হোলি, পাঞ্জাব

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
হোলি, পাঞ্জাব
অন্য নামহোলি
পালনকারীভারতীয় (হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধজৈন) নেপালি (প্রধানত হিন্দু এবং বহুসংখ্যক বৌদ্ধ) এবং বাংলাদেশ (প্রধানত হিন্দু এবং বহুসংখ্যক বৌদ্ধ)
উদযাপন৩ - ১৬ দিন
শুরুফাল্গুনী পূর্ণিমা
তারিখফাল্গুন (ফেব্রুয়ারি-মার্চ)
প্রহ্লাদপুরী মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ

হোলি হল পাঞ্জাব অঞ্চলের একটি উৎসব, যা অধুনা পাঞ্জাবের মুলতান[১] প্রদেশের প্রহ্লাদপুরী[২] মন্দির থেকে উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। পিতা হিরণ্যকশিপুর অত্যাচার থেকে বাঁচানোর জন্যে বিষ্ণুর অবতার নৃসিংহের উদ্দেশ্যে এই মন্দিরটি তৈরি করেন প্রহ্লাদ। এই হোলি উৎসবের মাধ্যমেই আবার বসন্তকালের সূচনা হয় । ফাগুনী পূর্ণিমার রাতে হোলিকা দহন উৎসবের মাধ্যমে পাঞ্জাবে দুদিন ব্যাপী হোলি উৎসবের সূচনা হয়। পরের দিন অর্থাৎ চেত (বাংলায় চৈত্র) মাসের প্রথম দিনে হোলি পালিত হয়।[৩][৪]

ব্যুৎপত্তি[সম্পাদনা]

হোলি শব্দের উৎপত্তি হয়েছে হোলা থেকে। যার অর্থ হল আগাম ফসলের প্রত্যাশায় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন। সংস্কৃত শব্দ হোলকা অর্থাৎ অর্ধ-পক্ব শস্য থেকেও হোলি শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়। এখনও এই সমস্ত অঞ্চলে হোলির দিনে অর্ধ পক্ব গম এবং ছোলা খাওয়ার রীতি আছে।[৫]
পাঞ্জাবে হোলির দু মাস পরে অর্থাৎ বৈশাখ মাসে গম কাটা হয়ে থাকে, তাই অনেকসময় এই হোলি উৎসবকে আগাম শস্য সংগ্রহ করার উৎসব হিসাবে চিহ্নিত করে কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন করা হয়।
হিরণ্যকশিপুর কনিষ্ঠ ভগিনী হোলিকার নামানুসারে হোলি শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়। ভ্রাতুষ্পুত্র প্রহহ্লাদকে হত্যা করার প্রয়াসে আগুনে পুড়ে এই হোলিকার মৃত্যু হয়।

প্রহ্লাদপুরী মন্দির এবং হোলিকা দহন[সম্পাদনা]

নৃসিংহরুপী বিষ্ণু কর্তৃক হিরণ্যকশিপুর নিধন

নিজের প্রতি ভক্তি তে খুশি হয়ে ভগবান বিষ্ণু রাজা হিরণ্যকশিপুকে কিছু বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছিলেন, কিন্ত পরবর্তী কালে অত্যন্ত অহংকারী এই রাজা বিষ্ণুর উপাসনা বন্ধ করে সমগ্র মুলতানবাসি কে নিজের উপাসনা করতে বাধ্য করেন[৩][৬]। হিরণ্যকশিপু পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন প্রকৃত বিষ্ণু ভক্ত, তিনি কখনওই বিষ্ণুর উপাসনা পরিত্যাগ করে পিতার উপাসনা করতে রাজি ছিলেন না।
হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদ কে মেরে ফেলার জন্যে বিষ প্রয়োগ করেন, মত্ত হাতীর পায়ের নিচে ফেলে দেন, বিষধর সাপেদের সঙ্গে কারারুদ্ধ করে রাখেন, কিন্তু কোনভাবেই তাকে হত্যা করতে সক্ষম হন নি। অতঃপর তিনি ভগিনী হোলিকার সাহায্যে প্রহ্লাদকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

