অ্যান্ড্রিউ স্কট ওয়াহ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
অ্যান্ড্রিউ স্কট ওয়াহ
অ্যান্ড্রিউ স্কট ওয়াহ ও তাঁর দুই পত্নীর সমাধি
ভারতের সার্ভেয়র জেনারেল
কাজের মেয়াদ
১৬ ডিসেম্বর ১৮৪৩ – ১২ মার্চ ১৮৬১
পূর্বসূরীজর্জ এভারেস্ট
উত্তরসূরীহেনরি এডওয়ার্ড ল্যান্ডর থুইলিয়ার
ব্যক্তিগত বিবরণ
জন্ম(১৮১০-০২-০৩)৩ ফেব্রুয়ারি ১৮১০
মৃত্যু২১ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৮(1878-02-21) (বয়স ৬৮)
৭ পিটারশাম টেরেস, কুইন'স গেট, ইংল্যান্ড
জাতীয়তাব্রিটিশ
দাম্পত্য সঙ্গীজোসেরিন মরিসন গ্রাহাম
সেসিলা এলিজা অ্যাডিলেড
ধর্মখ্রিস্ট ধর্ম

অ্যান্ড্রিউ স্কট ওয়াহ (৩ ফেব্রুয়ারি ১৮১০- ২১ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৮) একজন ব্রিটিশ সেনা আধিকারিক ও ভারতের সার্ভেয়র জেনারেল ছিলেন, যিনি মাউন্ট এভারেস্ট পর্বতশৃঙ্গের নাম তার পূর্বসূরী জর্জ এভারেস্টের নামে করেন।

প্রথম জীবন[সম্পাদনা]

অ্যান্ড্রিউ স্কট ওয়াহ ১৮১০ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা জেনারেল গিলবার্ট ওয়াহ মাদ্রাজের মিলিটারি অডিটর-জেনারেল ছিলেন। এডিনবার্গ হাই স্কুল থেকে শিক্ষা সম্পন্ন করে অ্যাডিসকম্বে অবস্থিত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনা কলেজে শিক্ষা সম্পন্ন করেন।

কর্মজীবন[সম্পাদনা]

অ্যান্ড্রিউ স্কট ওয়াহ কলেজ শিক্ষা সম্পন্ন করে ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই ডিসেম্বর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ার্সের লেফট্যানেন্ট হিসেবে যোগদান করেন ও ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মে ভারতে পৌছন। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই এপ্রিল বেঙ্গল স্যাপার্স ও মাইনার্স বাহিনীতে ও ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই জুলাই ভারতের মহান ত্রিকোণোমিতিক সর্বেক্ষণে একজন তরুণ আধিকারিক হিসেবে যোগদান করেন। পরের বছর অ্যান্ড্রিউ ও তার সহকর্মী লেফট্যানেন্ট রেনি টেইলিয়োর চুনারজব্বলপুরের মধ্যবর্তী বন্যাঞ্চল জরিপের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দে ওয়াহ দেরাদুন শহরে সর্বেক্ষণের অধিকরণে যোগদান করেন, যেখানে তিনি মহাজাগতিক বস্তু পর্যবেক্ষণের কাজে সাহায্য করেন। তিনি ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ফতেহগড়, ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দে কেপ কোমোরিন হতে দেরাদুন পর্য্যন্ত ৪৫০ মাইল এলাকা, ১৮৩৮ ও ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে বিদার অঞ্চল, ১৮৪২ খ্রিষ্টাব্দে রোহিলখণ্ড অঞ্চলে জরিপ কাজে নিযুক্ত হন। জর্জ এভারেস্ট ভারতের সার্ভেয়র জেনারেল পদ থেকে অবসর নিলে তার সুপারিশে ওয়াহ ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর এই পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই ফেব্রুয়ারি তাকে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত করা হয়। এই সময় তিনি কলকাতা থেকে আঠাশ হাজার বর্গমাইল এলাকা জরিপকাজ শুরু করেন।

মাউন্ট এভারেস্টের জরিপ[সম্পাদনা]

