বিষয়বস্তুতে চলুন

স্ফটিক কাঠামো

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
সোডিয়াম ক্লোরাইড (লবণ)–এর স্ফটিক কাঠামো (বেগুনি: সোডিয়াম, সবুজ: ক্লোরিন)

স্ফটিকবিদ্যায়, স্ফটিক কাঠামো বলতে বোঝানো হয় একটি স্ফটিকজাত পদার্থের মধ্যে পরমাণু, আয়ন বা অণুসমূহের সুশৃঙ্খল ও নিয়মিত বিন্যাস।[] এই ধরনের নিয়মিত বিন্যাস ঘটে পদার্থের কণাগুলোর অন্তর্নিহিত ধর্মের কারণে, যা ত্রিমাত্রিক স্থানে (three-dimensional space) নির্দিষ্ট দিক বরাবর পুনরাবৃত্ত সুষম গঠন তৈরি করে।

স্ফটিক কাঠামোর এই পুনরাবৃত্ত গঠনের ক্ষুদ্রতম একক অংশকে বলা হয় একক কোষ (unit cell)। একক কোষটি পুরো স্ফটিকের গঠন ও সুষমতা প্রতিফলিত করে এবং এটি বারবার অনুবাদ (translation) করে মূল অক্ষে বিস্তৃত হয়ে সম্পূর্ণ স্ফটিক গঠন করে। এই অনুবাদ ভেক্টরগুলো ব্রাভাই জালিকা (Bravais lattice)-এর কেন্দ্রবিন্দুগুলিকে সংজ্ঞায়িত করে।

একক কোষের মূল অক্ষ/ধারগুলোর দৈর্ঘ্য এবং তাদের পরস্পরের মধ্যেকার কোণগুলোকে জালিকা ধ্রুবক (lattice constant) বলা হয়, যাকে কখনো কখনো ল্যাটিস প্যারামিটার বা কোষ প্যারামিটার বলেও অভিহিত করা হয়। স্ফটিকের সুষমতা স্পেস গ্রুপ (space group) নামক ধারণার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়।[] ত্রিমাত্রিক স্থানে কণাগুলোর সম্ভাব্য সব সুষম বিন্যাসকে ২৩০টি স্পেস গ্রুপের মাধ্যমে বর্ণনা করা যায়।

স্ফটিক কাঠামো ও তার সুষম বৈশিষ্ট্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভৌত ধর্ম যেমন চিঁড় ধারা (cleavage), ইলেকট্রনিক ব্যান্ড গঠন (electronic band structure), এবং আলোকীয় স্বচ্ছতা (optical transparency)-র ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।

একক কোষ

[সম্পাদনা]

স্ফটিক কাঠামো বর্ণনা করা হয় একক কোষের অভ্যন্তরে কণাগুলোর জ্যামিতিক বিন্যাসের মাধ্যমে। একক কোষকে সংজ্ঞায়িত করা হয় স্ফটিক কাঠামোর পূর্ণ সুষমতা ধারণকারী সবচেয়ে ছোট পুনরাবৃত্ত একক হিসেবে।[] একক কোষের জ্যামিতিক রূপ একটি প্যারালেলোপিপেড আকারে বিবেচিত হয়, যার ছয়টি জালিকা পরামিতি (lattice parameters) রয়েছে — তিনটি প্রান্তের দৈর্ঘ্য (a, b, c) এবং সেগুলির মধ্যবর্তী কোণ (α, β, γ)।

একক কোষের অভ্যন্তরে কণাগুলোর অবস্থান বর্ণনা করা হয় ভগ্নাংশ আকারের স্থানাঙ্ক (xi, yi, zi) দ্বারা, যা কোষের প্রান্ত বরাবর একটি নির্দিষ্ট রেফারেন্স বিন্দু থেকে পরিমাপ করা হয়। ফলে শুধুমাত্র কণাগুলোর একটি ক্ষুদ্রতম অসাম্য অংশের স্থানাঙ্ক জানালেই চলে, যাকে বলা হয় স্ফটিকীয় অসমমিত একক (crystallographic asymmetric unit)। এই অসমমিত একক এমনভাবে নির্ধারণ করা যায় যাতে এটি সবচেয়ে কম জায়গা দখল করে; অর্থাৎ, সব কণাই জালিকা পরামিতি দ্বারা নির্ধারিত সীমানার মধ্যে অবস্থিত না-ও থাকতে পারে। একক কোষের বাকি কণাগুলো সংশ্লিষ্ট সুষমতা অপারেশন দ্বারা নির্ণীত হয়, যা কোষের সুষমতা নির্ধারণ করে। একক কোষের এই সব সুষমতা অপারেশনসমষ্টিকে স্পেস গ্রুপ (space group) নামে প্রকাশ করা হয়।[]

মিলার সূচক

[সম্পাদনা]
ঘনক স্ফটিকে বিভিন্ন মিলার সূচক সম্বলিত তল

স্ফটিক জালিকায় রেখা ও তলগুলোর অবস্থান বর্ণনা করা হয় তিনটি সংখ্যার মিলার সূচক (Miller indices) ব্যবহারে। এতে h, k, এবং প্রতীকগুলো ব্যবহার করা হয় দিকনির্দেশক পরামিতি হিসেবে।[]

(hkℓ) দ্বারা চিহ্নিত একটি তল সেই বিন্দুগুলোকে ছেদ করে যেগুলোর স্থানাঙ্ক a1/h, a2/k, এবং a3/ (বা এর গুণিতক)। অর্থাৎ, মিলার সূচকগুলো হল সেই তলের সঙ্গে একক কোষের ছেদবিন্দুগুলোর বিপরীতার (inverse) সমানুপাতিক। সূচকের মান শূন্য হলে বোঝায় যে তলটি সেই অক্ষ ছেদ করে না (অর্থাৎ ছেদ "অনন্তে")। কোনো তল যদি কোনো অক্ষের মধ্য দিয়ে যায়, তাহলে সূচক নির্ধারণের আগে সেই তলটিকে স্থানান্তর করে অক্ষটি বাদ দেওয়া হয়। সূচকগুলো এমন পূর্ণসংখ্যা হয় যেগুলোর মধ্যে কোনো সাধারণ গুণিতক থাকে না। ঋণাত্মক সূচকগুলি অনুভূমিক দাগ দিয়ে প্রকাশ করা হয়, যেমন: (1̅23)। ঘনক কোষের কার্তেসীয় স্থানাঙ্ক ব্যবস্থায় এই সূচকগুলো সেই তলের লম্ব দিকের ভেক্টরের উপাদান হিসেবে কাজ করে।

