সৈয়দ সুলতান
মহাকবি সৈয়দ সুলতান | |
---|---|
জন্ম | লস্করপুর গ্রাম, (প্রাচীন তরফ রাজ্যের রাজধানী) (বর্তমান হবিগঞ্জ, বাংলাদেশ ) |
মৃত্যু | সুলতানসী গ্রাম, ( বর্তমান হবিগঞ্জ, বাংলাদেশ ) |
সমাধিস্থল | ঐতিহাসিক সুলতানসী হাবিলী, সুলতানসী গ্রাম, হবিগঞ্জ, বাংলাদেশ |
ভাষা |
|
সময়কাল | মধ্যযুগ |
বিষয় | কাহিনীকাব্য ও শাস্ত্রকাব্য |
উল্লেখযোগ্য রচনা | নবীবংশ, রসুল বীজয়, শব-ই-মিরাজ, ওফাত-ই- রসুল, জ্ঞান প্রদীপ, জ্ঞানচৌতিশা, জয়কুম রাজার লড়াই এবং ইবলিশনামা। |
সক্রিয় বছর | ১৫৫০-১৬৪৮ |
সন্তান |
|
সৈয়দ সুলতান (আনু. ১৫৫০–১৬৪৮), বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগীয় কবি। তিনি হবিগঞ্জ জেলার হবিগঞ্জ সদর উপজেলার (প্রাচীন তরফ রাজ্যের রাজধানী) লস্করপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার রচনাবলী আহমদ শরীফ কর্তৃক সম্পাদিত হয়ে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হলে, অধ্যাপক আসাদ্দর আলী তার গবেষণা ভিত্তিক রচনায় লিখেন মহাকবি সৈয়দ সুলতান সিলেট বিভাগের হবীগঞ্জ জেলায় জন্ম।[১][২][৩][৪][৫]
কর্মজীবন
তিনি বহু পরমার্থ বিষয়ক সংগীত রচয়িতা। তার রচিত জ্ঞান প্রদীপ গ্রন্থে গভীর সাধনতত্ত্ব আলোচিত হয়েছে। তার অন্যান্য গ্রন্থ হচ্ছে নবীবংশ, রসুল বীজয়, শব-ই-মিরাজ, ওফাত-ই-রসুল, জয়কুম রাজার লড়াই, ইবলিশনামা, জ্ঞান প্রদীপ এবং জ্ঞান চৌতিশা। তার শবে মেরাজ গ্রন্থটির আনুমানিক রচনাকাল ১৫০০ সালের শেষভাগ।[৬] তার বংশ হতে ওলী-আউলিয়া, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ সহ অনেক জ্ঞানী-গুণীর আবির্ভাব ঘটে। সাধক ও সমাজ সংস্কারক সৈয়দ গোয়াস উদ্দীন, সৈয়দ মোস্তফা কামাল, সৈয়দ মোহাম্মদ জোবায়ের যাঁদের মধ্য অন্যতম।
কাব্য
মহাকবি সৈয়দ সুলতান কাহিনীকাব্য ও শাস্ত্রকাব্য রচয়িতা হিসেবে পরিচিত। তার বাংলাভাষার উপর বিশেষ দখল ছিল। তিনি একাধারে ফার্সী ও উর্দু ভাষায় কাব্য রচনা করেন। বাংলাভাষায় রচিত বিশেষ উল্লেখযোগ্য কাব্য নবীবংশ, জ্ঞানপ্রদীপ, জ্ঞানচৌতিশা ও জয়কুম রাজার লড়াই। কবির সর্ববৃহৎ রচনা নবী বংশ। প্রায় পচিশ হাজার পঙ্ক্তিতে নবী বংশ কাব্যের রচনা করেন। কাব্যের প্রথম চার লাইন;[১]
নিমিষে সৃজিছে যেই এ চৌদ্দ ভুবন৷
আদি অন্ত নাহি তার নাহি স্থান স্থিত৷
খন্ডন বর্জিত রূপ সর্বত্রে ব্যাপিত।[১]
নবী বংশ কাব্যের প্রথমে আল্লাহর গুণকির্তন করে কবি হযরত মোহাম্মদ এর জন্মবৃত্তান্ত শুরু করার আগে আঠারজন নবীর কাহিনী বর্ণনা করেছেন। আদম এর কাহিনী প্রথম এবং ঈশা এর কাহিনী দিয়ে নবী বংশ প্রথম পর্বের সমাপ্তি ঘটান। ঈশা এর কাহিনী শেষ করার পর সৈয়দ সুলতান লিখেছেন;
সৈয়দ সুলতানে পঞ্চালি ভণিল
অষ্ঠাদশ কিসসা নবীর সমাপ্ত হইল।[১]
এ ভাবে কবি এ মহাকাব্যের প্রথম খণ্ডের সমাপ্তি টানেন। কবির এ সুবিশাল ‘নবী বংশ’ কাব্যের নাম করণ নিয়ে গবেষক অধ্যাপক আসাদ্দর আলী চট্টগ্রামের খ্যাত নামা সাহিত্যিক আহমদ শরীফ এর উক্তি থেকে বলেন; বাংলায় অনূদিত রামায়ণ মহাভারত এবং দীন ভবানন্দের লেখা বাংলা ‘হবিবংশ’ সিলেটের মুসলমানদের মধ্যেও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল। সে জন্যেই সিলেটের যে সব মুসলমানেরা বাংলা লিপি পড়তে অজ্ঞ ছিলেন তাদের সাহিত্যিক রস পিপাসা নিবারণের কারণে সৈয়দ সুলতান ‘নবীবংশ’ লিখতে উৎসাহিত হয়েছিলেন। সৈয়দ সুলতানের গ্রন্থের নামকরনের ব্যাপারে দ্বীন ভবানন্দের ‘হরিবংশের পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে বলে আমরা মনে করি। সিলেটের দীন ভবানন্দ প্রথমে হিন্দু ছিলেন। সংস্কৃত ‘হরিবংশের নামানুকরণে লেখা তাঁর বাংলা ‘হরিবংশ’ গ্রন্থখানি আদিরসের ভিত্তিতে রচিত। সেখানে