ইসলামি শিল্প
ইসলামি শিল্প হল সেই সকল মানুষ দ্বারা সৃষ্ট দৃশ্যমান শিল্প যারা খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী হতে কোন মুসলিম মুসলিম বসবাস করছে অথবা মুসলিম শাসক দ্বারা শাসিত কোন বসতিতে বসবাস করেছে।[১] এটা খুবই জটিল শিল্প কারণ কারণ এই শিল্পের বিস্তৃতি অনেক বেশি ছড়ানো এবং নানান দেশের মুসলিম ১৪০০ বছর ধরে এই শিল্পের চর্চা করছে; এটা শুধু একটা বিশেষ গোষ্ঠীর শিল্প নয়, এটা কোন বিশেষ সময়ের শিল্প নয়, অথবা কোন জায়গা বা আঁকা আঁকির মতো নির্দিষ্ট গন্ডির শিল্প নয়।[২] এই শিল্পের প্রতিটি ক্ষেত্রই অনেক বিস্তৃত। ইসলামি স্থাপত্য যেমন অনেক বেশি বিস্তৃত ঠিক তেমনি ইসলামি ক্যালিওগ্রাফি, আঁকা আঁকি, গ্লাসে তৈরি কারুকাজ, ইসলামি মৃৃৎশিল্প, টেক্সটাইল শিল্পে কারুকাজ, ইসলামি এমব্রয়ডারি ইত্যাদি ক্ষেত্রের পরিসরও কম নয়।
ইসলামি শিল্প শুধু একটা ধর্মীয় শিল্প নয়, এটা ধনী এবং সব ধরনের মুসলিম সমাজের একটি শিল্প। ধারাবাহিকভাবে অনেক পুরনো উপাদানকে এই শিল্প নিজের অন্তর্ভুক্ত করেছে, বিশেষ করে ইসলামি মৌলভিদের দ্বারা যা নিষিদ্ধ হয় নি।[৩] এখন পর্যন্ত যত ইসলামি শিল্পে যত ক্যালিওগ্রাফি পাওয়া গেছে সেসবে ধর্মীয় দিকটি খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি। বরং প্রাধান্য পেয়েছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির শিল্প। কিন্তু স্থাপত্য ক্ষেত্রে দেখা যায়, ধর্মীয় দিকটি স্থাপত্যে খুব বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। নানারকম মসজিদ এবং এর সমতুল্য অন্যান্য বস্তুগুলো যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বিশেষ কিছুর গঠন সম্পর্কিত ছবি কিছুটা ইসলামি ভাবধারা ফুটিয়ে তুললেও, প্রাসাদের দেয়াল, কবিতার বইয়ে ইসলামি ভাবধারা ততটা ফুটে উঠে না। পবিত্র কুরআনের আয়াত এবং ইসলামি ক্যালিগ্রাফি এই শিল্পের প্রধান উপজীব্য বিষয় হলেও, এই শিল্পের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলো যেমন মসজিদের বাতির কাঁচে, কাঠের কারুকাজে, মসজিদের টাইলস, কার্পেটে এসব বিষয়গুলো স্থান পেয়েছে সমসাময়িক ভাবধারার সাথে মিশ্রিত হয়ে যেখানে ইসলামি মুদ্রিত অংশ বা ভাবধারা বেশি প্রাধান্য পায়।
"ইসলামি শিল্প বিভিন্ন উৎস থেকে উন্নতি লাভ করেছে: রোমান, সাম্প্রতিক খ্রিষ্টীয় শিল্প, বাইজানটাইন শিল্পগুলো ইসলামি শিল্পে সম্প্রতি প্রভাব বিস্তার করেছে; ইসলামি পারস্যের আগে যে সাসানিয়ান শিল্প ছিল, সেই শিল্পের প্রভাবও ইসলামি শিল্পে কম নয়; এছাড়া মধ্য এশিয়ার শিল্পের প্রভাবগুলো হটাৎ করেই এলোপাথারি ভাবে ইসলামি শিল্পে প্রভাব বিস্তার করেছে। এছাড়া আঁকাআঁকি, পটারি বা টেক্সটাইলে চায়নিজ শিল্পের প্রভাব কম নয়।"[৪] এতো বৈচিত্র্যের পরেও "ইসলামি শিল্প"কে এখনকার ঐতিহাসিকরা বলেন[৫] "কল্পিত উদ্ভাবন"[৬] বা শুধু "দৃষ্টিভ্রমকারী" ইউরোপকেন্দ্রিক চিন্তা,[৭] বিশেষ করে ইসলামি স্বর্ণযুগে, বিভিন্ন সময় এবং বিভিন্ন জায়গায় যত ইসলামি শিল্পের সৃষ্টি হয়েছে, সেসব শিল্পগুলোই "মরীচিকা" শব্দটি ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট।[৮]
