মোহিতলাল মজুমদার

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
মোহিতলাল মজুমদার
মোহিতলাল মজুমদার
মোহিতলাল মজুমদার
জন্ম২৬ অক্টোবর, ১৮৮৮
কাঁচড়াপাড়া, হালিশহর, উত্তর চব্বিশ পরগণা, ভারত
মৃত্যু২৬ জুলাই, ১৯৫২
কলকাতা, ভারত
ছদ্মনাম'কৃত্তিবাস ওঝা', 'চামারখায়-আম', 'সব্যসাচী', 'সত্যসুন্দর দাস', মধুকরকুমার কাঞ্জিয়াল'
পেশাকবি, সমালোচক, অধ্যাপক
জাতীয়তা ভারতীয়
উল্লেখযোগ্য রচনাবলিদেবেন্দ্র-মঙ্গল, স্বপন-পসারী, বিস্মরণী, আধুনিক বাংলা সাহিত্য

মোহিতলাল মজুমদার (জন্ম : ২৬ অক্টোবর, ১৮৮৮ – মৃত্যু : ২৬ জুলাই, ১৯৫২) বিংশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত বাঙালি কবি এবং সাহিত্য সমালোচক। এছাড়াও তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রবন্ধকার ছিলেন। গভীর অন্তর্দৃষ্টি, নিপুণ বিশ্লেষণ ও ভাব-গম্ভীর ভাষার মহিমায় মোহিতলালের সমালোচনাধর্মী গ্রন্থগুলো ধ্রুপদী সাহিত্যের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।

প্রথম জীবন[সম্পাদনা]

মোহিতলাল মজুমদারের পৈতৃক বাড়ি ছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুঁচুড়া মহকুমার অন্তর্গত বলাগড় গ্রাম।[১] তাঁর বাবার নাম নন্দলাল মজুমদার এবং তাঁর মাতার নাম হেমমালা দেবী। নন্দলাল ছিলেন কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের জ্ঞাতি ভাই৷ মোহিতলালের কৈশোর এবং বিদ্যালয় জীবন বলাগড় গ্রামেই অতিবাহিত হয়। তিনি চব্বিশ পরগণা জেলায় মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় তিনি কিছুদিন কাঁচড়াপাড়ার কাছে হালিশহরে মায়ের মামাবাড়িতে অবস্থান করে সেখানকার বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। মোহিতলাল চার-পাঁচ বছর বয়সে কাশীরাম দাসের মহাভারতের সঙ্গে পরিচিত হন। নয় বছর বয়সে তার রোমান্স পাঠে আগ্রহ জন্মায়। বারো-তেরো বছর বয়সে পলাশীর যুদ্ধ এবং মেঘনাদ বধ কাব্য পড়ে শেষ করেন।

কর্মজীবন[সম্পাদনা]

বলাগড় বিদ্যালয় থেকে ১৯০৪ সালে এন্ট্রান্স পাস করেন। ১৯০৮ সালে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন থেকে বি.এ পাস করেন। কিন্তু অসুবিধায় পড়ে এম.এ পড়া ছেড়ে দেন। ১৯১০ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত কলকাতার তালতলা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯১৪ সালে সরকারি জরিপ বিভাগে কানুনগো পদে চাকরি গ্রহণ করেন। তিন বছর তিনি এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। পুনরায় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন তিনি। ১৯২৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃত বিভাগে অধ্যাপনা কর্মে নিয়োজিত থাকেন। ১৯৪৪ সালে অধ্যাপনার চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন মোহিতলাল।[২] তারপর তিনি কলকাতায় চলে আসেন। পরে বঙ্গবাসী কলেজে গিরিশ সংস্কৃতি ভবনে অধ্যাপনায় যোগ দেন।[৩]

সাহিত্য প্রতিভা[সম্পাদনা]

মানসী পত্রিকাতে তাঁর সাহিত্যজীবনের সূত্রপাত হয়। বীরভূমি পত্রিকায় কবিতা প্রবন্ধ অনুবাদ প্রকাশ করেন। দেবেন্দ্রনাথ সেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের ফলে তাঁর কাব্যচর্চায় দেবেন্দ্রনাথের প্রভাব দেখা যায়। এছাড়াও, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় এর কবিতার ছন্দোমাধুর্য তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। মোহিতলাল কিছুকাল ভারতী গোষ্ঠীর অন্যতম লেখক ছিলেন। তিনি শনিচক্রের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। রবীন্দ্র পরবর্তী কাব্যে কবি মোহিতলালের স্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্য-সমালোচক হিসাবেও তাঁর সবিশেষ খ্যাতি ছিল। ভাষারীতির বিশুদ্ধতা নিয়ে তাঁর প্রবল আগ্রহ ও নিষ্ঠা ছিল।[৪] কবি ও প্রবন্ধকাররূপে তিনি বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করেন।

লেখার ধরন[সম্পাদনা]

মোহিতলাল মজুমদার সৃজনধর্মী সাহিত্য সমালোচক ও প্রবন্ধকাররূপে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করেন। তিনি একজন নিপুণ ও শব্দ সচেতন কবিরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবদ্দশাতেই তার কাব্য আপন বৈশিষ্ট্যে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। নজরুল ইসলামের পূর্বে আরবি-ফারসি শব্দের সার্থক প্রয়োগ তাঁর রচনায় বিশেষভাবে লক্ষণীয়।[৫] ভাবে ও ভাষায় প্রচলিত কাব্যরীতিতে মোহিতলাল ছিলেন বিদ্রোহীস্বরূপ। বাংলা সাহিত্যের দেহাত্মবাদী কবি হিসেবে তাঁর রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।[৬] তার কাব্যে ক্লাসিক্যাল ভঙ্গি এবং রোমান্টিক ভাবের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। তাঁর মানস-লক্ষ্মী কবিতার প্রথম কয়েকটি পঙ্‌ক্তি নিম্নরূপ--

আমার মনের গহন বনে

পা টিপে বেড়ায় কোন্ উদাসিনী

নারী-অপ্সরী সঙ্গোপনে!

