হাতিঘড়ি

হাতিঘড়ি হলো একটি জলঘড়ির মডেল, যা মধ্যযুগের ইসলামি প্রকৌশলী ইসমাইল আল-জাযারি (১১৩৬–১২০৬) আবিষ্কার করেন। এর নকশাটি তার রচিত গ্রন্থ ‘দ্য বুক অব নলেজ অব ইনজেনিয়াস মেকানিক্যাল ডিভাইসেস’-এ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
যন্ত্রকৌশল
[সম্পাদনা]
সময় নিরূপণের এই কৌশলটি হাতির পেটের ভেতরে লুকানো একটি জলপূর্ণ পাত্রের ওপর নির্ভরশীল। এই পাত্রের পানিতে একটি গভীর বাটি ভাসমান থাকে, যার কেন্দ্রে একটি ছোট ছিদ্র রয়েছে। ছিদ্রটি দিয়ে বাটিটি জলে পূর্ণ হতে আধ ঘণ্টা সময় লাগে। ডুবে যাওয়ার সময় বাটিটি একটি দড়িকে টানে, যা হাতির পিঠের ওপর থাকা মিনারের একটি দোলক-কৌশলের সঙ্গে যুক্ত। এর ফলে একটি বল মুক্ত হয়ে সাপের মুখে পড়ে, যার কারণে সাপটি সামনের দিকে ঝুঁকে যায়। এই ঝুঁকে পড়ার ফলে অন্য দড়ির টানে ডুবে যাওয়া বাটিটি জল থেকে উঠে আসে। একই সময়ে, একটি দড়ির ব্যবস্থা মিনারের ভেতরের একটি মানবমূর্তির ডান বা বাম হাতকে উপরে তুলে দেয় এবং মাহুত (সামনে বসা হাতির চালক) ঢোলে আঘাত করে। এটি আধ ঘণ্টা বা পূর্ণ ঘণ্টা নির্দেশ করে। এরপর, সাপটি আবার আগের অবস্থানে ফিরে আসে। বাটিটি খালি করার জন্য যতক্ষণ উপরের আধারে বল অবশিষ্ট থাকে, ততক্ষণ এই চক্রটি পুনরাবৃত্ত হতে থাকে।[২]
স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র
[সম্পাদনা]যন্ত্রকৌশলে একটি মানবাকৃতি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র সিম্বাল বাজায় এবং একটি যান্ত্রিক পাখি আওয়াজ করে, যেমনটি পূর্বে আর্কিমিডিস আবিষ্কৃত কোকিল ঘড়িতে দেখা যায়।
সময়ঘণ্টার প্রবাহ
[সম্পাদনা]ঘড়ির আরেকটি উদ্ভাবনী বৈশিষ্ট্য হলো 'টেম্পোরাল ঘণ্টা' বা পরিবর্তনশীল ঘণ্টা পরিমাপের পদ্ধতি। যেহেতু বছরের বিভিন্ন সময়ে দিনের দৈর্ঘ্য ভিন্ন, তাই প্রতিদিন জলের প্রবাহের হার পরিবর্তন করতে হতো। এটি সম্পন্ন করতে ঘড়িতে দুটি ট্যাংক রাখা হয়। উপরের ট্যাংকটি সময় নির্দেশক যন্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে, আর নিচের ট্যাংকটি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ রেগুলেটর এর সঙ্গে। ভোরবেলায় নল খোলা হতো এবং ফ্লোট রেগুলেটরের মাধ্যমে উপরের ট্যাংক থেকে নিচের ট্যাংকে জল প্রবাহিত হয়, যা নিচের ট্যাংকে স্থির চাপ বজায় রাখতো।[৩]
আধুনিক প্রতিরুপ
[সম্পাদনা]"১০০১ ইনভেনশনস" সংস্থা কর্তৃক হাতিঘড়ির বেশ কয়েকটি আধুনিক প্রতিরুপ তৈরি করা হয়েছে। এই প্রতিরূপগুলো ২০০৬ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শিত ১০০১ আবিষ্কার-এর শিক্ষামূলক বিজ্ঞান প্রদর্শনীগুলির অংশ হিসাবে দেখানো হয়। জানুয়ারি ২০১০ সালে, লন্ডন সায়েন্স মিউজিয়াম পরিদর্শনকালে, বিবিসি সাংবাদিক নিক হাইঅ্যাম "১০০১ ইনভেনশনস" কর্তৃক তৈরি পাঁচ মিটার উঁচু, কার্যকরী হাতিঘড়ির প্রতিরুপকে "অসাধারণ" হিসেবে বর্ণনা করেন।[৪][৫]
সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অবস্থিত ‘ইবনে বতুতা মল’ নামক শপিং মলের কেন্দ্রবিন্দুতে এর একটি আধুনিক, পূর্ণ আকারের ও সচল প্রতিরুপ দেখা যায়। এর আরেকটি সচল প্রতিরুপ সুইজারল্যান্ডের লে লোক্লে অবস্থিত ‘মুজে দ'রলজেরি দু লকল, শ্যাতো দে মোঁ’-এর বাইরে দেখা যায়। অন্য আরেকটি প্রতিরুপ সৌদি আরবের ‘কিং আব্দুল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে’ অবস্থিত ‘ইসলামি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে’ রয়েছে।
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ইবনে আল-রাজ্জাজ আল-জাযারি (সম্পা. ১৯৭৪), ‘দ্য বুক অব নলেজ অব ইনজেনিয়াস মেকানিক্যাল ডিভাইসেস’। অনুবাদ ও টীকা সংযোজন: ডোনাল্ড রাউটলেজ হিল, ডরড্রেখ্ট/ডি. রেইডেল।
- ↑ রবিনসন, অ্যান্ড্রু (২০০৭)। "মাপজোকের ইতিহাস: কিউবিট থেকে মেগাবাইট পর্যন্ত"। থেমস অ্যান্ড হাডসন। আইএসবিএন ৯৭৮-০-৫০০-৫১৩৬৭-৫।
- ↑ আহমাদ হাসান; ডোনাল্ড রাউটলেজ হিল (১৯৮৬)। "ইসলামি প্রযুক্তি: চিত্রসহ ইতিহাস"। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস। পৃ. ৫৭–৫৯। আইএসবিএন ০-৫২১-২৬৩৩৩-৬।
- ↑ "মুসলিম ঐতিহ্যের সায়েন্স মিউজিয়াম প্রদর্শনী"। বিবিসি নিউজ। ২১ জানুয়ারি ২০১০। সংগ্রহের তারিখ ২ ডিসেম্বর ২০১৪।
- ↑ "১০০১ আবিষ্কার: আমাদের বিশ্বের মুসলিম ঐতিহ্য আবিষ্কার করুন"। টাইম আউট লন্ডন। ২২ আগস্ট ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২ ডিসেম্বর ২০১৪।
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]- ইবনে বতুতা মলে হাতিঘড়ির ছবিসহ নিবন্ধ।
- তথ্য মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম, নিউ ইয়র্ক থেকে।
- সৌদি আরামকো ওয়ার্ল্ড: দ্য থার্ড ডাইমেনশন রিচার্ড কোভিংটনের রচনা, যেখানে ড. ফুয়াত সেজগিন, তার আরবি–ইসলামি বিজ্ঞানের জাদুঘর (ফ্রাঙ্কফুর্ট) এবং বিশেষভাবে হাতিঘড়ির একটি মডেল অন্তর্ভুক্ত আছে।
- হাতিঘড়ি (ইংরেজি) - ভিমিও