যদি মিলার তলগুলো জালিকার এক বা একাধিক বিন্দু ছেদ করে (অর্থাৎ তারা জালিকা তল), তাহলে এই তলগুলোর মধ্যকার দূরত্ব d ও তাদের সঙ্গে লম্ব রিসিপ্রোকাল ল্যাটিস (reciprocal lattice) ভেক্টরের সম্পর্ক:

তল ও দিক

[সম্পাদনা]

স্ফটিকীয় দিক (crystallographic directions) বলতে বোঝানো হয় এমন জ্যামিতিক রেখা, যা একটি স্ফটিকের কণাগুলিকে (যেমন: পরমাণু, আয়ন বা অণু) সংযুক্ত করে। অনুরূপভাবে, স্ফটিকীয় তল বলতে বোঝানো হয় এমন জ্যামিতিক তল যা কণাগুলিকে সংযুক্ত করে। কিছু নির্দিষ্ট দিক ও তলে কণার ঘনত্ব বেশি থাকে এবং এই ঘনত্ব স্ফটিকের নিম্নলিখিত ধর্মগুলির ওপর প্রভাব ফেলে:[]

  • আলোর ধর্ম: প্রতিসরণাঙ্ক কণার ঘনত্ব (বা ঘনত্বের পর্যায়ক্রমিকতার) সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত।
  • শোষণরসায়নিক ক্রিয়াশীলতা: পদার্থের পৃষ্ঠের আশেপাশের কণার সঙ্গে শারীরিক শোষণ ও রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া ঘটে, তাই এসব ধর্ম কণার ঘনত্বের ওপর নির্ভরশীল।
  • পৃষ্ঠটান: পদার্থ ঘনীভূত হলে কণাগুলি তাদের চারপাশে অন্যান্য অনুরূপ কণার উপস্থিতিতে স্থিতিশীল থাকে, তাই পৃষ্ঠটানও ঘনত্ব অনুসারে পরিবর্তিত হয়।
সঘন স্ফটিকীয় তল

কিছু দিক ও তল স্ফটিক ব্যবস্থার সুষমতা দ্বারা নির্ধারিত হয়। যেমন: একোণিক (monoclinic), ত্রিকোণিক (trigonal), চতুর্ভুজীয় (tetragonal), ও ষড়ভুজীয় (hexagonal) সিস্টেমে একটি অনন্য অক্ষ থাকে (যাকে মাঝে মাঝে প্রধান অক্ষ বলা হয়), যা অন্যান্য দুই অক্ষের তুলনায় উচ্চতর ঘূর্ণন সুষমতা ধারণ করে। এই সিস্টেমগুলোতে ভিত্তি তল (basal plane) হল সেই তল যা প্রধান অক্ষের লম্ব।

তবে ত্রিকোণিক, অর্থোরহম্বিক (orthorhombic), এবং ঘনক (cubic) সিস্টেমে অক্ষ নির্বাচন স্বেচ্ছাধীন এবং এখানে কোনো নির্দিষ্ট প্রধান অক্ষ থাকে না।

ঘনক কাঠামো

[সম্পাদনা]

সরল ঘনক স্ফটিকের ক্ষেত্রে, জালিকা ভেক্টরগুলো একে অপরের লম্ব এবং দৈর্ঘ্যে সমান (সাধারণত a দ্বারা চিহ্নিত); রিসিপ্রোকাল জালিকাও একই রকম। এই ক্ষেত্রে মিলার সূচকগুলো (ℓmn) ও [ℓmn] কার্তেসীয় স্থানাঙ্ক ব্যবস্থায় তলের লম্ব দিক ও দিকনির্দেশনা প্রকাশ করে। এই অবস্থায় (ℓmn) তলের মধ্যকার দূরত্ব d হয়:

ঘনক স্ফটিকের সুষমতার কারণে সূচকগুলোর স্থান বা চিহ্ন পরিবর্তন করলেও সমতুল্য দিক ও তল পাওয়া যায়:

  • কোণ বন্ধনী (angle brackets) যেমন ⟨100⟩ দ্বারা বোঝানো হয় এক শ্রেণির দিক, যেমন [100], [010], [001] বা এগুলোর ঋণাত্মক দিক।
  • বক্র বন্ধনী (curly brackets) যেমন {100} বোঝায় তলের একটি শ্রেণি, যেগুলো সুষমতা অপারেশনের ফলে সমতুল্য।

মুখকেন্দ্রিক ঘনক (fcc) ও কেন্দ্রস্থিত ঘনক (bcc) ল্যাটিসে মৌলিক জালিকা ভেক্টরগুলো একে অপরের লম্ব নয়। তবে, এই ক্ষেত্রেও মিলার সূচকগুলো ঘনক সুপারসেলের ভেক্টর অনুযায়ী নির্ধারিত হয় এবং তাই এগুলোও কার্তেসীয় নির্দেশনার প্রতিফলন করে।

আন্তঃতলীয় ব্যবধান

[সম্পাদনা]

(hkℓ) তলগুলোর মধ্যকার দূরত্ব d নিচের সূত্রগুলো অনুসারে নির্ধারিত হয়:[][]

  • Cubic (ঘনক):
  • Tetragonal (চতুর্ভুজীয়):
  • Hexagonal (ষড়ভুজীয়):
  • Rhombohedral (ত্রিকোণিক – প্রিমিটিভ সেটিং):
  • Orthorhombic (অর্থোরহম্বিক):
  • Monoclinic (একোণিক):
  • Triclinic (ত্রিকোণিক):