ইসলামি শিল্পে একই নকশা বারবার ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন জ্যামিতিক ফুল বা লতাপাতার নকশা বার বার ব্যবহৃত হয় যেগুলোকে বলা হয় অ্যারাবিস্ক। এটি ঈশ্বরের অদ্বিতীয়তা, অসীমতাকে নির্দেশ করে।[৯] অনেক সময় এ নকশাগুলোর বার বার ব্যবহার বাঁধাগ্রস্ত হয়। অনেক শিল্পী ইচ্ছে করেই এই বাঁধা সৃষ্টি করেন। কারণ তারা বিশ্বাস করেন একমাত্র ঈশ্বরই সূক্ষতা সৃষ্টি করতে পারেন, যদিও এই বিষয়ে মতভেদ রয়েছে।[১০][১১][১২]
পুরোপুরি ভাবে না হলেও ইসলামি শিল্পে মূলত জ্যামিতিক নকশা, লতাপাতার নকশা এবং আরবীয় ক্যালিওগ্রাফি বেশি প্রতিফলিত হয়। কারণ অনেক মুসলিমই মনে করেন মানব শরীরের আকার আকৃতির নকশা একটি খারাপ কাজ।[১৩] কারণ এটি একটি পাপ, যেহেতু, পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে নিষেধ রয়েছে। অবশ্য ইসলামি শিল্পের প্রায় প্রতিটা যুগেই মানুষের ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। বিশেষ করে ছোট খাট ক্ষেত্রগুলোতে। পূজার ক্ষেত্রে মানব আকৃতির ব্যবহার ইসলামি আইনে এটি সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ যা "শরীয়া" নামে পরিচিত।[১৪][১৫][১৬] ইসলামি শিল্পে, অনেক আগে থেকেই ছোট প্রাণী এবং মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়, বিশেষ করে শিকারের ছবি। তবে পোট্রেইট এর নিদর্শন খুব বেশি তৈরি হয়নি।
ক্যালিওগ্রাফি
ক্যালিওগ্রাফিক নকশা ইসলামি শিল্পে প্রায় সর্বক্ষেত্রেই দৃশ্যমান। বিশেষ করে মধ্যযুগের ইউরোপে, নানারকম মুদ্রায়, টাইলস, ধাতব শিল্পে এবং ছোট খাট চিত্রে যেখানে পবিত্র কুরআনের আয়াত রয়েছে বা কোন স্থাপত্যে, সেসব ক্ষেত্রগুলোতে এই ক্যালিওগ্রাফির ব্যবহার অনেক বেশি। ইসলামি ক্যালিওগ্রাফির ব্যবহার ইসলামি দিক থেকে সরে এসে আরো নানান ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন পবিত্র কুরআনের চায়নিজ ক্যালিওগ্রাফির ব্যবহার গ্রেট মস্কিউ অব জিয়ানে খুব ভালোভাবে ফুটে উঠেছে।[১৭] এছাড়াও কবিতার চরণের ক্ষেত্রে, অথবা রেকর্ডিং বা ডোনেশনের ক্ষেত্রেও এই ক্যালিওগ্রাফির ব্যবহার রয়েছে। ক্যালিওগ্রাফির ব্যবহার অনেক রকম ভাবে ঘটেছে এর মধ্যে দুটি প্রধান ক্ষেত্র হল "কুফিক" এবং "নাস্ক", যেগুলো নানারকম দেয়াল এবং ধাতব জিনিসপত্র বা মিনারসমূহতে দেখা যায়।[৯] আঁকা আঁকি কিংবা স্থাপত্যে ব্যবহৃত ইসলামি ক্যালিওগ্রাফিকে মাঝে মাঝে কুরআনিক শিল্প বলে অবহিত করা হয়।[১৮]
৯ম থেকে ১১তম শতাব্দীতে তৈরি পূর্ব পারস্যের তৈরি কিছু সিরামিক পাত্র দেখা যায় যেগুলোতে খুব বেশি পরিমাণে ক্যালিওগ্রাফি ফুটে উঠেছে। এগুলোকে বলা হয় মুদ্রিত পাত্র। এগুলোকে বলা হয়, "এই পাত্রগুলোই সম্ভবত পারস্যের তৈরি সবচেয়ে বেশি স্পর্শকাতর সিরামিক পাত্র"।