কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়
জন্ম২৪ মে, ১৮১৩
মৃত্যু১১ মে, ১৮৮৫
জাতীয়তাব্রিটিশ ভারতীয়
পেশাঅধ্যাপক, ধর্মযাজক

কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় (২৪ মে, ১৮১৩-১১ মে, ১৮৮৫) উনিশ শতকের অন্যতম বাঙ্গালী মনীষী। তিনি ছিলেন ইয়ং বেঙ্গল দলের সদস্য, শিক্ষাবিদ, ভাষাতত্ত্ববিদ ও খ্রিষ্টধর্মপ্রচারক। হিন্দুধর্মের বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছিলেন।

পারিবারিক পটভূমি[সম্পাদনা]

কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে কলকাতার ঝামাপুকুর নামক স্থানে (বর্তমানে বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রীট) মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতামহ রামজয় বিদ্যাভূষণ তৎকালপ্রসিদ্ধ কলকাতার জোড়াসাঁকো নিবাসী শান্তিরাম সিংহের (কালীপ্রসন্ন সিংহের প্রপিতামহ) সভাপণ্ডিত ছিলেন। কৃষ্ণমোহনের পিতা জীবনকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় ২৪ পরগণা জেলার নবগ্রাম নামক গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের কন্যা শ্রীমতি দেবীকে বিবাহ করে তিনি শ্বশুরালয়ে বাস করতে থাকেন। উক্ত দম্পতির কৃষ্ণমোহন ব্যতীত আরও দুটি পুত্র ও একটি কন্যা ছিল।[১] তাদের মধ্যে ভুবনমোহন ছিলেন সর্বজ্যেষ্ঠ এবং কালীমোহন কনিষ্ঠপুত্র ছিলেন। পরবর্তীকালে কৃষ্ণমোহনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কালীমোহনও খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষা নেন। বংশবৃদ্ধি হওয়াতে জীবনকৃষ্ণ শ্বশুরালয় ত্যাগ করে গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনে একটি আবাসগৃহে নির্মাণ করে অতি ক্লেশে পরিবার প্রতিপালন করতে থাকেন। এইসময় তার স্ত্রী শ্রীমতী দেবী গৃহকার্যের সাথে সাথে বেতের দড়ি পাকিয়ে, পৈতের সুতো তৈরী করে কিছু কিছু উপার্জন করতেন এবং তার দ্বারা সংসার নির্বাহ করতে সহায়তা করতেন।

শিক্ষাজীবন[সম্পাদনা]

১৮১৯ সালে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় কালীতলায় ডেভিড হেয়ার প্রতিষ্ঠিত স্কুল সোসাইটি ইস্টিটিউশনে ভর্তি হন। অল্পদিনের মধ্যে তার প্রতিভার পরিচয় পেয়ে ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে হেয়ার তাকে নবনির্মিত হেয়ার স্কুলে ভর্তি করে দেন। এরপর ১৮২৪ সালে তিনি স্কুল সোসাইটির অবৈতনিক ছাত্ররূপে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। ডিরোজিও হিন্দু কলেজে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করলে অন্যান্য ছাত্রদের মত কৃষ্ণমোহনও তার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং নব্যবঙ্গ দলের অগ্রগণ্য সদস্য হয়ে ওঠেন। পরবর্তীকালে একাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি তার যুবক সভ্যদের নেতৃত্ব দিতে থাকেন।

হিন্দুধর্মের বিরোধিতা ও খ্রীষ্টধর্মে রূপান্তর[সম্পাদনা]

১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে কলেরা রোগে কৃষ্ণমোহনের পিতার মৃত্যু হয়। ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে তিনি হিন্দু কলেজ থেকে উত্তীর্ণ হয়ে হেয়ারের স্কুলে দ্বিতীয় শিক্ষকের পদে নিযুক্ত হন। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে প্রসন্নকুমার ঠাকুর ''রিফর্মার'' নামে সংবাদপত্র বার করলে তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ওই বছর মে মাসে ''ইঙ্কোয়েরার'' নামে একটি পত্রিকা বার করেন এবং তাতে হিন্দুধর্ম ও হিন্দুসমাজ সম্পর্কে সমালোচনা করেন। ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একটি বিদ্রূপপূর্ণ পুস্তক প্রকাশ করে তাতে রাধাকান্ত দেবকে "গাধাকান্ত দেব" নামে অভিহিত করেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে ডিরোজিওর শিষ্যদের আড্ডা ছিল। একদিন তারা মহাবিভ্রাট বাধালেন। কৃষ্ণমোহনের অনুপস্থিতিতে অন্যান্য বন্ধুরা তার বাড়িতে এসে মুসলমানের রুটি ও বাজার থেকে আনা সিদ্ধ মাংস খেয়ে হাড়গুলো প্রতিবেশীর বাড়িতে ফেলে পলায়ন করে। প্রতিবেশীরা এই নিয়ে অত্যন্ত গোলোযোগ করার ফলে সন্ধ্যাবেলায় কৃষ্ণমোহন বাড়ি ফিরলে তিনি সেখান থেকে বিতাড়িত হন। এরপর তিনি দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন; কিন্তু সেখানেও তিনি বেশীদিন থাকতে পারেন নি।