সুষমতার ভিত্তিতে শ্রেণিবিন্যাস

[সম্পাদনা]

একটি স্ফটিকের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল এর অন্তর্নিহিত সুষমতা। কিছু নির্দিষ্ট সুষমতা অপারেশন স্ফটিক জালিকার ওপর প্রয়োগ করলে সেটি অপরিবর্তিত থাকে। সব স্ফটিকেই তিনটি দিক বরাবর অনুবাদীয় সুষমতা (translational symmetry) থাকে, তবে অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সুষমতা উপাদানও দেখা যায়। যেমন, কোনো নির্দিষ্ট অক্ষ বরাবর স্ফটিককে ১৮০° ঘুরিয়ে দিলে যদি পরমাণুগুলোর বিন্যাস মূল বিন্যাসের মতোই থাকে, তাহলে একে ঐ অক্ষ বরাবর দ্বিগুণ ঘূর্ণন সুষমতা (twofold rotational symmetry) বলা হয়।

ঘূর্ণন সুষমতা ছাড়াও কোনো স্ফটিকে প্রতিফলন তল (mirror planes) থাকতে পারে, আবার এমন যৌগিক সুষমতাও (compound symmetries) থাকতে পারে যা অনুবাদ এবং ঘূর্ণন বা প্রতিফলনের সংমিশ্রণ। একটি স্ফটিকের সম্পূর্ণ শ্রেণিবিন্যাস তখনই সম্পন্ন হয়, যখন তার সব অন্তর্নিহিত সুষমতা চিহ্নিত করা হয়।[]

জালিকা পদ্ধতি

[সম্পাদনা]

জালিকা পদ্ধতিতে স্ফটিক কাঠামোকে তাদের বিন্দু গুচ্ছের (point group) ভিত্তিতে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। সব স্ফটিকই সাতটি জালিকা পদ্ধতির একটির মধ্যে পড়ে। এরা স্ফটিক পদ্ধতির (crystal system) সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও এক নয়।

সাধারণ জালিকা পদ্ধতির সংক্ষিপ্তসার
স্ফটিক পরিবার জালিকা পদ্ধতি বিন্দু গুচ্ছ
(Schönflies নির্দেশনা)
১৪টি ব্রাভাই জালিকা
প্রিমিটিভ (P) ভিত্তিকেন্দ্রিক (S) দেহকেন্দ্রিক (I) মুখকেন্দ্রিক (F)
ত্রিকোণিক Ci aP
একোণিক C2h mP mS
অর্থোরহম্বিক D2h oP oS oI oF
চতুর্ভুজীয় D4h tP tI
ষড়ভুজীয় রম্বহেড্রাল D3d hR
ষড়ভুজীয় D6h hP
ঘনক Oh cP cI cF

ঘনক বা সমমাত্রিক পদ্ধতিটি সর্বোচ্চ সুষম। এই পদ্ধতিতে একটি ঘনের চারটি তিনগুণ ঘূর্ণন অক্ষ (threefold rotation axes) থাকে, যেগুলো ঘনের দেহ-ব্যাস বরাবর এবং একে অপরের সাথে ১০৯.৫° কোণে (যা টেট্রাহেড্রাল কোণ নামে পরিচিত) অবস্থিত। বাকি ছয়টি জালিকা পদ্ধতি হল: ষড়ভুজীয়, চতুর্ভুজীয়, রম্বহেড্রাল, অর্থোরহম্বিক, একোণিকত্রিকোণিক

ব্রাভাই জালিকা

[সম্পাদনা]

ব্রাভাই জালিকা (Bravais lattice), যাকে কখনও "স্পেস ল্যাটিস"ও বলা হয়, স্ফটিকের জালিকা বিন্দুগুলোর জ্যামিতিক বিন্যাস এবং অনুবাদীয় সুষমতা বর্ণনা করে। তিনটি মাত্রার ভেতরে ১৪টি ভিন্ন ব্রাভাই জালিকা রয়েছে, যা সকল স্ফটিকজাত পদার্থের (কোয়াসিক্রিস্টাল বাদে) শ্রেণিবিন্যাস নির্ধারণ করে।

স্ফটিক কাঠামো গঠিত হয় একটি নির্দিষ্ট পরমাণু বা পরমাণুগুচ্ছ (যাকে "বেসিস" বলা হয়) প্রতিটি জালিকা বিন্দুর চারপাশে সাজিয়ে। এই বেসিস তিনমাত্রিকভাবে প্রতিটি জালিকা বিন্দু বরাবর পুনরাবৃত্ত হয়। একক কোষের ঘূর্ণন ও প্রতিফলন সুষমতা বিন্দু গুচ্ছের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।

স্ফটিক পদ্ধতি

[সম্পাদনা]

একটি স্ফটিক পদ্ধতি হল একটি বিন্দু গুচ্ছসমষ্টি যার প্রতিটি বিন্দু গুচ্ছ ও সংশ্লিষ্ট স্পেস গ্রুপ একটি নির্দিষ্ট জালিকা পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত। তিনমাত্রিক স্থানে মোট ৩২টি বিন্দু গুচ্ছ রয়েছে, যাদের অধিকাংশই একটি মাত্র জালিকা পদ্ধতিতে পড়ে, এবং সেইক্ষেত্রে স্ফটিক পদ্ধতি ও জালিকা পদ্ধতির নাম একই হয়। তবে পাঁচটি বিন্দু গুচ্ছ একই সাথে রম্বহেড্রাল ও ষড়ভুজীয় উভয় জালিকায় পড়ে, কারণ এদের উভয় পদ্ধতিতেই তিনগুণ ঘূর্ণন সুষমতা বিদ্যমান। এই গুচ্ছগুলো ত্রিকোণিক স্ফটিক পদ্ধতির অন্তর্গত।


সব মিলিয়ে সাতটি স্ফটিক পদ্ধতি রয়েছে: ত্রিকোণিক, একোণিক, অর্থোরহম্বিক, চতুর্ভুজীয়, ত্রিকোণিক, ষড়ভুজীয় এবং ঘনক।

