নবদ্বীপের শাক্তরাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
রাসযাত্রা
নবদ্বীপ রাস যাত্রায় ডুমুরেশ্বরী মাতা
অন্য নামরাস, পট পূর্নিমা, শাক্ত রাস, রাসযাত্রা, রাস-কালী পূজা
পালনকারীবাঙালি শাক্ত হিন্দু ধর্মাবলম্বী
ধরনবাঙালি শাক্ত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠান
উদযাপনপূজা, বলি, আড়ং[১], বিসর্জন
পালনরাস পূর্নিমা বা কার্তিকীপূর্ণিমার দিন বিশালাকার মূর্তি গড়ে প্রার্থনা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবী আরাধনা
শুরুমূলত পাটা পুজোর মাধ্যমে, বিজয়াদশমী বা কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা বা কালী পূজার দিন
সমাপ্তিরাস পূর্নিমা বা কার্তিকীপূর্ণিমার পরেরদিন প্রতিপদে আড়ং ও বিসর্জনের মাধ্যমে
তারিখ৩০ নভেম্বর ২০২০
১৯ নভেম্বর ২০২১
বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে নির্ধারিত হয়

শাক্তরাস নবদ্বীপের প্রধান উৎসব।[২] শরৎকালে শারদোৎসবের পরেই উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয় উৎসবের প্রস্তুতি এবং কার্তিকীপূর্ণিমায় নবদ্বীপের এই লোকায়ত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।[৩] শাক্তদেবীদের বিশাল মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করে শক্তি আরাধনাই নবদ্বীপের রাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রতিটি মূর্তিতে কারুকার্যময় নির্মাণশৈলী, বিচিত্র রূপকল্পনা, ধর্মীয় ব্যঞ্জনা, পণ্ডিতের গভীর উপলব্ধির সুস্থিত বহিঃপ্রকাশ, শিল্পীর নিখুঁত চিত্রায়ণ সম্মিলিত ভাবে অদ্বিতীয় উৎসবের রূপ দান করেছে।[৪]

প্রেক্ষাপট[সম্পাদনা]

রাস মূলত কৃষ্ণের ব্রজলীলার অনুকরণে বৈষ্ণবীয় ভাবধারায় অনুষ্ঠিত ধর্মীয় উৎসব। তবে নবদ্বীপের রাস প্রধানত শাক্ত রসাশ্রিত। নবদ্বীপের জনসমাজে আবহমানকাল থেকেই ধর্ম-সংস্কৃতিতে তান্ত্রিক বীরাচারের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। মদ-মাংস (পঞ্চমকারের প্রধানবস্তু) এবং আড়ম্বরের জৌলুস নিয়েই বীরাচারের আরাধনার পূর্ণতা ঘটে। তাই অনিবার্যভাবেই সেই সবকিছুকে নিয়ে নবদ্বীপের রাসে ঘটেছে তন্ত্রাচারের পূর্ণ প্রতিফলন। নবদ্বীপের শাক্তরাসের চাপে বৈষ্ণবীয় রাসের সাত্ত্বিক ধারা অনেকটাই কোণঠাসা। তবে নবদ্বীপে এই একই দিনে মন্দির অভ্যন্তরে রাধাকৃষ্ণের চক্ররাস হয়, তবে তার জাঁকজমকপূর্ণতা শাক্তরাসের পাশে ম্রিয়মান। জনশ্রুতি প্রচলিত আছে, নবদ্বীপে চৈতন্যদেব রাধাকৃষ্ণের রাস উৎসবের সূচনা করেছিলেন। সেই হিসাবে ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভেই রাসের সূচনা হয়েছিল। তবে চৈতন্যদেবের সন্ন্যাস গ্রহণের পর নবদ্বীপের বৈষ্ণব আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। গৌরাঙ্গ-পরিজনেরা বাধ্য হয়ে নবদ্বীপ ত্যাগ করে স্থানান্তরে গমন করেন। ফলে বৈষ্ণবীয় উৎসব অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে। দ্বিতীয় পর্যায়ে নবদ্বীপে যে রাস উৎসবের সূচনা হয় তা অভিনব এবং বাংলার ধর্মীয় ইতিহাসে তা অদ্বিতীয়।

কালীপূজা ও শাক্তরাসের প্রবর্তন[সম্পাদনা]

কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ প্রতিষ্ঠিত নবদ্বীপের আগমেশ্বরী মাতা

