স্বামী নিরঞ্জনানন্দ
স্বামী নিরঞ্জনানন্দ | |
---|---|
![]() ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে স্বামী নিরঞ্জনানন্দ | |
ব্যক্তিগত তথ্য | |
জন্ম | নিত্যরঞ্জন ঘোষ ১৮৬২ রাজারহাট বিষ্ণুপুর, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমানে রাজারহাট বিষ্ণুপুর, উত্তর চব্বিশ পরগনা পশ্চিমবঙ্গ ভারত) |
মৃত্যু | ৯ মে ১৯০৪ |
ধর্ম | হিন্দুধর্ম |
দর্শন | অদ্বৈত বেদান্ত |
ধর্মীয় জীবন | |
গুরু | রামকৃষ্ণ পরমহংস |
স্বামী নিরঞ্জনানন্দ বা নিরঞ্জন মহারাজ (১৮৬২ - ৯ মে ১৯০৪) ছিলেন রামকৃষ্ণ মিশনের অন্যতম প্রধান সন্ন্যাসী এবং রামকৃষ্ণের প্রত্যক্ষ সন্ন্যাসী শিষ্যের একজন। তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল নিত্য নিরঞ্জন ঘোষ এবং তাঁকে সাধারণত সংক্ষেপে নিরঞ্জন নামে ডাকা হত। শ্রীরামকৃষ্ণ যে কয়জন শিষ্যকে "নিত্যসিদ্ধ" বা "ঈশ্বরকোটি" অর্থাৎ "পূর্ণতাপ্রাপ্ত আত্মা" হিসাবে অভিহিত করেন তাঁদের অন্যতম ছিলেন নিরঞ্জনানন্দ।[১]
জীবনী
[সম্পাদনা]প্রারম্ভিক জীবন—
[সম্পাদনা]নিত্য নিরঞ্জন ঘোষ ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বাংলা প্রদেশের চব্বিশ পরগনা জেলার রাজারহাট-বিষ্ণুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রারম্ভিক জীবনের বিশদ তথ্য অপ্রতুল। তিনি তাঁর মাতুল কালীকৃষ্ণ মিত্রের সঙ্গে কলকাতায় থাকতেন। শৈশবে তিনি একদল আধ্যাত্মবাদীর সাথে যুক্ত হন এবং শেষে সফলতা লাভ করেন।[২]:১২৬ স্পষ্টবাদী এবং মুক্তমনা হওয়ার কারণে রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রিয় পাত্র ছিলেন। কোমল প্রকৃতির নিরঞ্জন বৈবাহিক জীবনের প্রতি ছিলেন উদাসীন। পরে নিরঞ্জন মুর্শিদাবাদ জেলায় একজন নীলকর সংগ্রাহকের চাকরি নেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাব—
[সম্পাদনা]
নিরঞ্জন আঠারো বছর বয়সে প্রথমবার রামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ পান। আধ্যাত্মবাদের প্রতি নিরঞ্জনের আগ্রহ বুঝে রামকৃষ্ণ তাকে ঈশ্বর চিন্তার পরামর্শ দেন এবং বলেন এর মধ্য দিয়েই তোমার জীবনে ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রকাশ ঘটবে। [২]:১২৭ পরে নিরঞ্জন দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ করলে রামকৃষ্ণ তাকে প্রশ্ন করেন, সময় তো অতিক্রান্ত হচ্ছে, তুমি কখন ঈশ্বরকে উপলব্ধি করবে?" নিরঞ্জন তার এই কথায় মুগ্ধ হন এবং তিনি রামকৃষ্ণের সাথে তার সম্পর্ক অব্যাহত রাখেন। একবার, নদীপথে নিরঞ্জনের দক্ষিণেশ্বরে যাত্রার সময়, নৌকায় কিছু সহযাত্রী রামকৃষ্ণ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করলে,নিরঞ্জন ক্রোধ সম্বরণ না পুরো নৌকা ডুবিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে রামকৃষ্ণ যখন এই বিষয়ে অবগত হন, তিনি নিরঞ্জনকে বোঝান—
"ক্রোধ একটি মারাত্মক পাপ, তুমি কেন এতে বশীভূত হবে? মূর্খ লোকেরা তাদের অনভিজ্ঞ অজ্ঞতায় অনেক কিছু বলে থাকেন, তাই বলে তাদের কথার কোনরূপ গুরুত্ব না দিয়ে তাদের সম্পূর্ণরূপে অবহেলা করা উচিত" ।
[২]:১৩০
নিরঞ্জনের অফিসে কাজ করাটা রামকৃষ্ণ পছন্দ করতেন না, কিন্তু যখন তিনি জানতে পারলেন যে, নিরঞ্জন তার বৃদ্ধা মায়ের ভরণপোষণের জন্য চাকরি নিয়েছেন, তখন তিনি তাতে সম্মতি জানান। [৩]
