বিষয়বস্তুতে চলুন

ভাস্কো দা গামা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

এটি এই পাতার একটি পুরনো সংস্করণ, যা AishikBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৯:৩৯, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখে সম্পাদিত হয়েছিল (বানান সংশোধন (ধরণের ⇢ ধরনের))। উপস্থিত ঠিকানাটি (ইউআরএল) এই সংস্করণের একটি স্থায়ী লিঙ্ক, যা বর্তমান সংস্করণ থেকে ব্যাপকভাবে ভিন্ন হতে পারে।

ভাস্কো দা গামা
জন্ম১৪৬০ কিংবা ১৪৬৯
মৃত্যুডিসেম্বর ২৪, ১৫২৪ (বয়স ৫৫ বা ৬৪)
পেশাঅভিযাত্রী, পর্তুগিজ ভারতের গভর্নর
স্বাক্ষর

ভাস্কো দা গামা (পর্তুগিজ: Vasco da Gama, উচ্চারণ: ভ়াশ্‌কু দ্য গ্যঁম্য; আনু. ১৪৬০ – ২৪ ডিসেম্বর ১৫২৪, কোচি, ভারত) একজন পর্তুগীজ অনুসন্ধানকারী এবং পর্যটক যিনি প্রথম পঞ্চদশ শতাব্দীতে সমুদ্রপথে ইউরোপ থেকে ভারতে আসেন। তিনিই প্ৰথম ইউরোপীয় ব্যক্তি যিনি সম্পূৰ্ণ সাগর পথ পাড়ি দিয়ে ভারতে এসে উপস্থিত হন, তার ভ্ৰমণে এশিয়া এবং ইউরোপকে সংযোগ করার সাথে সাথে আটলান্তিক মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরকে সংযোগ করেছিল এবং এ দিক থেকেই তিনি পশ্চিমা সংস্কৃতির সাথে পাশ্চাত্য দুনিয়ার সেতুবন্ধন গড়ে তোলেন৷ তার প্ৰথম ভারতমুখী ভ্ৰমণে (১৪৯৭-১৪৯৯) এই কাজ সম্পন্ন হয়েছিল৷ ভাস্কো দা গামার এই আবিষ্কার বৈশ্বিক সাম্ৰাজ্যবাদের ইতিহাসে অতি তাৎপৰ্য্যপূৰ্ণ ছিল কারণ এই ভ্ৰমণের দ্বারাই পর্তুগীজদের এশিয়া মহাদেশে দীৰ্ঘকালীন উপনিবেশ স্থাপনের পথ সুগম হয়েছিল৷ তার দ্বারা আবিষ্কৃত পথটি বিবাদপূৰ্ণ ভূমধ্য সাগর এবং বিপদজনক আরব উপদ্বীপ পার হওয়া থেকে রেহাই দিয়েছিল কারণ সমগ্র পথটিই ছিল সাগর পথে৷

তিনি দুটি ভারত অভিমুখী নৌযাত্ৰার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন,প্রথমটি এবং চতুর্থটি, চতুর্থ যাত্ৰাটি ছিল সবচেয়ে বড় যাত্রা যা তিনি তার প্রথম সমুদ্র যাত্রা থেকে ফিরে আসার চার বছর পর পরিচালনা করেন। তার অবদানের জন্য ১৫২৪ সালে ভারতে নিযুক্ত পতুৰ্গীজ সাম্ৰাজ্যের গভৰ্ণর হিসেবে ভাইসরয় উপাধিতে নিযুক্তি করা হয়। এবং ১৫১৯ সালে তাকে নবগঠিত ভিডিগুয়েরা(Vidiguera)র কাউন্ট পদবী প্ৰদান করা হয়েছিল৷ এই দিনটিতে আবিষ্কারের জন্যে তিনি ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে আছেন। তার অন্বেষণ এবং শিক্ষাদীক্ষা উদ্‌যাপন করতে বিশ্বব্যাপী অসংখ্য শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়েছে। পতুৰ্গীজ মহাকাব্য অস লুইসিয়াডাস, তার সম্মানার্থে লেখা হয়েছে। ভারতে তার প্ৰথম ভ্ৰমণ কে বিশ্ব ইতিহাসে মাইলফলক বলে বিবেচনা করা হয় কারণ এই ভ্ৰমণের ফলেই বিশ্বায়নের বহুসাংস্কৃতিক ধারণাটির প্রচলন হয়৷[][পৃষ্ঠা নম্বর প্রয়োজন]

আসা যাওয়ার জন্য অতিক্ৰম করা দূরত্বের দৈৰ্ঘ্য সেই সময়কার সৰ্বাধিক ভ্ৰমণ দূরত্ব(সমুদ্র যাত্রা) ছিল এবং এই দূরত্ব বিষুবরেখার দৈৰ্ঘ্য থেকেও বেশি ছিল৷[] নৌপথ আবিষ্কারের এক শত বছর পর, ইউরোপীয় শক্তি যেমন ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস এবং ফ্রান্স অবশেষে সক্ষম হয় পর্তুগীজদের একাধিপত্য ভেঙ্গে দিতে এমনকি তাদের নৌ শক্তির আধিপত্য আফ্রিকার কাছাকাছি, ভারত মহাসাগর এবং প্রাচ্যের দূরবর্তী স্থানে, যা প্রাচ্যে ইউরোপীয় সাম্ৰাজ্যবাদের এক নতুন যুগ সৃষ্টি করে। হাজার হাজার জীবন এবং ডজন ডজন জাহাজ ডুবি এবং আক্রমণ, নাবিকদের দশকের পর দশক ধরে প্রচেষ্টার পর ভাস্কো দা গামা ১৪৯৮ সালের ২০মে ভারতের কালিকট(Calicut) বন্দরে উপস্থিত হতে সক্ষম হন। দা গামার আবিষ্কারে, পৌরাণিক ভারতীয় মসলা ব্যবসায় এসেই বাধাহীন সহযোগিতায় পর্তুগীজ সাম্ৰাজ্যের অর্থনীতি উন্নত করে তোলে, যা মূলত উত্তর এবং উপকূলীয় পশ্চিম আফ্রিকার সাথে ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে হত। প্রথম দিকে যার বেশির ভাগই গোলমরিচ এবং দারুচিনি/ডালচিনি ছিল, তবে শীঘ্রই অন্যান্য পণ্য ও যোগ হয়, যা ইউরোপে সম্পূর্ণ নতুন ছিল এবং কয়েক দশক ধরে ব্যবসায়িক আধিপত্য বজায় রাখতে কার্যকর হয়েছিল।

