আদি-বিশ্বায়ন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

আদি বিশ্বায়ন বা প্রারম্ভিক আধুনিক বিশ্বায়ন হল বিশ্বায়নের ইতিহাসের একটি পর্যায়বিশেষ, যার ব্যপ্তি ছিল মোটামুটি ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রাচীন বিশ্বায়নের পরবর্তী সময়কাল। এর প্রথম সংজ্ঞা দেন ইতিহাসবিদ এ. জি. হপকিন্স এবং ক্রিস্টোফার বেইলি; এ সংজ্ঞা দ্বারা উত্তরোত্তর বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের সময়কাল নির্দেশ করা হয়, যা উনিশ শতকের তথাকথিত "আধুনিক বিশ্বায়ন"-এর পূর্ববর্তী সময়কাল।[১]

আধুনিক বিশ্বায়ন ও আদি বিশ্বায়নের সময়কালের পার্থক্য করা হয় আঞ্চলিক বিস্তার (expansionism) দ্বারা, যা ছিল বৈশ্বিক বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি প্রক্রিয়া; এর আরেকটি পার্থক্য হল তথ্যের আদান-প্রদান বৃদ্ধি। আদি বিশ্বায়নের সময়কালটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মত সংস্থাসমূহের বাণিজ্যিক অভিযানের জন্য পরিচিত। এ সময় বিশ্বের নেতৃত্ব চলে আসতে থাকে পশ্চিম ইউরোপের জাতিসমূহের নিকট; এবং শক্তিশালী জাতিদের মধ্যে বৃহৎ পরিসরে যুদ্ধ ও সংঘাত দেখা দেয়, যেমন: ত্রিশ বছরব্যপী যুদ্ধ (Thirty Years War)। এবং অভিনব বাণিজ্যিক পণ্যের উদ্ভব ঘটে, বিশেষকরে দাস-বাণিজ্য। ত্রিভুজ বাণিজ্য ("The Triangular Trade", ইউরোপ-আফ্রিকা-আমেরিকার মধ্যবর্তী বাণিজ্য, যার কতৃত্ব ছিল ইউরোপের হাতে)-এর দ্বারা ইউরোপীয় জাতিসমূহ পশ্চিম গোলার্ধের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের কর্তৃত্ব পেয়ে যায়। এ মহাদেশগুলোর মধ্যে নানান প্রকার উদ্ভিদ, প্রাণী ও রোগ-জীবাণুর আদান প্রদান, যাকে আলফ্রেড কসবি কলম্বিয়ান আদান-প্রদান (Columbian Exchange) নামে আক্ষায়িত করেন, এসময়কার ঘটনাবলীতে বিস্তর প্রভাব ফেলে। আদি বিশ্বায়নের সময়কার বাণিজ্য ও যোগাযোগব্যবস্থা প্রভাব ফেলে ইউরোপীয়, মুসলিম বিশ্ব, ভারতীয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় ও চীনের বিপুল জনগণের ওপর, বিশেষ করে ভারত মহাসাগর অঞ্চলে এর ব্যপক প্রভাব পড়ে।

আদি বিশ্বায়ন থেকে আধুনিক বিশ্বায়নে উত্তরণের একটি নির্দেশক হল এসময়কার জটিলাকার যোগাযোগব্যবস্থা, যার মূলভিত্তি ছিল পুঁজিবাদী ও প্রযুক্তিগত আদান-প্রদান; তবে এর ফলশ্রুতিতে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান উল্লেখযোগ্যভাবে রহিত হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

বর্ণনা[সম্পাদনা]

আমস্টারডাম স্টক এক্সচেঞ্জের প্রাঙ্গণ, আনুমানিক ১৬৭০ খ্রীষ্টাব্দ।

যদিও ১৭শ ও ১৮শ শতকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, তবু্‌ও আদি বিশ্বায়ন পর্যায়ে পশ্চিম ইউরোপের সাথে প্রাচ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বিদ্যমান ব্যবস্থাসমূহের যোগাযোগ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়।[১] আদি বিশ্বায়ন পর্যায়টি ছিল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিদ্যমান সরকার, প্রথাগত ব্যবস্থাসমূহ, বৈশ্বিক অঞ্চল, ধর্মীয় রীতি ইত্যাদির সাথে পশ্চিমা বিশ্বের "নব বিশ্ব ব্যবস্থা" ("new world order") প্রক্রিয়ার একটি সামঞ্জস্য বিধানের সময়; তার মধ্যে ছিল বৈশ্বিক বাণিজ্য, সাম্রাজ্যবাদ ও রাজনৈতিক মৈত্রিস্থাপনের প্রক্রিয়াসমূহ; ইতিহাসবিদ এ. জি. হপকিন্সের ভাষায় এটি, "সমসাময়িক বিশ্বের পণ্য এবং নিকট অতীতেরও পণ্য"।[১]

হপকিন্সের মতে, "বিশ্বায়ন একটি অসম্পূর্ণ প্রক্রিয়া হিসেবে রয়ে গেছে: এটি খণ্ডিতকরণকে ত্বরাণ্বিত করে আবার ঐক্যেরও উদ্ভব ঘটায়; এটি পশ্চাদপসরন করতে পারে আবার অগ্রসরও হতে পারে; এর ভৌগোলিক পরিধি জোরালোভাবে আঞ্চলিক পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করতে পারে; এর ভবিষ্যৎ গতিপথ দ্ব্যর্থতার সাথে অনুমান করা যায় না- এবং এর অন্তর্নিহিত কোন যুক্তি আছে এমনটা অবশ্যই অনুধাবন করা যায় না।"[১] আদি বিশ্বায়নের পূর্বে, বিশ্বায়ন ছিল, "মহান রাজা ও যোদ্ধাগণের সম্পদ ও সম্মানের সন্ধানে অভাবনীয় সব রাজ্যে গমন, ধর্মীয় সন্নাসী,... এবং বণিক রাজপুত্রগণের ভ্রমণ"[২] -এর ফলাফল। আদি বিশ্বায়ন প্রাচীনকালের বিশ্বায়নের ধারা অব্যাহত রাখে এবং এর বিভিন্ন অংশকে পরিপক্ব ও বিকশিত করে তোলে, যেমন নগরায়ন, অভিবাসন এবং শ্রমের বিশেষায়ন ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে।[৩]

আদি বিশ্বায়নের আরেকটি নির্দেশক ছিল দু'টি প্রধান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন: "রাষ্ট্রব্যবস্থাসমূহের পুনর্বিন্যাস, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সেবা এবং শিল্প বিপ্লব-পূর্ব উৎপাদন ব্যবস্থা।"[৪] কতিপয় রাষ্ট্র এসময় তাদের "ভৌগোলিক অঞ্চল, রাজস্ব এবং সার্বভৌমত্বকে জোরদার করে থাকে", তাদের নাগরিকদের অবিরাম আনুগত্য সত্বেও।[৪] এ পর্যায়ের বিশ্বায়নের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই বাহ্যিক জগতের দ্রব্যসামগ্রী এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম।[৫] আদি বিশ্বায়ন সময়কালটি ছিল "আর্থিক লেনদেন ক্ষেত্রে কার্যকারিতা বৃদ্ধির" পর্যায়, যার উৎস ছিল চিনি, তামাক, চা, কফি, আফিম প্রভৃতি পণ্যের ব্যপক উৎপাদন ও প্রসার যা এর অতীতে আর কখনো দেখা যায়নি।[৫] অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার বিস্তর উন্নতি ও প্রসার ঘটে যা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মাঝে একটি যৌগিক সম্পর্কের সূচনা স্থাপন করে।[৫] বাণিজ্যপথগুলির সম্প্রসারণের ফলে "সবুজ বিপ্লব"-এর সূত্রপাত ঘটে, যার মূলভিত্তি ছিল বৃক্ষ উদ্যানসমূহ এবং আফ্রিকা থেকে কৃতদাস রপ্তানী ব্যবস্থা।[৫]

পূর্বসূচকসমূহ[সম্পাদনা]

আধুনিক যুগের পূর্ব থেকেই প্রাচীন বিশ্বায়নের কিছু নমুনা পরিলক্ষিত হচ্ছিল যা বিশ্ব-ব্যবস্থাকে (world system) প্রভাবিত করা শুরু করেছিল, এ. জি. হপকিন্স এ পর্যায়কে প্রাচীন বিশ্বায়ন বলে আখ্যায়িত করেছেন। আদি বিশ্বায়নের পূর্বাবস্থায় যে বিশ্ব ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল তাতে বিভিন্ন আঞ্চলিক পরাশক্তি তাদের পার্শ্ববর্তী জাতিসমূহকে নিজেদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে একীভূত করে ফেলত এবং অপরাপর পরাশক্তির সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হয়ে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা ও বিশ্ব-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকত।[৬]