যখন রামকৃষ্ণ অসুস্থ হন এবং তাঁর ভক্তরা তাঁকে শ্যামপুকুরে রেখে দেখাশোনা করছেন, সে সময় নিরঞ্জন চাকরি ছেড়ে সেই বাড়ির দ্বাররক্ষীর কাজ শুরু করেন। তবে সেকালের রঙ্গমঞ্চের খ্যাতনামা অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসী ইউরোপীয় ভদ্রলোকের ছদ্মবেশ ধরে নিরঞ্জনকে বোকা বানিয়ে, অসুস্থ রামকৃষ্ণের সাথে দেখা করেন। পরে অবশ্য যখন রামকৃষ্ণকে কাশীপুর বাগানবাড়িতে স্থানান্তরিত করা হয়, তখন তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে দ্বাররক্ষীর দায়িত্ব পালন করেন। শ্রীরামকৃষ্ণের গুরুতর অসুস্থতার সময়ে তার দুজন গৃহী শিষ্য রামচন্দ্র দত্ত এবং গিরিশচন্দ্র ঘোষের ভ্রাতা অতুলচন্দ্র ঘোষকে প্রাঙ্গণে প্রবেশে বাধা দেন।
রামকৃষ্ণের দেহাবসানের পর, তাঁর শিষ্যদের মধ্যে দেহভস্ম সংরক্ষণ নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়, তা নরেন্দ্রনাথ (পরবর্তীতে স্বামী বিবেকানন্দ) এর সহায়তায় প্রশমিত হয়। নিরঞ্জন এবং শশী মহারাজ (পরবর্তীতে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ ) বেশিরভাগ দেহভস্ম একটি পৃথক কলসে সংরক্ষণ করেন এবং বলরাম বসুর বাড়িতে রাখেন। পরবর্তীতে সেটি বেলুড় মঠে সরিয়ে নেওয়া হয়।
সন্ন্যাস জীবন
[সম্পাদনা]১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে নিরঞ্জন অন্যান্য ভাই শিষ্যদের সাথে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন এবং রামকৃষ্ণ সংঘের সন্ন্যাসীদের প্রথম আবাসস্থল বরানগর মঠে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। বিবেকানন্দ তাঁকে স্বামী নিরঞ্জনানন্দ (নিরঞ্জন - নির্দোষ বা নির্দোষ ব্যক্তি, এবং আনন্দ - পরমানন্দ) সন্ন্যাস নাম দেন। মঠে তিনি ছিলেন শারীরিকভাবে বেশ সক্ষম এবং তাই বেশিরভাগ শ্রমসাধ্য কাজ করতেন। তিনি পুরী ভ্রমণ করেন এবং ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে ফিরে আসেন। তিনি পুরাতন মঠ বাড়িতে গুরুদেবের জন্য একটি বেদী তৈরি করেন এবং কাশীপুরে যেখানে রামকৃষ্ণকে দাহ করা হয়েছিল সেখানে একটি বেল গাছও রোপণ করেন এবং গাছের চারপাশে একটি বেদী তৈরি করেন। ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে তিনি দেওঘরে তীর্থযাত্রায় বের হন এবং বংশী দত্তের বাগান বাড়িতে ভিক্ষা করে জীবনযাপন করেন। তিনি প্রয়াগে ( প্রয়াগরাজ ) যান, ভারতের বিভিন্ন অংশ ভ্রমণ করে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে যান। কিছু সময়ের জন্য তিনি সেখানে ধর্ম প্রচারক হিসেবে বসবাস করেন এবং তাঁর গুরুর আদর্শ শিক্ষা দেন। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে, তিনি রামকৃষ্ণের জন্মদিনের আগে আলমবাজার মঠে ফিরে আসেন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দের প্রত্যাবর্তনের সময় নিরঞ্জনানন্দ তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে কলম্বো যান। তিনি স্বামী বিবেকানন্দের সাথে সমগ্র উত্তর ও দক্ষিণ ভারত ভ্রমণ করেন। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে, তিনি আলমোড়ায় যান এবং সেখানে শুদ্ধানন্দকে (সুধীর মহারাজ) দীক্ষা দেন। এরপর তিনি বারাণসীতে যান এবং ভিক্ষা করে জীবনযাপন করেন। তিনি একদল যুবককে সেবা ও ত্যাগের পথ অনুসরণ করতে অনুপ্রাণিত করেন, যারা পরে সেবার আশ্রম সংগঠিত করেন।

পরে তিনি হরিদ্বারের কাছে কনখলে যান এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং চিকিৎসার জন্য কলকাতায় ফিরে আসেন। সুস্থ হয়ে ওঠার পর, পুনরায় তিনি বারাণসীতে ফিরে যান, সেখানে বিবেকানন্দের সাথে দেখা করেন। বিবেকানন্দের অসুস্থতার সময় তিনি আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন এবং শেষের দিনগুলিতে তিনি তাঁর দ্বাররক্ষী ছিলেন, ভক্তদের ভিড় করতে এবং তাঁর ঘরে অসুস্থ বিবেকানন্দকে বিরক্ত করতে বাধা দিতেন। বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর, তিনি হরিদ্বারে ফিরে আসেন। শেষের দিনগুলিতে নিরঞ্জনানন্দ দীর্ঘস্থায়ী আমাশয়ে ভুগছিলেন। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের ৯ মে তিনি হরিদ্বারে মারা যান।