প্রথম জীবন

সিনেস শহরে ভাস্কো দা গামার ভাস্কর্য
ভাস্কো দা গামা

ভাস্কো দা গামা জন্মগ্রহণ করেছিলেন পর্তুগালের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে সিনেস নামক একটি জায়গায় ১৪৬০[] কিংবা ১৪৬৯ সালে[] সম্ভবত চার্চ নোসা সেনিয়োরা দাস সালাস এর কাছে একটি বাড়িতে। সিনেস,আলেনতেজো উপকূলের হাতে গোনা কয়েকটি সমুদ্র বন্দরের একটিতে অবস্থিত,যেখানে কিছু সংখ্যক চুনকাম করা,লাল-টালির কুটির, প্রধানত জেলেরা ভাড়াটিয়া থাকত। তার বাবার নাম ছিলো এস্তেভাঁও দা গামা।তার পিতা এস্তেভাঁও দা গামা(Estevao da Gama) ১৪৬০ সাল থেকে ইনফেন্ট ফাৰ্ডিনান্ড,ডিউক অব ভিসেউ(Infant Ferdinand,Duke of Viseu)র নাইট(Knight) হিসাবে কর্মরত ছিলেন[]৷ তারপর তিনি অৰ্ডার অব সান্টিয়াগো(Order of Santiago)র সামরিক পদ মৰ্যাদা পান৷ ১৪৬০ সাল থেকে ১৪৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি সিনেসের গভর্নর ছিলেন, এবং খাজনা গ্রহীতা হিসেবে কাজ চালিয়ে যান।

এস্তেভাঁও দা গামা “জোয়াও চড্ৰের”(“জোয়াও দে রেসেন্ডে” নামেও পরিচিত) কন্যা ইসাবেল চড্ৰে(Isabel Sodré)কে বিয়ে করেন, যিনি ইংরেজ বংশোদ্ভূত অভিজাত পরিবারের তরুণী ছিলেন।[] তার পিতা ভিসেন্তে চড্রে এবং ভাই ব্রাস চড্রের “ইনফেন্ট ডিয়গো,ডিউক অব ভিসেউ” এর সাথে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল এবং মিলিটারি তে বিশেষ পরিচিতি ছিল।

এস্তেভাঁও দা গামা এবং ইসাবেল চড্ৰের পাঁচ পুত্রের মধ্যে ভাস্কো দা গামা তৃতীয় ছিলেন৷ তার ভাইদের নাম ছিল পউল’ দা গামা(Paulo de Gama),জোয়াও চড্ৰে,পেড্ৰো দা গামা(Pedro da Gama) এবং আইরেস দা গামা(Aires da Gama)৷ টেরেসা দা গামা(Teresa da Gama) নামে তাদের এক বোন ছিল (যার সাথে “লোপো মেনডেস দে ভাস্কোনসেলোস” এর বিয়ে হয়েছিল) ৷[]

ভাস্কো দা গামার প্রাথমিক জীবনের খুব কমই জানা যায়৷ পতুৰ্গীজ ইতিহাসবিদ টেক্সেইরা দে আরাগাও(Texeira da Gama)র মতে ভাস্কো দা গামা ইভরা শহরে লেখাপড়া করতেন এবং তিনি সম্ভবত গণিত এবং জাহাজ চালনা বিদ্যা শিখেছিলেন৷ এটাও মনে করা হয় যে তিনি জ্যোতিৰ্বিদ আব্ৰাহাম জাকুটো(Abraham Zacuto)র অধীনে অধ্যয়ন করতেন৷[]

১৪৮০ সালে দা গামা পিতাকে অনুসরণ করে অর্ডার অব সান্তিয়াগোতে যোগদান করেন।[] সে সময়ে সান্তিয়াগোর পণ্ডিত ছিলেন রাজকুমার জন(Prince John)৷ যিনি পরবর্তীতে ১৪৮১ সালে পৰ্তুগাল এর রাজা জন দ্বিতীয়(John II) হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন ৷

১৪৯২ সালে জন দ্বিতীয় সেতুবাল এবং এলগাৰ্ভ বন্দরে শান্তিকালীন সময়ে পতুৰ্গালের জাহাজে ফ্ৰান্স জাহাজের দ্বারা আক্রমণের প্ৰতিশোধ স্বরূপ ফ্রান্স জাহাজ জব্দ করার প্রয়াসে ভাস্কো দা গামাকে পাঠানো হয় – যা তিনি খুব অল্পসময়ে এবং ফলপ্রসুভাবে সম্পাদন করেন৷[১০]

ভাস্কো দা গামার পূর্বের অভিযানসমূহ

পনের শতকের প্ৰথম হতেই, রাজা হেনরীর উদ্যোগে আফ্রিকার উপকূলবর্তী অঞ্চলে অভিযান চালানোর জন্য সংঘবদ্ধ হতে থেকে, মূলত পশ্চিম আফ্রিকার সম্পদের(বিশেষত সোনা) অন্বেষণে ৷ তারা তাদের পর্তুগীজ সামুদ্রিক অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি করেছিল, তবুও তাদের প্রচেষ্টার প্রতিফলন ঘটিয়ে অতি সামান্য মুনাফা অর্জন করে। ১৪৬০ সালে হেনরীর মৃত্যুর পর, পর্তুগীজ রাজা সেই অভিযান চালিয়ে নিতে খুব কমই আগ্রহ দেখান, এবং ১৪৬৯ সালে আফ্রিকার আবিষ্কৃত অংশসমূহে ফের্ণাও গোমেসের নেতৃত্ব দেয়া একটি ব্যক্তিগত লিসবন ব্যবসায়ী সংস্থার নিকট বিক্রী করা হয়৷ কয়েক বছরের মধ্যেই, গোমেসের ক্যাপ্টেন পর্তুগীজ জ্ঞানের আলোকে গৈরিক ব্যবসায়, মেলেগুয়েটা কাগজ, গজদন্ত এবং ক্রীতদাসের ব্যবসায় এর মাধ্যমে গিনি উপসাগর পর্যন্ত তাদের ব্যবসায় কে সম্প্রসারণ করতে সক্ষম হয়৷