১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হিমালয়ের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত সওয়াজপুর স্টেশন থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ করেন। সে সময় কাঞ্চনজঙ্ঘাকে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হত, কিন্তু তিনি কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে ২৩০ কিমি (১৪০ মা)দুরত্বে অবস্থিত একটি আরো উচ্চ একটি শৃঙ্গ লক্ষ্য করেন। প্রায় একই সময়ে জন আর্মস্ট্রং নামে তার এক কর্মচারীও আরো পশ্চিম থেকে এই চূড়াটি লক্ষ্য করেন এবং একে peak-b হিসেবে অভিহিত করেন। ওয়াহ পরবর্তীকালে মন্তব্য করেন যে যদিও পর্যবেক্ষণ হতে বোঝা যাচ্ছিলো যে peak-b কাঞ্চনজঙ্ঘা অপেক্ষা উচ্চতর, তা সত্ত্বেও প্রমাণের জন্যে আরো নিকটতর স্থান হতে পর্যোবেক্ষণ প্রয়োজন ছিলো। পরের বছর তিনি এই শৃঙ্গের আরো কাছ থেকে পর্য্যবেক্ষণের জন্য তরাই অঞ্চলে একজন আধিকারিককে পাঠান, কিন্তু মেঘের কারণে জরিপকাজ চালানো সম্ভবপর হয়ে ওঠে না।[১]

১৮৪৯ সালে ওয়াহ সেখানে জেমস নিকলসনকে প্রেরণ করে, যিনি ১৯০ কিমি (১২০ মা) দূরে অবস্থিত জিরোল থেকে দুটি পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ করেন ও পাঁচটি বিভিন্ন স্থান হতে তিরিশেরও অধিক পর্যবেক্ষণ সম্পন্ন করেন। তার খসড়া উপাত্ত হতে তিনি peak-b এর উচ্চতা নির্ণয় করেন ৯,২০০ মি (৩০,২০০ ফু), কিন্তু এটি ছিল আলোর প্রতিসরণ জনিত ত্রুটি অগ্রাহ্য করে নির্ণীত উচ্চতা। তবুও এই খসড়া হিসাব থেকে বোঝা যায় যে, peak-b এর উচ্চতা কাঞ্চনজঙ্ঘা হতে বেশি। এরপর মাইকেল হেনেসি নামক ওয়াহর একজন সহকর্মী সে সময়ে পর্বতগুলিকে রোমান সংখ্যায় প্রকাশ করা আরম্ভ করেন এবং সেই রীতি অনুযায়ী peak-b এর নতুন নাম হয় peak-XV (১৫ নং শৃঙ্গ)।[১]

১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে দেরাদুন শহরে অবস্থিত সদর-দপ্তরে বাঙালি গণিতবিদ ও পর্যবেক্ষক রাধানাথ শিকদার নিকলসনের মাপ-জোক থেকে ত্রিকোণোমিতিক গণনা করে সর্বপ্রথম নির্ণয় করেন যে, এই শৃঙ্গ বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।[২] পরবর্তী কয়েক বছর গণনাগুলিকে বার বার নিশ্চিত করবার প্রচেষ্টার কারণে আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করতে দেরি হয়। নিকলসনের উপাত্ত নিয়ে ওয়াহ ও তার কর্মীরা পরবর্তী দুই বছর গণনা কার্য চালিয়ে যান এবং পর্যবেক্ষণস্থল থেকে শৃঙ্গের দুরত্বের কারণে আলোর প্রতিসরণ, বায়ুমন্ডলের চাপ ও তাপমাত্রা তারতম্যের সমস্যাগুলির সমাধানের প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। অবশেষে ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে তিনি কলকাতার সহকারীকে পত্র মারফত তার সিদ্ধান্ত জানান। তিনি সিদ্ধান্তে পৌছন যে, এই শৃঙ্গের উচ্চতা ৮,৮৩৯.২ মি (২৯,০০০ ফু) হওয়ায় এই শৃঙ্গ সম্ভবতঃ বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।[১] জনসমক্ষে এই শৃঙ্গের উচ্চতা জানানো হয় ৮,৮৩৯.৮ মি (২৯,০০২ ফু)।[৩]

মাউন্ট এভারেস্টের নামকরণ[সম্পাদনা]