শ্রীশ্রীমা'য়ের সাথে—
[সম্পাদনা]নিরঞ্জনানন্দ, তার সতীর্থ গুরুভাইদের মতো, সারদা দেবীকে অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতেন। তাঁকে "মা" "মা" ধ্বনিতেই ডাকতেন। গিরিশচন্দ্র ঘোষ যখন বিষণ্ণতার মাঝে শোকসন্তপ্ত ছিলেন, তখন তিনি তাকে জয়রামবাটিতে শ্রীমা'র কাছে নিয়ে যান। মৃত্যুর আগে, তিনি শ্রীমা'র সাথে শেষ বারের মত দেখা করতে এসে অবোধ শিশুর মত মার চরণে লুটিয়ে পড়েন এবং আকুল ক্রন্দনে ভেঙ্গে পড়েন। সেই সঙ্গে আবদার করেন মা যেন সদাসর্বদা অনুক্ষণ তাঁর সঙ্গে থাকেন। শ্রীমা'র আশীর্বাদ আর সম্মতি লাভ করে নিরঞ্জনানন্দ হরিদ্বার যাত্রা করেন।[৩][৪]
চরিত্র এবং উত্তরাধিকার—
[সম্পাদনা]রামকৃষ্ণের মতে, নিরঞ্জন ছিলেন "নিত্যসিদ্ধ" বা "ঈশ্বরকোটি" অর্থাৎ 'পবিত্র আত্মা'। ঈশ্বর উপলব্ধি তাঁর পক্ষে সহজ ছিল।[৩] শ্রীশ্রী মায়ের ছিলেন বীর সন্তান। তার বীর ভাবে পরিচয় মেলে কাশীপুর উদ্যানবাটীতে এবং পরবর্তীতে বেলুড় মঠে। শ্রীরামকৃষ্ণের এবং স্বামী বিবেকানন্দের পীড়িতাবস্থায়, দ্বাররক্ষীর ভূমিকায় সেবক নিরঞ্জনানন্দ স্মরণীয় হয়ে আছেন।[৪] তাঁর সহযোগী অচলানন্দ (কেদার মহারাজ) এর স্মৃতিকথা এবং অন্যান্য ভ্রাতৃপ্রেমীদের বর্ণনা অনুসারে , নিরঞ্জন তাঁর সরলতা, সত্যবাদিতা, পবিত্রতা, নির্ভীকতা, স্থিরতা (নীতিগত যেকোনো বিষয়ে) এবং ত্যাগের জন্য পরিচিত ছিলেন। তিনি একবার তাঁর ভ্রাতৃপ্রেমিক সারদা মহারাজকে ( স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ) জলে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করেন। তিনি বিবেকানন্দের নির্দেশে জনহিতকর ও দাতব্য কাজ শুরু করেছিলেন এবং পরে বারাণসীতে সেবাশ্রম বা রামকৃষ্ণ মিশন হোম অফ সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করেন যুবকদের সংসার ত্যাগ করে দরিদ্রদের সেবা করার জন্য অনুপ্রাণিত করে। তহবিলের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও, একজন ধনী ব্যক্তি যখন তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন তখন তিনি তাঁর অনেক ভ্রাতৃপ্রেমিকদের দান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি তাঁর অনেক ভ্রাতৃপ্রেমিককে, যার মধ্যে যোগানন্দও ছিলেন, অসুস্থ হলে তাদের সেবা করতেন। তিনি রামকৃষ্ণকে মানবরূপে অসীম ঈশ্বর হিসেবে বিশ্বাস করতেন, আচার-অনুষ্ঠানের উপর খুব বেশি জোর দিতেন না এবং সেবার মতবাদে বিশ্বাস করতেন।
২০২৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ এপ্রিল বিষ্ণুপুর ঘোষপাড়ায় অবস্থিত রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের রাজারহাট-বিষ্ণুপুর শাখাকেন্দ্রে স্বামী নিরঞ্জনানন্দের মর্মরমূর্তির আবরণ উন্মোচন করেন রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী গৌতমানন্দ মহারাজ।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "Swami Niranjanananda, RMIC"। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ জুলাই ২০১১।
- ↑ ক খ গ The Disciples of Sri Ramakrishna, published by Advaita Ashram, Mayawati, 1943.
- ↑ ক খ গ "God Lived with Them", by Chetanananda, published by Advaita Ashrama, 1997, page 243
- ↑ ক খ স্বামী, লোকেশ্বরানন্দ (২০১৯)। শতরূপে সারদা। রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার, কলকাতা। পৃষ্ঠা ১২১ –১২৪। আইএসবিএন 978-818584-311-7।