১৪৮১ সালে রাজা হয়ে, পর্তুগালের জন দ্বিতীয় বহু দীর্ঘকালীন সংস্কার সাধন করে৷ সম্রাটের সামন্ততান্ত্রিক আভিজাত্যের নির্ভরশীলতার হ্রাস করতে, জন দ্বিতীয়ের রাজকীয় কোষাগার স্থাপন করার প্রয়োজন হয়, এবং লক্ষ্য করেন রাজ বাণিজ্য এর আওতাধীন। তার পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই আফ্রিকায় সোনা এবং দাস ব্যবসায় বহুলভাবে প্রসারিত হয়৷ তিনি ইউরোপ এবং এশিয়ার মধ্যে অতি লাভবান মশলা ব্যবসায় এর প্রসারে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন।

ঐসময়ে, বস্তুত এটা ছিল ভেনিস প্রজাতন্ত্রের দ্বারা একচেটিয়া, যারা লেভ্যাটিনের স্থলপথ এবং মিশরীয় বন্দরগুলোর মাধ্যমে লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে ভারতের মশলা বাজারগুলো পরিচালনা করত। জন দ্বিতীয় ক্যাপ্টেনের জন্য একটি নতুন বিষয়বস্তু প্রণয়ন করেন যে: নৌপথে আফ্ৰিকা মহাদেশের কাছাকাছি হয়ে এশিয়ায় আসার রাস্তা অনুসন্ধান করতে হবে।

ভাস্কো দা গামা ত্যাগ করছেন লিসবন বন্দর,পর্তুগাল

ভাস্কো দা গামা যখন তার ক্যারিয়ারের বিশতম বছরে পৌঁছেন, তখন তার পরিকল্পনার সফলতা আসে। ১৪৮৭ সালে জন দ্বিতীয় দুজন গুপ্তচর, পেরো দা কভিলহা এবং আফন্সো দে পাইভা, স্থলপথে মিশর এবং পূর্ব আফ্রিকা হয়ে ভারত পর্যন্ত ভ্রমণ করে মশলা বাজার এবং বাণিজ্য পথের সন্ধান নিয়ে আসতে পাঠান৷ ১৪৮৮ সালে বারতলমিউ ডায়াস নামের জন দ্বিতীয় ক্যাপ্টেন কেপ অব গুড হোপ ভ্রমণ করে মৎস্য নদী (রিও দো ইনফ্যান্টে) পর্যন্ত ভ্রমণ করে যা বর্তমানকালের দক্ষিণ আফ্রিকায়, এবং এইবলে প্রতিবেদন দেয় যে আফ্রিকার অনাবিষ্কৃত উপকূল উত্তর-পূর্ব দিক পর্যন্ত প্রসারিত ৷

ডায়াস এবং দা কভিলহা ও দে পেইভা উভয়ের তথ্যসমূহের ওপর ভিত্তি করে ভারত মহাসাগরের সাথে সংযুক্ত করে একটি সুগম সামুদ্রিক বাণিজ্যিক পথ অনুসন্ধান কাজ বাকী রয়৷

প্রথম ভ্রমণ

১৪৯৭ সালের ৮ জুলাই ৪টি জাহাজ এবং ১৭০জনের এক নাবিকদল নিয়ে ভাস্কো দা গামা লিসবন থেকে যাত্রা শুরু করেন। আফ্রিকা থেকে ভারত এবং আবার ফিরে আসার দূরত্ব বিষুবরেখার চারপাশের দূরত্ব থেকে ও বেশি ছিল।[১১][১২] নাবিক হিসেবে তাঁর সাথে ছিলেন পর্তুগালের সবচেয়ে অভিজ্ঞ পেরো দি আলেনকুয়ের(Pero de Alenquer),পেড্ৰো ইস্কোবার( Pedro Escobar),জোয়াও দি কইম্ব্রা( João de Coimbra) এবং আফন্সো গনকালেভস(Afonso Gonçalves)৷ প্রতিটা জাহাজে কতজন করে নাবিক ছিলেন তার সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি তবে যাত্রা শেষে ৫৫জন লোক ফিরে এসেছিলেন এবং দুটি জাহাজ হারিয়ে যায়। ফলে যাত্রার জন্যে দুটি জাহাজ নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল৷[১১] তাদের সাথে যে চারটি জাহাজ ছিল:

ভাস্কো দা গামার প্রথম যাত্রা পথ(১৪৯৭–১৪৯৯)
  • সাঁও গ্যাব্রিয়েল(Sao Gabriel),নেতৃত্ব দেন ভাস্কো দা গামা; ১৭৮ ওজন,

দৈর্ঘ্য ২৭ মিটার, প্রস্থ ৮.৫ মিতার, হলরুম ২.৩ মিটার, পাল ৩৭২ মিটার²

  • সাঁও রাফায়েল(Sao Rafael),নেতৃত্ব দেন ভাস্কো দা গামার ভাই পউল দা গামা; যেটা ছিল সাঁও গ্যাব্রিয়েলের অনুরূপ
  • মালবাহী বেরিও, যা আগের দুটার চেয়ে কিছুটা ছোট (পরবর্তীতে যেটার নাম দেয়া হয় সাও মিগুয়েল),নেতৃত্ব দেন নিকোলউ কোয়েলহো(Nicolau Coelho)
  • একটি নাম না জানা মালবাহী জাহাজ,যা আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে, সাঁও ব্রাস উপসাগরের কাছে ধ্বংস হয়ে যায়,যার নেতৃত্ব দেন গনকালো নানস(Goncalo Nunes) []

অন্তরীপে যাত্রা

৮ জুলাই, ১৪৯৭ সালে তারা লিসবনের উদ্দেশ্যে সমুদ্রযাত্রা শুরু করে। ভাস্কো দা গামা পূর্বের ভ্রমণকারীদের দ্বারা বর্ণিত তেনেরিফা এবং ভারডি অন্তরিপের দ্বীপপূঞ্জসমূহ হয়ে আফ্রিকার উপকূল বরাবর অতিক্রম করা পথ অনুসরণ করেন৷ বর্তমানকার সিয়েরা লিয়ন উপকূলে পৌঁছার পর দা গামা দলবল সমেত মুক্ত সাগরের দক্ষিণের পথ ধরে বিষুবরেখা অতিক্রম করে বার্তলমিউ ডায়াস দ্বারা ১৪৮৭ সালে আবিষ্কৃত দক্ষিণ আটলাণ্টিকের পশ্চিমমুখী পথ সন্ধান করেন।[১৩] এতে তিনি সফল হন এবং ১৪৯৭ সালের ৪ নভেম্বর আফ্রিকা উপকূলের তটরেখায় আসেন৷ তিন মাসের অধিক সময় ধরে যাত্রার পর তারা ১০,০০০ কিলোমিটার (৬,০০০ মা) পথ ভ্রমণ করেন যা ছিল সেইসময়কার দীর্ঘতম সামুদ্রিক ভ্রমণ৷[১১][১৪]

