মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত
জন্ম(১৮৫৪-০৭-১৪)১৪ জুলাই ১৮৫৪
মৃত্যু৪ জুন ১৯৩২(1932-06-04) (বয়স ৭৭)
পরিচিতির কারণশ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত- গ্রন্থের প্রণেতা, স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী প্রেমানন্দ ও পরমহংস যোগানন্দ-এর শিক্ষক

মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত অন্যনাম শ্রীম (জন্ম: ১৪ জুলাই ১৮৫৪ - মৃত্যু: ৪ জুন ১৯৩২) একজন জীবনীকার। তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত রচনা। ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জীবনের শেষ চার বছরে পঞ্চাশটির মত দেখা সাক্ষাতের নিপুন বিবরণ তিনি যত্নসহকারে তার ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন। যা পরে বই আকারে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত নামে প্রকাশিত হয়ে অসাধারণ খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি সংসারে থেকেও শ্রীরামকৃষ্ণদেবের বাণী প্রচার করে গেছেন।[১]

জন্ম ও শিক্ষাজীবন[সম্পাদনা]

মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত কলকাতার বিখ্যাত বৈদ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মধুসূদন গুপ্ত। তিনি হেয়ার স্কুল এবং প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি হেয়ার স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় দ্বিতীয়, এফ.এ পরীক্ষায় পঞ্চম এবং প্রেসিডেন্সি থেকে বি.এ পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান লাভ করেছিলেন।[১]

কর্মজীবন[সম্পাদনা]

তিনি যশোহরে নড়াইল স্কুলে, কলকাতার সিটি, রিপন, মেট্রোপলিটন, এরিয়ান, ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, মডেল প্রভৃতি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। রিপন, সিটি এবং মেট্রোপলিটন কলেজে তিনি ইংরেজি, অর্থনীতি, মনোবিজ্ঞানইতিহাস পড়াতেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ে তিনি বিদ্যাসাগরের শ্যামপুকুর ব্রাঞ্চ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ১৮৭৫ থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত নানা স্থানে শিক্ষকতা করে জীবনের শেষ পাঁচ বছর নকড়ি ঘোষের কাছ থেকে ঝামাপুকুর মর্টন ইন্সটিটিউশন (বর্তমানে আমহার্স্ট স্ট্রীটের হিন্দু অ্যাকাডেমি) কিনে তার অধ্যক্ষ এবং পরিচালক হন। এই স্কুলই কিছু দিন পরে ৫০ নম্বর আমহার্স্ট স্ট্রিটে স্থানান্তরিত হয়। [২]

অদ্ভুত ত্যাগের জীবন মাস্টারমশায়ের। তিনটি স্কুলের তিনটি উপার্জন যেত তিন জায়গায়— একটি বরাহনগর মঠে সংসারত্যাগী গুরুভাইদের সেবায়, আর একটি সারদাদেবী ও সন্ন্যাসীদের সেবায় এবং তৃতীয় মাইনে থেকে চলত নিজের সংসার।

পারিবারিক জীবন[সম্পাদনা]

অপরের মঙ্গল নিয়ে সদাবিব্রত মহেন্দ্রনাথ নিজের পারিবারিক অশান্তি থেকে মুক্তি পাননি , তার বিবরণ রয়েছে তাঁর শিষ্য নিত্যানন্দের ১৬ খণ্ডের ‘শ্রীমদর্শন’-এ। প্রথম ছেলে নির্মলের অকালমৃত্যুর সময়ে শ্রীরামকৃষ্ণের আশ্রয় মহেন্দ্রনাথের কাজে লেগেছিল। তৃতীয় পুত্র চারু বয়ে গিয়েছিল। আদরের কন্যা হাঁদুর বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি, তাঁর অকালমৃত্যু ২২-২৩ বছরে। চিরকুমার কনিষ্ঠ পুত্রের সঙ্গে পিতার সম্পর্ক বেদনাদায়ক। সে রেসকোর্সে ঘোড়দৌড় ও জুয়াখেলায় আকৃষ্ট। এই পুত্রকে গৃহ থেকে বিতাড়িত করলেন দ্বিধাহীন মহেন্দ্রনাথ। ১৯২৪ সালে সেই পুত্র ‘আশ্রয়হীন ও অন্নবস্ত্রহীন হইয়া খুবই দুর্দশায় পতিত হইলেন।’

