লুইজ ভাজ দি কামোঁইশ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
লুইজ ভাজ দি কামোঁইশ
লুইজ দি কামোঁইশের প্রতিকৃতি (আনু. ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দ)
লুইজ দি কামোঁইশের প্রতিকৃতি (আনু. ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দ)
জন্মলুইজ ভাজ দি কামোঁইশ
আনু. ১৫২৪-১৫২৫
লিসবন (আনুমানিক), পর্তুগাল রাজ্য
মৃত্যু১০ই জুন, ১৫৮০ (৫৫-৫৬ বছর বয়সে)
লিসবন, পর্তুগাল রাজ্য
পেশাকবি
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকুইঁব্রা বিশ্ববিদ্যালয়
সময়কালপর্তুগিজ রেনেসাঁস
ধরনমহাকাব্য
সাহিত্য আন্দোলনধ্রুপদীবাদ
উল্লেখযোগ্য রচনাবলিউজ লুজিয়াদাশ
আত্মীয়কামোঁইশ পরিবার
পর্তুগালের রাজধানী লিসবন নগরীতে লুইজ দি কামোঁইশের স্মারক মূর্তি ও সৌধ

লুইজ ভাজ দি কামোঁইশ (পর্তুগিজ: Luís Vaz de Camões, আ-ধ্ব-ব: [luˈiʒ ˈvaʒ dɨ kaˈmõjʃ], আনু. ১৫২৪/১৫২৫, লিসবন - ১০ই জুন ১৫৮০, লিসবন) পর্তুগালের জাতীয় কবি। তিনি পর্তুগিজ ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ও পাশ্চাত্য সাহিত্যের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে পরিচিত। কাব্য রচনার দক্ষতার বিচারে তাঁকে ইংরেজি ভাষার কবি শেকসপিয়র, ফরাসি ভাষার কবি মলিয়ের, গ্রিক ভাষার মহাকবি হোমার বা ইতালীয় ভাষার মহাকবি দান্তে-র সাথে একই কাতারে স্থান দেওয়া হয়েছে। তাঁকে ১৬শ শতকে ইউরোপের সেরা গীতিকবি বলা হয়।[১]