রোমান সিনেটের সদস্যগণের সভা

এরূপ একটি প্রধান পরাশক্তি ছিল রোমান সাম্রাজ্য, যারা বৃহত্তর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও পশ্চিম ইউরোপ অঞ্চলে সামরিক ও রাজনৈতিক অভিযান চালিয়ে রোমান রাষ্ট্রব্যবস্থা, রোমান রীতিনীতি ও নৈতিকতাকে এসব অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে দিয়েছিল। বিজিত অঞ্চলগুলি রোমান সাম্রাজ্যের প্রদেশে পরিণত হয় এবং রোমানদের সামরিক ঘাঁটিগুলো এক পর্যায়ে নগরীতে রূপান্তরিত হয়, যার অবকাঠামো গড়ে ওঠে প্রতিভাবান রোমান স্থপতিদের দ্বারা, ফলে রোমানদের "আধুনিক" জীবনব্যবস্থা এসব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং স্থানীয়দের রীতিনীতি ও সংস্কৃতির সাথে মিশ্রিত হয়ে পড়ে।[৭] জাতীয়তাবাদী আদর্শবাদ ও রোমানদের রাজনৈতিক প্রচারণা, রোমানদের সামরিক সাফল্য, সাহসিকতা ও বীরত্ব ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় রোমান রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সুসংহত করে তোলে।[৮] রোমানদের তৈরি সুগঠিত সেচ ব্যবস্থা (aqueducts), খোয়া বাধা সড়কব্যবস্থা, শক্তিশালী নৌবহর ইত্যাদি তাদেরকে দ্রুত ও সহজসাধ্য চলাচলের সুযোগ করে দেয় এবং পার্শ্ববর্তী রাজ্য ও প্রদেশসমূহের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের সুব্যবস্থা করে দেয়।[৯]

চীনের হান সাম্রাজ্যের সম্রাট উূ (Emperor Wu) (খ্রীষ্টপূর্ব ১৪১ - খ্রীষ্টপূর্ব ৮৭) -এর শাসনামলে চীনা সরকার একটি একতাবদ্ধ সাম্রাজ্য গঠনে সফল হয় এবং নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির ফলে পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপ শুরু করে।[১০] তবে চীনের হান সাম্রাজ্যের সাম্রাজ্যবাদ ছিল একটি শান্তিপূর্ণ করব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা যার মূল লক্ষ্য ছিল কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন।[১১] হান সাম্রাজ্যের উত্তরোত্তর প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে ফলে তাদের বাণিজ্য ও সংস্কৃতির প্রভাব জানা বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, যার বিস্তৃতি ছিল এশিয়া থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে রোম পর্যন্ত।[১২] চীনা রেশম এই পথ ধরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তাং সাম্রাজ্য এর সূচনালগ্নে চীনে বৈদেশিক প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং তাং রাজ্য একটি সুবিশাল সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।[১৩] সমুদ্রপথে ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্যের প্রসার ঘটে এবং চীনের পূর্ব ও দক্ষিণ উপকূল প্রধান বৈদেশিক বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হয়, এর অতীতে যে অঞ্চলকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হত না।[১৪] সং রাজবংশের শাসনামলে জাহাজ নির্মাণ প্রযুক্তি ও নৌপরিবহনবিদ্যার ব্যাপক উন্নতি সাধনের ফলে এর নৌবাহিনী অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং নৌপথে তাদের বাণিজ্যেরও বিস্তর প্রসার ঘটে।[১৫]

১৬শ শতাব্দীতে চীনের ক্ষমতা হ্রাস পেতে শুরু করে, কেননা তৎকালীন মিং রাজবংশ এর নৌবাহিনী ও সমুদ্রপথের বাণিজ্যকে উপেক্ষা করে। ফলশ্রুতিতে সমুদ্রপথের কর্তৃত্ব চীনের হাতছাড়া হয়ে যায় এবং চীন মশলা বাণিজ্যের (spice trade) উপর নিয়ন্ত্রণ হারায়। ইউরোপীয় পরাশক্তিসমূহ এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। তাদের মধ্য পর্তুগীজরা ছিল নৌ-প্রযুক্তি, দিক নির্দেশনা, নৌচালনা, এবং অস্ত্রশস্ত্রে সমুন্নত, ফলে তারা চীনের নৌবাহিনীকে পরাস্ত করে মশলা বাণিজ্যের কর্তৃত্ব নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে আসে। এর সাথে করে শুরু হয় ইউরোপীয়দের সাম্রাজ্যবাদ এবং বিশ্বব্যাপী ইউরোপের জাতিসমূহের আধিপত্য বিস্তারের সূত্রপাত। এতদসত্বেও চীনারা অনেক বাণিজ্য অঞ্চলে তাদের কর্তৃত্ব টিকিয়ে রেখেছিল।[১৬]

বাণিজ্য ব্যবস্থার পরিবর্তন[সম্পাদনা]

বাটাভিয়া, ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের রাজধানী, আনুমানিক ১৬৬১ খ্রী.

আদি বিশ্বায়ন ও প্রাচীন বিশ্বায়নের মধ্যে একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হল- আদি বিশ্বায়নের যুগে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কেবলমাত্র দুর্লভ পণ্যের বেচাকেনার পরিবর্তে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বেচাকেনা প্রসার লাভ করে। ১২শ ও ১৩শ শতাব্দীতে ভিনদেশীয় বিভিন্ন দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য বস্তুর বাণিজ্য অধিক প্রচলিত ছিল, বিভিন্ন সভ্যতার কাছে অপরিচিত পণ্যসমূহের ক্রয়বিক্রয় করতে তারা আগ্রহী হত। উদাহরণস্বরূপ ইউরোপীয় বণিকগণ সমুদ্রযাত্রা করে ভারত ও চীনে আসত বিভিন্ন বিলাসদ্রব্য যেমন- চীনামাটি, রেশম, মশলা ইত্যাদি ক্রয় করতে। আধুনিক যুগের পূর্বেও বণিকগণ ঔষধ, ইক্ষু ও অন্যান্য ফসলাদির বাণিজ্য করে থাকত।[১৭] যদিও এই দ্রব্যসমূহকে দুর্লভ বলা যায় না, বিভিন্ন ঔষধ ও খাদ্যদ্রব্য মানবস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হওয়াতে এদের কদর করা হত। অপরদিকে আদি বিশ্বায়নের যুগে তুলা, ধান এবং তামাকজাতীয় পণ্যের বাণিজ্য প্রসার লাভ করে। আদি বিশ্বায়নের সূচনা "আধুনিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার উদ্ভব" ঘটায় এবং ১৭শ শতাব্দীতে আটলান্টিক মহাসাগরীয় অঞ্চলে পুঁজিবাদি আগ্রাসনের গোড়াপত্তন করে, যা ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।[১৮]

আটলান্টিক দাস বাণিজ্য[সম্পাদনা]

আটলান্টিক দাস বাণিজ্যে ব্যবহৃত একটি জাহাজের নকশা। ১৭৯০ এবং ১৭৯১ সালে ব্রিটেনের হাউস অব কমন্‌স -এর একটি বিশেষ কমিটির সামনে তথ্য প্রমাণ হিসেবে এই চিত্রটি পেশ করা হয়।

ভোগ্যপণের বাজারের উথ্থানের একটি প্রধান কারণ ছিল দাস বাণিজ্য, সুনির্দিষ্টভাবে আটলান্টিক দাস বাণিজ্য।

অতীতে ১৫শ শতাব্দীর পূর্বে ক্রীতদাসদের ব্যবহার অনেকাংশে সীমিত ছিল, এবং শ্রমশক্তির একটি ছোট অংশ ছিল ক্রীতদাসেরা, পণ্যদ্রব্যের উৎপাদনে তাদের ভূমিকা মুখ্য ছিল না। তবে কালক্রমে শ্রমশক্তির অভাব দেখা দিলে দাসপ্রথার প্রসার বৃদ্ধি পায়।[১৯] ১৫০০ সালের পর থেকে সাও টোম দ্বীপপুঞ্জের স্বৈরাচারী শাসকেরা এবং বাণিজ্যিক বৃক্ষ উদ্যানসমূহের (plantations) মালিকেরা আফ্রিকার কঙ্গো সাম্রাজ্যের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করে, এভাবে মধ্য-পশ্চিম আফ্রিকা আটলান্টিক দাস বাণিজ্যের আওতায় এসে পড়ে।[২০] পর্তুগীজ বণিকেরা মরক্কোর আগাদির বন্দর থেকে দাস পাচার করা শুরু করে, যা তারা ১৬শ শতাব্দীর প্রথমাংশ ব্যপী বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল।[২১] তাছাড়া ব্রাজিলে পর্তুগীজ উপনিবেশ থাকায় তারা আমেরিকায় ক্রীতদাসের বাজার শুরু করে এবং সাও টোম দ্বীপপুঞ্জ থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে সরাসরি আমেরিকায় ক্রীতদাস পাচার করে আনা শুরু করে।[২০] ইউরোপের জনগণও এই দাসপ্রথাকে কাজে লাগানো শুরু করে। ক্রীতদাস ভর্তি জাহাজ আফ্রিকা থেকে আইবেরীয় উপদ্বীপে পাড়ি জমায়; তবে ইউরোপে ক্রীতদাসের উচ্চমূল্যের কারণে শুধুমাত্র ধনী ও সম্ভ্রান্তরাই দাস ব্যবহার করত, এর থেকে অনেক কম মূল্যে স্থানীয় কৃষক-শ্রমিকদেরই নিয়োগ দেয়া যেত। এবং কৃষিকাজে প্রথম আফ্রিকান দাসদের ব্যবহার আরম্ভ হয় আটলান্টিক মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জসমূহে, ইউরোপ মহাদেশে নয়।[২২] ১৪৫০ থেকে ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে আনুমানিক ১ কোটি ২ লক্ষ আফ্রিকান ক্রীতদাসকে জীবিত অবস্থায় আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে দুই আমেরিকায় পাচার করা হয়।[২৩] ইউরোপের বাজারে এই ক্রীতদাসদের উৎপন্ন পণ্য ফসলাদির চাহিদা ব্যপক আকারে বৃদ্ধি পায়, কেননা স্থানীয়ভাবে এসব ফসল উৎপাদনের চাইতে এগুলি আমদানি করাই ইউরোপের বণিকদের জন্যে সস্তা ছিল। একারণেই দীর্ঘকাল করে ক্রীতদাস প্রথা টিকে ছিল।[২৪]