ভাস্কো দা গামার ক্রোশ স্মৃতিস্তম্ব, দক্ষিণ আফ্রিকা

১৬ ডিসেম্বর, তারা “বিশাল মৎস্য নদী” পার হয় (প্রাচ্যের অন্তরীপ, দক্ষিণ আফ্রিকা) – যেখান থেকে ডায়াস ফিরে আসে– এবং অজানা সমুদ্রের দিকে যাত্রা করেন যা কোনো ইউরোপীয় ব্যক্তিদের কাছে অপরিচিত ছিল। খ্রীষ্টমাসের সময় হওয়ায়, তারা সেই উপকূল অঞ্চলের নাম দিয়েছিল নাটাল , মানে পতুৰ্গীজ ভাষায় যীশুখ্রীষ্টর জন্ম৷

মোজাম্বিক

ভাস্কো দা গামা ১৪৯৮ সালের ২রা মার্চ থেকে ২৯ শে মার্চ পর্যন্ত মোজাম্বিক দ্বীপের নিকটে সময় অতিবাহিত করেন৷ ভারত মহাসাগরে বাণিজ্যিক অঞ্চলের একটি অংশ ছিল পূর্ব আফ্রিকার উপকূলবর্তী আরব অধ্যুষিত এই অঞ্চল। স্থানীয় মুসলিম লোকেরা খ্রীষ্টানদের প্রতি আক্রমণাত্মক হতে পারে ভেবে দা গামা একজন মুসলিমের বেশে মোজাম্বিকের সুলতানের শরণাপন্ন হন৷ কিন্তু তিনি সুলতানকে সন্তোষজনক উপহার সামগ্রী প্রদানে ব্যর্থ হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দারা দা গামা ও তার দলের প্রতি সন্দেহ পোষণ করে৷ অবশেষে একটা আক্ৰমণাত্মক দলের তাড়া খেয়ে সবাই পালাতে বাধ্য হয়৷ তবে যাওয়ার সময় প্রতিশোধস্বরূপ দা গামা শহরে গুলিবর্ষণ করে যান৷[১৫]

মোম্বাছা

আধুনিক কেনিয়ার কাছে, সমুদ্রযাত্রায় তারা জলদস্যুতার পথ অবলম্বন করত, এবং কোন রকম ভারি কামান ছাড়া নিরস্র আরব বাণিজ্যিক জাহাজে লুটপাট করত। পর্তুগীজরা হচ্ছে প্ৰথম ইউরোপীয় যারা ১৪৯৮ সালের ৭ এপ্রিল থেকে ১৩ এপ্রিল এর মধ্যে মোম্বাসা বন্দরের পরিচয় পায়৷ কিন্তু তারা স্থানীয় লোকের প্রতিশোধের বলি হয়ে পলায়ন করে।

মালিন্দী

ভাস্কো দা গামা উত্তরে যাত্রা অব্যাহত রেখে ১৪৯৮ সালের ১৪ এপ্রিল মালিন্দী বন্দরে এসে উপস্থিত হন- যার তৎকালীন নেতা মোম্বাসার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিলেন- সেখানে তারা ভারতীয় ব্যবসায়ীদের প্রামাণ্য দেখা পান৷ দা গামা এবং তাঁর সহযোগীরা সেখানে একজন নৌপরিচালক খোঁজে পায় যার ভারতের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের উপকূল, কালিকটে যাবার জন্য অনুকূল মৌসুমী বায়ু সম্বন্ধে জ্ঞান ছিল৷ এই নৌপরিচালকের পরিচয় সম্পর্কে অনেক মতভেদ আছে- কেউ বলেন খ্রিস্টান, কেউ মুসলিম কেউবা আবার গুজরাটি লোক বলেন৷ একটি প্রচলিত কাহিনী মতে এই নৌপরিচালক ছিলেন আরবের মহান নাবিক ইবনে মজিদ, কিন্তু অনেকে এই কাহিনী মানতে নারায , বরং তারা মনে করেন তিনি ঐ সময়টাতে ঐ উপকূলে থাকার কথা না৷[১৬] এমনকি তৎকালীন কোন পর্তুগীজ ঐতিহাসিক ইবনে মজিদের নাম উল্লেখ করেন নি। ১৪৯৮ সালের ২৪এপ্রিল দা গামা দলবলসমেত মালিন্দী থেকে ভারত অভিমুখে রাওনা হন৷

কালিকট,ভারত

১৮৫০ এর ইস্পাতে খোঁদাই—জামোরিনের সাথে ভাস্কো দা গামার সাক্ষাৎ কে প্রদর্শন করছে
ভাস্কো দা গামা কালিকট অবতরণ করেন,২০ মে ১৪৯৮ সালে
কাপ্পাড, কালিকটের নিকটবর্তী
কাপ্পাডের সমুদ্রসৈকত

১৪৯৮ সালের ২০ মে ভাস্কো দা গামা নৌবহরসহ কালিকটের নিকটবর্তী কাপ্পাডুতে এসে উপস্থিত হন৷ কালিকটের রাজা সামুদিরি (জামরিণ) সেইসময়ে তার দ্বিতীয় রাজধানী পোন্নানিতে ছিলেন, তবে বিদেশী নৌবহর আসার খবর শুনে সেখান থেকে তিনি কালিকটে ফিরে আসেন৷ কমপক্ষে তিন হাজার সশস্র নায়ের বাহিনীর বৃহৎ শোভাযাত্রার মাধ্যমে জাহাজের নাবিকদের ঐতিহ্যগতভাবে অভ্যর্থনা জানানো হয়, কিন্তু জামরিনের সাথে সাক্ষাৎ কোন রকম সুসম্পর্ক গড়তে ব্যর্থ হয়৷ ‘’দা গামা’’ ডোম ম্যানুয়েল এর কাছ থেকে জামরিনকে উজ্জ্বল লাল কাপড়ের চারটি জোব্বা, ছয়টি টুপি, চার ধরনের প্রবাল, বারটি আলমাসার, সাতটি পিতলের পাত্রসহ একটি বাক্স, এক সিন্দুক চিনি, দুই ব্যারেল (পিপা) তেল এবং এক পিপা মধু উপহার স্বরূপ প্রেরণ করেন। এসব উপঢৌকনকে তাচ্ছিল্য করা হয়, এবং সম্রাটের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। কারণ জামরিনের প্রজাবর্গ উপহার তালিকায় সোনা বা রোপা না দেখে বিস্মিত হয়৷ একজন মুসলিম সওঁদাগর দা গামাকে প্ৰতিপক্ষ বলে ভাবেন এবং সেইসাথে পরামর্শ দেন যে দা গামা কোন রাজ প্ৰতিনিধি নয় বরং সে একজন জলদস্যু।[১৭] ভাস্কো দা গামা ভারতে ব্যবসায় করার জন্যে অনুমতি চাইলে সম্ৰাট প্রত্যাখ্যান করেন এবং তার কাছ থেকে জানানো হয় যে ভারতে ব্যবসায় করতে হলে অন্যান্য ব্যবসায়ীদের মতো কর হিসেবে সোনা দিতে হবে৷ এই কথায় ক্ষুণ্ণ হয়ে দা গামা কয়েকজন নায়ার এবং ষোলজন জেলে কে জোর-জবরদস্তি করে ধরে নিয়ে যান৷[১৮] অনেক যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকা স্বত্বেও, দা গামার সমুদ্রাভিযান সফল হয়ছিল,প্রত্যাবর্তন কালে জাহাজে যেসব মালামাল ছিল তার মূল্য ছিল অভিযানের খরচের ষাট গুন।

