স্যাম রুবেন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

স্যামুয়েল রুবেন (জন্ম চার্লস রুবেনস্টাইন; ৫ নভেম্বর ১৯১৩ - ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪৩) ছিলেন একজন মার্কিন বিজ্ঞানী।

প্রথম জীবন[সম্পাদনা]

স্যামুয়েল রুবেনের বাবা-মার নাম - হার্শেল রুবেন্সটাইন ও ফ্রেডা পেন রুবেনস্টাইন। ১৯৩০ সালে তারা নামটাকে ছোট করে "রুবেন" করে নেন। বিখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা জ্যাক ডেম্পসে ছিলেন কিশোর স্যামের প্রতিবেশী। ডেম্পসের সঙ্গে স্যামের বন্ধুত্ব হয় এবং স্যাম স্থানীয় মুষ্টিযোদ্ধাদের ক্লাবে যোগ দেন। পরে যখন পরিবার বার্কলেতে স্থানান্তরিত হয়, তখন সেখানে বাস্কেটবল খেলা শুরু করেন। স্যাম বার্কলে হাই স্কুলের একজন ভাল বাস্কেটবল খেলোয়াড় ছিলেন। স্যাম বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিষ্ট্রিতে বিএস করে সেখানেই তিনি উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন এবং ১৯৩৮ সালের মে মাসে সেখান থেকে তিনি ফিজিক্যাল কেমিষ্ট্রিতে পিএচডি ডিগ্রী সম্পূর্ণ করেন। সঙ্গে সঙ্গে ওখানে তিনি ইন্সট্রাক্টর (instructor) বা নির্দেশক রূপে যোগ দেন ও ১৯৪১ সালে সহ অধ্যাপক (assistant professor) পদে উন্নীত হন।

গবেষণা[সম্পাদনা]

রুবেন বার্কলে রেডিয়েশন ল্যাবরেটরিতে আর্নেস্ট ও. লরেন্সের অধীনে গবেষণা শুরু করেন। এখানে তার সহকর্মী ছিলেন মার্টিন কামেন। মার্টিন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএচডি। নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ও কেমিষ্ট্রি তার বিষয়। বার্কলেতে দুজনের গবেষণার বিষয়-বস্তু ছিল সালোক-সংশ্লেষের কার্য-প্রণালী (mechanism)। সাধারণ কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিবর্তে স্বল্পজীবি তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ কার্বন-১১ যুক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড প্রয়োগ করে তারা সালোক-সংশ্লেষের কার্য-প্রণালী (mechanism) বোঝার চেষ্টা করলেন। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত চলেছিল এই গবেষণা। এঁদের পরীক্ষালব্ধ ফল ও তার সঙ্গে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হপকিন্স মেরিন স্টেশনের সি বি ভ্যান নীলের (C. B. Van Niel) গবেষণা যুক্ত হয়ে এটা পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হল যে সূর্যের আলো ছাড়াও অন্ধকারে সালোক-সংশ্লেষ (dark photosynthesis) ঘটতে পারে। এই সালোক-সংশ্লেষ প্রক্রিয়া ব্যাক্ট্রিয়ার মধ্যে যে সব প্রক্রিয়া হয়, অনেকটা তার অনুরূপ। প্রায় এক শতক ধরে এই ধারণা চালু ছিল যে একমাত্র সূর্যের আলো ও ক্লোরোফিলের মাধ্যমেই সালোক-সংশ্লেষ হয়। তাছাড়া অ্যাডল্ফ্ ফন বায়ারের (Adolf von Bayer) এক তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে রিচার্ড উইলস্ট্যাটার (Richard Willstätter), আর্থার স্টল (Arthur Stoll)-এর মত বিজ্ঞানীরা বহু দশক ধরে সালোক-সংশ্লেষের অন্তর্বর্তী পদার্থ রূপে ফর্ম্যাল্ডিহাইড খুঁজে বেড়িয়েছেন। রুবেন-কামেনের পরীক্ষালব্ধ ফল অর্থাৎ অন্ধকারে সালোক-সংশ্লেষ ঘটার তত্ত্ব সেই ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করল।