কামোঁইশ অভিজাত কিন্তু অস্বচ্ছল এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন জাহাজার কাপ্তান, যিনি জাহাজে করে ভারতে গিয়েছিলেন এবং গোয়াতে জাহাজডুবির শিকার হয়েছিলেন।[২] কামোইঁশের শৈশব, কৈশোর ও শিক্ষাজীবন নিয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য বিরল। তিনি সম্ভবত কুইঁব্রা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করেন। তিনি লাতিন ভাষা ও ধ্রুপদী সাহিত্য (ভার্জিল, হোরেস ও ওভিদের রচনা) নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন ও ১৫৪২ সালে স্নাতক হন। এরপর পর্তুগালের রাজদরবারের কবি হিসেবে স্থান পান ও সেখানে ইতালীয় সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। ধারণা করা হয় তিনি রাজপ্রাসাদের গৃহাধ্যক্ষের কন্যা কাতারিনা দি আতাইদি-র (যিনি পরবর্তীতে ভাস্কো দা গামা-র স্ত্রী হয়েছিলেন) সাথে প্রণয় করতে গিয়ে রাজদরবারের রোষে পড়েন এবং তাকে সেখান থেকে বহিস্কার করা হয়। নির্বাসনের অংশ হিসেবে উত্তর আফ্রিকাতে সেউতা নগরীতে (বর্তমান মরক্কোতে স্পেনের ছিটমহল) পর্তুগিজ সেনাদের পক্ষে আরব মুসলমান মুর জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে একটি চোখ হারান। পর্তুগালে ফেরত এসে ১৫৫০ সালে এক উৎসবে রাজপ্রাসাদের এক কর্মচারীকে তরবারির আঘাতে আহত করার কারণে কারারুদ্ধ হন।[৩] এরপর তাঁকে শাস্তি লাঘব করে সাধারণ সৈন্য হিসেবে তিন বছরের জন্য ভারতের গোয়াতে প্রেরণ করা হয়।[৩] ৭ মাসের সমুদ্রযাত্রা শেষে ১৫৫৩ সালের নভেম্বর মাসে তিনি ২৮ বছর বয়সে গোয়াতে পৌঁছান।[৩] এরপর গোয়া থেকে তিনি বহুসংখ্যক পর্তুগিজ নৌসেনা অভিযানের অংশ হিসেবে মালাবার উপকূল, লোহিত সাগর, পারস্য উপসাগর, মালাক্কা প্রণালী ও মালুকু দ্বীপপুঞ্জ (ইন্দোনেশিয়া) ভ্রমণ করেন।[২][৩] ১৫৫৬ সালে তাঁকে চীনের মূল ভূখণ্ডে অবস্থিত মাকাওতে চাকুরি দেওয়া হয়।[৩] ১৯৫৯ সালে মাকাও থেকে অর্থ আত্মসাতের দায়ে চাকুরিচ্যুত হয়ে জাহাজে করে ফেরত আসার সময় ভিয়েতনামের মেকং ব-দ্বীপের কাছে জাহাজডুবির শিকার হন।[৩] শেষ পর্যন্ত আবার গোয়াতে ফেরত আসলে সেখানে তাঁকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়; কারামুক্তির পরেও তিনি ১৫৬৭ সাল পর্যন্ত গোয়াতেই ছিলেন।[৩] সে বছর তিনি গোয়া থেকে জাহাজে করে লিসবনের দিকে যাত্রা করেন, কিন্তু অর্থাভাবে যাত্রার মাঝপথে আফ্রিকার মোজাম্বিকে (একটি পর্তুগিজ উপনিবেশ) আটকা পড়ে যান।[৩] শেষ পর্যন্ত প্রায় ২ বছর মোজাম্বিকে কাটানোর পরে ১৫৬৯ সালের সেপ্টেম্বরে লিসবনগামী জাহাজ ধরে ১৯৭০ সালের এপ্রিলে মাতৃভূমি পর্তুগালে ফেরত আসেন।[৩] এই সুদীর্ঘ নির্বাসন জীবনে তিনি পর্তুগিজ সেনাদের সাথে কাঁধ মিলিয়ে বহু যুদ্ধে অংশ নেন এবং গোয়াতে অবস্থানকালে তাঁর জীবনের সেরা সাহিত্যকর্ম উজ লুজিয়াদাশ (Os Lusíadas, "পর্তুগিজ জাতি") নামক মহাকাব্যটি রচনা করেন। ১৫৭০ সালে পর্তুগালে ফেরত আসার পরে ১৫৭২ সালে লিসবন থেকে প্রকাশিত দশটি খণ্ডবিশিষ্ট (কান্তু Canto) অষ্টপদী শৈলীতে লেখা এই মহাকাব্যে পর্তুগিজ সমুদ্র অভিযাত্রী ভাস্কো দা গামা-র ভারতের যাওয়ার সমুদ্রপথ আবিষ্কারের বর্ণনার পাশাপাশি পর্তুগালের ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায়গুলি, বিশেষত বহিরাগতদের বিরুদ্ধ খ্রিস্টানদের বিজয়ের ঘটনাগুলি চিত্রিত করা হয়েছে। এতে কামোঁইশ গ্রিক ও লাতিন ধ্রুপদী অভিযাত্রা (ইলিয়াড ও অডিসি), মধ্যযুগীয় খ্রিস্টান ধর্ম এবং পর্তুগালের স্থানীয় ও জাতীয় বিষয়াবলির সফল সংশ্লেষণ ঘটান।[১] উজ লুজিয়াদাশ-এর প্রভাব এতই সুদূরপ্রসারী যে পর্তুগিজ ভাষাকে কখনও কখনও "কামোঁইশের ভাষা" নামে ডাকা হয়। পারনাজু দি কামোঁইশ (Parnaso de Camões, "কামোঁইশের কবিতাসমগ্র") নামে একটি কাব্য সঙ্কলন তাঁর জীবদ্দশাতেই মোজাম্বিকে থাকাকালীন অবস্থায় চুরি যায়। উজ লুজিয়াদাশ রচনার স্বীকৃতিস্বরূপ রাজার কাছ থেকে তিনি স্বল্প পরিমাণ রাজকীয় বয়স্ক ভাতা লাভ করেন।[৩] জীবদ্দশায় তেমন স্বীকৃতি না পেলেও মৃত্যুর পরে কামোইঁশের ভাষা ও রচনাশৈলীর তারিফ করা শুরু হয়। মৃত্যুর পরে তাঁর লেখা অনেকগুলি গীতিকবিতা রিমাশ (Rimas) নামের সঙ্কলন আকারে ১৫৯৫ সাল থেকে একাধিক সংস্করণে প্রকাশিত হয়। কামোঁইশ অনেক নাটকও রচনা করেন, যার মধ্যে ১৫৮৭ সালে রচিত আউতু দি ফিলুদেমু ( Auto de Filodemo) নামক নৈতিকতাভিত্তিক এক অঙ্কের নাটক এবং ১৫৮৭ সালে রচিত আঁফিত্রিওঁইশ (Anfitriões, "নিমন্ত্রাতাগণ") নামক দুইটি হাস্যরসাত্মক নাটক উল্লেখযোগ্য।[১] ইউরোপীয় পর্তুগিজ ও ব্রাজিলীয় পর্তুগিজ সাহিত্যে কামোঁইশের অবদান অতুলনীয়। তাঁকে পর্তুগালের জাতীয় কবি হিসেবে গণ্য করা হয়। কামোঁইশের মৃত্যুদিবস ১০ই জুন তারিখকে পর্তুগালের জাতীয় দিবস হিসেবে উদ্‌যাপন করা হয়। লিসবনের জেরোনিমুস মঠের ভেতরে ভাস্কো দা গামার পাশেই তার সমাধিটি অবস্থিত।