রাস উৎসবের সূচনার আগেই নবদ্বীপে কয়েকটি কালীমূর্তি পূজার প্রচলন ঘটেছিল। শাক্ত ঐতিহ্য বিভিন্ন মতবাদ অনুসারে বঙ্গদেশ তন্ত্রসাধনার ঐতিহাসিক পীঠস্থান ছিল। ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির দাপট বৃদ্ধি পাওয়ায় নিপীড়িত মানুষ তন্ত্রকে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে আঁকড়ে ধরেছে। দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতক থেকেই সমগ্র বাংলায় তান্ত্রিক সাধনার সামগ্রিক বিকাশ ঘটতে থাকে। সেই সময় সিদ্ধ তন্ত্রসাধকেরা নিষ্ঠা সহকারে নিয়ম-নীতি মেনে দেবীর উপাসনা করতেন। ঐতিহ্য অনুসারে বাংলায় তখনও তেমনভাবে মূর্তিপূজার প্রচলন ঘটেনি। কথিত আছে, নবদ্বীপের বিশিষ্ট তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের (জন্ম ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ) তন্ত্রসার গ্রন্থ রচনার পর কালীপূজার প্রসার ঘটে।[৫] কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দে রচিত কালী সপর্যাবিধি গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে তখনও তেমনভাবে কালীপূজার প্রসার ঘটেনি। জনশ্রুতি আছে, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রত্যক্ষ পোষকতায় এদেশে ব্যাপকভাবে কালীপূজার প্রসারণ ঘটে।[৬] মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পোষকতায় নবদ্বীপ যখন গঙ্গা ভাঙনে বিপর্যস্ত তখন নবদ্বীপ সংলগ্ন ভাগীরথীর অপরপাড়ে অবস্থিত কুলিয়া পাহাড়পুরে অন্তত তিনটি শক্তিপূজার প্রচলন করেছিলেন।[৭]

পট পূর্ণিমা[সম্পাদনা]

উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে রাজা গিরীশচন্দ্রের পোষকতায় প্রবর্তন হয় রাস উৎসবের। সূচনাপর্বে পুজো হতো পটে, নাম ছিল পট-পূর্ণিমা’। পরবর্তী পর্যায়ে মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করে পূজো অনুষ্ঠিত হতো। এই সময় রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও ঈশ্বরচন্দ্রের আমলে প্রবর্তিত কালীমূর্তিগুলির পূজার কাল পরিবর্তিত হয়ে কার্তিকী পূর্ণিমায় হয়েছিল এবং রাস উৎসবকে প্রাচীনত্ব প্রদান করেছিল।

ইতিহাসের আলোয় শাক্ত রাস[সম্পাদনা]

"সেকালের দারোগা কাহিনী" থেকে[সম্পাদনা]

নবদ্বীপের শাক্তরাস বিষয়ে প্রথম আলোকপাত করেছেন গিরিশচন্দ্র বসু। ইনি ১৮৫৩-১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে নবদ্বীপ-শান্তিপুর ও কৃষ্ণনগরের দারোগা ছিলেন। তার রচিত “সেকালের দারোগা কাহিনী” (প্রকাশকাল ১৮৮৮ খ্রি.) থেকে তৎকালীন নবদ্বীপের ভৌগোলিক অবস্থান সহ সমাজ-সংস্কৃতিমূলক বিবিধ সংবাদ জানা যায়। নবদ্বীপের রাস সম্পর্কে তিনি লিখেছেন,

গিরিশচন্দ্র বসুর বর্ণনায় নবদ্বীপের শাক্তরাস[সম্পাদনা]