নৃসিংহরুপী বিষ্ণু কর্তৃক হিরণ্যকশিপুর নিধন

কিন্তু অদ্ভুতভাবে, আগুনে পুড়ে হোলিকার মৃত্যু হয়। হোলিকার একটি মন্ত্রপূত শাল ছিল, যা তাকে আগুনের হাত থেকে রক্ষা করত।

হিরণ্যকশিপুর একটি চিতার উপর হোলিকার অঙ্কদেশে প্রহ্লাদকে বসতে বাধ্য করেন। কথিত আছে, প্রহ্লাদ আগুন প্রবেশ করামাত্র প্রবল শক্তিশালী বাতাস বইতে থাকে এবং সেই মায়াবী শাল হোলিকার পরিবর্তে প্রহ্লাদকে আবৃত করে রাখে। আগুনে পুড়ে হোলিকার মৃত্যু হয়। হোলিকা দহনের সময় নৃসিংহরুপী বিষ্ণু হিরণ্যকশিপুরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং তাকে দু টুকরো করে ফেলে হত্যা করেন। মুলতানের সূর্য মন্দির এই ঘটনার সাক্ষ্য দেয় এবং এটিকে এই ঘটনার স্মারক মন্দির হিসাবে মনে করা হয়ে থাকে।

হোলাষ্টক উৎসব[সম্পাদনা]

হোলিকা দহন

পাঞ্জাবে নয় দিন ব্যাপী হোলাষ্টক উৎসব হিসেবে হোলি পালিত হয়। হোলাষ্টক অর্থাৎ হোলা এবং অষ্টক, যার মানে হোলির আগের আট দিন ধরে চলা এই উৎসব। রং এবং গুলাল এর মাধ্যমে হোলির দিনে এই হোলাষ্টক উৎসব শেষ হয়। হোলাষ্টক হোলির সূচনা করে। এছাড়াও, হোলিকা দহন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি এদিন থেকেই শুরু হয়ে যায়[৭]
হোলিকা দহনের আট দিন আগে থেকে হোলিকা পূজন শুরু হয়। পুজাস্থান প্রথমে পবিত্র জলের ছিটে দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। তারপর, এই জায়গায় দুটো কাঠি রাখা হয়ে থাকে, যার মধ্যে একটি প্রহ্লাদ এবং অন্যটি হোলিকাকে ব্যক্ত করে। ঘুঁটে, শুকনো কাঠ এবং ঘাস এই দুই কাঠির মাঝখানে রাখা হয়।
হোলাষ্টক থেকে শুরু করে হোলিকা দহনের দিন অবধি প্রতিদিন কিছু ছোট ছোট কাঠের টুকরো এবং কাঠি জড়ো করা হয়। হোলিকা দহনের সময় এটিকেই হোলিকার প্রতীকী কুশপুত্তলিকা হিসাবে দাহ করা হয়। সেই সময়, এই কুশপুত্তলিকার উপর কিছুটা রং ছড়িয়ে দেয়ার প্রচলন আছে[৮]। রাজা রঞ্জিত সিংহ সপ্তাহ ব্যাপী এই হোলি উৎসব পালন করতেন[৯]

আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকলাপ[সম্পাদনা]

মাটির ঘড়া ভাঙ্গা[সম্পাদনা]