১৭শ শতকের মাঝামাঝি সময় ক্রীতদাসদের উপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল অঞ্চলসমূহে দাস-ব্যবসায়ী কোম্পানিগুলির মধ্যে বহু যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ওয়েস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এসকল যুদ্ধে (বিশেষ করে পর্তুগালের বিরুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধে) যুদ্ধলব্ধ সম্পত্তি হিসেবে প্রচুর ক্রীতদাস লাভ করেছিল, বিজয়ী ক্যাপ্টেনগণ পরাজিত শত্রুপক্ষের জাহাজ দখল করে তাদের দাসদের হস্তগত করতেন; এভাবে ওয়েস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ১৬২৩ থেকে ১৬৩৭ সালের মধ্যে ২৩৩৬ জন ক্রীতদাস লুঠ করে পুনরায় নতুন বিশ্বে (আমেরিকায়) বিক্রয় করে।[২৫] নতুন বিশ্বে ক্রীতদাস বিক্রয়ের দ্বারা উত্তর আমেরিকার বাণিজ্য ঘাঁটিসমূহের (trading post) গোড়াপত্তন হয়; ডাচ্‌রা ১৬১৩ খ্রীষ্টাব্দে ম্যানহাটান দ্বীপে তাদের প্রথম বাণিজ্য ঘাঁটি স্থাপন করে।[২৫] ওয়েস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে একটি বাণিজ্য ঘাঁটি স্থাপন করে এবং এ কোম্পানি নিউ নেদারল্যান্ড উপনিবেশেও ক্রীতদাস পাচার করে থাকত।[২৫] দাস-বাণিজ্য এ অঞ্চলের অর্থনীতি ও উৎপাদনকে ব্যপকভাবে ত্বরান্বিত করে। ইউরোপের বাজারে কফি, চা, এবং চকোলেট জনপ্রিয় হওয়াতে চিনি উৎপাদনের বিপুল চাহিদা দেখা দেয়। ৭০ শতাংশ ক্রীতদাস শস্যক্ষেত্রের মজুর হিসেবে ব্যবহৃত হত, যেখানে প্রচুর কায়িক শ্রমের প্রয়োজন ছিল।[২৬] বাণিজ্য অভিযানসমূহের জন্যেও দাস-বাণিজ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কেননা আটলান্টিক মহাসাগরে সবসময়ই একের পর এক পালতোলা জাহাজ বাণিজ্য অভিযানে রওয়ানা দিত। এসব প্রতিটি জাহাজেই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ছোট ছোট হিস্যা ক্রয় করে রাখত।[২৭] হপকিন্সসহ বহু পণ্ডিতগণের মতে, আদি বিশ্বায়নের যুগে এবং এর পরবর্তী সময়ে, বহু রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্রীতদাস বাণিজ্য অপরিহার্য ছিল, এবং এই দাসপ্রথা না থাকলে তাদের অর্থনীতিতে ব্যপক আকারে ধস নামত।[৩] সমগ্র আদি বিশ্বায়ন এবং আধুনিক বিশ্বায়ন পর্বজুড়ে উন্নততর জাহাজ ও নৌ-প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ তৎকালীন বাণিজ্য ব্যবস্থার জন্যে অপরিহার্য ছিল।[১৭]

প্ল্যান্টেশন বাণিজ্য[সম্পাদনা]

১৭শ শতাব্দীতে আমেরিকার ভার্জিনিয়ায় ক্রীতদাসরা তামাক প্রক্রিয়াজাত করছে।

বিভিন্ন প্রকার শস্যের উৎপাদন ও বাণিজ্যের প্রসারের ফলশ্রুতিতে দাসপ্রথার বিস্তার ঘটে থাকে, বিশেষ করে বাণিজ্যিক শস্যক্ষেত্র বা প্ল্যান্টেশন (plantation)-ভিত্তিক অর্থনীতির উত্থান ক্রীতদাস প্রথার বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আদি বিশ্বায়নের যুগে নিত্যপণ্যের বাণিজ্য বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ ছিল এসকল বাণিজ্যিক শস্যক্ষেত্র বা প্ল্যান্টেশন। রপ্তানিকারক রাষ্ট্রসমূহ (প্রধানত আমেরিকা) এসব প্ল্যান্টেশনে কাঁচামাল উৎপাদন করে তা বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করত, ঐসকল দেশ আবার এই কাঁচামাল দ্বারা উৎপন্ন পণ্য প্ল্যান্টেশন-ভিত্তিক রাষ্ট্রসমূহের নিকট বিক্রয় করত।[২৮] প্ল্যান্টেশন-ভিত্তিক অর্থনীতিসমূহের প্রধান প্রধান উৎপাদিত দ্রব্যসমূহ ছিল তামাক, তুলা, ইক্ষু ও রাবার।[২৮]

তামাক[সম্পাদনা]

Nicotiana Tabacum (তামাক গাছ)

১৬শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে নতুন বিশ্বে (আমেরিকায়) ইউরোপীয় বণিকদের অভিযানের প্রধান লক্ষ্য ছিল স্বর্ণ ও রৌপ্য, তামাক নয়। কেননা, তামাকের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করত স্থানীয় আদিবাসীগণ (আমেরিকান ইন্ডিয়ান); এতে ইউরোপীয়দের জন্যে তামাক বাণিজ্য অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক ছিল না।[২৯] কিন্তু প্ল্যান্টেশনসমূহের প্রসারের সাথে সাথে তামাকের বাণিজ্য ব্যপকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং ইউরোপে তামাকের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমনকি অর্থের মানদণ্ড হিসেবে তামাক ব্যবহৃত হতে থাকে, এভাবেই "cash crop" বা অর্থশস্য কথাটির প্রচলন ঘটে।[২৮]

তৎকালীন আমেরিকার উপনিবেশসমূহ থেকে (বিশেষ করে ভার্জিনিয়া থেকে) লন্ডনে তামাক রপ্তানি বাণিজ্যের ফলে ইংরেজ বাণিজ্য সংস্থাসমূহ বিপুল পরিমাণে অর্থসম্পত্তি লাভ করে, এবং ১৬২৭ সালের মধ্যে চালান প্রতি ৫ লক্ষ পাউন্ড ভার্জিনিয়া তামাক আমেরিকা থেকে ইংল্যান্ডে রপ্তানি করা হত।[৩০] ১৬৩৭ সালের মধ্যে উপনেবিশগুলোতে মুদ্রা হিসেবে তামাকের প্রচলন হয় এবং ১৬৩৯ সালের মধ্যে ম্যারিল্যান্ড অঙ্গরাজ্য থেকেও ১ লক্ষ পাউন্ড তামাক লন্ডনে চালান করা হত।[৩১] তামাক বাণিজ্যে ইংরেজদের এই সাফল্য ইউরোপের অন্যান্য রাজ্যগুলোরও নজর কাড়ে এবং ফরাসীরাও তাদের উপনিবেশ মার্টিনিক ও গোয়াডিলোপ দ্বীপপুঞ্জে তামাক উৎপাদন ও রপ্তানি শুরু করে। ১৬৭১ সালের মধ্যে এই দ্বীপপুঞ্জসমূহের মোট শস্যক্ষেত্রের এক-তৃতীয়াংশই ব্যবহৃত হত তামাক উৎপাদনে।[৩২] তামাকের এই ব্যপক উৎপাদন হলেও, চিনির মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাজারে তামাকের মূল্যপতন হয়। একটি সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বারবাডোস দ্বীপপুঞ্জের মোট আয়ের ৮২ শতাংশই আসত চিনি উৎপাদন থেকে এবং তামাক উৎপাদনের আয় ছিল মোট আয়ের শতকরা ১ ভাগেরও কম।[৩৩]