কামোইঁশ কবিতা রচনাতে তাঁর মাতৃভাষা পর্তুগিজ ভাষার কবিতায় ব্যবহৃত ছন্দের বিভিন্ন মাত্রা (metres) যেমন কাঁসোঁয়া (cançõa), কাঁতিগা (cantiga), এঁদিচা (endecha), মুতিশ (motes), ত্রুভা (trova) এবং ভোলতা (volta), ইত্যাদির পাশাপাশি রেনেসাঁস পর্বের ইতালীয় কাব্যের বিভিন্ন রূপ যেমন অন্ত্যেষ্টিগাথা, মহিমাগাথা, পল্লীকবিতা, চতুর্দশপদী, অষ্টপদী বীরত্বগাথা (ottava rima), ইত্যাদির ব্যবহারে দক্ষতার পরিচয় দেন।[৪] তিনি ছিলেন সম্ভবত আক্ষরিক অর্থেই সাহিত্যের ইতিহাসের সর্বপ্রথম বিশ্বকবি, যার রচনায় ইউরোপ, আফ্রিকা (উত্তর ও পূর্ব আফ্রিকা) ও এশিয়া মহাদেশের (ভারত, ইন্দোচীন, ইন্দোনেশিয়া, চীন) বিভিন্ন স্থানে তাঁর কষ্টার্জিত জীবন-অভিজ্ঞতাগুলির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। গবেষক ল্যান্ডেগ হোয়াইটের মতে উজ লুজিয়াদাশ কেবল পর্তুগালের জাতীয় মহাকাব্য নয়, দেশ-মহাদেশের সীমানা ছাড়ানো ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাব্য।[৩][টীকা ১] কামোঁইশের লেখা জটিল; এতে একদিকে যেমন ভারতীয় হিন্দু ও আরব মুসলমান জাতির বিরুদ্ধে খ্রিস্টান পর্তুগিজদের যুদ্ধ ও দেশবিজয়ের বীরত্বগাথার কথা বলা হয়েছে, অন্যদিকে পর্তুগিজ আগ্রাসী উপনিবেশবাদের বিভিন্ন নেতিবাচক দিকও তিনি বিদ্রুপাকারে বিভিন্ন চরিত্রকে দিয়ে বলিয়েছেন।

১৯৮৮ সালে পর্তুগাল ও ব্রাজিলের সরকার যৌথভাবে পর্তুগাজভাষী লেখকদের জন্য একটি বার্ষিক সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণা করে, যার মূল্যমান ১ লক্ষ ইউরো; পুরস্কারটির নাম দেওয়া হয় "প্রেমিউ কামোঁইশ" (Premio Camões) অর্থাৎ "কামোঁইশ পুরস্কার"। এটি পর্তুগিজভাষী লেখকদের জন্য সবচেয়ে মর্যাদাবাহী পুরস্কার।

