১৯৮৮ চট্টগ্রাম গণহত্যা
১৯৮৮ চট্টগ্রাম গণহত্যা | |
---|---|
স্থান | চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ |
তারিখ | ২৪ জানুয়ারি ১৯৮৮ |
লক্ষ্য | আওয়ামী লীগ কর্মী |
হামলার ধরন | গণহত্যা |
নিহত | অন্তত ২৪ জন |
অভিযুক্ত | ৪৬ জন পুলিশ সদস্য |
অপরাধীগণ | চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ |
কারণ | আন্দোলন দমানো |
চট্টগ্রাম গণহত্যা বলতে ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে এরশাদ বিরোধী দলের নেতা কর্মীদের গণহত্যাকে বুঝায়।[১] স্বৈরাচারী শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে সেদিন চট্টগ্রামের রাজপথে মিছিলকারী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপর পুলিশের হামলা করা হয়। তৎকালীন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদা পুলিশকে ওই সমাবেশে গুলি চালানোর নির্দেশ দেন যাতে অন্তত ২৪ জন নিহত হয়।[২] তবে সরকারী বিবৃতিতে অনুমান করা হয়েছে যে সেদিন ৯ জন নিহত হয়েছিল। অন্যদিকে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা দাবি করেছেন যে ওই গণহত্যায় তাদের ৩৩ জন নেতাকর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।[৩]
পটভূমি
[সম্পাদনা]হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ ছিলেন। তিনি ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। এরশাদ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং ওই দিন বাংলাদেশের সংবিধান স্থগিত করেন। তিনি বাংলাদেশের ডি ফ্যাক্টো শাসক হয়ে ওঠেন।[৪]
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ১৯৮৬ সালের ৭ মে একটি নির্বাচন করেন। শুরুতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচনটিকে অবৈধ ঘোষণা করে এবং এরশাদকে স্বৈরশাসক বলে অভিহিত করে। ১৯৮৬ সালের ১৭ মার্চ চট্টগ্রামের লালদীঘিতে এক সমাবেশে শেখ হাসিনা বলেছিলেন:
আমাদের কোনো পরিকল্পনা নেই আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার। যারা এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, তাদের ‘জাতীয় বিশ্বাসঘাতক ঘোষণা করা হবে।[৪]
কিন্তু পরবর্তীতে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৭ মে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং এরশাদের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির কাছে পরাজিত হয়।[৫] শেখ হাসিনা তিনটি আসনে জয়লাভ করতে সক্ষম হন।[৬] পরবর্তীতে, একই বছরের ১৫ অক্টোবর এরশাদ একটি প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।[৭]
অসন্তুষ্ট বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৮৭ সালের ২৯ আগস্ট এরশাদের সাথে কোনো সংলাপে বসতে অস্বীকৃতি জানায় এবং সরকারের সঙ্গে একাধিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকায় পুলিশ বিরোধী কর্মীদের উপর গুলি চালালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কর্মী নূর হোসেন নিহত হন। এই ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে এবং এরশাদকে ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সংসদ স্থগিত করতে বাধ্য করে।
এরশাদ ১৯৮৮ সালে তার শাসনকে বৈধতা দিতে ৪ মার্চ একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বাধীন জামায়াতে ইসলাম সহ সাত দলীয় জোট, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন আট দলীয় জোট এবং বামপন্থী পাঁচ দলীয় জোট নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয় এবং নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য প্রায়ই মিছিল করছিল।
ঘটনা
[সম্পাদনা]১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে শেখ হাসিনা এবং কয়েকজন আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রামে পৌঁছান।[৮] পরে তিনি চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ কর্তৃক শহরের লালদীঘিতে আয়োজিত এক জনসভায় বিপুল জনসমাগমের সামনে বক্তব্য রাখেন। সমাবেশ শেষে শেখ হাসিনা একটি ট্রাকে চড়ে চট্টগ্রামের রাস্তায় মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।[৮] তার মিছিলটি শহরের কোতোয়ালি মোড়ের সামনে আটকে যায়। পুলিশ কোতোয়ালি থানার সামনে রাস্তা ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ করে রাখে। জনতা যখন ব্যারিকেড সরিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তখন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদা তার বাহিনীকে জনতার উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন।[৯]