ইক্ষু[সম্পাদনা]

এসময়কার বাণিজ্যের অপর একটি পণ্য ছিল ইক্ষু। ইক্ষুর প্রথম চাষ আরম্ভ হয় ভারতে, সেখান থেকে তা সংগ্রহ করে বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জে বপন করা হয়। আইবেরীয় উপদ্বীপে এই শস্য পৌঁছানোর পর সেখান থেকে তা আটলান্টিক পাড়ি দেয় এবং এককালে আমেরিকায় পৌঁছে। ১৬শ শতাব্দীতে নতুন বিশ্বে প্রথমবারের মত চিনির বাণিজক উৎপাদন (তথা প্লান্টেশন) শুরু হলে, এ অঞ্চলে ইক্ষুর উৎপাদন এর পরবর্তী পর্যায়ে পৌঁছে।[৩৪] অশোধিত চিনি রপ্তানী নিয়ে দ্বন্দের কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাথে চিনি সম্পৃক্ত ছিল না, এর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় চিনি পরিশোধন প্রক্রিয়া আবিষ্কারের পর; এ পরিশোধন প্রক্রিয়া চিনি শীল্পের কেন্দ্রে পরিণত হয়। মধ্যযুগে চিনি পরিশোধনের কেন্দ্র ছিল ভেনিস নগরী, ফলে চিনির প্রধান বণিকেরা ছিল এ নগরীর বাসিন্দা। যদিও স্প্যানিশ ও পর্তুগীজরা আমেরিকার ইক্ষুর চাষ নিয়ন্ত্রণ করত, তাদের যোগান দিয়ে থাকত ভেনিস নগরী। ১৭শ শতাব্দীতে ইংরেজরা ভেনিস নগরীর নিকট থেকে চিনি উৎপাদন ও পরিশোধনের একচেটিয়া বাণিজ্য নিজেদের কর্তৃত্বে নিয়ে আসে; এ কর্তৃত্ব তারা বজায় রাখে ফরাসী শিল্পসমূহের উত্থানের আগ পর্যন্ত। [৩৫] ১৭শ শতাব্দী পর্যন্ত চিনি একটি বিলাস-পণ্য হিসেবে বিবেচিত হত, কিন্তু ১৭শ শতাব্দীর শেষার্ধে চিনির বিপুল পরিমাণে উৎপাদনের ফলে ইংল্যান্ডের জনসাধারণের নিকট তা সুলভ হয়ে পড়ে।[৩৬] এ ঘটনাসমূহের পালাক্রমে চিনি বিলাস-পণ্য থেকে একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে পরিণত হয়, কারণ শুধুমাত্র বিশেষ আয়োজনে চিনির ব্যবহার সীমাবদ্ধ না থেকে তা দৈনন্দিন আহার্যের একটি উপাদানরূপে গণ্য হতে থাকে।

বিরোধ, যুদ্ধ এবং সাম্রাজ্যবাদ[সম্পাদনা]

১৭৫৪ সালে সমগ্র বিশ্বে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যসমূহের মানচিত্র

আদি বিশ্বায়ন, নানান দিক থেকে আধুনিক বিশ্বায়ন থেকে ভিন্ন ছিল, সাম্রাজ্যবাদের বিস্তৃতি, বৈশ্বিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া, অর্থনীতি এবং বাণিজ্যিক উদ্ভাবন ইত্যাদি ক্ষেত্রে এসময়কার প্রক্রিয়াসমূহএ আধুনিক যুগের তুলনায় ভিন্নতা দেখা যায়। সাম্রাজ্যবাদএর কলকাঠি তখন পশ্চিম ইউরোপের শক্তিশালী জাতিদের হাতে চলে যায় এবং তারা সমগ্র বিশ্বের ওপর কর্তৃত্ব আনার লড়াইয়ে একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এই শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ভূখণ্ডের দখল নিয়ে বৃহৎ পরিসরে দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা দেয় এবং বিজয়ীরা পরাজিতদের নিকট থেকে প্রাপ্ত ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদ, জমাকৃত অর্থবিত্ত ইত্যাদি নিজেদের স্বাধীন ভূখণ্ডে পাচার করতে থাকে। যদিও ১৬০০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে সারাবিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা দেয়, ইউরোপীয়দের নিকট এসব যুদ্ধের মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র ছিল, যা অন্যান্য জাতিসমূহের ছিল না। ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার অ্যালান বেইলি ইউরোপীয়দের এই একচ্ছত্র আধিপত্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, "ইউরোপীয়রা মানব হত্যায় অধিক পারদর্শী ছিল। ১৭শ শতাব্দীতে ইউরোপে যে আদর্শগত দ্বন্দ্ব-সংঘাতসমূহ সংঘটিত হয় তার ফলাফলস্বরূপ তাদের যুদ্ধ, অর্থনীতি এবং বাণিজ্যিক উদ্ভাবনের ফলে তারা এই পারদর্শিতা লাভ করে। এর ফলে ১৮শ শতাব্দীর যুদ্ধসমূহে সারা বিশ্বের তুলনায় তারা কয়েকধাপ এগিয়ে ছিল। পশ্চিম ইউরোপের যুদ্ধরীতি অত্যন্ত জটিল ও ব্যয়বহুল ছিল, এর প্রধান কারণ হল জলে-স্থলে উভয় ক্ষেত্রেই তারা যুদ্ধ পরিচালনা করে থাকত।"[৩৭] এই যুদ্ধবাজ জাতিসমূহ তাদের নিজ নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে যুদ্ধ করে থাকত, কিন্তু বাস্তবে তাদের সাফল্য বিশ্ববাজারে ইউরোপের অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখে। পরবর্তী অনুচ্ছেদসমূহে ঐসময়ের প্রধান প্রধান সংঘাতের ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল। যুদ্ধের পটভূমি ধর্মীয় হোক অথবা বাণিজ্যিক হোক, এর প্রভাব সারাবিশ্বেই পরিলক্ষিত হত। ইঙ্গ-ওলোন্দাজ যুদ্ধে ইংরেজদের বিজয়ের ফলে তারা বাণিজ্যিক নৌ চলাচলের কর্তৃত্ব লাভ করে এবং প্রধান সামরিক নৌ-পরাশক্তিতে পরিণত হয়। এ ঘটনার ফলশ্রুতিতে ব্রিটেনের সাথে অন্যান্য জাতিসমূহের সংঘাতের পটভূমি রচিত হয়, এমনকি তাদের উত্তর আমেরিকায় তাদের নিজ জনগণের সাথেও অন্তর্দ্বন্দের সূত্রপাত ঘটে। ইউরোপের দুই পরাশক্তি ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যে সংঘটিত হয় "ফরাসি ও ইন্ডিয়ান যুদ্ধ", এতে ইংরেজরা জয়লাভ করে এবং সমুদ্রোপকূলসমূহের কর্তৃত্ব তাদের কাছে চলে আসে। আবার মার্কিন স্বাধীনতা যুদ্ধ বৈদেশিক বাজারের কর্তৃত্ব পুনরায় হাতবদলের সূচনা করে।

ইংরেজ গৃহযুদ্ধ[সম্পাদনা]