প্রত্যাবর্তন

১৪৯৮ সালের ২৯ আগস্ট কালিকট বন্দর থেকে প্রত্যাবর্তন যাত্রা করেন৷ ঐসময় তিনি অনুকূল মৌসুমী বায়ুর জ্ঞান অগ্রাহ্য করে দেশের পথে পাল তুলেন, যা তখনও ডাঙ্গার দিকে প্রবাহিত হচ্ছিল৷ তাদের নৌবহর প্রাথমিক পর্যায়ে ভারতের উপকূলে উত্তর দিক বরাবর খানিকটা যাত্রা করে, পরবর্তীতে আনজেদিভা দ্বীপে নোঙ্গর করে। অবশেষে ঐবছর ৩ অক্টোবর তাদের নৌবহর ভারত মহাসাগর পাড়ি দেয়৷ তবে ঐসময়ে যেহেতু শীতকালীন মৌসুমী জলবায়ু বিরাজ করছিল, সেজন্যে তাদের যাত্রা চরম দুর্দশায় পতিত হয়। অনুকূল মৌসুমী বায়ু থাকায় ভারত মহাসাগর পাড়ি দিতে যেখানে তাদের মাত্র ২৩ দিন সময় লেগেছিল, সেখানে বায়ুর প্রতিকূলে তাদের ফিরে যেতে ১৩২ দিন সময় লাগে৷

১৪৯৯ সালের ২ জানুয়ারিতে, মোগাদিশুর উপকূলীয় শহর সোমালি পার হবার সময় দা গামা স্থলভাগের দেখা পান,যা আফ্রিকা শৃঙ্গের তৎকালীন আজুরান সম্রাটের অধীনে ছিল। তাদের নৌবহর কোথাও না থামিয়ে তারা যাত্রা অব্যাহত রাখে৷ তাদের একজন অজ্ঞাত দিনলিপি লেখকের কাছ থেকে জানা যায় যে মোগাদিশুতে তখন চার বা পাঁচতলা বাড়িঘর,সুদৃশ্য প্রাসাদ এবং বহু বেলনাকৃতির মিনারবিশিষ্ট মসজিদ ছিল[১৯]

ভাস্কো দা গামার নৌবহর ১৪৯৯ সালের ৭ জানুয়ারি মালিন্দী এসে উপস্থিত হলেও ইতোমধ্যে তাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পরেছিল৷ প্রায় অর্ধ সংখ্যক জাহাজকর্মীর মৃত্যু ঘটেছিল এবং বাকীরা স্কার্ভি রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল৷ পর্যাপ্ত জাহাজকর্মী না থাকায় তাদের তিনটি জাহাজ পরিচালনা করা অসুবিধা হয়ে পড়ে৷ সেজন্যে সাঁও রাফায়েল নামের জাহাজটি পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে ডুবিয়ে দিতে আদেশ দেয়া হয়৷ এবং তিনটি জাহাজের কর্মীদের দুটি জাহাজে, সাঁও গ্যাব্রিয়েল এবং বেরিও তে ভাগ করে দেয়া হয়৷ এতে জাহাজ স্বচ্ছন্দে চলতে থাকে৷ মার্চের শুরুতেই, তারা মোসেল উপসাগরে এসে পৌঁছে, এবং ২০ মার্চ তারা গুড হোপ অন্তরীপ অতিক্রম করে। ২৫ এপ্রিল তারা পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে এসে উপস্থিত হয়৷

ভাস্কো দা গামা স্তম্ব, মালিন্দী, প্রত্যাবর্তন যাত্রা

ঐ সমুদ্রযাত্রার দৈনন্দিন লিখিত বিবরণী আকস্মিকভাবে এখানে থেমে যায়। অন্যান্য সূত্রের বরাত থেকে জানা যায়, তারা কেপ ভার্ডি পর্যন্ত অগ্রসর হয়, যেখান থেকে নিকোলাউ কোয়েলহো দ্বারা পরিচালিত “বেরিও” নামের জাহাজটি “ভাস্কো দা গামা”র “সাঁও গেব্রিয়েল” এর থেকে পৃথক হয়ে পরে; এবং নিজে থেকেই চলতে শুরু করে।[২০] ১৪৯৯ সালের ১০ জুলাই “বেরিও” লিসবনে এসে পৌঁছে এবং নিকোলাউ কোয়েলহো রাজা প্রথম ম্যানুয়েল এবং রাজকীয় আদালত কে ব্যক্তিগত বার্তা পাঠান এবং পরবর্তীতে সিন্ত্রায় একত্রীত হন। ঐ সময়ে, কেপ ভার্ডি তে ফিরার সময়, দা গামার ভাই পাউলো দা গামা ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। দা গামা তার ভাইয়ের সাথে সান্তিয়াগো দ্বীপে কিছুদিন থাকেন এবং জাহাজের কেরাণী “জোয়াও দে সাঁ” কে “সাঁও গেব্রিয়েল” এর সাথে দেশে পাঠিয়ে দেন৷ জুলাইয়ের শেষ বা আগস্টের প্রথম দিকে সাঁও গেব্রিয়েল লিসবনে গিয়ে উপস্থিত হয়৷ গামা এবং তার অসুস্থ ভাই একটি গিনি হাল্কা দ্রুতগামী জাহাজে করে পর্তুগালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন যদিও যাত্রাপথে তার ভাইয়ের মৃত্যু হয়৷ দা গামা তার ভাইকে সমাধিস্থ করার জন্য এজরেস এ অবতরণ করেন, এবং শোক প্রকাশের জন্য সেখানে কিছুদিন সময় অতিবাহিত করেন৷ অবশেষে তিনি একটি এজোরিয়ান হাল্কা দ্রুতগামী জাহাজে করে প্রস্থান করেন এবং ১৪৯৯ সালের ২৯শে আগস্টে লিসবনে এসে উপস্থিত হন(ব্যারোস এর মতানুযায়ী),[২১] বা সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে (৮ বা ১৮ তারিখে, অন্য একটি সূত্রের থেকে)। দা গামাকে দেশের মাটিতে বীরের মতো স্বাগত জানিয়ে,সন্মানের সাথে,শোভাযাত্রা এবং রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বরণ করা হয়। রাজা ম্যানুয়েল দুটি পত্রে ভাস্কো দা গামার প্রথম সমুদ্রযাত্রার বর্ণনা দেন, তার জাহাজগুলো ফিরে আসার পরপরই, জুলাই এবং আগস্ট এর মধ্যে ১৪৯৯ সালে। গিরলামো সারনিগিও তিনটি পত্রে দা গামার প্রথম সমুদ্রযাত্রার বর্ণনা করেন তার যাত্রা থেকে প্রত্যাবর্তনের পরপরই।