গৌরাঙ্গিনী যোগনাথ তলা
গৌরাঙ্গিনী মাতা যোগনাথ তলা
বিন্ধ্যবাসিনী
বিন্ধ্যবাসিনী

গিরিশচন্দ্র বসুর বর্ণনায় উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে নবদ্বীপের শাক্তরাস উৎসবের একটি স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। বর্তমানে লুপ্ত পুরাণগঞ্জে বিন্ধ্যবাসিনী পূজিতা হতেন। এখানে রাধীকালুর ভিটেয় লছমনদাস শ্রীবাসঅঙ্গন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি তোতা রামদাস বাবাজির শিষ্য ছিলেন। ১৮৫৩-৬০ খ্রিষ্টাব্দে গিরিশচন্দ্র বসু পুরাণগঞ্জকে দেখেছিলেন নির্দিষ্ট স্থানে। পরে শ্রীবাসঅঙ্গন গঙ্গাগর্ভে নিমজ্জিত হওয়ায় পর ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় বর্তমান স্থানে স্থাপন করা হয়। ১৮৬০-৭০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সংঘটিত প্রবল বন্যা বা ভূমিকম্পে পুরাণগঞ্জ ধ্বংস হয়েছিল। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রবল বন্যা হয়েছিল। সম্ভবত এই বন্যাতেই পুরাণগঞ্জ গঙ্গাগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এরপর এখানকার অধিবাসীরা বর্তমান শ্রীবাসঅঙ্গন পাড়ায় উঠে আসেন। এরপর থেকে পুরাণগঞ্জের বিন্ধ্যবাসিনী শ্রীবাসঅঙ্গন পাড়ায় পূজিতা হতে থাকে। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে গোষ্ঠীকোন্দলে এই পূজা ভাগ হয়ে যায়। একটি গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করে রামসীতাপাড়ায় খড়েরগোলা বিন্ধ্যবাসিনী আর অপরটি যোগনাথতলায় গৌরাঙ্গিনী নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজপুরোহিত অসীমকুমার ভট্টাচার্যের মতানুশারে, গোলকীনাথ ন্যায়রত্ন এই দেবীর ধ্যানমন্ত্র রচনা করেছিলেন।

রাস প্রসঙ্গে কান্তিচন্দ্র রাঢ়ি[সম্পাদনা]

নবদ্বীপ গবেষক কান্তিচন্দ্র রাঢ়ি রাস প্রসঙ্গে অনেক তত্ত্বের অবতারণা করেছেন, নবদ্বীপ মহিমা বইয়ে লিখেছেন,

এখানে উল্লিখিত মহারাজ যে গিরীশচন্দ্র তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে বারোয়ারি পূজার প্রচলন ছিল না। নদিয়ার রাজার শিল্পের কদর বুঝতেন অকুণ্ঠ চিত্তে সম্মান জানাতেন জগৎস্রষ্টাকে।

বৈষ্ণব রাসের উদ্ভব এবং শাক্ত রাসের সাথে সংঘাত[সম্পাদনা]

ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত মুষ্টিমেয় ভক্তিবাদীদের হাতে যখন বৈষ্ণবীয় ভক্তি আন্দোলন দানা বঁাধে তখন কৌলাচারী তন্ত্রসাধকদের সঙ্গে এদের শুরু হয় সংঘাত। প্রায় তিনশো বছর এই দুই সম্প্রদায়ের দ্বন্দ্ব ছিল অব্যাহত। নবদ্বীপের রাসেও পড়েছিল এর অনিবার্য প্রভাব। আজকের বাতাবরণ সম্পূর্ণ আলাদা, আজ কোনো কুটিল দ্বন্দ্ব আবিলতা নেই।

কিছু নবদ্বীপ রাস প্রতিমার ইতিহাস[সম্পাদনা]

রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে[সম্পাদনা]

রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের (১৭২৮-১৭৮২ খ্রী) পৃষ্ঠপোষকতায় নবদ্বীপের শাক্ত রাসের প্রভূত উন্নতি হয়েছিল, সেই সময় রাজ পোষকতায় নানা পূজা হয় এবং রাজার নাম সংকল্প করা হত।

এলানিয়া কালী
এলানিয়া কালী
তেঘরিপাড়ায় বড়শ্যামা মাতা
তেঘরিপাড়ায় বড়শ্যামা মাতা
চারিচারাপাড়ায় ভদ্রাকালী
চারিচারাপাড়ায় ভদ্রাকালী
ব্যাঁদড়াপাড়ার নৃত্যকালী
ব্যাঁদড়াপাড়ার নৃত্যকালী
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে প্রতিষ্ঠিত দেবী

এলানিয়া কালী[সম্পাদনা]

শক্তি উপাসক ভৃগুরামের উত্তরপুরুষদের কাছে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, ঢাকা নিবাসী ভৃগুরাম ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে নবদ্বীপে এসে ভাগীরথীর তীরে মহাশ্মশানে পঞ্চমুণ্ডির আসন স্থাপন করে শক্তি আরাধনায় ব্রতী হন, এই কালীর নাম এলানিয়াকালী। কথিত আছে, প্রখ্যাত পণ্ডিত শঙ্কর তর্কবাগীশ (জন্ম, আনুমানিক ১৭১৭ খ্রি.) যখন রাজসভার সভাপণ্ডিত তখন এলানিয়া কালী পূজার প্রবর্তন হয়েছিল। এটিকেই নবদ্বীপ রাস পূর্ণিমা শাক্ত মূর্তি হিসাবে ধরা হয়। এই প্রতিমা পঞ্চমুন্ডি আসনে বিরাজমান। এটি সর্বপ্রথম পূজা হিসাবে ধরা হয়ে থাকে।