বিন্দু গুচ্ছ

[সম্পাদনা]

স্ফটিকীয় বিন্দু গুচ্ছ বা স্ফটিক শ্রেণি (crystal class) হল সেই গাণিতিক গুচ্ছ যা বিভিন্ন সুষমতা অপারেশন নিয়ে গঠিত — যেগুলো কমপক্ষে একটি বিন্দুকে স্থির রাখে এবং স্ফটিক কাঠামোর দৃশ্যগত রূপ অপরিবর্তিত রাখে। এই অপারেশনগুলো হল:

  • প্রতিফলন — একটি তল বরাবর কাঠামোকে প্রতিফলিত করে।
  • ঘূর্ণন — একটি অক্ষ বরাবর কাঠামোকে নির্দিষ্ট কোণে ঘোরায়।
  • উলটন (inversion) — প্রতিটি বিন্দুর স্থানাঙ্ককে একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রবিন্দুর চারপাশে উল্টে দেয়।
  • অপ্রকৃত ঘূর্ণন (improper rotation) — একটি অক্ষ বরাবর ঘূর্ণনের পর একটি উলটন প্রয়োগ করা হয়।

ঘূর্ণন অক্ষ (সাধারণ ও অপ্রকৃত উভয়), প্রতিফলন তল এবং কেন্দ্রবিন্দুগুলো একত্রে সুষমতা উপাদান (symmetry elements) নামে পরিচিত। মোট ৩২টি স্ফটিক শ্রেণি রয়েছে এবং প্রতিটি একটি নির্দিষ্ট স্ফটিক পদ্ধতির অন্তর্গত।

স্থান গুচ্ছ

[সম্পাদনা]

বিন্দু গুচ্ছের অপারেশন ছাড়াও, স্থান গুচ্ছ (space group)–এ স্ফটিক কাঠামোর অনুবাদীয় সুষমতার অপারেশন অন্তর্ভুক্ত থাকে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • পরিপূর্ণ অনুবাদ — একটি বিন্দুকে একটি ভেক্টরের বরাবর সরিয়ে দেয়।
  • স্ক্রু অক্ষ (screw axis) — একটি বিন্দুকে একটি অক্ষ বরাবর ঘূর্ণন করে সেই অক্ষ বরাবর অনুবাদ করে।[]
  • গ্লাইড তল (glide plane) — একটি বিন্দুকে একটি তলের মধ্যে প্রতিফলিত করে এবং সেই তল বরাবর অনুবাদ করে।[]

মোট ২৩০টি স্বতন্ত্র স্থান গুচ্ছ (space group) রয়েছে।

পরমাণুর সমন্বয় (Atomic coordination)

[সম্পাদনা]

একটি স্ফটিক কাঠামোতে পরমাণুগুলোর পারস্পরিক অবস্থান, তাদের সমন্বয় সংখ্যা (coordination number), আন্তঃপরমাণবিক দূরত্ব, বন্ধনের ধরন ইত্যাদি বিবেচনা করে কাঠামোর একটি সামগ্রিক ধারণা পাওয়া যায় এবং এসব কাঠামো ভিজুয়ালাইজ করার বিকল্প পদ্ধতিও নির্ধারণ করা যায়।[]

ঘন প্যাকিং

[সম্পাদনা]
বামদিকে: HCP ল্যাটিস, ডানদিকে: CCP ল্যাটিস

এই ধারণা বোঝার জন্য সমান আকারের গোলকসমূহকে সবচেয়ে দক্ষভাবে কীভাবে জায়গা করে সাজানো যায় এবং তিনমাত্রায় ঘনভাবে প্যাক করা পরমাণবিক তল (close-packed planes) কিভাবে স্তরে স্তরে সাজানো হয়, তা বিশ্লেষণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি A তলটি B তলের নিচে থাকে, তাহলে B-এর ওপর একটি নতুন পরমাণু বসানোর দুটি সম্ভাব্য পদ্ধতি থাকে। যদি নতুন স্তরটি সরাসরি A-এর ওপর স্থাপন করা হয়, তাহলে এই রকম একটি পুনরাবৃত্ত ক্রম দেখা যায়:

...ABABABAB...

এই গঠনকে বলা হয় ষড়ভুজীয় ঘন প্যাকিং (hcp)

অন্যদিকে, যদি তিনটি স্তর একে অপরের থেকে সরানো থাকে এবং পুনরাবৃত্তি চতুর্থ স্তরে গিয়ে ঘটে, তাহলে এই রকম একটি ক্রম দেখা যায়:

...ABCABCABC...

এই গঠনকে বলা হয় ঘনক ঘন প্যাকিং (ccp)

CCP গঠনের একক কোষ হল মুখকেন্দ্রিক ঘনক (face-centered cubic বা FCC)। যদিও এটি প্রথমে স্পষ্ট নাও হতে পারে, ঘন প্যাক তলগুলো FCC কোষের {111} তলের সমান্তরাল। ঘন প্যাক স্তরের চারটি ভিন্ন বিন্যাস দেখা যায়।

পারমাণবিক প্যাকিং ফ্যাক্টর (APF) ও সমন্বয় সংখ্যা (CN)

[সম্পাদনা]

স্ফটিক কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এর পারমাণবিক প্যাকিং ফ্যাক্টর (APF)। একে হিসাব করা হয় এই ধরে নিয়ে যে সব পরমাণু সমান আকারের গোলক এবং প্রতিটি গোলক তার পাশের গোলকের সঙ্গে সংস্পর্শে রয়েছে। APF হল এককে কোষে গোলকগুলোর দ্বারা দখল করা স্থানভাগ, এবং তা নিম্নলিখিতভাবে নির্ধারিত হয়:

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল সমন্বয় সংখ্যা (Coordination number বা CN)। এটি হলো একটি কেন্দ্রীয় পরমাণুর সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী পরমাণুর সংখ্যা।

সাধারণ কিছু স্ফটিক কাঠামোর APF এবং CN নিচে দেখানো হয়েছে:

স্ফটিক কাঠামো পারমাণবিক প্যাকিং ফ্যাক্টর (APF) সমন্বয় সংখ্যা
(জ্যামিতি)
ডায়মন্ড ঘনক ০.৩৪ ৪ (টেট্রাহেড্রন)
সরল ঘনক ০.৫২[১০] ৬ (অক্টাহেড্রন)
দেহকেন্দ্রিক ঘনক (BCC) ০.৬৮[১০] ৮ (ঘনক)
মুখকেন্দ্রিক ঘনক (FCC) ০.৭৪[১০] ১২ (কিউবোক্টাহেড্রন)
ষড়ভুজীয় ঘন প্যাকিং (HCP) ০.৭৪[১০] ১২ (ত্রিভুজাকার অর্থোবিকুপোলা)

FCC ও HCP কাঠামোর ৭৪% প্যাকিং দক্ষতা এক আকারের গোলক দ্বারা গঠিত একক কোষে সম্ভব সর্বোচ্চ ঘনত্ব।

আন্তঃস্থানীয় স্থান (Interstitial sites)

[সম্পাদনা]
FCC জালিকায় অক্টাহেড্রাল (লাল) ও টেট্রাহেড্রাল (নীল) আন্তঃস্থানীয় স্থান

আন্তঃস্থানীয় স্থান বলতে বোঝানো হয় স্ফটিক জালিকার পরমাণুগুলোর মাঝে ফাঁকা জায়গাগুলো। এই ফাঁকাগুলো বিপরীত চার্জযুক্ত আয়ন দ্বারা পূরণ করে বহু উপাদানবিশিষ্ট কাঠামো তৈরি করা যায়। এছাড়া এসব জায়গায় অভিকূট পরমাণু (impurity atoms) বা স্ব-আন্তঃস্থানীয় পরমাণুও থাকতে পারে, যা আন্তঃস্থানীয় ত্রুটি তৈরি করে।

ত্রুটি ও অমিশ্রণ (Defects and impurities)

[সম্পাদনা]

বাস্তব স্ফটিক কাঠামোতে উপরের বর্ণিত আদর্শ বিন্যাসের তুলনায় বিভিন্ন ত্রুটি বা অনিয়ম দেখা যায়, এবং এই ত্রুটিগুলিই প্রকৃত পদার্থের অনেক বৈদ্যুতিক ও যান্ত্রিক ধর্ম নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অমিশ্রণ (Impurities)

[সম্পাদনা]

যখন একটি ভিন্ন পরমাণু স্ফটিক কাঠামোর প্রধান পরমাণুর জায়গায় প্রতিস্থাপিত হয়, তখন পদার্থের বৈদ্যুতিক ও তাপীয় ধর্মে পরিবর্তন দেখা দিতে পারে।[১১] কিছু পদার্থে অমিশ্রণ ইলেকট্রন স্পিন (electron spin) অমিশ্রণ হিসেবেও উপস্থিত থাকতে পারে।

চৌম্বক অমিশ্রণ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে যে, সামান্য পরিমাণে অমিশ্রণ থাকলেও পদার্থের নির্দিষ্ট কিছু ধর্ম, যেমন নির্দিষ্ট তাপ (specific heat), উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন, আধা-পরিবাহী চৌম্বক অ্যালয়-এ অল্প পরিমাণ অমিশ্রণের উপস্থিতি সত্ত্বেও বিভিন্ন ধরনের ধর্ম প্রকাশ পেতে পারে, যা প্রথম ১৯৬০-এর দশকে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল।[১২][১৩]

স্ফটিক বিচ্যুতি (Dislocations)

[সম্পাদনা]

স্ফটিক জালিকায় বিচ্যুতি হলো একটি রেখীয় ত্রুটি, যা স্থানীয় চাপক্ষেত্র (stress field)-এর সঙ্গে যুক্ত। এই বিচ্যুতিগুলো কাপন চাপ (shear stress) কম প্রয়োগ করেই স্ফটিক কাঠামোর ভেতর সঞ্চালনের সুযোগ তৈরি করে, যা একটি নিখুঁত কাঠামোর ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।[১৪] এই স্থানীয় চাপক্ষেত্রের পারস্পরিক ক্রিয়া স্ফটিকে বিকৃতি কঠিনতা বা শীতপ্রক্রিয়াজাতকরণ (cold working) ঘটায়।

শস্যসীমা (Grain boundaries)

[সম্পাদনা]

শস্যসীমা এমন প্রান্ত বা ক্ষেত্র যেখানে বিভিন্ন অভিমুখে বিস্তার লাভকারী স্ফটিক একে অপরের সঙ্গে মিলিত হয়।[] একটি শস্যসীমা হলো একধরনের একক-পর্বীয় (single-phase) পৃষ্ঠ, যার উভয় পাশে থাকা স্ফটিক গঠন একই রকম হলেও তাদের অভিমুখ ভিন্ন। “ক্রিস্টালাইট সীমা” (crystallite boundary) শব্দটি কোনো কোনো সময়ে ব্যবহৃত হয়, যদিও তা বিরল।

এই শস্যসীমা অঞ্চলে অনেক পরমাণুই তাদের আদর্শ জালিকা অবস্থান থেকে বিচ্যুত থাকে। এখানেই বিচ্যুতি এবং অমিশ্রণ-এর উপস্থিতি বেশি থাকে, কারণ তারা কম শক্তিসম্পন্ন এই সীমায় অভিসৃত হয়।

যদি জ্যামিতিকভাবে একটি একক স্ফটিককে দুই ভাগে ভাগ করা হয় এবং একটি অংশকে ঘোরানো হয়, তাহলে তাদের মধ্যে যে সীমা তৈরি হয় সেটিই শস্যসীমা। এই সীমা সঠিকভাবে বর্ণনা করতে পাঁচটি পরিবর্তশীল দরকার হয়: প্রথম দুটি একটি একক ভেক্টর নির্ধারণ করে, যা ঘূর্ণন অক্ষ নির্দেশ করে; তৃতীয়টি সেই ঘূর্ণনের কোণ নির্ধারণ করে; আর শেষ দুটি সীমা তলের অবস্থান বা তার লম্ব ভেক্টরকে নির্ধারণ করে।[]