১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে আলেকজান্ডার ডাফ কলকাতায় এসে খ্রীষ্টধর্ম প্রচার করতে শুরু করেন। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে তার বক্তৃতা শুনতে যেতেন এবং ডাফ ও ডিয়ালট্রির বাড়িতে গিয়ে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে তর্কবিতর্ক করতেন। গৃহ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর এইভাবে এক বছর কাটে। ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে ২৮শে আগস্ট ইঙ্কোয়েরার পত্রিকায় প্রকাশিত হয় যে ডিরোজিওর শিষ্যদলের অন্যতম ও কৃষ্ণমোহনের বন্ধু মহেশচন্দ্র ঘোষ খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বন করেন। এই নিয়ে হিন্দুসমাজে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়। ওই বছরেরই ১৭ই আগস্ট আলেকজান্ডার ডাফের কাছে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ও খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। ফলে হেয়ারের স্কুলের চাকরি থেকে তিনি বিতাড়িত হন এবং চার্চ মিশনারি সোসাইটি স্কুলে শিক্ষকতা গ্রহণ করেন।[১] এই সকল কারণবশতঃ কৃষ্ণমোহনের স্ত্রী বিন্দ্যবাসিনী দেবী প্রথমে তার সহচারিণী হতে অস্বীকার করেন। অবশেষে ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এসে কৃষ্ণমোহনের সঙ্গে যোগ দেন।

১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আচার্য্যের পদে উন্নীত হন। আচার্য্য পদে তার প্রথম কাজ মহেশচন্দ্র ঘোষের মৃত্যু উপলক্ষে। ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কনিষ্ঠভ্রাতা কালীমোহনকেও খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত করেন। ঐ সালেই হেদুয়ার কাছে ভজনালয় তৈরী করে তিনি ধর্ম প্রচার করতে থাকেন। এখানে থাকতেই প্রসন্নকুমার ঠাকুরের একমাত্র পুত্র জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হন এবং কৃষ্ণমোহনের কন্যা কমলমণিকে বিবাহ করেন।

পরবর্তী জীবন[সম্পাদনা]

১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় বিশপস কলেজে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। এই কলেজে ১৮৩৬-১৮৩৯ সাল পর্যন্ত তিনি খ্রীষ্টধর্ম সম্পর্কে পড়ালেখাও করেছিলেন। ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তিনি রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৮৬৭-১৮৬৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো হন। ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডক্টরেট উপাধি দেন।[২] ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার অধিবাসীরা তাকে পুরসভার প্রতিনিধিপদে বরণ করেন। ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ১১ মে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় পরলোকগমন করেন।

গ্রন্থ রচনা[সম্পাদনা]

১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জের অনুরোধে ''সর্বার্থ সংগ্রহ'' নামে মহাকোষ প্রণয়ন শুরু করেন। এটি সম্পূর্ণ হয় ১৮৫১ সালে । তার কাজে খুশি হয়ে হার্ডিঞ্জ তাকে এলফিনস্টোন প্রণীত ''ভারতবর্ষের ইতিহাস'' উপহার দেন। ১৮৪৬ থেকে ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তিনি ইংরেজি বিশ্বকোষের অনুকরণে ''বিদ্যাকল্পদ্রুম''' নামক তেরো খণ্ডের একটি বাংলা বিশ্বকোষ রচনা করেন।[৩] ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দ্য পার্সিকিয়টেড নামক একটি ইংরেজি নাটকও রচনা করেন। ১৮৬১-১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হিন্দু ষড়দর্শন সম্পর্কে এক গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে দ্য এরিয়ান উইটনেস, ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে ডায়লগস অন দ্য হিন্দু ফিলোসফি এবং ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে দ্য রিলেশন বিটউইন ক্রিশ্চিয়ানিটি অ্যান্ড হিন্দুইজম নামক গ্রন্থগুলি রচনা করেন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Dastider, Shipra। "Banerji, Rev. Krishna Mohan"Banglapedia। ২৪ জুন ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৩ 
  2. "Annual Convocation"University of Calcutta। ২৮ মে ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ মে ২০১৪ 
  3. Datta, Amaresh (১৯৮৮)। Encyclopaedia of Indian literature2। Delhi: South Asia Books। পৃষ্ঠা 1162–1163। আইএসবিএন 978-81-7201-649-4 

আরো পড়ুন[সম্পাদনা]