পুরস্কার এবং সন্মাননা

ভাস্কো দা গামার স্বাক্ষর

১৪৯৯ সালের ডিসেম্বর মাসে, ভাস্কো দা গামাকে পর্তুগালের রাজা প্রথম ম্যানুয়েল সিনেস শহরটি বংশগত জায়গীর হিসেবে পুরস্কার প্রদান করেন, যেখানে তার পিতা ইস্তাবাও দা গামা একদা কমেন্ডা হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন৷ সিনেস শহরটি অর্ডার অব সান্তিয়াগোর অধীনে থাকায় এটা পেতে তার জন্য জটিল হয়ে পড়ে। কিন্তু সেই শহরটি অর্ডার অব সান্তিয়াগোর প্রধান জর্জ দে লেনকেষ্ট্রির পুরস্কার হিসেবে অনুমোদন করতে সমস্যা ছিলনা, যদিও দা গামা, লেনকেষ্ট্রির একজন সান্তিয়াগো সদস্য এবং খুব অন্তরঙ্গ ছিলেন।[২২]৷ কিন্তু প্রকৃত পক্ষে রাজা সিনেস শহরটি পুরস্কার হিসেবে প্রদান করেন, যা নীতির ঊর্ধ্বে লেনকেষ্ট্রিকে প্ররোচিত করেছিল যদিও রাজা অর্ডারের সম্পত্তি অন্যান্য অনুদান হিসেবে দিয়ে দেন।[২২] দা গামা পরবর্তী বছরগুলো সিনেস শহরটির দায়িত্ব নিতে অতিবাহিত করেন,এই প্রচেষ্টা তাকে লেনকেষ্ট্রির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল এমনকি দা গামা তার প্রিয় অর্ডার অব সান্তিয়াগো পরিত্যাগ করেন, যা তার অর্ডার অব খ্রিস্ট-এর প্রতিদ্বন্দ্বীকে ১৫০৭ সালে তাড়িত করে।

দ্বিতীয় যাত্রা

ভারতের মালাবার উপকূল, ১৫০০ খ্রীঃ, ভাস্কো দা গামার ৪র্থ পর্তুগীজ ভারতীয় নৌবহর প্রদর্শন করছে , ১৫০২ খ্রীঃ

১৫০০ সালের দ্বিতীয় পর্তুগীজ ভারতীয় নৌবহর অভিযানের নেতৃত্ব দেন পেড্রো আলভারেস কেব্রেল, যে অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল কালিকটের সম্রাট জামরিণের সাথে চুক্তি করে শহরটিতে একটি কারখানা স্থাপন করা৷ যাহোক, পেড্রো আলভারেস কেব্রেল আরব ব্যবসায়ীদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়৷ যার ফলশ্রুতিতে কারখানাতে থাকা সত্তরজন পর্তুগীজের মৃত্যু হয়৷ এই ঘটনায় জামরিণের নিন্দা করে প্রতিশোধস্বরূপ পেড্রো আলভারেস কেব্রেল শহরটিতে বোমাবর্ষণ করে ৷ এভাবে পর্তুগাল এবং কালিকটের মধ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে।

১৫০২ সালে ভাস্কো দা গামা চতুর্থ পর্তুগীজ ভারতীয় নৌবহর অভিযানে যোগদান করতে রাজকীয় পত্র পাঠায়৷ এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল কালিকটের রাজা জামরিণের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়া এবং পর্তুগীজদের শর্তে আত্মসমৰ্পণ করার জন্য চাপ দেয়া৷ অস্ত্র-শস্ত্রে সুসজ্জিত পনেরটি জাহাজ এবং আঠশত লোক নিয়ে ১৫০২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তারা লিসবন থেকে যাত্রা করে৷ তার চাচাত ভাই (এস্তাবাও দা গামা, আইরেস দা গামার পুত্র)এপ্রিল মাসে আরো পাঁচটি জাহাজ নিয়ে ভারত অভিমুখে রাওনা হয়, যা ভারত মহাসাগরে এসে তাদের সাথে মিলিত হয়৷ চতুর্থ নৌবহরটি ছিল দা গামা পরিবারের যথার্থ কার্যসিদ্ধ বিষয়। তার দুই চাচা, ভিসেন্ট সড্রে এবং ব্রাস সড্রে, ভারত মহাসাগরে জাহাজের নজরদারির উপর আদেশ দিতে পূর্ব-মনোনীত ছিলেন, যেখানে তার শালা আল্ভারো দা আটাইদে (ক্যাটেরিনার ভাই) এবং লোপো মেন্দেস দা ভাস্কন্সেলস (বোনের স্বামী) প্রধান জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিল।

