । যে কোনো নদীর পার্বত্য গতিপথে এই ধরনের বাধা থাকলে নদীটি এঁকে বাঁক প্রবাহিত হয়, যার ফলে আড়াআড়ি পাড় বা  অন্তর্বদ্ধ শৈলশিরার অভিক্ষিপ্তাংশ [Interlocking Spur] -এর সৃষ্টি হয় । হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে তিস্তা, তোর্সা, মহানন্দা প্রভৃতি নদীর গতিপথে কর্তিত শৈলশিরা[Truncated Spur] দেখা যায় ।

V -অক্ষরের উপত্যকা ও গিরিখাত [V-Shaped Valley & Gorge]: পার্বত্য অঞ্চলে নদীর ক্ষয়কাজের ফলে যে সমস্ত ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, V -অক্ষরের উপত্যকা ও গিরিখাত [V-Shaped Valley & Gorge] হল তাদের মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপ । পার্বত্য অঞ্চলে স্রোতের বেগ প্রচন্ড হওয়ায় নদী বড় বড় শিলাখন্ড, নুড়ি, পাথর প্রভৃতি বহন করে নামতে থাকে । শিলাখন্ডের আঘাতে নদীগর্ভ ক্ষয় হয় । পার্বত্যপথে নদীর ইংরেজি I অথবা সরু  V আকৃতির নদী-উপত্যকা যখন খুব গভীর হয়, তখন তাকে গিরিখাত [Gorge] বলে । গিরিখাত যতটা গভীর ততটা চওড়া নয় । কখনো কখনো এই সমস্ত গিরিখাতের তলদেশের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী পর্বতের চূড়ার মধ্যে উচ্চতার পার্থক্য প্রায় কয়েক হাজার মিটার হয়।

উদাহরণ- শতদ্রু, সিন্ধু, তিস্তা প্রভৃতি নদীর হিমালয়ের পার্বত্য গতিপথে গভীর নদী উপত্যকা বা গিরিখাত দেখতে পাওয়া যায় । সিন্ধুনদের অরুণ গিরিখাত বিখ্যাত । দক্ষিণ পেরুর কল্কা নদীর গিরিখাতটি হল বিশ্বের গভীরতম গিরিখাত যার গভীরতা  সর্বাধিক ৪,৩৭৫ মিটার ।

জলপ্রপাত [Waterfalls] ও প্রপাত কূপ [Plunge-pool] :  পার্বত্য প্রবাহে নদীর গতিপথে আড়াআড়ি ভাবে কোনো কঠিন শিলা থাকলে, সেই কঠিন শিলা পাশের কোমল শিলা থেকে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষয় পায় এবং কালক্রমে উঁচু হয়ে থাকে । নদীস্রোত সেই খাড়া ঢাল থেকে বিপুল বেগে নীচের কোমল শিলায় পড়ে জলপ্রপাতের [Walerfalls] সৃষ্টি করে । নদীর গতিপথের যে অংশে জলপ্রপাতের জলধারা সজোরে এসে পড়ে সেখানে এই জলধারা সজোরে এসে পড়ার ফলে মন্থকূপের সৃষ্টি হয় যাকে প্রপাতকূপ[Plunge-pool] বলে । জলপ্রপাতের উপস্থিতির ফলে নীচের কোমল শিলাস্তরের ভিতরের অংশের দ্রুত ক্ষয় হওয়ায় এই ধরনের জলপ্রপাত ধীরে ধীরে পিছনের দিকে সরে আসতে থাকে, একে জলপ্রপাতের পশ্চাদপসরণ বলে । দক্ষিণ-আমেরিকার ভেনিজুয়ালার অ্যাঞ্জেল জলপ্রপাতটি হল পৃথিবীর  উচ্চতম জলপ্রপাত ।

ক্যানিয়ন [Canyon] : পার্বত্য অঞ্চলে নদীর ক্ষয়কাজের ফলে যে সমস্ত ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, ক্যানিয়ন [Canyon] হল তাদের মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপ । বৃষ্টিহীন মরুপ্রায় শুষ্ক অঞ্চলে ইংরেজী ‘I’ অক্ষরের মতো গিরিখাতকে ক্যানিয়ন [Canyon] বলা হয় । দীর্ঘপথ ধরে বৃষ্টিহীন পার্বত্য মরূ অঞ্চল দিয়ে কোনো নদী প্রবাহিত হলে নদীর জলের স্বল্পতার জন্য নদীখাতে শুধু মাত্র নিম্নক্ষয় হয় । শুষ্ক অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম, ফলে দুই পাড় ভেঙ্গে জল নদীতে নেমে আসে না । তাই নদীর পার্শ্বক্ষয় বিশেষ হয় না । শুধুমাত্র নিম্নক্ষয়ের জন্য ‘I’ আকৃতির সুগভীর খাত বা ক্যানিয়ন [canyon] -এর সৃষ্টি হয় ।

উদাহরণ: আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় কলোরাডো নদী পৃথিবী বিখ্যাত গ্রান্ড ক্যানিয়ন সৃষ্টি করেছে যার দৈর্ঘ হল ৪৪৬ কিলোমিটার এবং কোথাও কোথাও এর গভীরতা ১.৬ কিলোমিটারেরও বেশি ।

যানবাহন

নৌকা ও নদী - একে-অপরের পরিপূরক। নদীতে মূলত নৌকা চললেও লঞ্চ, স্টিমার, স্পীডবোট, ট্রলার ইত্যাদির দেখা পাওয়া যায়।

সাহিত্য, চলচ্চিত্র, সঙ্গীতে নদী

বাংলা সাহিত্যে নদী গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তন্মধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর পদ্মা নদীর মাঝি অন্যতম। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সুজন-সখী’র গান হিসেবে ‘সব সখীরে পাড় করিতে নেব আনা আনা, তোমার বেলা নেব সখী’ - প্রেমের গানটি তৎকালীন সময়ে সকলের মুখে মুখে ছিল। সঙ্গীত জগতে ‘নদী’ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে। মান্নাদে’র এ নদী এমন নদী; জগজিৎ সিং এর ‘নদীতে তুফান এলে কুল ভেঙ্গে যায়, সহজেই তাকে দেখা যায়। মনেতে তুফান এলে বুক ভেঙ্গে যায় দেখানোর নেইজে উপায়!’পথিক নবীর আমার একটা নদী ছিল। কিংবা আরতী মুখোপাধ্যায়ের ‘নদীর যেমন ঝরনা আছে, ঝরনারও নদী আছে’ ইত্যাদি অমর সঙ্গীত হিসেবে টিকে থাকবে আজীবন। এছাড়াও, মোহনায় এসে নদী পিছনের পথটাকি ভুলতে পারে - গানটি বেশ জনপ্রিয়।

তথ্যসূত্র

  1. বাংলাদেশের নদীঃ মোকাররম হোসেন; পৃষ্ঠা ৩২, ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৫৮, ৫৯, ৬১ ও ৬২ কথাপ্রকাশ; দ্বিতীয় সংস্করণঃ আগস্ট ২০১৪

অধিক পঠন

বহি:সংযোগ

***