বড় শ্যামা[সম্পাদনা]

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ভৃগুরামকে ১২০০ বিঘা জমি দান করেন। ভৃগুরামের তিন পুত্র এখানে বসতি স্থাপন করলে এই অঞ্চলের নাম হয় তেঘরি। ভৃগুরামের জ্যেষ্ঠ পুত্র গদাধর তেঘরিপাড়ায় বড়শ্যামা মাতার পূজা প্রতিষ্ঠা করেন।

চারিচারাপাড়ায় ভদ্রকালী[সম্পাদনা]

এই সময়ে চারিচারপাড়ায় ভদ্রকালী পূজার সূচনা হয় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণায়। শোনা যায়, সেকালে রাজবাড়ি থেকে পূজা আসত, মহারাজের নামে সংকল্প হতো।

অন্যান্য[সম্পাদনা]

কুলিয়া তখন নদী ভাঙনে পড়েনি, ফলে পূজা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনও প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়নি। কুলিয়া গ্রামে এই তিনটি শক্তিপূজার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তিনি এলানিয়াকালীর পূজা প্রাঙ্গণে একটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন এবং এখানে অলোকনাথ শিবের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশ্বরচন্দ্রও ছিলেন কৌলাচারী। তিনিও হাজার হাজার মণি নৈবেদ্য, বস্তু-খণ্ড এবং নানা উপাচারে কালী আরাধনায় ব্রতী থাকতেন। তাঁর আমলে (১৭৮৮– ১৮০২ খ্রি.) প্রথম নবদ্বীপের মূল ভূখণ্ডে রাজাদের পোষকতায় শক্তি পূজার প্রচলন ঘটে। অন্তত তিনটি শক্তিপূজা প্রচলনের ক্ষেত্রে তিনি প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্যে আগমেশ্বরী পাড়ার মহিষাসুরমর্দিনী, হরিসভাপড়ার ভদ্রকালী এবং ব্যাঁদড়াপাড়ার নৃত্যকালী (কুলিয়া-পাহাড়পুরে)। মহিষাসুরমর্দিনী পূজা প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রাজপুরোহিত লক্ষ্মীকান্ত ন্যায়ভূষণ। সূচনা পর্বে এই শক্তিপূজাগুলি অনুষ্ঠিত হত অমাবস্যা তিথিতে। কারণ ভৃগুরামের মতো শক্তিসাধক এবং লক্ষ্মীকান্ত ন্যায়ভূষণের মতো খ্যাতিমান পণ্ডিত যখন দেবীপূজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তখন তা শাক্ত-ঐতিহ্য মেনেই করেছিলেন। সূচনা পর্বে এই দেবীপূজাগুলি রাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়নি, কারণ তখনও নবদ্বীপে বৈষ্ণবীয় উৎসব অনুষ্ঠানের প্রচলন ঘটেনি।

রাজা গিরীশচন্দ্র আমলে[সম্পাদনা]

