হাকিম ইবনে হিযাম

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

হাকিম ইবনে হিযাম (৫৫৭-৬৭৪ খ্রিঃ) রাসুল এর একজন প্রখ্যাত সাহাবাখাদীজা বিনতু খুওয়াইলিদ তার ফুফু ছিলেন ।

জন্মগ্রহণ ও নাম বৃত্তান্ত[সম্পাদনা]

হাকিম ইবনে হিযাম এর মূলনাম নাম হাকিম ও কুনিয়াত/উপনাম আবু খালিদ । পিতা হিযাম ইবনে খুওয়াইলিদ এবং মাতা যয়নাব মতান্তরে সাফিয়া । উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজা বিনতু খুওয়াইলিদ তার ফুফু ।

হাকিমের নিজেই মতে, হস্তিবর্ষ অর্থাৎ আবরাহার কাবা আক্রমণের ১৩ বছর পূর্বে (তার মানে আনুমানিক ৫৫৭ খ্রিঃ) জন্মগ্রহণ করে । তবে ওয়াকিদী বলেন, হাকিম রাসুলের জন্মের ৫ বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন । তার পিতা হিযাম ফিজার যুদ্ধ মারা যায়,হাকিমও এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ।

যুবাইর ইবন বাককার বলেন, হাকীম কাবার অভ্যন্তরে জন্ম গ্রহণ করেন।[১] ইতিহাস বলছে, তিনিই আরবের একমাত্র সন্তান যে কাবার অভ্যন্তরে ভূমিষ্ট হয়েছে । তার মা সন্তান প্রসবের অন্তিম সময়ে বান্ধবীদের সাথে কাবার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেলে সেখানে প্রসব বেদনা হয়ে হাকিম ইবনে হিযাম জন্ম গ্রহণ করেন ।

ইসলাম গ্রহণের পূর্বে[সম্পাদনা]

হাকিম মক্কার এক সম্পদশালী অভিজাত পরিবারে বেড়ে ওঠেন । তিনি ছিলেন অতিশয় ভদ্র ও বুদ্ধিমান । কুরাইশরা তাকে নেতা হিসাবে বরণ করে নেয় । জাহেলী যুগ তিনি মক্কায় আগত হাজিদের দেখাশোনা,আহার করানোর দায়িত্বে থাকতো । এইজন্য তাকে আরবি পরিভাষায় মুতয়িম বলা হয় ।[২] জাহিলী যুগে যারা ‍আল্লাহর ঘর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মক্কায় এসে দূর্দশায় পড়তো তিনি নিজের অর্থ দিয়ে তাদের সাহায্য করতেন ।

নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে ছিলেন মুহাম্মদ এর অন্তরঙ্গ বন্ধু । অতঃপর খাদীজা বিনতু খুওয়াইলিদের সাথে রাসুল বিয়ের মাধ্যমে রাসুল এর সাথে ‍হাকিমের আত্মীয়তার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত ও দৃঢ় হয় ।

৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে যখন রাসুল ও বনু হাশিম সবাই যখন মক্কার উপত্যকা শিবে আবী তালিব উপত্যকাতে অবরুদ্ধ করা হয় । তখন হাকিম ইবনে হিযাম ইসলাম গ্রহণ না করলেও গোপনে বিভিন্ন বিপদ এড়িয়ে তার ফুফু খাদীজাকে খাদ্য সামগ্রী পাঠাতেন ।[৩]

রাসুল হাকিম ইবনে হিযামের ইসলাম গ্রহণের জন্য সবসময় দোয়া করতেন । মক্কা বিজয়ের পূর্বরাত্রি রাসূল সাহাবীদের বলছিলেন,

মক্কার চার ব্যক্তির ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করুক এটাই আমি কামনা করেছি । হল তাঁরা হল আত্তাব ইবন উসাইদ, জুবাইর ইবন মুতইম , হাকিম ইবনে হিযাম ও সুহাইল ইবন আমর । পরবর্তীতে এরা সকলে ইসলাম গ্রহণ করে ।

বদর যুদ্ধের সময়[সম্পাদনা]

বদর যুদ্ধের পূর্বে কুরাইশদের মুহাম্মদের ব্যাপারে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য একটি বৈঠক ‘দারুন নাদওয়া’ হয়, সেই বৈঠকেও উপস্থিত ছিলেন হাকিম ।[৪]

বদরের যুদ্ধের সময় হাকিম ইবনে হিযাম মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ এড়ানোর পরামর্শ দিয়ে ছিলেন আবু জাহেলকে,সাথে উতবাহ ইবনে রাবীআহ যুদ্ধ এড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলো কিন্তু আবু জেহেলের চাপের কারণেই যুদ্ধ সংগঠিত হয় ।[৫]

বদরের পরাজয় সম্পর্কে হাকিম পরবর্তীকালে একটি বর্ণনা করেছেন,

আমরা একটি শব্দ শুনতে পেলাম, যেন আকাশ থেকে মাটিতে এসে পড়লো। শব্দটি ছিল একটি থালার ওপর পাথর পড়ার মত। রাসূলুল্লাহ সেই পাথরটি নিক্ষেপ করেছিলেন এবং আমরা পরাজিত হয়েছিলাম ।[৬]

ইসলাম গ্রহণ[সম্পাদনা]

মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে রাসুল ‘মাররাজ জাহরান’ নামক স্থানে পৌঁছে শিবির স্থাপন করেছেন । কুরাইশদের পক্ষ থেকে গোপনে খবর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আবু সুফিয়ান ইবনে হারব, হাকিম ইবন হিযামবুদাইল ইবনে ওয়ারকা মক্কা থেকে বের হন । মক্কার অদূরে ‘আরাক’ নামক স্থানে পৌঁছালে তারা অন্ধকারে মুসলিম শিবিরে ঢুকে পরলে প্রহরীদের নিকট ধরা পরে । আবু সুফিয়ানের ঘাড়ে উমার কয়েকটি ঘুষি বসিয়ে দেন । আবু সুফিয়ান ভয়ে চেঁচিয়ে আব্বাসের সাহায্য কামনা করেন । আব্বাস ছুটে এসে তাকে উমারের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান । এদিকে হাকিম ও বুদাইলকে বন্দী করে রাসূলুল্লাহর নিকট উপস্থিত করা হলে তারা স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেন । পরে আবু সুফিয়ানও ইসলাম গ্রহণ করেন ।[৭][৮]

তিনি এই দীর্ঘ দেরীতে ইসলাম গ্রহণের জন্য সবসময় আফসোস করতেন ও আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতেন ।

মক্কা বিজয়ের দিন রাসুল হাকিম ও আবু সুফিয়ানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ঘোষণা দেন,

১. আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি এক, তার কোন শরীক নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর বান্দাহ ও রাসূল─ যারা এ সাক্ষ্য দিবে তারা নিরাপদ।

২. যে ব্যক্তি অস্ত্র ফেলে কাবার চত্বরে বসে পড়বে সে নিরাপদ।

৩. যারা নিজ ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে তারা নিরাপদ। (হাকিমের বাড়ী ছিল মক্কার নিম্ন ভূমিতে)

৪. যে আবু সুফিয়ানের বাড়ীতে আশ্রয় নেবে সে নিরাপদ । (আবু সুফিয়ানের বাড়ী মক্কার ছিলো উচ্চ ভূমিতে)

৫. যে হাকীম ইবন হাযামের বাড়ীতে আশ্রয় নেবে সেও নিরাপদ।

দান সদকা[সম্পাদনা]

মক্কার উল্লেখযোগ্য একটি বাড়ি ‘দারুন নাদওয়া’ । কুরাইশরা সেখানে সমবেত হয়ে বিভিন্ন পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো এবং মদ্য পান আড্ডা চলতো । কুরাইশ বংশের ঊর্ধ্বতন পুরুষ কুসাঈ এ বাড়ীটি নির্মাণ করে । হাত বদল হয়ে ইসলাম পূর্ব যুগে হাকিম বাড়ীটির মালিক হন । ইসলাম গ্রহণের পর ‍মুয়াবিয়ার খিলাফতকালে তিনি বাড়ীটি এক লক্ষ দিরহামে বিক্রি করে সমস্ত টাকা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করেন । তিনি বলেন, জাহিলী যুগে একপাত্র মদের বিনিময়ে বাড়ীটি আমি কিনেছিলাম,আজ সব আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় হবে ।[৯]

ইসলাম গ্রহণের পরের ঘটনা,

হাকিম ইবন হিযাম একবার হজ্জ আদায় করলেন । ১০০ টি মূল্যবান কাপড়ে সজ্জিত উত্তম জাতের উট কুরবানি করে গোশত দিয়ে মুসলমান গরীব মিসকীনদের বিলিয়ে দিলেন ।

তিনি আর একবার তিনি হজ্জ করলেন । ১০০ জন দাস সজ্জিত রুপোর প্লেট সহ মুক্ত করে দিলেন ।

আবার অন্য একটি হজ্জে তিনি ১০০০ বকরী সংগে নিয়ে সবগুলো কুরবানি করে গোশত দিয়ে মুসলমান গরীব মিসকীনদের বিলিয়ে দিলেন ।

তিনি আবু বকর ও উমরের আমলে রাষ্ট্র ভাণ্ডার হতে কোন ভাতা গ্রহণ করেননি ।[১০]

হুনাইনের যুদ্ধে[সম্পাদনা]

হুনাইন যুদ্ধের পর হাকিম ইবনে হিযাম রাসূল এর নিকট গণীমতের সম্পদ থেকে ১০০ টি উট লাভ করেছিলেন ।[১১]

মৃত্যু[সম্পাদনা]

হযরত হাকিমের মৃত্যুসন সম্পর্কে মতভেদ আছে । ইমাম বুখারী বলেছেন, তিনি ৬০ হিজরী/৬৭৪ খ্রিঃ ১২০ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন । তবে উরওয়ার মতে তিনি খলীফা মুয়াবিয়ার খিলাফতের ১০ বছরে মৃত্যুবরণ করেন ।[১২]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. [আল ইসাবা-১/৩৪৯] 
  2. [সীরাতু ইবন হিশাম-১/৬৬৪-৬৫] 
  3. [সীরাতু ইবন হিশাম-১/৩৫৩-৩৫৪] 
  4. [সীরাতু ইবন হিশাম-১/৪৮০-৮১] 
  5. [সীরাতু ইবন হিশাম-১/৬২২-২৪] 
  6. [হায়াতুস সাহাবা-৩/৫৫০] 
  7. [হায়াতুস সাহাবা-১/১৬৩, ১৭০-৭২] 
  8. [সীরাতু ইবন হিশাম-২/৪০০] 
  9. [সীরাতু ইবন হিশাম-১/১২৫] 
  10. [হায়াতুস সাহাবা-২/২৫০-৫১] 
  11. [সীরাতু ইবন হিশাম-২৪৯৩] 
  12. (বইঃ আসহাবে রাসূলের জীবনকথা – দ্বিতীয় খন্ড)