হৈমবতী সেন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
হৈমবতী সেন
হৈমবতী সেন
জন্ম
মণি ঘোষ

১৮৬৬
মৃত্যু৫ আগস্ট ১৯৩৩(1933-08-05) (বয়স ৬৬–৬৭)
পেশাচিকিৎসক
দাম্পত্য সঙ্গীকুঞ্জবিহারী সেন
সন্তানধ্রুবজ্যোতি, আত্মজ্যোতি, শান্তজ্যোতি, জগজ্যোতি (পুত্র) ভক্তিসুধা (কন্যা)
পিতা-মাতাপ্রসন্নকুমার ঘোষ (পিতা)

হৈমবতী সেন (১৮৬৬ – ৫ আগস্ট ১৯৩৩) (বিবাহের পূর্বে হৈমবতী বা হেমবতী ঘোষ), ছিলেন একজন ভারতীয় মহিলা চিকিৎসক [১] যিনি বাল্যবিধবা হয়ে কেবল আত্মবিশ্বাসে ভর করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হন।[২]

জীবনের প্রথমার্ধ[সম্পাদনা]

হৈমবতী ঘোষের জন্ম ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ভারতের অধুনা বাংলাদেশের খুলনা জেলার নৈহাটি ইউনিয়নের  শ্রীরামপুর নৈহাটির এক  কুলীন কায়স্থ বংশে। পিতা প্রসন্নকুমার ঘোষ ছিলেন জমিদার। পিতামহ শিবনাথ ঘোষ (১৮০৯-১৮৪৯) নীলকুঠি সাহেব রেনির বিরোধিতা করে বাংলার বাহাদুর আখ্যা লাভ করেছিলেন। দাদা ও ভাইদের পড়াশোনা দেখে হৈমবতীর পড়াশোনার ইচ্ছা হত। কিন্তু তখনকার পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নির্মমতায় কিছুদিন বিদ্যালয়ের পাঠের পরই অসহায়  পিতা মাত্র সাড়ে নয় বৎসর বয়সে বিবাহ দেন বছর পঁয়তাল্লিশের এক বিপত্নীক পাত্রের সঙ্গে।[৩] কিন্তু বিবাহের অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই হৈমবতী বিধবা হন। বালবিধবা হয়ে শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়িসহ পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে কোনো সাহায্য না পেয়ে নিঃসম্বল ও নিরুপায় অবস্থায় যুবতী হৈমবতী কাশীবাসী হন। সেখানে বালিকা বিদ্যালয়ে পড়িয়ে গ্রাসচ্ছাদনের ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট হতে না পেরে পড়াশোনার ইচ্ছায় কলকাতা আসেন। ব্রাহ্মসমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে সাহায্য প্রার্থনায় তিনি ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচারক কুঞ্জবিহারী সেনকে বিবাহের শর্তে লেখাপড়ার অনুমতি পান। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের তাদের বিবাহ হয়।[১] কলকাতার ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুলের এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পান। স্কুলের সেরা ছাত্রী হিসাবে বিশেষ পারদর্শিতার জন্য বৃত্তিসহ পাঁচটি পদক লাভ করেন।[৪][৫] ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে ক্লাসে শীর্ষ স্থান অধিকার করে [৬] ভার্নাকুলার লাইসেনশিয়েটেড ইন মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি ডিপ্লোমা লাভ করেন। তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি না থাকায় এল. এম. এস. এর সমস্ত পাঠক্রম শেষ করেও তিনি এল এম এস ডিপ্লোমা পান নি।

কর্মজীবন[সম্পাদনা]

হৈমবতী ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দ হতেই  তিনি চল্লিশ টাকা বেতনে হুগলির চুঁচুড়ায় লেডি ডাফরিন মহিলা হাসপাতালে যুক্ত হন। এল এম এস ডিপ্লোমা না পাওয়ার কারণে হসপিটাল অ্যাসিস্ট্যান্ট -এর বেশি উচ্চ পদে চাকরি করতে পারেন নি। প্রাইভেট প্র্যাকটিস করার সময় তাকে শিক্ষনপ্রাপ্ত "দাই" বলে গণ্য করা হত। পদের নাম হসপিটাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হলেও তার কর্মদক্ষতায় দুবছর পর বেতন হয় পঞ্চাশ টাকা এবং তাকে লেডি ডাক্তার বা চুনিবাবু বলেই উল্লেখ করা হত। ওই একই বেতনে তিনি দীর্ঘ ষোল বৎসর সেখানে কাজ করেন। [৪][৭] চিকিৎসা পদ্ধতির গুণে এবং রোগীদের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাবের কারণে তিনি বিশেষ জনপ্রিয় ডাক্তার দিদি হয়েছিলেন।