১৫০২ সালের অক্টোবরে তাদের বিশাল নৌবহরটি ভারতে এসে উপস্থিত হলে সেই সময়ে মক্কা থেকে মিরি নামের একটি তীর্থযাত্রিতে পরিপূর্ণ জাহাজে আক্রমণ চালিয়ে দা গামা সমস্ত যাত্রীদের মুক্ত জলাশয়ে হত্যা করেন[২৩]৷ তার পর তিনি কালিকটে পেড্রো আলভারেস কেব্রেলের করা চুক্তির সংশোধন করেন৷ যখন জামরিণ নতুন চুক্তিতে সই করার ইচ্ছা পোষণ করেন[২৪]৷ কিন্তু দা গামা কোনো সিদ্ধান্তে আসার আগে শহর থেকে সকল মুসলিমদের বের করে দেবার জন্য কালিকটের হিন্দু রাজার কাছে দাবী জানালে তা খারিজ করা হয়৷ ফলশ্রুতিতে পর্তুগীজ যুদ্ধ জাহাজ সমুদ্র উপকূল থেকে প্রায় দুদিন ধরে শহরটিতে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করে৷ যার ফলে শহরটিতে বিস্তর ক্ষয়ক্ষতি হয়৷ তদুপরি দা গামা কিছু ভারতীয় জাহাজ আটক করে কর্মীদের হাত,নাক,কান ইত্যাদি কেটে দেয়, অপমানের চিহ্ন সরূপ জামরিণের নিকট তাদের প্রেরণ করা হয়৷[২৫]

দা গামার জাহাজের চিত্রাঙ্কন

তীৰ্থযাত্ৰী জাহাজের ঘটনা

দ্বিতীয় ভ্রমণের সময় দা গামা ব্যবসায়ী এবং স্থানীয় লোকদের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছিলেন, যা ভারতে তার কুখ্যাতি ছড়িয়ে দেয়।[২৬][২৭] তার দ্বিতীয় সমুদ্র যাত্রার সময় মাদায়ি-তে তিনি কালিকট থেকে মক্কায় যেতে থাকা একটি জাহাজ আটক করেন৷ প্রত্যক্ষদর্শী থম লোপেজ এবং ঘটনাপঞ্জী লেখক গ্যাস্পার করিয়া বিশদভাবে বর্ণনা করেন যে, জাহাজটিতে থাকা চারশ যাত্রীর মধ্যে পঞ্চাশ জন মহিলা ছিল৷ গামা জাহাজটিতে লুটপাত চালায় এবং জাহাজের যাত্রী, মালিক এবং মিশরীয় একজন রাষ্ট্রদূত সহ সকলকে জীবন্ত জ্বালিয়ে হত্যা করে৷ তারা তাদের সম্পদের বিনিময়ে মুক্তিপণ চেয়েছিল যা দিয়ে ফেজ রাজ্যের সকল খ্রিস্টান ক্রীতদাসদের মুক্ত করে আনা এবং আরো অনেক কিছু করা যেত, তবুও তাদের নিষ্কৃতি দেয়া হয়নি। দা গামা দেখেছিল যে মহিলারা তাদের স্বর্ণালংকার এবং তাদের বাচ্চাদের ধরে প্রাণভিক্ষা চাইছিল[২৮]

কালিকট থেকে মুসলিমদের বিতারনের জন্য হিন্দু জামরিনের কাছে দাবির পর, পরবর্তীতে দা গামার কাছে তালাপ্পানা নাম্বুথিরি নামের একজন উচ্চপদস্থ ব্রাহ্মণকে আলোচনার জন্য পাঠানো হয়। দা গামার ব্রাহ্মণকে গুপ্তচর বলে সন্দেহ করে তার ঠোঁট এবং কান কেটে সেই জায়গায় কুকুরের কান লাগিয়ে দেবার নির্দেশ দেন৷[২৬]

বিরতি

এরপরে প্রায় দুই দশক দা গামা নীরবে নির্জনে সময় অতিবাহিত করেন, এবং সবধরনের ভারতীয় রাজকীয় কাজ থেকে দূরে সরে থাকেন। ম্যানুয়েল প্রথম-এর সহায়তায় তার প্রচেষ্টা খুব কমই স্বীকার করা হয়ে থাকে।

তৃতীয় ভারত অভিযান এবং মৃত্যু

১৫২১ সালে রাজা প্রথম ম্যানুয়েলের মৃত্যুর পর তার পুত্র এবং উত্তরসূরি, পর্তুগালের তৃতীয় জন ক্ষমতায় এসে বিদেশের সাথে সামুদ্রিক অভিযান চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য তিনি পুরাতন আলবুকারক ক্লিক এর থেকে সরে এসে নতুন করে যাত্রার পদক্ষেপ নেন। ফলে রাজনৈতিক অভিজ্ঞ ভাস্কো দা গামাকে নতুন রাজার নিয়োগদাতা এবং কলাকুশলী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টার দায়িত্ব দেবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়৷

পূর্বপুরুষ

ভাস্কো দা গামার পরিবার
১৬.আল্ভার আনেস দা গামা
৮.এস্তাবাও ভাজ দা গামা
১৭.মারিয়া এস্তেভেস বারেটো
৪. ভাস্কো দা গামা, আল্কাদে অব সাইন্স
৯. ক্যাটেরিন মেন্ডেস
২. এস্তাবাও দা গামা
৫. ইয়ান্স সড্রে
১. ভাস্কো দা গামা
১২. ফারনাও সড্রে
৬.জোয়াও সড্রে
৩. ইসাবেল সড্রে
৭.ইসাবেল সেরা

বিবাহ এবং সন্তানসন্ততি

ভাস্কো দা গামা এবং তার স্ত্রী, ক্যাটেরিনা দি এটেইদের ছয় পুত্র ও এক কন্যা সন্তান ছিল:[২৯]