নদিয়ারাজ গিরীশচন্দ্র (১৮০২-৪২ খ্রি.) ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্রের প্রকৃত উত্তরসূরি। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় বাংলার মাটিতে তন্ত্রাচারের যে বীজ বপন করেছিলেন, গিরীশচন্দ্রের উপযুক্ত পরিচর্যা ও জলসিঞ্চনে তা হয়ে উঠেছিল মহীরূহ। গিরীশচন্দ্র ছিলেন নিষ্ঠাবান তন্ত্রসাধক ও পরধর্মসহিষ্ণু। বৈষ্ণব-ঐতিহ্য অনুসারে তীর আমলেই নবদ্বীপে গড়ে উঠেছিল বৈষ্ণবীয় মন্দির এবং সূচনা হয়েছিল উৎসব, অনুষ্ঠান ও চৈতন্যচর্চার। তার আমলেই প্রচুর অর্থব্যয়ে হটহটিকা বাসন্তীপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রকাণ্ড মূর্তি নির্মাণ করে। শান্তিপুর সন্নিহিত সূত্রাগড়ে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন র্তারই কীর্তি। নবদ্বীপের রথযাত্রা ও দোলযাত্রায় তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন। ব্যাদড়বংশের আদি পুরুষ রাজারাম পূর্ববঙ্গ থেকে নবদ্বীপে এসেছিলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে। বর্তমানে (২০০৫ খ্রিঃ অনুযায়ী) এই বংশের নবম পুরুষ আসীন। হিসাব অনুযায়ী ২৫×৯ = ২২৫ বছর আগে অর্থাৎ (২০০৫-২২৫) = ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে তিনি নবদ্বীপে এসেছিলেন, এই তথ্যানুযায়ী ব্যাদাড়াপাড়ার শবশিবার প্রতিষ্ঠাকালও কৃষ্ণচন্দ্রের উত্তরকালে। কারণ রাজারাম নবদ্বীপে এসে প্রথমে ঘর গোছানোর কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন; বাসস্থান নির্মাণ, অন্নের সংস্থান প্রভৃতি বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের পর তবেই তিনি শক্তিপূজা প্রবর্তনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ক্ষেত্র সমীক্ষা করে জানা যায় যে, ব্যাদাঁড়াবিংশের আদিপুরুষ রাজারাম কর্তৃক শব্বশিবার পূজা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল গিরীশচন্দ্রের আমলে। মূর্তির অভিনব রূপ কল্পনায় সাংখ্যের ত্রিগুণাত্মিক প্রকৃতিতত্ত্ব এবং তন্ত্রের বিপরীতরতাতুরা তত্ত্বের মিশ্রণ ঘটেছে এখানে।
শবশিবা ছাড়াও তারই আমলে যেসব রাস প্রতিমা পুজোর সূচনা ঘটেছিল নবদ্বীপে, তার মধ্যে অন্যতম হলো—নন্দীপাড়ার মহিষাসুরমর্দিনী, পুরাণগঞ্জ ও বুড়োশিবতলার বিন্ধ্যবাসিনী, মহাপ্রভুপাড়ার গোঁসাইগঙ্গা, দণ্ডপাণিতলার মুক্তকেশী, আমপুলিয়াপাড়ার শবশিবা, রামসীতাপাড়ার কৃষ্ণমাতা ইত্যাদি। আমপুলিয়াপাড়ার শবশিবা ছিলেন মহামহােপাধ্যায় শিতিকণ্ঠ বাচস্পতির ইষ্টদেবী।
পুরাণগঞ্জ গঙ্গাগর্ভে নিমজ্জিত হওয়ার পর এখানকার বিন্ধ্যবাসিনী উঠে আসে শ্রীবাস অঙ্গনে।

পাটা পূজা[সম্পাদনা]

পাটা পূজা, কোজাগরী পূর্ণিমার দিন পাটা পূজা

নবদ্বীপের রাস উৎসবের সূচনা হয়ে যায় পাটা পুজোর মাধ্যমে। পাটা হলো শাল কাঠের তৈরী একটি কাঠামো, এর উপরেই মূল ঠাকুরের কাঠামো তৈরী করা হয়। দেবী পূজার মতো পাটা পূজাও মহা সমারোহে উদ্‌যাপন করা হয় বিজয়া দশমী, কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা এবং কালী পুজোর দিন এই পাটা পুজো হয়। ওই দিন মহা ধুমধাম সহকারে এই পাটা পূজা করা হয়। এরপরই ঠাকুর তৈরির কাজ শুরু করা হয়। সাধারণত সারা বাংলায় লক্ষ্মী পুজোর দিন বেশি আওয়াজ না করার রীতি আছে তবে নবদ্বীপে পাটা পুজোর সময় (লক্ষ্মী পুজোর দিন) বাজি, শব্দ বাজি ফাটানো হয়।[৮]

মৃৎশিল্প ও নবদ্বীপ রাস[সম্পাদনা]

সূচনাপর্বে রাস উৎসব 'পট' পূজার মাধ্যমে হতো। সেই সময় মৃৎশিল্পীরা নবদ্বীপে ছিলেন না। কথিত আছে, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমন্ত্রণে মৃৎশিল্পীরা নাটোর থেকে নবদ্বীপে আসেন। মোহিত রায় জানিয়েছেন, "কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীরা ইংরেজ রাজপুরুষদের পোষকতায় বিকাশ লাভ করেছিল।" পটপূজার সময় অতিক্রমণের পর ক্রমে মৃন্ময়ী মূর্তিপূজোর প্রচলন হয়। তখন লোকমুখে রাস উৎসব ‘রাসকালী” পূজা নামে পরিচিত ছিল। তারপর থেকে বিশাল বিশাল মূর্তি নির্মাণে নবদ্বীপের শিল্পীদের অসাধারণ দক্ষতা কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। অনেক জায়গাতেই বিশাল মূর্তি হয় কিন্তু নবদ্বীপের রাসের মূর্তি বিশালত্বের মধ্যেও প্রতিটি অঙ্গের আনুপাতিক মাপ বজায় রাখা হয়।

নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের নির্মাণশৈলীর প্রশংসায় দেশ-বিদেশে সমান প্রচারিত। নবদ্বীপের শিল্পীরা বিশালাকার মূর্তি নির্মাণে স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখেছেন। নবদ্বীপের মৃৎশিল্পীদের সম্পর্কে ড. সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন,

নবদ্বীপের খ্যাতিমান মৃৎশিল্পীরা হলেন – সন্দু পাল, ফন্তে পাল, বেঁটে পাল, পাল, নানু পাল, বিজন পাল, জগদীশ বিশ্বাস, রমেন পাল (জুনিয়র), প্রদীপ৷ দাস, নাড়গোপাল দাস, অচিন পাল, ললিত পাল, কান্তি পাল, শিবু, পাল, কাশীনাথ পাল, হাজারী পাল, বলাই পাল, কালী পাল, ধর্ম পাল, প্রশান্ত পাল, গৌরাঙ্গ পাল, দেবাশিস পাল ,গৌতম সাহা প্রমুখ। পাথরের মূর্তি নির্মাণে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন রমেন পাল (১৯২৬-৯২ খ্রি.)।[৯]

প্রতিমা ও চালচিত্র[সম্পাদনা]

চালচিত্র সহ নবদ্বীপের ভদ্রকালী মাতার হাতে আঁকা চিত্র

নবদ্বীপ রাসে শতাধিক বছরের প্রাচীন যে সকল শাক্ত দেবী পূজিত হয়, সেই সকল প্রতিমার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল চালচিত্রের প্রয়োগ। গৌরাঙ্গিনী মাতা, মহিষমর্দিনী, ভদ্রকালী, নৃত্যকালী, শবশিবা মাতা, দেবী গোষ্ঠমাতা, রণকালী মাতা প্রভৃতি প্রতিমাগুলিতে চালচিত্রের ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায়। প্রতিমায় চালচিত্রের প্রয়োগ নবদ্বীপ রাসযাত্রার প্রাচীনত্বকে তুলে ধরে। বিখ্যাত লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ সুধীর চক্রবর্তী তার সুধীর চক্রবর্তী রচনাবলী, ১ খণ্ড পুস্তকে নবদ্বীপ চারিচারাবাজারের ভদ্রকালী মাতার চিত্রসহ চালচিত্রের বর্ণনা দিয়েছেন।

নবদ্বীপ শাক্তরাসের চিত্রসম্ভার[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. সংবাদদাতা, নিজস্ব। "রাসে পরিবর্তনের ছোঁয়া, খুশি নবদ্বীপ - Anandabazar"anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০২-২২ 
  2. "Fairs & Festivals of West Bengal | WEST BENGAL INFORMATION & CULTURAL CENTRE" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০২-২১ 
  3. "আনন্দবাজার পত্রিকা - কলকাতা"archives.anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-১১-২০ 
  4. নবদ্বীপের ইতিবৃত্ত। নবদ্বীপ, নদিয়া: মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল। জানুয়ারী ২০১৩। 
  5. মিত্র, সুধীরকুমার (১৯৫৮)। দেব-দেবীর কথা ও কাহিনী। ৪২ বিধান সরণি, কলকাতা: ডি. এম. লাইব্রেরী। পৃষ্ঠা ২৩০। 
  6. দাসগুপ্ত, শশিভূষণ (১৯৬০)। ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য (দ্বিতীয় সংস্করণ)। ৩২এ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড, কলিকাতা: সাহিত্য সংসদ। পৃষ্ঠা ৭৫। 
  7. বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবাশিস। "আজও অটুট রাসের মেজাজ"anandabazar.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-১১-২০ 
  8. সংবাদদাতা, নিজস্ব। "কোজাগরীতেই শুরু রাসের প্রস্তুতি"anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০২-২২ 
  9. "রাসে মাতোয়ারা নবদ্বীপ"। ৫ নভেম্বর ২০১৭। 

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

অতিরিক্ত পঠন[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]