হাতেম আলী মিয়া

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
হাতেম আলী মিয়া
জন্ম১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯২৬
মৃত্যু২৬ এপ্রিল ২০০৫(2005-04-26) (বয়স ৭৯)
হাতেম আলী সড়ক, গৌরীপুর, ময়মনসিংহ
জাতীয়তাবাংলাদেশি
নাগরিকত্ববাংলাদেশ
পরিচিতির কারণএকুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষা সৈনিক, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা, গণপরিষদ সদস্য, বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাক্ষরকারী, রাজনীতিবিদ
দাম্পত্য সঙ্গীজাহানারা বেগম
সন্তানরোকেয়া বেগম জলি, রওশন আরা দোলেনা, মোঃ হারুন উর রশীদ, রাবেয়া আক্তার ডলি, মোঃ মামুন উর রশীদ
পিতা-মাতাজহির উদ্দিন মাষ্টার (পিতা)
মেহেরুন্নেছা (মাতা)

হাতেম আলী মিয়া (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯২৬ - ২৬ এপ্রিল ২০০৫) বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের একজন ভাষা সৈনিক, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রবীণ রাজনীতিবিদ এবং গণপরিষদের সদস্য ছিলেন। [১] ২০২৪ সালে তিনি মরণোত্তর "একুশে পদকে" ভূষিত হন ৷ তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও ক্যাম্প ইন চার্জ ছিলেন। ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সহ: সম্পাদক, ময়মনসিংহ সদর উত্তর মহকুমা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং গৌরীপুর থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সভাপতি হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।[২]

তিনি আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসাবে ১৯৭০-এর নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালে গণপরিষদের সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাক্ষর করেন।[৩]

শিক্ষাজীবন[সম্পাদনা]

নিজ বাড়িতে পিতার নিকটে তার পড়ালেখার হাতেখড়ি হয়েছিল। এরপর পার্শ্ববর্তী গ্রামের গোবিন্দপুর মাদ্রাসায় তিনি প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি গৌরীপুর রাজেন্দ্র কিশোর সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক এবং গৌরীপুর সরকারী কলেজ থেকে আই.এ পাশ করেন। রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে তিনি পড়ালেখায় বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি।

রাজনৈতিক জীবন[সম্পাদনা]

রাজনীতিতে পদার্পন[সম্পাদনা]

১৯৪৬ সালে তিনি কৃষক প্রজা পার্টির সক্রিয় কর্মী হিসেবে রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ১৯৫০ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গৌরীপুর শাখার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক পদে ও পরবর্তীতে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সহ সম্পাদক ও সদর উত্তর মহকুমা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদেও দায়িত্ব পালন করেন।

ভাষা আন্দোলন ভূমিকা[সম্পাদনা]

১৯৫২ সালে তিনি ভাষা আন্দোলনে ছাত্রজনতাকে ঐক্যবদ্ধ করার কারনে পাক সরকারের চক্ষুশূলে পরিণত হয়ে গ্রেফতার হন এবং দীর্ঘ ৯ মাস কারাভোগ করেন। বাংলা ভাষাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিতে তিনি গৌরীপুরের ছাত্রজনতাকে ঐক্যবদ্ধ করেন। গৌরীপুরের তৎকালীন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রবৃন্দকে নিয়ে তিনি নিয়মিত মিছিল মিটিং করেন। ৫২'র ২১শে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় ভাষা আন্দোলনে নিহত শহীদদের সম্মান জানাতে গৌরীপুর বাজারে ইট সাজিয়ে লাল কাপড়ে ঢেকে প্রতীকি শহীদ মিনার বানিয়ে তাতে ফুল দিয়েছিলেন। এসময় পুলিশ এসে ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করে, শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে দেয় এবং তাকে গ্রেফতার করে।[৪]

৫২ পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক কর্মকান্ড[সম্পাদনা]

১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে তিনি ঢাকায় শের ই বাংলা এ কে ফজলুল হকের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সে বছরই তিনি ভাষানী সোহরাওয়াদীর সাথে নেত্রকোনা মহকুমার মোহনগঞ্জে সফরে যাওয়ার পথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে গৌরীপুর রেলস্টেশনে স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে ফুলের মালা দিয়ে অভিনন্দন জানান।

১৯৫৩ সালের ১৩ এপ্রিল তৎকালীন গৌরীপুর বাজার ময়দান বর্তমান শহীদ হারুন পার্কে এক বিশাল জনসভায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাষানীর উপস্থিতিতে তরুণ বক্তা হিসেবে সর্বপ্রথম তিনি তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষণ দেওয়ার সুযোগ পান এবং পরবর্তীতে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন এবং কারাবরণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক কর্মকান্ড[সম্পাদনা]

১৯৭২ সালে তিনি গণপরিষদের সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাক্ষর করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর প্রাণপ্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গৌরীপুর শাখাকে তিনি শক্তহাতে সুসংগঠিত করেন। তৎকালীন সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ১৯৭৬ সালের ১৫ই আগষ্ট হাতেম আলী মিয়া তার নিজ বাসভবনে নেতাকর্মীদের নিয়ে মিলাদ মাহফিল ও কাঙ্গালী ভোজের আয়োজন করেন। খুনী সরকারের রোষানলে শিকার হয়ে তিনি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন এবং রাজবন্দী হিসেবে কারাবরণ করেন।

হাতেম আলী মিয়ার আমন্ত্রনে ১৯৮৭ সালে তৎকালীন জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা গৌরীপুর তার বাসভবনে আসেন। পরে স্থানীয় হারুন পার্কে বিশাল জনসভায় ভাষন দেন।