ফুলেরি ছায়ায় বসে তার দুই চরণ মেলি
বিজন-নিভৃতে মাথা হতে দেয় ঘোমটা ফেলি,

শুধু একবার হেসে চায় কভু
নয়ন কোণে,
আমারি মনের গহন বনে।

প্রকাশনা জগৎ[সম্পাদনা]

রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই এই বিতর্কিত সাহিত্য-প্রতিভার কাব্য আপন বৈশিষ্ট্যে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। বঙ্গসাহিত্য প্রসঙ্গে মোহিতলাল সৃজনধর্মী ও সৃষ্টিশীল আলোচনা করে গেছেন। অনেক মাসিক পত্রিকায়, বিশেষ করে ভারতীতে কবিতা লিখতেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক ১৮৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত বঙ্গদর্শন পত্রিকা তৃতীয় পর্যায়ে প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন।[৫] শনিবারের চিঠির নিয়মিত লেখক ছিলেন তিনি। মাঝে মাঝে 'কৃত্তিবাস ওঝা', 'চামারখায়-আম', 'সব্যসাচী', 'সত্যসুন্দর দাস' ছদ্মনামে লিখতেন।[৩]

প্রকাশিত গ্রন্থ তালিকা[সম্পাদনা]

কাব্যগ্রন্থ[সম্পাদনা]

  • দেবেন্দ্র-মঙ্গল (১৯১২)
  • স্বপন-পসারী (১৯২২)
  • বিস্মরণী (১৯২৭)
  • স্মরগরল (১৯৩৬)
  • হেমন্ত-গোধূলি (১৯৪১)
  • ছন্দ চতুর্দশী (১৯৪১) (সনেট সঙ্কলন)
  • কাব্য মঞ্জুষা

তন্মধ্যে - 'দেবেন্দ্র-মঙ্গল' কাব্যগ্রন্থটি ছিল আত্মীয় ও কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের প্রশস্তিমূলক ১৬টি সনেটের সঙ্কলন।

প্রবন্ধগ্রন্থ[সম্পাদনা]

  • আধুনিক বাংলা সাহিত্য (১৯৩৬)
  • সাহিত্যকথা (১৯৩৮)
  • বিবিধ কথা (১৯৪১)
  • বিচিত্র কথা (১৯৪১)
  • সাহিত্য বিতান (১৯৪২)
  • বাঙলা কবিতার ছন্দ (১৯৪৫)
  • বাঙলার নবযুগ (১৯৪৫)
  • জয়তু নেতাজী (১৯৪৬)
  • কবি শ্রীমধুসূদন (১৯৪৭)
  • সাহিত্য বিচার (১৯৪৭)
  • বঙ্কিমবরণ (১৯৪৯)
  • রবি-প্রদক্ষিণ (১৯৪৯)
  • শ্রীকান্তের শরৎচন্দ্র (১৯৫০)
  • জীবন জিজ্ঞাসা (১৯৫১)
  • বাঙলা ও বাঙালী (১৯৫১)
  • কবি রবীন্দ্র ও রবীন্দ্র কাব্য (প্রথম খণ্ড ১৯৫২, দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৫৩)
  • বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস (১৯৫৫)
  • বিবিধ প্রবন্ধ
  • বঙ্কিম বরণ (১৯৪৯)

গ্রন্থপঞ্জি[সম্পাদনা]

  • বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, সুকুমার সেন, ৪র্থ খণ্ড, ১ম সংস্করণ, বর্ধমান সাহিত্য সভা, কলকাতা, ১৯৫৮ইং
  • বাংলা সাহিত্যে মোহিতলাল, আজাহারউদ্দীন খান, জিজ্ঞাসা, কলকাতা, ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. বাংলা সাহিত্যে মোহিতলাল, আজহারুদ্দিন খান, জিজ্ঞাসা, কলিকাতা, ১৯৬১, পৃ. ২
  2. বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান, সম্পাদনাঃ সেলিনা হোসেনন ও নূরুল ইসলাম, ২য় সংস্করণ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০০৩
  3. সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, সম্পাদনাঃ অঞ্জলি বসু, ১ম খণ্ড, সংশোধিত চতুর্থ সংস্করণ, সাহিত্য সংসদ, ২০০২, কলকাতা
  4. সাহিত্য-সম্পুট শ্রী প্রমথনাথ বিশী ও শ্রী বিজিতকুমার দত্ত সম্পাদিত বিশ্বভারতী, কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, মার্চ, ১৯৬২
  5. প্রবন্ধ সংগ্রহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সম্পাদনায়ঃ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও সৈয়দ আকরম হোসেন, ১ম সংস্করণ, ১৯৯২ইং, পৃষ্ঠাঃ ৪৬৫-৬
  6. "বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, মাহবুবুল আলম, খান ব্রাদার্স এ্যান্ড কোম্পানি, ঢাকা, ৭ম সংস্করণ, ১৯৯৭, পৃষ্ঠাঃ ৫০১-২