ইংরেজ গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাস কিংবা রাজনৈতিক কারণে নয় বরং এর আর্থিক ও সামাজিক পটভূমিও ছিল। এই যুদ্ধ সংঘটিত হয় সাংসদীয় শাসনবাদী বা পার্লামেন্টারিয়ান (Parliamentarian) এবং রাজতন্ত্রবাদীদের (Royalists) মধ্যে। ১৬৪২ সাল থেকে ১৬৫১ সালের মধ্যে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল এবং এই যুদ্ধ কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন সংঘাতে বিভক্ত ছিল। রাজা প্রথম চার্লস এবং তাঁর সমর্থকরা যুদ্ধের প্রথম দুই পর্যায়ে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেন। অতঃপর রাজা সংসদ ("ব্রিটিশ পার্লামেন্ট") ভেঙে দেন, পরবর্তী দশ বছরেরও বেশি সময় সংসদের কোন অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়নি। সংসদ ভেঙে দেয়ার মূল কারণ ছিল "দীর্ঘ পার্লামেন্ট"(Long Parliament) -এর সমর্থকগণ কর্তৃক ইংরেজ আইনে দুটি প্রস্তাব উত্থাপন। প্রথম প্রস্তাবটি ছিল এই যে- কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ পার্লামেন্টের সম্মতি ছাড়া রাজস্ব সংগ্রহ করলে তাদের শাস্তি প্রদান এবং তাদেরকে ইংল্যান্ডের শত্রু হিসেবে চিহ্নিতকরণ। দ্বিতীয় প্রস্তাবটি ছিল- কোন ব্যক্তি প্রচলিত ধর্মের কোন পরিবর্তন সাধন করলে তাদেরকেও একইভাবে ইংল্যান্ডের শত্রু গণ্য করা হবে। দুটি প্রস্তাবই রাজা প্রথম চার্লসকে লক্ষ্য করে রচিত হয়েছিল, রাজার শত্রুপক্ষের ক্ষোভের কারণ- তিনি একজন দূর্বল শাসক এবং ক্যাথলিক বিশ্বাসের সমর্থক ছিলেন। এই দাবির ফলে পিউরিটান বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটে এবং তার ফলশ্রুতিতে রাজা প্রথম চার্লসকে বিচারপূর্বক তাঁকে বিশ্বাসঘাতক অভিহিত করা হয় এবং তাঁর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। ইংরেজ গৃহযুদ্ধের সর্বশেষ পর্যায় ছিল ১৬৪৯ সাল থেকে ১৬৫১ সাল পর্যন্ত। এ সময় রাজা ১ম চার্লসের পুত্র রাজা ২য় চার্লস তাঁর সমর্থকদের নিয়ে পার্লামেন্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। ১৬৫১ সালে ওয়েস্টারের যুদ্ধ (The Battle of Worcester) সংঘটিত হয়, যে যুদ্ধে রাজা ২য় চার্লস পার্লামেন্টারিয়ানদের নেতা অলিভার ক্রমওয়েলের নিকট পরাজিত হন। এর সাথে সাথে ইংরেজ গৃহযুদ্ধের চূড়ান্ত অবসান হয়। এ যুদ্ধ ইংল্যান্ডের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, আর্থিক ও সামাজিক চিন্তাধারায় ব্যপক পরিবর্তন আনে। এবং ইংল্যান্ডের সংবিধানে এই আইন প্রতিষ্ঠিত হয় যে- কোন ব্রিটিশ রাজা বা রাণী পার্লামেন্টের সম্মতি ছাড়া শাসন করার অনুমতি রাখেন না।

ইঙ্গ-ওলোন্দাজ যুদ্ধ[সম্পাদনা]

"শেভেনিঙ্গেনের যুদ্ধ, ১০ আগস্ট, ১৬৫৩", শিল্পী: জাঁ আব্রাহাম বীরস্ট্রাটেন, অঙ্কন করা হয় আনুমানিক ১৬৫৪ সালে। চিত্রটিতে দেখা যাচ্ছে ওলোন্দাজ উপকূল থেকে যুদ্ধটি দেখার জন্যে হাজার হাজার জনতা ভিড় জমিয়েছে।

ইঙ্গ-ওলোন্দাজ যুদ্ধ (Anglo-Dutch War) সংঘটিত হয় ১৬৫২ সাল থেকে ১৬৫৪ সাল পর্যন্ত, যে যুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ওলোন্দাজ প্রজাতন্ত্র নৌবাণিজ্যের কর্তৃত্ব নিয়ে সংঘাতে লিপ্ত হয়। এ যুদ্ধের মূল কেন্দ্র ছিল ইস্ট-ইন্ডিজ বা পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ-এর উপকূল।[৩৮] এ যুদ্ধের পটভূমি ছিল ইংরেজদের রচিত প্রথম নৌ পরিবহন আইন (First Navigation Act), যাতে কোন পণ্য ইংরেজ জাহাজ ব্যতীত অন্য কোন জাহাজে করে পরিবহন নিষিদ্ধ করা হয়, যদিনা ঐ জাহাজ পণ্য উৎপাদনকারী রাষ্ট্রের হয়ে থাকে।[৩৮] এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল ওলোন্দাজদের বাণিজ্যে বিঘ্ন সৃষ্টি, যার ফলে ১৬৫২ সালের ১৯শে মে তারিখে ইংরেজ ও ওলোন্দাজ নৌবহরের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে, এবং এর মধ্য দিয়ে ইঙ্গ-ওলোন্দাজ যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে।[৩৮] আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শুরু হয় জুলাই মাসে এবং দুই বছর ধরে এ যুদ্ধ চলতে থাকে। ১৬৫৩ সালে শেভেনিঙ্গেনের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সম্মুখ সমরের অবসান ঘটে।[৩৯] এ যুদ্ধের অবসান ঘটে ১৬৫৪ সালের এপ্রিল মাসে ওয়েস্টমিন্‌স্টারের চুক্তিসাক্ষরের মাধ্যমে, এ চুক্তিতে ইংরেজরা ওলোন্দাজ প্রজাতন্ত্রকে তাদের তৈরি নেভিগেশন আইন মেনে চলতে বাধ্য করে এবং যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির জন্যে তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করে।[৩৯]

ফরাসি ও ইন্ডিয়ান যুদ্ধ[সম্পাদনা]

আনুষ্ঠানিক অগ্নিকুন্ডের পাশে ফরাসি ও ইন্ডিয়ান (আমেরিকান আদিবাসী) নেতাগণের সম্মেলন, অলংকরণ: শিল্পী এমিল লুই ভের্নিয়ে

ফরাসি ও ইন্ডিয়ান যুদ্ধ ইংরেজ ও ফরাসিগণের মধ্যে সংঘটিত হয়, এবং উভয়পক্ষেই যোগ দেয় বহু আমেরিকান আদিবাসী গোত্র যারা ইংরেজ বা ফরাসিদের পক্ষ অবলম্বন করেছিল।[৪০] মূলতঃ ফরাসি ও ইন্ডিয়ান যুদ্ধ ছিল ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যকার "সাত বছরের যুদ্ধের" মার্কিন রণাঙ্গন, যার মূল ক্ষেত্র ছিল ইউরোপ। উত্তর আমেরিকার ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলসমূহের জনসংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির কারণে তারা ক্রমশঃ পশ্চিম দিকে সম্প্রসারণ শুরু করে; তবে এতে করে ব্রিটিশরা ফরাসি ও তাদের স্থানীয় আদিবাসী মিত্রগোষ্ঠীসমূহের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।[৪০] ফরাসি সেনারা ব্রিটিশ অধিকৃত অঞ্চলে প্রবেশ করতে থাকে এবং দখলকৃত ভূখণ্ড প্রতিরক্ষার্থে বহুসংখ্যক দুর্গ নির্মাণ করে। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ফরাসি ও তাদের মিত্র আদিবাসী গোত্রসমূহ ব্রিটিশদেরকে একের পর এক যুদ্ধে পরাজিত করতে থাকে, এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অবস্থানে আসীন হয়। অবশেষে ১৭৫৬ সালে ব্রিটিশরা প্রথমবার কোন যুদ্ধে তাদের অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়। পিট্‌সবার্গ ছিল ফরাসি ও ইন্ডিয়ান যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, কেননা এর অবস্থান তিনটি নদীর সঙ্গমস্থলের কেন্দ্রে হওয়াতে এর ভৌগোলিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম; নদী তিনটি হল- অ্যালেগেনি, মোনোঙ্গাহেলা এবং ওহাইয়ো নদী। বর্তমান পিট্‌সবার্গ নগরী যে স্থানে অবস্থিত, সেটি সেসময় নদীপথ নিয়ন্ত্রণের জন্য অপরিহার্য ছিল। এই কেন্দ্রটির দখল শুধুমাত্র নদীপথের নিয়ন্ত্রণই নয় বরং অর্থনৈতিক কার্যকলাপ দূরদূরান্তে সম্প্রসারণের জন্যে জরুরী ছিল, কারণ এ স্থানে নদীপথে রসদ ও মালামাল পরিবহন অত্যন্ত সুবিধাজনক ছিল। ফরাসি ও ব্রিটিশ উভয়পক্ষই এই অঞ্চলের মালিকানা দাবী করে; ফরাসিরা এস্থানে ডুকেইন দুর্গ এবং ব্রিটিশরা পিট দুর্গ নির্মাণ করে। ফরাসিরা তাদের ডুকেইন দুর্গ থেকে প্রস্থান করার সময় দুর্গটি ধ্বংস করে দিয়ে গেলে ব্রিটিশরা ১৭৫৮ সালে এর স্থানে পিট দুর্গ নির্মাণ করে।[৪১] ১৭৬৩ সালে ব্রিটিশ বাহিনী ফরাসিদের নিকট থেকে কেবেকমন্ট্রিয়াল নগরীর দখল করে নিলে ফরাসি ও ইন্ডিয়ান যুদ্ধের অবসান ঘটে। এবং ১৭৮৩ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ ও ফরাসিদের মধ্যে প্যারিস শান্তি চুক্তি সাক্ষরিত হয়।[৪০] চুক্তি অনুযায়ী ফরাসিরা ব্রিটিশদেরকে তাদের উত্তর আমেরিকার সকল ঘাঁটি হস্তান্তর করে দিতে বাধ্য হয় এবং এতে করে ইংল্যান্ড সুদূর মিসিসিপি নদী পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের কর্তৃত্ব পেয়ে যায়। এই যুদ্ধ উত্তর আমেরিকার ব্রিটিশ উপনেবিশগুলোর ওপর বিস্তর প্রভাব ফেলে। ইংল্যান্ড এ সময় যুদ্ধের রসদ সংগ্রহের জন্যে উপনিবেশের জনগণের কাছ থেকে উচ্চহারে কর নিতে শুরু করে, যার দ্বারা তারা নতুন অধিকৃত এলাকাসমূহের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারে। এর ফলে যে অসন্তোষের উদ্ভব হয় তার ফলশ্রুতিতেই উপনিবেশগুলো তাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করে এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্ষমতার হাতবদলের সূচনা ঘটে।