১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার প্রবল নেতৃত্বে স্থানীয় নৌকা প্রার্থীকে বিজয়ী করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

হাতেম আলী মিয়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সহকর্মী ছিলেন। শেখ মুজিব এবং বেগম মুজিব দু'জনই তাকে ভীষণ ভালবাসতেন। বঙ্গবন্ধু তাকে আদর করে হাতেম বলে ডাকতেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা[সম্পাদনা]

১৯৬৯ এর গণঅভুত্থানে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে গৌরীপুরে গণমিছিলের নেতৃত্ব দেন। ১৯৭০ সালে নির্বাচনী প্রচারনায় বঙ্গবন্ধু ময়মনসিংহ হতে নান্দাইল যাওয়ার পথে হাতেম আলী মিয়া কলতাপাড়া বাজারে তার সহকর্মীদের নিয়ে ফুলের মালা দিয়ে অভিনন্দন জানান। [৫]

১৯৭০ সালে জাতীয় নির্বাচনে হাতেম আলী মিয়া আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকে বিপুল ভোটে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। [৬]

১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ গৌরীপুর শহীদ হারুন পার্কে বিশাল জনসভায় তার সহকর্মীদের নিয়ে হাতেম আলী মিয়া পাকিস্তানের পতাকাতে অগ্নিসংযোগ করেন এবং জয়বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন ৷ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণের পর তিনি গৌরীপুরে সংগ্রাম কমিটির সভাপতির দ্বায়িত্ব পালন করেন। [৭]

১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিলের পর মুজিবনগর সরকারের অধীনে তিনি ভারত সরকারের সহযোগিতায় মেঘালয় রাজ্যের শিববাড়িতে ইয়্যুথ ক্যাম্প স্থাপন করেন এবং সেখানে ইনর্চাজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।[৮]

জনহিতকর ও সামাজিক কর্মকান্ড[সম্পাদনা]

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে তার সর্বস্ব উজার করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের কর্মী এবং সাধারণ মানুষের মাঝে। জেল জুলুম কারাবরণের মধ্য দিয়ে তিনি তার জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে অনুসরণ করে চলেছেন সারাজীবন।

তিনি গৌরীপুর সরকারী কলেজ, গৌরীপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, গৌরীপুর মহিলা ডিগ্রী কলেজসহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি তৎকালীন সময়ে ইকবাল ক্লাব প্রতিষ্ঠা ও যুব কিশোর সংগঠন কঁচিকাঁচার আসর, গোবিন্দ জিউর মন্দির প্রতিষ্ঠা ও রাজ রাজেশ্বরী বোকাইনগর কালীবাড়ী মন্দির গৌরীপুর শহরে পুন:প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

১৯৬০ সালে বাউন্ডারী কমিশনের নিকট গৌরীপুরকে জেলায় উন্নীত করার প্রথম প্রস্তাব করেন ৷ ১৯৭৫ সালের ১০ জুলাই তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করে গৌরীপুরকে জেলা করার প্রস্তাব ও ১নং মইলাকান্দা ইউনিয়নের কাউরাট বাজারে রেলস্টেশন স্থাপন এবং হযরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়া(রাঃ) এর মাজারের সংস্কারের আবেদন জানান।

তিনি দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদের নিজস্ব প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। গৌরীপুর থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক সুবর্ণ বাংলা পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন। তার লেখা অসমাপ্ত গ্রন্থ মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধু (অপ্রকাশিত)।

একুশে পদক[সম্পাদনা]

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে গৌরবোজ্জ্বল অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০২৪ সালে তাকে মরণোত্তর একুুুশে পদকে ভূষিত করেন ৷ তার পক্ষে পদকটি গ্রহণ করেন তার স্ত্রী জাহানারা বেগম ৷ [১] [২]

হাতেম আলী মিয়ার স্ত্রী জাহানারা বেগম একুশে পদক গ্রহণ করছেন

চিত্রশালা[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. গৌরীপুরের ইতিহাস ঐতিহ্য ও কিংবদন্তি। ফেব্রুয়ারি ২০১৫। পৃষ্ঠা ৩৩৩। 
  2. "হাতেম আলী মিয়া"যুগান্তর। সংগ্রহের তারিখ ২৬ এপ্রিল ২০২২ 
  3. "হাতেম আলী মিয়া"চমক নিউজ। সংগ্রহের তারিখ ২৮ এপ্রিল ২০২২ 
  4. "স্বীকৃতি ছাড়াই চলে গেলেন ১৯ ভাষাসৈনিক"ভালুকা ডট কম। সংগ্রহের তারিখ ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৮ 
  5. কমল সরকার। "গৌরীপুরের ভাষা সৈনিক এম.সি.এ হাতেম আলী মিয়ার ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত"দৈনিক সময় সংবাদ ২৪। সংগ্রহের তারিখ ২৬ এপ্রিল ২০২০ 
  6. "বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহচর গণপরিষদ সদস্য হাতেম আলী মিয়া'কে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ"দৈনিক দেশের সংবাদ। সংগ্রহের তারিখ ২৬ এপ্রিল ২০২২ 
  7. গৌরীপুরের ইতিহাস ঐতিহ্য ও কিংবদন্তি। ফেব্রুয়ারি ২০১৫। পৃষ্ঠা ২৭৩-৭৪। 
  8. "বৃহত্তর ময়মনসিংহে আওয়ামী রাজনীতির প্রবাদ পুরুষ সাবেক ( এম পি এ) হাতেম আলী মিয়ার ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী"দৈনিক সংবাদ সারাক্ষণ। সংগ্রহের তারিখ ২৬ এপ্রিল ২০২২