[১৯] টাইলসে তৈরি বড় রকমের ক্যালিওগ্রাফি, মাঝে মুদ্রিত অক্ষরগুলো সামনের দিকে বেরিয়ে আসে, অথবা পেছনের অংশ কেটে ফেলা হয়, এই ধরনের ক্যালিওগ্রাফি সমূহ নানারকম বিখ্যাত ভবনের দরজা বা বের হওয়ার দরজায় দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া জটিল ভাবে মুদ্রিত ক্যালিওগ্রাফিও ভবন সাজানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। বেশিরভাগ ইসলামি সময়ে, বিভিন্ন ইসলামি মুদ্রায় শুধুমাত্র অক্ষরই মুদ্রিত থাকত যদিও তাদের আকৃতি ছিল খুবই ছোট। অটোমান সুলতানদের মনোগ্রাম বা নিজস্ব চিহ্ন ব্যবহারের ক্ষেত্রেও ইসলামি ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার দেখা যায়। একজন অটোমান সুলতান তার মনোগ্রামে এই ইসলামি ইসলামি ক্যালিওগ্রাফির ব্যবহার করেছিলেন যা অফিসিয়াল কাগজপত্রে বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাগজে ব্যবহৃত হত। এছাড়াও নানাকরম অ্যালবাম, ছোট কবিতা অথবা কুরআনিক আয়াতে এই এর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
ক্যালিওগ্রাফি তৈরি হয় মূলত আরবীয় অক্ষর দ্বারাই। এছাড়াও পারসিয়ান অক্ষর, তুরস্কের অক্ষর এবং অনেক পরে উর্দু, এসকল ভাষা দ্বারাও বর্তমনানে ক্যালিওগ্রাফি তৈরি হয়। ক্যালিওগ্রাফির মর্যাদা অন্যান্য চিত্রশিল্পির তৈরি শিল্প থেকেও অনেক বেশি।
চিত্র
যদিও দেয়াল চিত্রের একটি সুন্দর অতীত রয়েছে, তবুও ইসলামি বিশ্বে সবচেয়ে উন্নত এবং সবচেয়ে বেশি অক্ষত অবস্থায় রয়েছে মুদ্রিত অক্ষরসমূহই, বিশেষ করে ক্ষুদ্র কোন মুদ্রা বা এমন কোন ছোট আকৃতির বস্তুতে করা ক্যালিওগ্রাফি বা মুদ্রিত কোন অক্ষর। সুদূর ১৩শ শতাব্দী থেকে পারস্যের প্রচ্ছদগুলোই অনেক বেশি বিখ্যাত। এসকল প্রচ্ছদ গুলো অটোমান প্রচ্ছদ গুলোকে ফুটিয়ে তোলে এবং ভারতের মুঘল সম্রাজ্যের প্রচ্ছদসমূহকে। তবে এইসকল প্রচ্ছদ গুলো মূলত অফিস আদালতেই বেশি ব্যবহৃত হয়, কারণ স্বাভাবিক জীবনে এসকল শিল্পের খুব বেশি দেখা যায় না। এছাড়া একটি বিষয় নিয়ে অনেক মতানৈক্য রয়েছে যে মানুষের আকার আকৃতি অনেকটাই বেশি প্রচলিত চিত্রের ক্ষেত্রে। যদিও ছোট আকৃতির শিল্পগুলোতেও অনেক মানব আকার আকৃতি রয়েছে। বিশেষ করে ১৬শ শতাব্দী থেকে এর ব্যবহার অনেক বেড়েছে। যদিও অনেক আগের ছোট আকৃতির চিত্রে মানব মানব আকার আকৃতির ব্যবহার অনেক বেশি দৃশ্যমান। বিশেষ করে উম্মাদ ডিজার্ট প্রাসাদ (৬৬০-৭৫০) এবং আব্বাসিদ খলিফার আমল (৭৪৯-১২৫৮) এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।[২০] ইসলামি শিল্পে চিত্রের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি দেখা যায় পারস্যের কবিতার বইয়ে।
তথ্যসূত্র
- ↑ Marilyn Jenkins-Madina, Richard Ettinghausen and Oleg Grabar, 2001, Islamic Art and Architecture: 650–1250, Yale University Press, আইএসবিএন ৯৭৮-০-৩০০-০৮৮৬৯-৪, p.3; Brend, 10
- ↑ J. M. Bloom; S. S. Blair (২০০৯)। Grove Encyclopedia of Islamic Art and Architecture, Vol. II। New York: Oxford University Press। পৃষ্ঠা vii। আইএসবিএন 978-0-19-530991-1।
- ↑ Davies, Penelope J.E. Denny, Walter B. Hofrichter, Frima Fox. Jacobs, Joseph. Roberts, Ann M. Simon, David L. Janson's History of Art, Prentice Hall; 2007, Upper Saddle River, New Jersey. Seventh Edition, আইএসবিএন ০-১৩-১৯৩৪৫৫-৪ pg. 277