শস্যসীমা স্ফটিকের মধ্য দিয়ে বিচ্যুতি চলাচলে বাধা দেয়, ফলে স্ফটিক কণার আকার ছোট করলে পদার্থের শক্তি বৃদ্ধি পায় — এটি Hall–Petch সম্পর্ক দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়। যেহেতু শস্যসীমা একটি ত্রুটি, তাই এটি সাধারণত পদার্থের বৈদ্যুতিকতাপ পরিবাহিতা কমিয়ে দেয়।

বেশিরভাগ শস্যসীমার সংযোগ দুর্বল ও উচ্চ আন্তঃপৃষ্ঠ শক্তি থাকার কারণে এরা অনেক সময় ক্ষয় (corrosion) এবং কঠিন পদার্থে নতুন পর্বের ক্ষরণের জন্য পছন্দনীয় স্থান হয়ে ওঠে। এরা ক্রিপ বিকৃতি (creep)–এর অনেক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।[]

সাধারণভাবে শস্যসীমাগুলোর প্রস্থ কয়েক ন্যানোমিটার মাত্র। সাধারণ পদার্থে স্ফটিক কণাগুলো এত বড় হয় যে শস্যসীমা পদার্থের সামগ্রিক আয়তনের খুব কম অংশ দখল করে। তবে, ন্যানোস্ফটিক কঠিন পদার্থে শস্যসীমার অনুপাত অনেক বেড়ে যায়, ফলে প্রসারণপ্লাস্টিকতার মতো ধর্মগুলোর ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। চরম ছোট কণার সীমায়, যখন শস্যসীমার আয়তন প্রায় ১০০% হয়ে যায়, তখন পদার্থ আর স্ফটিক থাকে না, বরং অস্ফটিক (amorphous) রূপ ধারণ করে।[]

কাঠামো পূর্বাভাস (Prediction of structure)

[সম্পাদনা]

শুধুমাত্র রাসায়নিক সংমিশ্রণের ভিত্তিতে একটি স্থিতিশীল স্ফটিক কাঠামো পূর্বাভাস দেওয়া দীর্ঘদিন ধরেই পূর্ণাঙ্গভাবে গণনাভিত্তিক পদার্থ নকশার পথে একটি বড় বাধা হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। তবে এখন অধিকতর শক্তিশালী অ্যালগরিদম এবং উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন গণনার সাহায্যে মাঝারি জটিলতার কাঠামো পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এর জন্য ব্যবহার করা হয় উদ্বর্তন অ্যালগরিদম (evolutionary algorithms), র‍্যান্ডম স্যাম্পলিং বা মেটাডায়নামিকস (metadynamics) এর মতো পদ্ধতি।

সরল আয়নিক কঠিন পদার্থের (যেমন NaCl বা টেবিল লবণ) স্ফটিক কাঠামো অনেক আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে পলিং-এর নিয়ম (Pauling's rules) অনুসারে, যা ১৯২৯ সালে লিনাস পলিং প্রথম প্রস্তাব করেন।[১৫] পলিং ধাতব পদার্থে আন্তঃপরমাণবিক বলের প্রকৃতিও বিবেচনা করেন এবং উপসংহারে পৌঁছান যে ট্রানজিশন ধাতুগুলোর পাঁচটি d-অরবিটালের মধ্যে প্রায় অর্ধেক বন্ধনে যুক্ত হয় এবং অবশিষ্ট অ-বন্ধনকারী (nonbonding) অরবিটালগুলো চৌম্বক ধর্মের জন্য দায়ী। তিনি d-অরবিটালের সংখ্যা, বন্ধনের দৈর্ঘ্য এবং পদার্থের অন্যান্য ভৌত ধর্মগুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি পরবর্তীতে একটি অতিরিক্ত "ধাতব অরবিটাল"–এর ধারণা দেন, যা বিভিন্ন ইলেকট্রনিক গঠনের মধ্যে ভালেন্স বন্ধনের অনির্বিঘ্ন অনুরণন (resonance) সম্ভব করে তোলে।[১৬]

অনুরণন ভালেন্স বন্ধন তত্ত্বে (resonating valence bond theory), ধাতু বা আন্তঃধাতব যৌগের বিকল্প স্ফটিক কাঠামোগুলোর মধ্যে যেটি গৃহীত হবে তা নির্ভর করে পরমাণবিক অবস্থানের মধ্যে বন্ধনের অনুরণন শক্তির উপর। কিছু অনুরণন ধরন অন্যদের তুলনায় বেশি অবদান রাখে (অর্থাৎ যান্ত্রিকভাবে বেশি স্থিতিশীল হয়), এবং সরল ভগ্নাংশীয় অনুপাত — যেমন , , , , ইত্যাদি — বিশেষভাবে স্থিতিশীল। কাঠামো নির্বাচন এবং অক্ষীয় অনুপাত (axial ratio; যা আপেক্ষিক বন্ধনের দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করে) একটি পরমাণুর সরল ভগ্নাংশ বন্ধনের মাধ্যমে তার সম্পূর্ণ ভালেন্স ব্যবহারের প্রবণতা দ্বারা নির্ধারিত হয়।[১৭][১৮]

হিউম-রথেরি ইলেকট্রন ঘনত্ব ও স্ফটিক কাঠামোর মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক অনুমান করেন, বিশেষ করে বিটা-পর্যায় অ্যালয়গুলোতে। তিনি দ্রবণাঙ্ক, সংকোচনযোগ্যতা ও বন্ধনের দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে পর্যায় সারণির গ্রুপ নম্বর অনুসারে ধাতুগুলোর ভালেন্স নির্ধারণ করেন এবং বন্ধন শক্তি বৃদ্ধির প্রবণতা তুলে ধরেন।[১৯]