যদিও সার্ভে পর্বতশৃঙ্গগুলির নামকরণ স্থানীয় নামে রাখতে ইচ্ছুক ছিল, কিন্তু ওয়াহ বলেন যে, তিনি ১৫ নং শৃঙ্গের কোন স্থানীয় নাম খুঁজে পাননি। বিদেশীদের জন্যে তিব্বত ও নেপাল উন্মুক্ত না থাকায় তার স্থানীয় নামের অণুসন্ধান বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু এই পর্বতের বেশ কয়েকটি স্থানীয় নাম ছিল, যেমন দার্জিলিং অঞ্চলে প্রচলিত দেওধুঙ্গা বা পবিত্র পর্বত,[৪] তিব্বতে প্রচলিত চোমোলাংমা ইত্যাদি। ওয়াহ এই যুক্তি উত্থাপন করেন যে, অনেকগুলি স্থানীয় নাম থাকায় যে কোন একটি নামকে রাখা ঠিক হবে না, সেই কারণে তিনি তার পূর্বসূরী সার্ভেয়র জেনারেল জর্জ এভারেস্টের নামে এই শৃঙ্গের নামকরণের সুপারিশ করেন।[১][৫][৬] জর্জ স্বয়ং তার নাম ব্যবহারের বিরোধী ছিলেন এবং তিনি রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটিকে জানান যে, এভারেস্ট নামটি হিন্দিতে লেখা যায় না ও ভারতীয়রা উচ্চারণ করতে পারেন না। এতৎসত্ত্বেও বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের নাম তার নামানুসারে রাখা হয় মাউন্ট এভারেস্ট।[১]

অন্যান্য জরিপ কার্য[সম্পাদনা]

১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দক্ষিণ কোঙ্কন অঞ্চল, মাদ্রাজ উপকূল, দক্ষিণ পরেশনাথ, ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে কচ্ছ ও ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে দেরাদুন হতে করাচি পর্য্যন্ত জরিপ কাজ তার তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা আগস্ট ওয়াহকে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ার্স বাহিনীর মেজর পদে উন্নীত করা হয়। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তার তত্ত্বাবধানে সিন্ধু নদ সর্বেক্ষণ প্রকল্প শুরু হয় এবং ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে তা সম্পন্ন হয়। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২০ শে সেপ্টেম্বর তাকে লেফট্যানেন্ট কর্ণেল পদ প্রদান করা হয়। সেই বছর তাকে রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটির স্বর্ণ পদক প্রদান করা হয় ও পরের বছর তাকে এই ঐতিহ্যশালী প্রতিষ্ঠানের ফেলো হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই আগস্ট তাকে কর্ণেল পদে উন্নীত করা হয়। তার কার্যকালে ভারতের ৯৪,০০০ বর্গমাইল এলাকার জরিপ কার্য সম্পূর্ণ হয়। এই বছর ১২ই মার্চ তিনি সর্বেক্ষণ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই আগস্ট তাকে সাম্মানিক মেজর জেনারেল পদ ও নাইট উপাধি প্রদান করা হয়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Peter Gillman, সম্পাদক (১৯৯৩)। Everest – The Best Writing and Pictures from Seventy Years of Human Endeavour। Little, Brown and Company। পৃষ্ঠা 10–13। আইএসবিএন 978-0-316-90489-6 
  2. Biswas, Soutik (২০ অক্টোবর ২০০৩)। "The man who "discovered" Everest"। BBC News। সংগ্রহের তারিখ ১১ এপ্রিল ২০০৮ 
  3. "Letters to the Editor"The American Statistician36 (1): 64–67। ফেব্রুয়ারি ১৯৮২। জেস্টোর 2684102ডিওআই:10.1080/00031305.1982.10482782 
  4. "Mt. Everest 1857"। harappa.com। ২৬ ডিসেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ জানুয়ারি ২০০৮ 
  5. টেমপ্লেট:সংবাদ উদ্ধৃতিpaper The Times
  6. "Papers relating to the Himalaya and Mount Everest", Proceedings of the Royal Geographical Society of London, no.IX pp.345–351, April–May 1857.

আরও পড়ুন[সম্পাদনা]

  • John Keay, The Great Arc: The Dramatic Tale of How India was Mapped and Everest was Named, HarperCollins Publishers: New York, 2000 (আইএসবিএন ০-০০-২৫৭০৬২-৯).
  • Andrew Scott Waugh: "Papers relating to the Himalaya and Mount Everest", Proceedings of the Royal Geographical Society of London, no.IX pp. 345–351, April–May 1857.
  • Andrew Scott Waugh: "Mounts Everest and Deodanga", Proceedings of the Royal Geographical Society of London, vol.2, 1858
রাজনৈতিক দপ্তর
পূর্বসূরী
জর্জ এভারেস্ট
ভারতের সার্ভেয়র জেনারেল উত্তরসূরী
হেনরি এডওয়ার্ড ল্যান্ডর থুইলিয়ার