বার্কলের রেডিয়েশন ল্যাবরেটরিতে ছিল একটা ৩৭-ইঞ্চি সাইক্লোট্রন। সেই সাইক্লোট্রনে বোরন-১০-এর সঙ্গে ডয়টেরিয়ামের বিক্রিয়া ঘটিয়ে কামেন তৈরী করতেন প্রচুর পরিমাণে কার্বন-১১ আইসোটোপ, আর ঐ কার্বন-১১ আইসোটোপ দিয়ে রুবেন করতেন শত-শত পরীক্ষা। কিছুদিনের মধ্যেই রুবেন ও কামেনের সংগে উদ্ভিদ-বিদ্যা, অণুজীবতত্ব (microbiology), শারীর-বিদ্যা ও জৈব-রসায়ন জগতের বহু বিজ্ঞানী সহযোগিতা-মূলক কাজ শুরু করলেন। এঁদের সকলেরই উদ্দেশ্য এক - এঁরা জানতে চান, উদ্ভিদ, সমুদ্র-শৈবাল শ্রেণী (algae) ও ব্যাক্ট্রিয়ার মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইড কোন পথে অর্থাৎ কীভাবে শর্করা (carbohydrate)-জাতীয় পদার্থে রূপান্তরিত হয়। অবশ্য প্রথমদিকে এঁরা কেউই কোন সুনির্দিষ্ট ফল পান নি - বরং যে সব ফল পাওয়া যাচ্ছিল তা ছিল অনেক সময় পরস্পর বিরোধী। এর মূল কারণ ছিল কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ  ও তার বিভিন্ন রূপান্তরের পথে নানা ধরনের প্রোটিন-যুক্ত অবশিষ্টাংশের উপস্থিতি, যে অবশিষ্টাংশগুলোকে ঠিক ভাবে শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। কিন্তু রুবেন ও কামেনের এই কাজ সারা বিশ্ব-জুড়ে উদ্দীপনার সৃষ্টি করল  - বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে বিপাকীয় ক্রিয়ার (metabolism) ওপর এত কাজ শুরু হল যে, অদূর ভবিষ্যতে জীব-রসায়ন (biochemistry) ও চিকিৎসা-বিদ্যায় এক বিপ্লবের সূত্রপাত হল।

এর পর রুবেন ভারী জল নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। ‘ভারী জল’ মানে এই জলের প্রতিটি অণুতে সাধারণ অক্সিজেন (16O) পরমাণুর জায়গায় 18O পরমাণু থাকে। অর্থাৎ এর আণবিক সংকেতঃ 1H218O । এই ভারী জল দিয়ে রুবেন সুনির্দিষ্ট ভাবে প্রমাণ করলেন যে সালোক-সংশ্লেষের ফলে যে  শর্করা উৎপন্ন হয়, তার সমস্ত অক্সিজেন জল থেকেই আসে, কার্বন ডাই অক্সাইডের কোন অক্সিজেন শর্করায় গ্রথিত হয় না।

ইতিমধ্যে বহু নিউক্লীয় পদার্থবিদ কার্বনের মধ্যে এক অপেক্ষাকৃত দীর্ঘজীবী আইসোটপের অস্তিত্বের কথা বলে আসছেন, কিন্তু আইসোটোপটিকে সঠিকভাবে ধরা ছোঁয়া যাচ্ছিল না। আইসোটোপটি কার্বন-১৪ (C-14)। রুবেন ও কামেন আইসোটোপটিকে সঠিকভাবে শনাক্ত করার জন্য নানা  রকমে চেষ্টা শুরু করলেন। অনেক ব্যর্থতার পর অবশেষে কামেন একদিন সাইক্লোট্রনে ১২০ ঘণ্টা ধরে গ্রাফাইটের ওপর ‘গোলাবর্ষণ’ করে যে অবশিষ্টাংশ পেলেন, মনে হল এটাই সেই প্রার্থিত বস্তু। সাইক্লোট্রন ও কেমিষ্ট্রি ডিপার্টমেন্টের মাঝখানে কাছেই ছিল রুবেনের ল্যাবরেটরী - ডাক নাম ‘Rat House’ (ইঁদুরের বাড়ি)। বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছিল। ঐ বৃষ্টির মধ্যে কামেন দৌড়লেন রুবেনের ল্যাবরেটরীতে।  কামেন যেমন নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে দক্ষ ছিলেন, রুবেন তেমনি দক্ষ ছিলেন রাসায়নিক বিশ্লেষণে। এর কয়েক দিন পরে ১৯৪০ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি সকাল আটটায় রুবেন সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করলেন যে কামেন সাইক্লোট্রন থেকে যে অবশিষ্টাংশ সংগ্রহ করেছেন তা কার্বন-১৪ আইসোটোপ এবং এই আইসোটোপটি তেজস্ক্রিয়।  পরবর্তী কালে কার্বন-১৪ আইসোটোপ ব্যবহার করে প্রত্নতত্বে, চিকিৎসা-বিদ্যা এবং বিজ্ঞানের নানা বিভাগে এত কাজ হয়েছে এবং এত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে যে স্যাম রুবেন ও মার্টিন কামেনের কার্বন-১৪ আবিষ্কার বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি বিশাল ঘটনা।