  1. ডোম ফ্রান্সিস্কো দা গামা, তিনি দ্বিতীয় কাউন্ট অব ভিদিগুয়েরা হিসেবে তার বাবার বংশানুক্রমিক উপাধি বহন করেন এবং "ভারত, আরব ও পারস্য সাগরে দ্বিতীয় নৌসেনাপতির" দায়িত্বে ছিলেন। তিনি পর্তুগালে বসবাস করতেন।
  2. ডোম এস্তেবাও দা গামা, ১৫২৪-সালে তার ভারতীয় প্রহরী সেনাপতি পদে অকালে সময় শেষ হয়, পরে তিনি তিন বছরের জন্য মালাক্কার সেনাপতি নিযুক্ত হন, এবং ১৫৩৪ থেকে ১৫৩৯ পর্যন্ত ছিলেন (তার ভাই পাউলোর কার্যকালীন শেষ দুই বছর সহ)। পরবর্তী বছর তিনি ১৫৪০ থেকে ১৫৪২ পর্যন্ত ভারতের ১১তম গভর্নর নিযুক্ত হন।
  3. ডোম পাউলো দা গামা, ১৫৩৩-৩৪ মালাক্কার সেনাপতির দায়িত্বে ছিলেন। তিনি মালাক্কার নৌবাহিনীর এক কর্মকাণ্ডে নিহত হন।
  4. ডোম ক্রিস্টোভাউ দা গামা, ১৫৩৮-৪০ মালাক্কার নৌবহরের সেনাপতির দায়িত্বে ছিলেন। তিনি মালাক্কা জয় করার জন্য নিযুক্ত হন, কিন্তু ১৫৪২ সালের ইথিওপিয়ার আদাল যুদ্ধে আহমেদ ইবনে ইব্রাহীমের হয়ে কাজ করতে হয়।
  5. ডোম পেড্রো দা সিলভা দা গামা, ১৫৪৮ থেকে ১৫৫২ পর্যন্ত মালাক্কার সেনাপতির দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন।
  6. ডোম আলভারো ডি’আটাইদে দা গামা মালাক্কার নৌবহরের সেনাপতির দায়িত্বে নিযুক্ত হন ১৫৪০ সালে। তিনি ১৫৫২ থেকে ১৫৫৪ পর্যন্ত মালাক্কার সেনাপতির দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন।
  7. ডনা ইসাবেল ডি’আটাইদে দা গামা, তার একমাত্র কন্যা, ইগনাশিও দি নরনহা-র সাথে বিয়ে হয়, প্রথম কাউন্ট অব লিনহারেস এর পুত্র।

১৭৪৭ সালে তার পুরুষ পক্ষের বংশ পরম্পরার অবসান ঘটে, যদিও বর্তমানে তার কন্যা পক্ষের লোকেরা তার উপাধি বহন করছে।

বহিঃসংযোগ

তথ্যসূত্র

  1. Nigel, Cliff (সেপ্টেম্বর ২০১১)। Holy War: How Vasco da Gama's Epic Voyages Turned the Tide in a Centuries-Old Clash of Civilizations। Harper। [পৃষ্ঠা নম্বর প্রয়োজন].
  2. Diffie, Bailey W. and George D. Winius, "Foundations of the Portuguese Empire, 1415–1580", p.176
  3. Modern History Sourcebook: Vasco da Gama: Round Africa to India, 1497-1498 CE, fordham.edu, Retrieved June 27, 2007
  4. Catholic Encyclopedia: Vasco da Gama Retrieved June 27, 2007
  5. Ames, Glenn J. (২০০৮)। The Globe Encompassed। পৃষ্ঠা 27আইএসবিএন 0-13-193388-4। সংগ্রহের তারিখ ১০ জানুয়ারি ২০০৮ .
  6. The Sodrés were said to have been descended from Frederick Sudley, of Gloucestershire, who accompanied the Earl of Cambridge to Portugal in 1381, and subsequently settled down there (Subrahmanyam, 1997, p. 61).
  7. Subrahmanyam, 1997, p. 61.
  8. Subrahmanyam, 1997, p. 62.
  9. Subrahmanyam, 1997, pp. 60-61.
  10. Subrahmanyam, 1997, p. 63.
  11. Diffie, Bailey W.; Winius, George D. (১৯৭৭)। Foundations of the Portuguese Empire, 1415–1850। Europe and the World in the Age of Expansion। 1। পৃষ্ঠা 177। আইএসবিএন 978-0-8166-0850-8 .
  12. Da Gama's Round Africa to India, fordham.edu Retrieved 16 November 2006.
  13. Gago Coutinho, C.V. (1951–52) A Nautica dos Descobrimentos: os descobrimentos maritimos visitos por um navegador, Lisbon: Agencia Geral do Ultramar; p. 319-63; Axelson, E. (1988) "The Dias Voyage, 1487–1488: toponymy and padrões", Revista da Universidade de Coimbra, Vol. 34, p. 29-55 offprint; Waters, D.W. (1988) "Reflections Upon Some Navigational and Hydrographic Problems of the XVth Century Related to the voyage of Bartolomeu Dias", Revista da Universidade de Coimbra, Vol. 34, p. 275-347. offprint.
  14. Fernandez-Armesto, Felipe (২০০৬)। Pathfinders: A Global History of ExplorationW. W. Norton & Company। পৃষ্ঠা 177–178। আইএসবিএন 0-393-06259-7 .
  15. Vasco da Gamma Seeks Sea Route to India ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২২ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে, Oldnewspublishing.com. Retrieved 8 July 2006.
  16. Fernandez-Armesto, Felipe (২০০৬)। Pathfinders: A Global History of Exploration। W. W. Norton & Company। পৃষ্ঠা 178–179। আইএসবিএন 0-393-06259-7 .
  17. Castaneda, Herman Lopes de, The First Book of the Historie of the Discoveries and Conquests of the East India by the Portingals, London, 1582, in Kerr, Robert (ed.) A General History and Collection of Voyages and Travels Vol. II, London, 1811.
  18. M.G.S. Narayanan, Calicut: The City of Truth (2006) Calicut University Publications (The incident is mentioned by Camoes in The Lusiads, wherein it is stated that the Zamorin "showed no signs of treachery" and that "on the other hand, da Gama's conduct in carrying off the five men he had entrapped on board his ships is indefensible.").
  19. Da Gama's First Voyage pg.88.
  20. Subrahmanyam, 1997, p. 149.
  21. João de Barros, Da Asia, Dec. I, Lib. IV, c.11, p. 370.
  22. Subrahmanyam, 1997, p. 168.
  23. Subrahmanyam, 1997, p. 205.
  24. northpark.edu [ত্রুটি: আর্কাইভের ইউআরএল অজানা] Vasco da Gama Arrives in India 1498 ([তারিখ অনুপস্থিত] তারিখে আর্কাইভকৃত) Dana Thompson, Felicity Ruiz, Michelle Mejiak; 15 December 1998. Retrieved 8 July 2006.
  25. Sreedhara Menon. A. A Survey of Kerala History(1967), p. 152. D. C. Books Kottayam.
  26. M. G. S. Narayanan, Calicut: The City of Truth (2006) Calicut University Publications.
  27. A. Sreedhara Menon. A Survey of Kerala History (1967), D. C. Books Kottayam.
  28. Nambiar O.K, The Kunjalis- Admirals of Calicut, Bombay, 1963.
  29. See also Diogo do Couto (Decadas de Asia, Dec. IV, Lib. 8, c.2); Teixeira de Aragão p. 15-16, and Castanhoso (1898: p. viiff.).