মার্কিন স্বাধীনতা যুদ্ধ[সম্পাদনা]

শিল্পী এমানুয়েল লইত্‌জের অলংকরণে "ওয়াশিংটনের ডেলাওয়ের নদী পার হওয়া"-এর চিত্র, ১৮৫১ সালে অঙ্কিত

আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল ইংল্যান্ড ও উত্তর আমেরিকার ১৩টি উপনিবেশের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ। এই যুদ্ধ ১৭৭৫ সাল থেকে ১৭৮৩ সাল পর্যন্ত চলে; এ সংঘাতের সূচনা হয় বাংকার হিলের যুদ্ধের (Battle of Bunker Hill) মধ্য দিয়ে, যেখানে ১,১৫০ জন ব্রিটিশ সেনা হতাহত হয়, যা ছিল এ যুদ্ধে অংশ নেয়া ব্রিটিশ বাহিনীর প্রায় অর্ধেক। অপরপক্ষে মার্কিনিদের হতাহতের সংখ্যা ছিল ৪৫০ জন। তথাপি এ সংঘাতের পর ব্রিটিশরা এ অঞ্চলের কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল এবং নবগঠিত মহাদেশীয় সেনাবাহিনীকে (Continental Army) পিছু হটিয়ে বস্টন নগরী পর্যন্ত নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। বাংকার হিলের যুদ্ধের পূর্বে ১৭৭৫ সালের এপ্রিল মাসে লেক্সিংটন এবং কনকর্ডের যুদ্ধে প্রথমবারের মত ব্রিটিশ বাহিনী তাদের মার্কিন উপনেবেশগুলোতে আক্রমণ চালায়। অতঃপর ব্রিটিশরা ঔপনিবেশিক বাহিনীর রসদভান্ডারসমূহ খুঁজে বের করতে তৎপর হয় কিন্তু তারা শত্রুপক্ষের কঠিন প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। কনকর্ডে তাদের থেকে সংখ্যাধিক মিনিটম্যান বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে ব্রিটিশরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ১৭৭৬ সালের ৪ই জুলাই ২য় মহাদেশীয় কনগ্রেস (second continental congress) তাদের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় এবং উত্তর আমেরিকার উপনিবেশসমূহকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম ভূখণ্ড হিসেবে ঘোষণা করে, যা হবে ইংল্যান্ডের শাসন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। তদুপরি কনগ্রেস একটি মহাদেশীয় বা কন্টিনেন্টাল সেনাবাহিনী গঠনের জন্যে অর্থ সংগ্রহের অনুমতি দেয়, যা ছিল আমেরিকার যেকোনো রাজনৈতিক সংস্থা কর্তৃক গঠিত প্রথম সামরিক সংগঠন। যুদ্ধের প্রথম ভাগে ব্রিটিশরা আধিপত্য বিস্তার করে, কন্টিনেন্টাল বাহিনীর পেশাদার সৈন্যবাহিনী ও মিলিশিয়া বাহিনী উভয়কেই তারা রুখে দেয় এবং উত্তর আমেরিকার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়। তবে, ১৭৭৭ সালের সারাটোগার যুদ্ধে কন্টিনেন্টাল বাহিনীর হাতে ব্রিটিশদের পরাজয়ে এ যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। এর পরবর্তীতে যুদ্ধের আধিপত্য ব্রিটিশ ও মার্কিনিদের মধ্যে বারবার হাতবদল হতে থাকে। অবশেষে ১৭৭৮ সালে ফ্রান্সের ও মার্কিনিদের মধ্যে চুক্তি সাক্ষরিত হওয়ায় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তারা একটি শক্তিশালী অবস্থানে চলে আসে এবং নতুন উদ্যমে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়; পরিশেষে তারা ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনী উভয়কেই চূড়ান্তভাবে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। ১৭৮১ সালে ইয়র্কটাউন নগরীতে মার্কিন ও ফরাসি বাহিনী ব্রিটিশদের দক্ষিণ সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে ও সম্পূর্ণভাবে ঘেরাও করতে সক্ষম হয়, এভাবেই শেষ হয় আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের যুদ্ধ। ১৭৮৩ সালে প্যারিস চুক্তি সাক্ষরিত হয় এবং এ চুক্তিতে মার্কিন উপনিবেশগুলোকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এই নবগঠিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কালের বিবর্তনে পৃথিবীর অন্যতম অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তিতে পরিণত হয়।

চুক্তি ও সমঝোতা[সম্পাদনা]

১৭৯৯-১৮০০ সালে পুনর্নির্মিত ইস্ট ইন্ডিয়া হল, লেডেনহল সড়ক, লন্ডন। স্থপতি: রিচার্ড জুপ (১৮১৭ সালের দৃশ্য, ১৯২৯ সালে দালানটি ভেঙে ফেলা হয়

আদি বিশ্বায়নের যুগে বাণিজ্যের সিংহভাগের নিয়ন্ত্রণে ছিল ইউরোপীয়রা। অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিশ্বায়নের কর্তৃত্ব করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল ১৭শ ও ১৮শ শতাব্দীতে ইউরোপে গড়ে ওঠা কতিপয় সংস্থা, যার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল ইস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ। ভারতের সাথে পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত এই কোম্পানি।[৪২]

বিশ্বায়নে অন্যতম প্রধান অবদান রাখে "ত্রিভুজ বাণিজ্য" এবং সমগ্র বিশ্বের সাথে এর সংযোগ স্থাপন। "ত্রিভুজ বাণিজ্য" ছিল বিশ্বের তিনটি অঞ্চলকে বাণিজ্যিকভাবে সংযুক্ত করার একটি প্রক্রিয়া।[৪৩] এই বাণিজ্যের পণ্যসমূহ এরপর পৃথিবীর অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে, ফলে ত্রিভুজ বাণিজ্য গোটা পৃথিবীর বাণিজ্যের একটি অন্যতম চাবিকাঠি হয়ে দাঁড়ায়। ইউরোপীয়রা এই ত্রিভুজ বাণিজ্যের কর্তৃত্ব পেয়ে যায়, যার ফলে সারাবিশ্বে তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।[৪৩]

ইউরোপীয়রা সাগর পাড়ি দিয়ে পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে গমন করত এবং স্থানীয় রাজাদের নিকট থেকে তৈরি পণ্যের বিনিময়ে ক্রীতদাস ক্রয় করত।[৪৩] অতঃপর এই ক্রীতদাসদেরকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জে অথবা উত্তর আমেরিকার উপকূলে পাঠানো হত। এসকল স্থানে তুলা, মোলাসেস, চিনি, তামাক ইত্যাদি পণ্য উৎপাদনে শ্রমিক হিসেবে ক্রীতদাসদের ব্যবহার করা হত। এই পণ্যসমূহ এরপর ইউরোপে পাঠিয়ে দেয়া হত।[৪৩] ইউরোপীয়রা আবার এসকল পণ্যসমূহ এশীয় রাষ্ট্রসমূহের কাছে বিক্রয় করে তাদের নিকট থেকে চা, কাপড় এবং মশলা ক্রয় করত।[৪৩] এক অর্থে "ত্রিভুজ বাণিজ্য" ছিল একটি সমঝোতা যা বৈশ্বিক একীভূতকরণ প্রক্রিয়াকে ত্বরাণ্বিত করে, যা অবশেষে বিশ্বায়নের সূত্রপাত ঘটায়।[২৩]

বিশ্ব বাণিজ্যে ইউরোপীয়দের আধিপত্য বিস্তারের সাথে সাথে কতিপয় চুক্তি ও আইনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৭৭৩ সালে "নিয়ন্ত্রণ আইন" (Regulating Act) পাশ করা হয়, যা ভারত ও লন্ডনে কোম্পানির কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।[৪৪] ১৭৪৮ সালে "আই-লা-চ্যাপেল" -এর চুক্তি সাক্ষরিত হয়, যা অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধের অবসান ঘটায়, তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত ও আফ্রিকায় ফরাসি ও ব্রিটিশদের দ্বন্দ‌্বের কোন সুরাহা করতে পারেনি এই চুক্তি।[৪৫] এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল এই দুই অঞ্চলের বাণিজ্য ও বাজার সম্প‌্রসারণ নিয়ন্ত্রণ করা, যদিও তা করতে এ চুক্তি ব্যর্থ হয়।