কার্বন-১৪ তো পাওয়া গেল, কিন্তু এটা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়াল এর দুর্বল তেজষ্ক্রিয়তা। কার্বন-১৪ থেকে যে বিটা-রশ্মি বিকীরণ হচ্ছিল, তা সহজে মাপা যাচ্ছিল না। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধ শুরু হল। সাইক্লোট্রনে আইসোটোপ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেল। ১৯৪২ সালে রুবেনের ডাক পড়ল অন্যত্র। যুদ্ধ-সংক্রান্ত অন্য-ধরনের গবেষণা করার জন্য রুবেন বার্কলে ছাড়লেন। এদিকে কামেনেরও ওপর এক বিপদ নেমে এসেছে।  নানা কারণে কামেনের ওপর কর্তৃপক্ষ সন্দেহ করতে লাগলেন, কামেনের ওপর গোপন নজরদারি শুরু হল, এবং কামেন বার্কলের চাকরি খোয়ালেন। রুবেন কার্বন-১৪-এর যথাযথ গুরুত্ব, বিশেষ করে সালোক-সংশ্লেষ সংক্রান্ত গবেষণায় এর প্রয়োজনীয়তা, বুঝতে পেরেছিলেন। তাই বার্কলে ছাড়ার সময় কেমিষ্ট্রি ডিপার্টমেন্টের আর এক ফ্যাকাল্টি অ্যাণ্ড্রু বেনসনকে তার কাছে সঞ্চিত কার্বন-১৪ যুক্ত সমস্ত বেরিয়াম কার্বনেট দিয়ে দেন। বেনসন এই কার্বন-১৪ দিয়ে সালোক-সংশ্লেষে কার্বনের পথ-নির্দেশ সম্পর্কিত বহু গবেষণা করেন। এই কার্বন-১৪ দিয়েই ১৯৪৯ সালে উইলার্ড লিবি (Willard Libby) তার বিখ্যাত তেজষ্ক্রিয় কার্বনের দ্বারা প্রাচীন বস্তুর বয়স নির্ধারণ পদ্ধতি (radiocarbon dating) উদ্ভাবন করেন, যার জন্য ১৯৬০ সালে লিবি নোবেল পুরস্কার পান।

এদিকে যুদ্ধ-সংক্রান্ত গবেষণায় রুবেন বিষাক্ত গ্যাস নিয়ে কাজ শুরু করেছেন এবং কিছুদিন পরে বার্কলেতে ফিরে এসেছেন। স্বল্পজীবি তেজস্ক্রিয় কার্বন-১১ আইসোটোপ দিয়ে অ্যাণ্ড্রু বেনসন তৈরী করেছেন ভয়ানক বিষাক্ত গ্যাস ফসজিন (11COCl2) । রুবেনের ইচ্ছে, ফুসফুসের প্রোটিনের ওপর এই গ্যাসের প্রভাব এবং কার্য-প্রণালী পরীক্ষা করবেন। ১৯৪৩-এর জুলাই মাসে বেনসন বার্কলে ছাড়লেন। তার প্রায় দু মাস পরে ঘটল ভয়ংকর দুর্ঘটনা। ২৭শে সেপ্টেম্বর ফসজিন নিয়ে কাজ করার সময় প্রচুর পরিমাণে ফসজিন স্যাম রুবেনের শরীরে ঢুকে গেল। পরদিন ১৯৪৩ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে স্যাম রুবেন মারা গেলেন।

স্যাম রুবেন যখন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আণ্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্র ছিলেন, তখন তার সহপাঠিনী ছিলেন হেলেনা কলিন্স ওয়েস্ট। শেষ সেমিস্টারে হেলেনাকে স্যাম বিয়ে করেন। সেটা ছিল ১৯৩৫ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর। তাদের তিনটি সন্তান - ডানা ওয়েস্ট রুবেন (জ.  ১৯৩৮, নভেম্বর ১১), জর্জ কলিন্স রুবেন (জ. ১৯৪১, এপ্রিল ২৯) এবং কনি মা রুবেন ফাৎ (Connie Mae Ruben Fatt) (জ. ১৯৪৩, জুন ১৮) ।  পরবর্তী কালে জর্জ কলিন্স রুবেন ডার্টমাউথ কলেজের অধ্যাপক হয়েছিলেন। [১]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Gest, Howard (২০০৪)। "Samuel Ruben's contributions to research on photosynthesis and bacterial metabolism with radioactive carbon" (পিডিএফ)Photosynthesis Research80 (1–3): 77–83। এসটুসিআইডি 12186280ডিওআই:10.1023/b:pres.0000030438.72496.2cপিএমআইডি 16328812 

Sources[সম্পাদনা]