বঞ্চিত ভারতীয় নারীর অবস্থান থেকে তিনি এক সফল কর্মজীবন গড়ে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। পর্দাপ্রথা  সম্পর্কে  গোঁড়া না হয়েও, অবস্থা অনুসারে ব্যবস্থাগ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন তিনি।

হৈমবতী নিজেকে শুধুমাত্র চিকিৎসকের গণ্ডিতে বেঁধে রাখেননি। তিনি পরিবারের দেখাশোনার সঙ্গে সাহিত্যচর্চাও করেছেন। কবিতা, ছোট গল্প ছাড়াও তিনি একান্ত ঘরোয়া বাংলায় আত্মজীবনী স্মৃতিকথা রচনা করেন। প্রবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় "ডাঃ হৈমবতী সেন-এর জীবনকথা" নামে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এছাড়ামেমোরিজ় অফ ডক্টর হৈমবতী সেন— ফ্রম চাইল্ড উইডো টু লেডি ডক্টর নামে ইংরাজীতে অনূদিত হয় ২০০০ খ্রিস্টাব্দে। কানাডার নারীবাদী লেখিকা জেরাল্ডিন ফোর্বস ২০২০ খ্রিস্টাব্দে তপন রায়চৌধুরীর সঙ্গে তার জীবনীর প্রেক্ষাপটে যুগ্মভাবে লেখেন -দ্য মেমোরস্ অফ ড. হৈমবতী সেন

ব্যক্তিগত জীবন[সম্পাদনা]

হৈমবতীর লেখাপড়া শিখে সাবলম্বী হবার স্বপ্ন পূরণ হলেও বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি। পডাশোনা করার জন্যই ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক কুন্জবিহারী সেনকে। তার কোনও উপার্জন ছিল না। উপরন্তু তাদের পাঁচ সন্তান (চার পুত্র ও এক কন্যা) ছিল। তাদের ও সংসারের সব খরচ বহন করতে হত হৈমবতীকে। আর এর সঙ্গে চলত তার উপর স্বামীর শারীরিক নির্যাতন। স্বামীর মৃত্যুর পর এক দিকে সন্তানপালন, অন্য দিকে হাসপাতাল, দুটো জীবনকে সমান তালে সামলেছিলেন তিনি। সন্তাদের সকলকেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন।[২] জ্যেষ্ঠ পুত্র ধ্রুবজ্যোতি ছিলেন আইনজীবি ও অধ্যাপক। দ্বিতীয় পুত্র কর্নেল ডাঃ আত্মজ্যোতি, তৃতীয় ও কনিষ্ঠ পুত্র শান্তজ্যোতি ও জগজ্যোতি ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। একমাত্র কন্যা ভক্তিসুধা বেথুন থেকে পাশ করে পরে শিক্ষকতা করতেন।[৮] ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ৫ আগস্ট ৬৭ বৎসর বয়সে স্তন ক্যান্সারে পরলোক গমন করেন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1.  সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট  ২০১৬ পৃষ্ঠা ৮৮৩, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  2. "বাল্যবিধবা থেকে চিকিৎসক"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৮-১৮ 
  3. Sen, Indrani (২০১২)। "Resisting Patriarchy: Complexities and Conflicts in the Memoir of Haimabati Sen"Economic and Political Weekly47 (12): 55–62; quotes from pages 55 and 57। আইএসএসএন 0012-9976জেস্টোর 23214502 
  4. Forbes, Geraldine Hancock (২০০৫)। Women in Colonial India: Essays on Politics, Medicine, and Historiography (ইংরেজি ভাষায়)। Orient Blackswan। পৃষ্ঠা 146। আইএসবিএন 978-81-8028-017-7 
  5. Mukherjee, Sujata (২০১৭-০১-০৫)। Gender, Medicine, and Society in Colonial India: Women's Health Care in Nineteenth- and Early Twentieth-Century Bengal। Oxford University Press। আইএসবিএন 978-0-19-946822-5ডিওআই:10.1093/acprof:oso/9780199468225.001.0001 
  6. Chattopadhyay, Anjana (২০১৮)। Women Scientists in India: Lives, Struggles & Achievements (পিডিএফ) (ইংরেজি ভাষায়)। National Book Trust, India। আইএসবিএন 978-81-237-8144-0 
  7. "Book on India's premier women doctors"The Hans India (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৯-১০-১৭। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১০-১৯ 
  8. "সাদা থান থেকে সাদা অ্যাপ্রন"। ২০২২-০৮-১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৮-১৮