নির্বাচিত ছত্র[সম্পাদনা]

মূল পর্তুগিজ বাংলা অনুবাদ

«Ó glória de mandar, ó vã cobiça Desta vaidade a quem chamamos Fama! Ó fraudulento gosto, que se atiça Cũa aura popular, que honra se chama! Que castigo tamanho e que justiça Fazes no peito vão que muito te ama! Que mortes, que perigos, que tormentas, Que crueldades neles experimentas! «Dura inquietação d’alma e da vida Fonte de desemparos e adultérios, Sagaz consumidora conhecida De fazendas, de reinos e de impérios! Chamam-te ilustre, chamam-te subida, Sendo dina de infames vitupérios; Chamam-te Fama e Glória soberana, Nomes com quem se o povo néscio engana!

«A que novos desastres determinas De levar estes Reinos e esta gente? Que perigos, que mortes lhe destinas, Debaixo dalgum nome preminente? Que promessas de reinos e de minas D’ ouro, que lhe farás tão facilmente? Que famas lhe prometerás? Que histórias? Que triunfos? Que palmas? Que vitórias?

হে গর্ব ও ক্ষমতা! খ্যাতির দম্ভের জন্য হে নিরর্থক লালসা! হে অন্তঃসারহীন নিজেকে ফুলানো অহঙ্কার যাকে গণসঙ্গীতে ডাকা হয় সম্ভ্রম আর মর্যাদা বলে! কী যে শাস্তি, কী যে কাব্যিক ন্যায়বিচার, তুমি প্রদান করো তাদেরকে যারা তোমার পেছনে ছোটে! কী মৃত্যু, কী কষ্ট তুমি দাও তোমার নায়কদেরকে! কী যন্ত্রণা তুমি বর্ষণ করো তাদের উপর! তুমি আত্মা ও দেহের সমস্ত শান্তি বিনষ্ট কর, তুমি বিচ্ছেদ আর পরকীয়ার আগুন উস্কে দাও; নিভৃতে, প্রত্যক্ষভাবে তুমি রাজ্য ও সাম্রাজ্যের সব সম্পদ ভোগ করে নাও! তারা যাকে সম্মান বলে, সম্ভ্রম বলে তার প্রাপ্য কেবলই বিদ্রূপ আর অবজ্ঞা; তারা যশ আর চিরঞ্জীব অগ্নিশিখার কথা বলে, আর মানুষ একটি নাম শুনে উন্মত্ত হয়ে ওঠে!

নতুন কোন বিপর্যয়ের পরিকল্পনা করছো তুমি এই রাজ্য আর এই জাতির জন্য? কী বিপদ, কী মৃত্যু তোমার ভাগ্যে লেখা আছে আর তা কোন্‌ বাগড়ম্বরমূলক উপাধি দিয়ে বরণ করা হবে? কোন্‌ কোন্‌ রাজ্য আর স্বর্ণখনির দিকে তুমি তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে অবধারিতভাবে? কোন্‌ খ্যাতির প্রতিশ্রুতি তুমি তাদেরকে দিয়েছ? কোন্‌ আখ্যান? কোন্‌ বিজয়, কোন্‌ মিছিল? কোন্‌ গৌরব?

উৎস: উজ লুজিয়াদাশ, চতুর্থ খণ্ড (৯৫ ও ৯৭ নং অষ্টপদী)।

টীকা[সম্পাদনা]

  1. ল্যান্ডেগ হোয়াইটের মতে "Camões was the first great European poet to cross the equator, and The Lusíads is the first truly global poem."

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Jo Eldridge Carney, সম্পাদক (২০০১), Renaissance and Reformation, 1500-1620: A Biographical Dictionary, Greenwood Publishing Group, পৃষ্ঠা 63-64 
  2. Andrea Gibbons, THE LUSIADS OF CAMÕES — VERSE ON THE CONQUERING OF WORLDS, ১৮ জুন ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা, সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুন ২০২০ 
  3. Landeg White (২০১৭), Camões: Made in Goa, Under the Peepal Tree 
  4. Gordon Campbell (২০০৫), The Oxford Dictionary of the Renaissance 

আরও দেখুন[সম্পাদনা]