ধাতব কাঠামো ও বন্ধন হাইব্রিডের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে একটি গবেষণায় দিকনির্দেশী বলগুলোর (directional forces) গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। এই গবেষণায় দেখা যায় যে, ইলেকট্রনিক কাঠামো ও স্ফটিক কাঠামোর মধ্যে একটি সরল সম্পর্ক রয়েছে — যার প্রকাশ ঘটে প্রতি হাইব্রিড ধাতব অরবিটালে থাকা d-ইলেকট্রনের “ওজন” দ্বারা। এই “d-weight” FCC, HCP ও BCC কাঠামোর জন্য যথাক্রমে 0.5, 0.7 ও 0.9 হিসেব করা হয়েছে।[২০] এভাবে স্পষ্ট হয় যে, d-ইলেকট্রনের উপস্থিতি স্ফটিক কাঠামোর ধরন নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ।

স্ফটিক কাঠামোর পূর্বাভাস বা সিমুলেশনে সাধারণত পর্যায়বৃত্ততা (periodicity) প্রয়োগ করা হয়, যেখানে সিস্টেমটি সব দিকে অসীম ধরা হয়। শুরুতে একটি ত্রিকোণিক কাঠামো নিয়ে, কোনো সুষমতা পূর্বধারণা না নিয়েও, নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র প্রয়োগ করে এবং একটি সাম্প্রতিকভাবে উন্নয়নকৃত পিরিয়ড ভেক্টরের গতিসূত্র ব্যবহার করে কাঠামোতে অতিরিক্ত সুষমতা তৈরি করা যায় — এমনকি বাহ্যিক চাপ উপস্থিত থাকলেও।[২১]

পলিমরফিজম (Polymorphism)

[সম্পাদনা]
কোয়ার্টজ হলো সিলিকা, SiO2-এর অনেকগুলো স্ফটিকজাত রূপের একটি। গুরুত্বপূর্ণ রূপগুলোর মধ্যে রয়েছে: α-কোয়ার্টজ, β-কোয়ার্টজ, ট্রিডিমাইট, ক্রিস্টোবালাইট, কোসাইটস্টিশোভাইট

পলিমরফিজম হলো একটি পদার্থের একাধিক স্ফটিক রূপ থাকার ঘটনা। এটি পলিমার, খনিজ এবং ধাতব পদার্থসহ অনেক ধরনের স্ফটিক পদার্থে দেখা যায়। গিবস-এর পর্যায় সাম্যাবস্থার নিয়ম অনুযায়ী, এই অনন্য স্ফটিক পর্যায়গুলো চাপ ও তাপমাত্রা মতো নিবিড় চলক (intensive variables)-এর ওপর নির্ভরশীল।

পলিমরফিজমের ধারণাটি অ্যালোট্রপির সঙ্গে সম্পর্কিত, যা মৌলিক কঠিন পদার্থের বিভিন্ন রূপ নির্দেশ করে। একটি পদার্থের পূর্ণ গঠন (morphology) পলিমরফিজম এবং অন্যান্য উপাদান যেমন স্ফটিক অভ্যাস, অস্ফটিক অংশ (amorphous fraction) অথবা স্ফটিক ত্রুটি দ্বারা নির্ধারিত হয়।

প্রতিটি পলিমরফের স্থিতিশীলতা ভিন্ন হয় এবং কোনো কোনো পলিমরফ একটি তাপমাত্রায় স্বতঃস্ফূর্ত ও অপরিবর্তনীয়ভাবে একটি স্থিতিশীল রূপে রূপান্তরিত হতে পারে, যদি তা একটি মেটাস্টেবল (অস্থায়ীভাবে স্থিতিশীল) বা তাপগতিগতভাবে অস্থিতিশীল রূপ হয়।[২২] পলিমরফসমূহের গলনাঙ্ক, দ্রাব্যতা এবং এক্স-রে ডিফ্র্যাকশন প্যাটার্ন ভিন্ন হয়।

এর একটি ভালো উদাহরণ হলো সিলিকন ডাইঅক্সাইড বা SiO2-এর কোয়ার্টজ রূপ। অধিকাংশ সিলিকেট যৌগে, Si পরমাণুটি চারটি অক্সিজেন পরমাণুর সঙ্গে টেট্রাহেড্রাল সমন্বয়ে থাকে। প্রায় সব স্ফটিক রূপেই {SiO4} টেট্রাহেড্রা পরস্পরের সঙ্গে কোণ ভাগ করে যুক্ত থাকে। বিভিন্ন খনিজে এই টেট্রাহেড্রাগুলি এককভাবে, জোড়ায়, রিং-আকারে, শৃঙ্খল, দ্বি-শৃঙ্খল, স্তর এবং ত্রিমাত্রিক কাঠামোতেও দেখা যায়। এই গঠন অনুসারে খনিজগুলোকে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। কোয়ার্টজের সাতটি তাপগতিগতভাবে স্থিতিশীল স্ফটিক রূপ বা পলিমরফে, প্রতিটি {SiO4} টেট্রাহেড্রার চারটি ধারের মধ্যে দুটি ভাগাভাগি হয়, যার ফলে সিলিকার রসায়নিক সংকেত দাঁড়ায় SiO2

আরেকটি উদাহরণ হলো টিন (Sn)। ঘরের তাপমাত্রার আশেপাশে এটি নমনীয় হলেও ঠান্ডা করলে এটি ভঙ্গুর হয়ে যায়। এই যান্ত্রিক ধর্মের পরিবর্তন এর দুটি প্রধান অ্যালোট্রপ—α-টিন ও β-টিন-এর অস্তিত্বের কারণে ঘটে। সাধারণ চাপ ও তাপমাত্রায় পাওয়া দুটি রূপ হলো α-টিন (গ্রে টিন) এবং β-টিন (হোয়াইট টিন)। আরো দুটি রূপ, γ ও σ, উচ্চ তাপমাত্রা (১৬১ °C-এর বেশি) ও উচ্চ চাপ (কয়েক GPa-এর বেশি)–এ বিদ্যমান।[২৩]