এসময়কার বিশ্বায়ন বাধাপ্রাপ্ত হয় যুদ্ধ-কলহ, রোগ-ব্যধি এবং কতিপয় এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির দ্বারা।[৪৬] ইংল্যান্ডে শস্যসমূহ রপ্তানী নিয়ন্ত্রণ করতে "ভুট্টা আইন" পাশ করা হয়, যা বাণিজ্য ও বিশ্বায়নের গতিকে স্তীমিত করে দেয়।[৪৭]

ক্রমান্বয়ে আধুনিক বিশ্বায়নের সূচনা[সম্পাদনা]

ইতিহাসবিদ সেবাস্টিয়ার কনরাডের মতে, আদি বিশ্বায়নের কয়েকটি সূচক হল "উগ্র জাতীয়তাবাদ, বর্ণবিদ্বেষ, সামাজিক ডারউইনবাদ, এবং গণহত্যামূলক মানসিকতা" যাকে "একটি বিশ্ব অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার" সাথে সম্পৃক্ত করা হয়।[৪৮] ১৮৭০ সাল থেকে শুরু করে, বৈশ্বিক বাণিজ্যের গাঁথুনি উত্তরোত্তর মজবুত হতে থাকে কেননা বিভিন্ন জাতির অর্থনীতি ক্রমশঃই অপরাপর জাতির অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে থাকে, যা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। নতুন বিশ্বের বাণিজ্য চক্রে কোন মন্দা দেখা দিলে অথবা বৃদ্ধি আসলে তার প্রভাব সমগ্র বিশ্বজুড়ে পরিলক্ষিত হতে থাকে।[৪৮] ইতিহাসবিদ মডেলস্কি -এর মতে আদি বিশ্বায়ন যুগের শেষভাগে "বৈশ্বিক বাণিজ্য সম্পর্কের একটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ধারাবিশেষ যা সমগ্র বিশ্বে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে।"[৪৯] ১৭৫০ সালের মধ্যে ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়া ও আমেরিকার মধ্যকার যোগাযোগ ব্যবস্থা একটি স্থিতিশীল ও বহুপাক্ষিক নির্ভরশীলতায় পরিণত হয়, যার প্রভাব আধুনিক বিশ্বায়নের যুগেও পরিলক্ষিত হয়। [৫০]

মূলধনের স্থানান্তর[সম্পাদনা]

উত্তর আটলান্টিক অঞ্চল আদি বিশ্বায়নের পূর্ববর্তী সময়ে বিশ্ব ব্যবস্থায় আধিপত্য বিস্তার করলেও, ১৯শ শতাব্দীর প্রারম্ভে একটি "বহুমুখী বিশ্ব অর্থনীতি" গঠিত হতে থাকে এবং বাণিজ্যিক বিনিয়োগের স্থান দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে।[৫১] ১৯শ শতাব্দীর শেষে ব্রিটিশ মোট মূলধনের ১৭ শতাংশ বৈদেশিক বিনিয়োগে ব্যবহৃত হয়[৫২] এবং ১৯১৩ সালের মধ্যে তাদের বৈদেশিক বিনিয়োগ দ্বিগুণ হয়ে শতকরা ৩৩ ভাগে পরিণত হয়।[৫২] ১৮৮০ সালে জার্মানি তার মোট জাতীয় সঞ্চয়ের এক পঞ্চমাংশ বিনিয়োগ করে, এবং বিংশ শতকে তারাও ব্রিটিশদের ন্যায় বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ব্যপক পরিমাণে বৃদ্ধি করে।[৫২] ১৮৬০ সালে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মোট জাতীয় সঞ্চয়ের ৩৫ শতাংশ, ১৮৮০ সালে ৪৭ শতাংশ, এবং ১ম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৩ শতাংশে।[৫২] সমাজে বৈশ্বিক বিনিয়োগের পরিমাণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে, এবং বিত্তশালীরা তাদের সঞ্চয় থেকে ততোধিক পরিমাণে অর্থ আন্তর্জাতিক বাজারে বিনিয়োগ করতে থাকে।

মূলধনের এই স্থানান্তর সম্ভব হবার পেছনে মূল অবদান রেখেছিল শিল্প বিপ্লব এবং যান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা, যা সর্বাধিক প্রসার পায় ব্রিটেনে।[৫৩] আদি বিশ্বায়নের কালে পুঁজিবাদী বণিকগণ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সম্ভাবনাময় বাজারসমূহ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয় এবং এই বাজারগুলোর একটি সাথে অপরগুলোর সংযোগ স্থাপনা করে বৈশ্বিক বাণিজ্যের গোড়াপত্তন করে। ক্রীতদাস কর্তৃক উৎপাদন এবং আমেরিকা মহাদেশদ্বয়ের প্রাকৃতিক সম্পদের শোষণের মাধ্যমে ইউরোপীয়রা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের শীর্ষে আরোহণ করে।[৫৪] আধুনিক বিশ্বায়নের যুগে বিপুল পরিমাণে উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আরো শক্তিশালী ও জটিল আকার ধারণ করে। ইউরোপীয়দের সাফল্যের আরেকটি কারণ ছিল ১৭৫০ সাল থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে আফ্রিকা ও এশিয়ার শিল্প বিপ্লবের ব্যর্থতা।[৫৫] আধুনিক বিশ্বায়নের একটি অন্যতম পরিচায়ক ছিল ইউরোপে অর্থসম্পদের স্থানান্তর।

সংস্কৃতির স্থানান্তর[সম্পাদনা]

আদি বিশ্বায়নের যুগে মূলধনের ন্যায় ব্যক্তিবর্গও ব্যপকভাবে স্থানান্তরিত হতে থাকে। আদি বিশ্বায়নের সময়কালে "পারস্পরিক প্রভাববিস্তার, বিভিন্ন সংস্কৃতির সংকরায়ন এবং বিভিন্ন সংস্কৃতিসমূহের পরস্পরের সাথে জড়িয়ে পড়া", ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয়।[৫৬] বহু ইতিহাসবিদ ১ম বিশ্বযুদ্ধের বিশ্বব্যপী বিস্তারের জন্যে আদি বিশ্বায়ন কালে জাতি সমূহের পরস্পরের সাথে জটিল সম্পর্কে ও বিভিন্ন চুক্তিতে জড়িয়ে পড়াকে দায়ী করেন। ১৭৫০-১৮৮০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যপী অন্তর্ভুক্তির সম্প্রাসারণে ভূমিকা রাখে বিপুল পরিমাণে উৎপাদন ক্ষমতা, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন।[৫০] আদি বিশ্বায়নের সমাপ্তি গবাদি পশুপালনের বিস্তৃতির সর্বশেষ ধাপকেও চিহ্নিত করে।[৫৩] ১৬৫০-এর দশকের পরবর্তী সময়কালে সাধারণ ও নিবিড় কৃষি পদ্ধতিসমূহ পূর্ণতা লাভ করে। মহামারীসমূহ বিদায় নেয়ায় মানব জনসংখ্যা গুণানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। আদি বিশ্বায়নের শেষ পর্যায় এবং আধুনিক বিশ্বায়নের প্রাক্কালে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার জনসংখ্যা "পুনরুদ্ধার" হতে আরম্ভ করে, যেখানে আদি বিশ্বায়নের শুরুর ভাগে ইউরোপীয়দের নিয়ে আসা ছোঁয়াচে রোগসমূহে লক্ষ লক্ষ স্থানীয় বাসিন্দাদের মৃত্যুতে জনসংখ্যা বিপুলভাবে হ্রাস পায়।[৫৩] মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আগত পুষ্টিগুণে ভরপুর খাদ্যদ্রব্য বিশ্বের জনগণের পুষ্টি ও সুস্বাস্থ্যে অবদান রাখে, যার ফলশ্রুতিতে আধুনিক বিশ্বায়ন সম্ভবপর হয়।[৫৩] জনবহুল অঞ্চলসমূহে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মানুষ পূর্বে কম জনবহুল বা জনহীন অরণ্য ও চারণভূমিসমূহে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, এবং এসমস্ত অঞ্চলকে কৃষিক্ষেত্রে রূপান্তর করতে থাকে।[৫৩] একারণে কৃষি পণ্যের উৎপাদন ও রপ্তানি বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।