পুলিশের নির্বিচার গুলিতে সেদিন অন্তত ২৪ জন নিহত হয় এবং শত শত মানুষ আহত হন। শেখ হাসিনা এই আক্রমণ থেকে রক্ষা পান, কারণ কিছু সংখ্যক কর্মী তাকে ঘিরে মানব প্রাচীর তৈরি করে তাকে রক্ষা করে। শেখ হাসিনা বারবার গুলি বন্ধ করার অনুরোধ করলেও পুলিশ সেদিকে কোনো কর্ণপাত করেনি।[৮] চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুসলিম ইনস্টিটিউট, কেসি দে রোড, নন্দনকানন, আমতলা এবং কোর্ট বিল্ডিং এলাকা এই গণহত্যার অন্যতম ঘটনাস্থল ছিল।[৯] এই গণহত্যায় অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বদানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ইন্সপেক্টর গোবিন্দ চন্দ্র মণ্ডল, কনস্টেবল প্রদীপ বড়ুয়া, কনস্টেবল মমতাজউদ্দিন, কনস্টেবল মোস্তাফিজুর রহমান, কনস্টেবল শাহ আব্দুল্লাহ, কনস্টেবল বশির আহমেদ, কনস্টেবল আবদুস সালাম প্রমুখ।[১০]
পরবর্তী ঘটনা
[সম্পাদনা]গণহত্যার প্রায় পাঁচ বছর পর ১৯৯২ সালে আইনজীবী শহীদুল হুদা চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদাসহ ৪৬ জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ১৯৯৬ সালে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব সিআইডিকে দেওয়া হয়। সিআইডি ১৯৯৭ সালের ১২ ডিসেম্বর একটি চার্জশিট দাখিল করে। ১৯৯৮ সালের ৩ ডিসেম্বর একটি পরিপূরক চার্জশিট দাখিল করা হয়। ২০০০ সালের ৯ মে আদালত ৪৬ জন সন্দেহভাজনের মধ্যে আট জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। তারা সবাই পুলিশ ছিল। অভিযুক্তদের মধ্যে ইন্সপেক্টর গোবিন্দ চন্দ্র মণ্ডল মামলা দায়েরের পর থেকে পলাতক রয়েছেন। অন্যান্য অভিযুক্তদের ২০০৩ সালে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। কনস্টেবল বশির আহমেদ এবং কনস্টেবল আবদুস সালাম স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেন।[১১] ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এই গণহত্যার কোনো সাক্ষীই আদালতের কার্যক্রমে উপস্থিত হননি।[১১]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ চট্টগ্রাম গণহত্যা দিবস আজ। Channel 24। ২০১৫-০১-২৪। ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০২-০১।
- ↑ UMD (২৬ জানুয়ারি ২০১৯)। "31 years on, plea for justice in Chittagong massacre falls on deaf ears"। Dhaka Tribune। সংগ্রহের তারিখ ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯।
- ↑ "For progress, people will have to re-elect AL: Hasina"। bdnews24.com। ২০১৩-১০-০৬। অক্টোবর ৯, ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০২-০১।
- ↑ ক খ মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান (২০১৩)। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপঞ্জি। প্রথমা।
- ↑ আওয়ামী রাজনীতির স্বরূপ। Daily Jugantor। ২০১৩-১০-২৯। অক্টোবর ৩১, ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০২-০১।
- ↑ "Sheikh Hasina Biography"। Prime Minister's Office। ২০১৩-১০-০৬। অক্টোবর ৮, ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০২-০১।
- ↑ "Former Presidents"। Office of the President of Bangladesh। ২০১৩-১০-০৬। ২০১৫-০২-০১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০২-০১।
- ↑ ক খ গ থমকে আছে বিচার!। Prothom Alo। ২০১৪-০১-২৪। ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০২-০১।
- ↑ ক খ ২৩ বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি চট্টগ্রাম গণহত্যা মামলা। Kaler Kantho। ২০১০-০৯-০৮। ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০২-০১।
- ↑ চট্টগ্রাম গণহত্যার ২৭ বছর আজ। Prothom Alo। ২০১৫-০১-২৪। ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০২-০১।
- ↑ ক খ পাঁচ বছরে একজন সাক্ষীও হাজির হননি। Prothom Alo। ২০১৫-০১-২৪। ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০২-০১।