- ↑ MSN Encarta: Islamic Art and architecture। ২০০৯-১১-০১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ Melikian, Souren (ডিসেম্বর ৫, ২০০৮)। "Qatar's Museum of Islamic Art: Despite flaws, a house of masterpieces"। International Herald Tribune। সংগ্রহের তারিখ সেপ্টেম্বর ৬, ২০১১।
This is a European construct of the 19th century that gained wide acceptance following a display of Les Arts Musulmans at the old Trocadero palace in Paris during the 1889 Exposition Universelle. The idea of "Islamic art" has even less substance than the notion of "Christian art" from the British Isles to Germany to Russia during the 1000 years separating the reigns of Charlemagne and Queen Victoria might have.
- ↑ Melikian, Souren (এপ্রিল ২৪, ২০০৪)। "Toward a clearer vision of 'Islamic' art"। International Herald Tribune। সংগ্রহের তারিখ সেপ্টেম্বর ৬, ২০১১।
- ↑ Blair, Shirley S.; Bloom, Jonathan M. (২০০৩)। "The Mirage of Islamic Art: Reflections on the Study of an Unwieldy Field"। The Art Bulletin। 85 (1): 152–184। জেস্টোর 3177331।
- ↑ De Guise, Lucien। "What is Islamic Art?"। Islamica Magazine।
- ↑ ক খ Madden (1975), pp.423–430
- ↑ Thompson, Muhammad; Begum, Nasima। "Islamic Textile Art: Anomalies in Kilims"। Salon du Tapis d'Orient। TurkoTek। সংগ্রহের তারিখ ২৫ আগস্ট ২০০৯।
- ↑ Alexenberg, Melvin L. (২০০৬)। The future of art in a digital age: from Hellenistic to Hebraic consciousness। Intellect Ltd। পৃষ্ঠা 55। আইএসবিএন 1-84150-136-0।
- ↑ Backhouse, Tim। "Only God is Perfect"। Islamic and Geometric Art। সংগ্রহের তারিখ ২৫ আগস্ট ২০০৯।
- ↑ John L. Esposito (2010), The future of Islam, Oxford University Press, page 42
- ↑ Bouaissa, Malikka (২৭ জুলাই ২০১৩)। "The crucial role of geometry in Islamic art"। Al Arte Magazine। ২৭ মার্চ ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ ডিসেম্বর ২০১৫।
- ↑ The Arab Contribution to Islamic Art: From the Seventh to the Fifteenth Centuries, Wijdan Ali, American Univ in Cairo Press, December 10, 1999, আইএসবিএন ৯৭৭-৪২৪-৪৭৬-১
- ↑ From the Literal to the Spiritual: The Development of the Prophet Muhammad's Portrayal from 13th Century Ilkhanid Miniatures to 17th Century Ottoman Art ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৩ ডিসেম্বর ২০০৪ তারিখে, Wijdan Ali, EJOS (Electronic Journal of Oriental Studies), volume IV, issue 7, p. 1-24, 2001
- ↑ Bondak, Marwa। "Islamic Art History: An Influential Period"। Mozaico। সংগ্রহের তারিখ ২৬ মে ২০১৭।
- ↑ Islamic Archaeology in the Sudan - Page 22, Intisar Soghayroun Elzein - 2004
- ↑ Arts, p. 223. see nos. 278–290
- ↑ J. Bloom; S. Blair (২০০৯)। Grove Encyclopedia of Islamic Art। New York: Oxford University Press, Inc.। পৃষ্ঠা 192 and 207। আইএসবিএন 978-0-19-530991-1।