আধুনিক বিশ্বায়নের সূচনার আরেকটি চিহ্ন ছিল বিভিন্ন প্রক্রিয়ার অত্যধিক রাজনীতিকরণ।[৫৭] আদি বিশ্বায়ন পর্যায়ে ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জ থেকে আরম্ভ করে উত্তর স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চল পর্যন্ত বৃহদাকার রাষ্ট্রসমূহের উদ্ভব ঘটে।[৫৮] এসব অঞ্চলে বসতি স্থাপনের ফলে সরকারসমূহের পক্ষে রাজস্ব গ্রহণ, সেনাবাহিনী গড়ে তোলা, শ্রমশক্তির যোগান এবং দীর্ঘস্থায়ী অর্থনীতি গড়ে তোলা সম্ভব হয়।[৫৮] এসকল ক্ষেত্রে উন্নয়ন এবং সাংস্কৃতিক বিভিন্ন বিষয়ে অগ্রগতি বিশ্বায়নের বৃহৎ মঞ্চে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক রাষ্ট্রসমূহও অবদান রাখতে আরম্ভ করে। আদি বিশ্বায়নের শেষাংশে এবং আধুনিক বিশ্বায়নের প্রথামাংশে গড়ে ওঠা স্থিতিশীল আইনি সংস্থাসমূহ অর্থনৈতিক অগ্রগতি, সম্পত্তি অধিকার আইন (বিশেষ করে ইংল্যান্ডে), ভৌগোলিক স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক উন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রসমূহের ভিত্তি স্থাপন করে।[৫৯] আধুনিক বিশ্বায়নের অপর একটি কারণ ছিল প্রযুক্তিগত উন্নয়নসমূহের আদান-প্রদান।

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইউরোপীয় সভ্যতাসমূহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং "বিভিন্ন রাষ্ট্রের ভাষা, ধর্ম, প্রথা এবং রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বিষদ জ্ঞানলাভ করে।"[৬০] অবশেষে উনবিংশ শতাব্দীর সমাপ্তিতে ইউরোপীয় জাতিসমূহ এশিয়া অঞ্চলগুলো থেকে নতুন কোন উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন গ্রহণ করেনি।[৬০]

বৈশ্বিক পারস্পরিক সম্পর্কের স্থানান্তর[সম্পাদনা]

সারাবিশ্বে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের ফলে নতুন নতুন পণ্যের উৎপাদনের সূচনা ঘটে।[৬১] ১৮৮০ সালের মধ্যে ইউরোপের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ এক নতুন উদ্যম পায়।[৬২] আধুনিক বিশ্বায়নে স্থানান্তর ছিল একটি মন্থর এবং পারস্পরিক সম্পর্ক গঠনমূলক প্রক্রিয়া। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে অপ্রতিযোগী পণ্যদ্রব্যসমূহ মহাদেশগুলোর বাজারগুলোতে নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যসমূহের বিনিময়ে আদান-প্রদান হতে থাকে।[৬২] তদুপরি, বৈশ্বিকভাবে শ্রমশক্তির অন্তর্ভুক্তিকরণ শুরু হয়।[৬২] আধুনিক বিশ্বায়নের অর্থ হয়ে দাঁড়ায় আর্থ-সামাজিক পারস্পরিক সম্পর্কের একটি সাধারণ বিস্তৃতির প্রক্রিয়া। এই উন্নয়নের একটি উদাহরণ হল "ফ্রিম্যাসনরি" (Freemasonry)-এর গোড়াপত্তন।[৬৩] বিদ্যমান বাণিজ্য ব্যবস্থাসমূহের বিস্তার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়, মূলধন ও পণ্যদ্রব্যের প্রবাহ আরো স্থিতিশীল হয়।[৬৪] দীর্ঘমেয়াদি পারস্পরিক নির্ভরশীলতাসমূহ অপরিবর্তিত থাকে।[৬১] আধুনিক বিশ্বায়নের শুরুতে ইউরোপীয়দের ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাসমূহ ধীরে ধীরে গুটিয়ে আসতে থাকে। জাতীয় সমাজসমূহ অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির ফলাফলে আক্ষেপ করতে থাকে এবং এর প্রভাবসমূহ সীমাবদ্ধ করার প্রচেষ্টা করতে থাকে।[৬৫] ইতিহাসবিদ বেইলি, হপকিন্স প্রমুখ এবিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেন যে, আদি বিশ্বায়ন থেকে আধুনিক বিশ্বায়নে রূপান্তর প্রক্রিয়াটি ছিল জটিল ও মন্থর এবং বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে এর সময়কাল ছিল ভিন্ন ভিন্ন। অনেক ক্ষেত্রে প্রাক-আধুনিক যুগে সূচিত হওয়া মূল্যবোধ, রীতিনীতি ইত্যাদি এ যুগেও টিকে ছিল। যার ফলৈ আরম্ভ হয় একটি অর্থনৈতিক "অবিশ্বায়ন" প্রক্রিয়া এবং তারও ফলশ্রুতিতে সংঘটিত দুটি বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৪৫ সালে এ প্রক্রিয়াটির সমাপ্তি ঘটে।[৬৫]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

সহায়ক নির্দেশিকা[সম্পাদনা]

টীকা[সম্পাদনা]

  1. Hopkins 2003, পৃ. 3.
  2. Hopkins 2003, পৃ. 4–5.
  3. Hopkins 2003, পৃ. 5.
  4. Hopkins 2003, পৃ. 6.
  5. Hopkins 2003, পৃ. 7.
  6. Hopkins 2003, পৃ. 4–5, 7.
  7. Shelton 1998, পৃ. 20.
  8. Dillon ও Garland 2005, পৃ. 235.
  9. Dillon ও Garland 2005, পৃ. 56–58.
  10. Cohen 2000, পৃ. 58–59.
  11. Cohen 2000, পৃ. 60.
  12. Cohen 2000, পৃ. 61–62.
  13. Fairbank, Reischauer এবং Craig 1973, পৃ. 111.
  14. Fairbank, Reischauer এবং Craig 1973, পৃ. 135–36.
  15. Fairbank, Reischauer এবং Craig 1973, পৃ. 135.
  16. Fairbank, Reischauer এবং Craig 1973, পৃ. 181–83.
  17. Hopkins 2003, পৃ. 4.
  18. Bayly 2004, পৃ. 15.
  19. Klein 1999, পৃ. 2.
  20. Klein 1999, পৃ. 9.
  21. Thomas 1997, পৃ. 107.
  22. Klein 1999, পৃ. 20.
  23. Osterhammel ও Petersson 2005, পৃ. 50.
  24. Solow 1991, পৃ. 5.
  25. Thomas 1997, পৃ. 170.
  26. Thomas 1997, পৃ. 189.
  27. Daudin 2002.
  28. "Tobacco in Virginia"। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-১১-১১ 
  29. Goodman 1993, পৃ. 129.
  30. Gately 2001, পৃ. 72.
  31. Goodman 1993, পৃ. 136.
  32. Goodman 1993, পৃ. 137.
  33. Goodman 1993, পৃ. 140.
  34. Ellis 1905, পৃ. 4.
  35. Ellis 1905, পৃ. 5.
  36. Ellis 1905, পৃ. 6.
  37. Bayly 2004, পৃ. 64.
  38. "First Anglo-Dutch War, (1652–1654)"। Historyofwar.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-১১-১৫ 
  39. এ যুদ্ধে শতাধিক জাহাজ সংবলিত ব্রিটিশ ও ওলোন্দাজ নৌবহর ১২ ঘণ্টা ব্যপী যুদ্ধরত থাকে। এ যুদ্ধে ১৬ শতাধিক ওলোন্দাজ সেনা নিহত হয় যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন ওলোন্দাজ নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল ট্রম্প, অপরদিকে ইংরেজদের হতাহতের সংখ্যা ছিল ওলোন্দাজদের অর্ধেক।
  40. Schwartz 1999.
  41. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২৭ জুলাই ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জুলাই ২০১৯ 
  42. "East India Company"। ২০০৯। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-১১-১৩ 
  43. "Slaves"। ২০০১। ২০০৯-১১-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-১১-১৬ 
  44. "Regulating Act 2009"। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-১১-১৩ 
  45. "Treaty of Aix-la-Chapelle"। Encyclopædia Britannica। ২০০৯। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-১১-১৫ 
  46. "Why globalisation might have started in the eighteenth century"। মে ১৬, ২০০৮। মে ৩০, ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-১১-১৪ 
  47. Lusztig 1995, পৃ. 394–396.
  48. Conrad 2007, পৃ. 4.
  49. Modelski, Devezas এবং Thompson 2008, পৃ. 12.
  50. Osterhammel ও Petersson 2005, পৃ. 28.
  51. Conrad 2007, পৃ. 5.
  52. O'Rourke ও Williamson 1999, পৃ. 208.
  53. Bayly 2004, পৃ. 49.
  54. Bayly 2004, পৃ. 53–55.
  55. Bayly 2004, পৃ. 56.
  56. Conrad 2007, পৃ. 6.
  57. Osterhammel ও Petersson 2005, পৃ. 208.
  58. Bayly 2004, পৃ. 50.
  59. Bayly 2004, পৃ. 61.
  60. Osterhammel ও Petersson 2005, পৃ. 52.
  61. Modelski, Devezas এবং Thompson 2008, পৃ. 248.
  62. Osterhammel ও Petersson 2005, পৃ. 16.
  63. Harland-Jacobs 2007, পৃ. 24.
  64. Harland-Jacobs 2007, পৃ. 4.
  65. Osterhammel ও Petersson 2005, পৃ. 29.

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]