মুসলমানদের ধর্ম ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত কোন কিছু না থাকলেও হিন্দুদের ন্যায় ভবানন্দ কেদ্রিক এক শ্রেণীর মুসলমান সাধক সম্প্রদায়ও ‘হরিবংশ’ পাঠের জন্যে একদম পাগলপারা ছিলেন। সে জন্যেই পরবর্তীকালে বাংলায় লেখা ‘হরিবংশ’কে সিলেটি নাগরী লিপিতে লিপ্যন্তরের গরজ দেখা দিয়েছিল। সে যুগ দূরের কথা, এখন পর্যন্ত সিলেটের আউল-বাউল-পীর-ফকির প্রভৃতি মুসলমান সাধক সম্প্রদায়ের উপর দীন ভবানন্দের ‘হরিবংশে’র ব্যাপক প্রভাবের কথা অনস্বীকার্য। মহাকবি সৈয়দ সুলতান স্ব-সমাজে ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির সেসব প্রভাবকে মনে-প্রাণে বরণ করে নিতে পারেননি। তাই স্বতন্ত্রভাবে ও ব্যাপকভাবে তিনি বাংলা ভাষার মাধ্যমে মুসলমানদের ধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চার প্রয়োজনীয়তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। যেমন কবি নিজেই তার কাব্যে লিখেছেন;
মনুষ্যে করিতে পাপ নিষেধ না কৈলা।
গুরু ভেটিলাম গুরু না জানাইল মোরে
কাজেই- দেশেত আলিম থাকি যদি না জানাএ
সে আলিম নরকে যাইবে সর্বথাএ
এহি ভএ ভাবিয়া রচিল নবীবংশ
শুনি পাপীগণে যেন পাপে নহে ধ্বংস।[১]
নবী বংশ’ কাব্যের ভাষার সৌন্দর্য ও ভাবের মনোহারিত্বের কারণে ড. মুহাম্মদ এনামুল হক কাব্যটিকে ‘ম্যাগনাস ওপাস’ (Magnus Opus) বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, ‘ইহা বিষয়-বৈচিত্র্যে ও আকারে সপ্তকান্ড রামায়ণকেও হার মানাইয়াছে।[৭] নবী বংশ’ এর দ্বিতীয় খণ্ডে মুহাম্মাদ (সা.) ও হযরত খাদিজা (রা.)'র সঙ্গে বিয়ে প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে যেন আমাদেরই পরিচিত পরিবেশের কথা উল্লেখ করেছেন-
হীরা জরি চান্দোয়া যে মাণিক্য পোখম
চিনি আদি সর্করা আঙ্গুর খোরমান
ঘৃত মধু দধি দুগ্ধ অমৃত সমান
খাসী বকরী দুম্বা আর উটযে প্রধান
মেজায়ানী করিলেন্ত এবাজ সমান।[৭]
নবী বংশ দ্বিতীয় খণ্ডের পঙ্ক্তি সংখ্যা পনেরো হাজারেরও বেশি। কাব্যে কাহিনীর যেহেতু নবীগণ নিয়ে, এর জন্য শেষ নবী মোহাম্মদ পর্যন্ত এসে কাব্যের কাহিনী সমাপ্ত করেছেন। সৈয়দ সুলতান শেষ পঙ্ক্তিতে লিখেনঃ
সমাপ্ত হইল পাঞ্চালিকা অনুপাম।[১]
তথ্যসূত্র
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ মধ্যযুগের মহাকবি সৈয়দ সুলতান ও তার কাব্য প্রসঙ্গ-পর্ব ১
- ↑ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত পূর্বাংশ,তরফের কথা দ্বিতীয় ভাগ, দিত্বীয় খণ্ড, পঞ্চম অধ্যায়, অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি; প্রকাশক: মোস্তফা সেলিম; উৎস প্রকাশন, ২০০৪।
- ↑ সৈয়দ মোস্তফা কামাল (২৯ জুলাই ২০১১)। "বাংলাভাষা সুদিনে-নিদানে"। দৈনিক সংগ্রাম। ৫ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ সিলেটের মরমী মানস সৈয়দ মোস্তফা কামাল,প্রকাশনায়- মহাকবি সৈয়দ সুলতান সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ, প্রকাশ কাল ২০০৯।
- ↑ "জেলা তথ্য বাতায়ন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব"। ৩১ অক্টোবর ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ ডিসেম্বর ২০১২।
- ↑ সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, নভেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠা ৮৩১, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
- ↑ ক খ বাংলা ভাষায় সীরাত চর্চা
আরও পড়ুন
- খন্দকার মুজাম্মিল হক (২০১২)। "সৈয়দ সুলতান"। ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743।
- আহমদ শরীফ (২০০৬)। সৈয়দ সুলতান তাঁর গ্রন্থাবলী ও তাঁর যুগ। ঢাকা: আগামী প্রকাশনী। আইএসবিএন 9844018919।