টাকা কিছু দেবেন, কিন্তু পুত্রকে ঘোড়দৌড়ে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। পুত্র সেই চিঠি পড়লেন, কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্থ গ্রহণ করলেন না। অনাহারে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও নিজের বাবাকে প্রবঞ্চিত তিনি করতে চাইলেন না। স্নেহে অন্ধ হয়েও আমাদের শ্রীম নিজের নিয়মকানুন বিন্দুমাত্র শিথিল করেননি। এই বিপথগামী পুত্রকে দেখা যায় ১৯৩২ সালে কলকাতায়। পিতার দাহকার্যের সময়ে।

নাম খ্যাতি[সম্পাদনা]

মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত মাস্টার মশায় নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সন্ন্যাসী শিষ্যদের কেউ কেউ তার শিষ্য এবং তার ছাত্ররা অনেকে পরে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। অনেকে তাকে তাই ছেলে ধরা মাস্টার আখ্যা দিয়েছিলেন।[১] উল্লেখযোগ্য সন্ন্যাসী ছাত্ররা হলেন স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী প্রেমানন্দ (বাবুরাম ঘোষ) , স্বামী সুবোধানন্দ (সুবোধ চন্দ্র ঘোষ) প্রমুখ।

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত[সম্পাদনা]

রামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ — ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৮৮২, রবিবার দক্ষিণেশ্বরে। এই ঠাকুরই তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন নরেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে।

ঠাকুরের মহাপ্রয়াণ ১৮৮৬ সালের আগস্ট মাসে আর মহেন্দ্রনাথের সাহিত্যযাত্রার সময় ১৮৯৭ থেকে ১৯৩২— অর্থাৎ ৩৫ বছর। গবেষক স্বামী প্রভানন্দ (বরুণ মহারাজ) জানিয়েছেন, কথামৃতের শতকরা আশি ভাগ রচনা শ্রীম শেষ করেছিলেন ১৮৯৭ থেকে ১৯১০-এর মধ্যে। তখন তাঁর বয়স ৪৪ থেকে ৫৬।

ঠাকুরের মহাসমাধির দু’বছর পরে রথযাত্রার পরের দিন (১১ জুলাই ১৮৮৮) নীলাম্বরবাবুর ভাড়াবাড়িতে মহেন্দ্রনাথ তাঁর পাণ্ডুলিপির একাংশ শুনিয়েছিলেন জননী সারদামণিকে।

১৮৯৮ থেকেই বাংলায় তাঁর লেখা বেরোচ্ছে, কিন্তু "কথামৃত" শব্দটি প্রথমে ছিল না। তত্ত্বমঞ্জরী পত্রিকায় নাম ছিল শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত। পরে নাম হল শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণপরমহংসের কথা। ১৮৯৯ থেকে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতম্।

বাংলায় শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয় ১৯০২ সালে, দ্বিতীয় ভাগ ১৯০৫, তৃতীয় ভাগ ১৯০৮, চতুর্থ খণ্ড ১৯১০ এবং শেষ খণ্ড মাস্টারমশায়ের মৃত্যুর পরে (১৯৩২)।

ঠাকুরের প্রথম দর্শনলাভের পরে অর্ধশতাব্দী বেঁচে থেকে, ১৯৩২ সালের ৪ জুন কলকাতায় তাঁর দেহাবশেষ। তার পূর্বরাত্রে ন’টার সময়ে পঞ্চমভাগ কথামৃতের প্রুফ দেখা শেষ হয়।

ঠাকুরের সঙ্গে মহেন্দ্রনাথের ৭১টি সাক্ষাৎকার দক্ষিণেশ্বরে, ২৫৫ জন ভক্ত ও আগন্তুকের নাম উল্লেখ আছে মহেন্দ্রনাথের সুবিশাল রচনায়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, নভেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠা ৫৫৮, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  2. "ML Gupta"