এই রেওয়াজ মূলত পশ্চিম পাঞ্জাব এবং পূর্ব পাঞ্জাবের হোলি দিনে পালিত হয় । একটি মাটির ঘড়ার মধ্যে মাখন এবং দুধ রেখে উঁচু স্থানে ঝুলিয়ে রাখা হয় । প্রায় ছয়জন পুরুষ মিলে একে অপরের কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে এবং মাথার সাহায্যে একটি পিরামিড তৈরি করে এবং আরও কয়েকজন এই পিরামিড আরোহণ করে ঘড়াটা ভেঙ্গে ফেলে। আর অন্য যারা এই পিরামিডে ওঠেনি, তারা বাইরে থেকে রং আর জল ছুঁড়তে থাকে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ননী চুরির ঘটনার পুনরাবৃত্তি করা হয় এই অনুষ্ঠানে[১০]

রং[সম্পাদনা]

পাঞ্জাবের মানুষ হোলি উদ্‌যাপনের সময় একে অপরের উপর গুঁড়ো রং নিক্ষেপ করে থাকে।

চঙ্কা পূর্ণা[সম্পাদনা]

পাঞ্জাবে দশেরা,কড়বা চৌথ,হোলি বা দীপাবলী মত উৎসবে, গ্রামের ঘরের মাটির দেয়ালে ও আঙ্গিনায় একরকম আলপনা দেওয়া হয়। ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর কাছ থেকে আশীর্বাদ চাওয়া হয়ে থাকে এই ধরনের আলপনার মাধ্যমে।
কৃষিজীবী গ্রাম্য মহিলার রূপ দেওয়া হয় এই আলপনার মাধ্যমে। কিছু নির্দিষ্ট গাছের নকশা, ফুল, পর্ণাঙ্গ, লতা, ময়ূর, পালকী, জ্যামিতিক নকশা এবং তার সঙ্গে উল্লম্ব, অনুভূমিক এবং তির্যক রেখার সঙ্গমে তৈরি হওয়া সরল, নির্বস্তুক নিগূঢ়তা এই ধরনের শিল্পকর্মের গুরুত্ব প্রকাশ করে।

হোলি এবং বসন্তকাল[সম্পাদনা]

হোলি উৎসবের মাধ্যমে পাঞ্জাবে শীতকালের সমাপ্তি হয় [১১]। এখানে শীতকাল সাধারণত দুভাগে বিভক্ত । পাঞ্জাবি মাস মাঘর এবং পোহ কে নিয়ে হেমন্ত এবং মাঘ ও ফাগন কে নিয়ে শিশির। হোলিকা দহনের দ্বারা শিশিরের সমাপ্তি এবং হোলি র মাধ্যমে বসন্তের সূচনা হয়ে থাকে।

হোলি এবং শিখ ধর্ম[সম্পাদনা]

শিখদের ধর্ম গ্রন্থ শ্রী গুরু গ্রন্থ সাহিবজি তে ঈশ্বরের সেবার উদ্দেশে হোলি উদ্‌যাপন করার নির্দেশ আছে। হোলিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন রংগুলি ঈশ্বরের করুণা কে ব্যক্ত করে। [১২]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. A White Trail: A Journey into the heart of Pakistan's Religious Minorities by HAROON KHALID [১]
  2. Arshad, Sohaib। "The holi temple"http://www.thefridaytimes.com। ১৬ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জুলাই ২০১৬  |ওয়েবসাইট= এ বহিঃসংযোগ দেয়া (সাহায্য)
  3. "Haroon Khalid The Friday Times 15 04 2011"। ১১ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জুলাই ২০১৬ 
  4. Temple of Prahladpuri Department of Archaeology & Museums Ministry of Culture, Government of Pakistan [২] ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৭ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে
  5. Bhavan's Journal, Volume 14, Issues 14-26 Bharatiya Vidya Bhavan 1968
  6. Legend of Ram–Retold By Sanujit Ghose
  7. [৩] The Tribune 25 February 2012
  8. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২২ মে ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ জুলাই ২০১৬ 
  9. [৪] The Sunday Tribune Holi on Canvas Kanwarjit Singh Kang 13 March 2011
  10. http://festivals.iloveindia.com/holi/holi-celebrtions.html
  11. A Different Springtime Rite Wall Street Journal
  12. Sri Guru Granth Sahib Ji