হোয়াইট টিন ধাতব প্রকৃতির এবং ঘরের তাপমাত্রায় স্থিতিশীল রূপ, যেখানে গ্রে টিন ১৩.২ °C-এর নিচে গঠিত হয় এবং এর ডায়মন্ড ঘনক (diamond cubic) কাঠামো রয়েছে—যা ডায়মন্ড, সিলিকন বা জার্মেনিয়াম-এর মতো। গ্রে টিন ধূসর রঙের, গুঁড়ো ধরনের এবং কোনো ধাতব ধর্ম প্রদর্শন করে না; এটি সাধারণত সেমিকন্ডাক্টর–সম্পর্কিত কিছু বিশেষ কাজে ব্যবহৃত হয়।[২৪]

যদিও α–β রূপান্তর তাপমাত্রা আদর্শভাবে ১৩.২ °C, তবু অমিশ্রণ (যেমন Al, Zn ইত্যাদি) এই রূপান্তর তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির নিচে নামিয়ে দিতে পারে এবং Sb বা Bi যোগ করলে রূপান্তর একেবারেই নাও ঘটতে পারে।[২৫]

ভৌত ধর্ম (Physical properties)

[সম্পাদনা]

৩২টি স্ফটিক শ্রেণির মধ্যে ২০টি পিয়েজোইলেকট্রিক (piezoelectric) শ্রেণি রয়েছে, এবং এই শ্রেণিভুক্ত (অর্থাৎ নির্দিষ্ট পয়েন্ট গ্রুপ) স্ফটিকগুলো পিয়েজোইলেকট্রিসিটি প্রদর্শন করে। সব পিয়েজোইলেকট্রিক শ্রেণিতেই উলটন সুষমতা (inversion symmetry) অনুপস্থিত।

যেকোনো পদার্থে যখন বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র প্রয়োগ করা হয়, তখন সেটি ডাইইলেকট্রিক মেরুকরণ (dielectric polarization) প্রদর্শন করে। কিন্তু কিছু পদার্থে ক্ষেত্র না থাকলেও প্রাকৃতিকভাবে চার্জ বিভাজন থাকে — এ ধরনের পদার্থকে বলা হয় মেরু পদার্থ (polar material)। একটি পদার্থ মেরু কি না, তা একমাত্র এর স্ফটিক কাঠামোর ওপর নির্ভর করে। ৩২টি পয়েন্ট গ্রুপের মধ্যে মাত্র ১০টি মেরু শ্রেণি (polar point group)।

সব মেরু স্ফটিকই পাইরোইলেকট্রিক (pyroelectric), অর্থাৎ তাপমাত্রার পরিবর্তনে এরা বৈদ্যুতিক মেরুকরণ পরিবর্তন করে। এই জন্য মেরু শ্রেণিগুলোকেই প্রায়ই পাইরোইলেকট্রিক শ্রেণি বলা হয়।

কিছু বিশেষ স্ফটিক কাঠামো, যেমন পেরোভস্কাইট কাঠামো (perovskite structure), ফেরোইলেকট্রিক ধর্ম (ferroelectric behavior) প্রদর্শন করে। এটি ফেরোম্যাগনেটিজমের সঙ্গে তুলনীয় — যেমন, উৎপাদনের সময় যদি কোনো বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র না থাকে, তবুও এই স্ফটিক স্থায়ীভাবে মেরুকৃত থাকে না। কিন্তু যদি উপযুক্ত মানের বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র প্রয়োগ করা হয়, তবে স্ফটিকটি স্থায়ীভাবে মেরুকৃত হয়ে যায়।

এই মেরুকরণ একটি বিপরীতধর্মী বড় বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র প্রয়োগ করে উল্টানো যায় — যেমনটি ফেরোম্যাগনেটিক পদার্থের ক্ষেত্রে চৌম্বক মেরুকরণ উল্টানো যায়। যদিও এদের নাম ফেরোইলেকট্রিক, এই প্রভাব কোনো ফেরাস ধাতুর উপস্থিতির কারণে নয়, বরং স্ফটিক কাঠামোর কারণে ঘটে।

কিছু স্ফটিক কাঠামোর উদাহরণ

[সম্পাদনা]

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Hook, J.R.; Hall, H.E. (২০১০)। Solid State Physicsবিনামূল্যে নিবন্ধন প্রয়োজন। Manchester Physics Series (2nd সংস্করণ)। John Wiley & Sons। আইএসবিএন 9780471928041 
  2. West, Anthony R. (১৯৯৯)। Basic Solid State Chemistry (2nd সংস্করণ)। Wiley। পৃষ্ঠা 1। আইএসবিএন 978-0-471-98756-7 
  3. International Tables for Crystallography (2006). Volume A, Space-group symmetry.
  4. Encyclopedia of Physics (2nd Edition), R.G. Lerner, G.L. Trigg, VHC publishers, 1991, ISBN (Verlagsgesellschaft) 3-527-26954-1, ISBN (VHC Inc.) 0-89573-752-3
  5. "4. Direct and reciprocal lattices"CSIC Dept de Cristalografia y Biologia Estructural। ৬ এপ্রিল ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ১৮ মে ২০১৭ 
  6. Edington, J. W. (১৯৭৫)। Electron Diffraction in the Electron Microscope (ইংরেজি ভাষায়)। আইএসবিএন 978-0-333-18292-5ডিওআই:10.1007/978-1-349-02595-4 
  7. Ashcroft, N.; Mermin, D. (১৯৭৬)। "Chapter 7"। Solid State Physics। Brooks/Cole (Thomson Learning, Inc.)। আইএসবিএন 978-0030493461 
  8. Donald E. Sands (১৯৯৪)। "§4-2 Screw axes and §4-3 Glide planes"Introduction to Crystallography (Reprint of WA Benjamin corrected 1975 সংস্করণ)। Courier-Dover। পৃষ্ঠা 70–71। আইএসবিএন 978-0486678399 
  9. Parker, C.B., সম্পাদক (১৯৯৪)। McGraw Hill Encyclopaedia of Physicsবিনামূল্যে নিবন্ধন প্রয়োজন (2nd সংস্করণ)। McGraw-Hill। আইএসবিএন 978-0070514003 
  10. Ellis, Arthur B.; ও অন্যান্য (১৯৯৫)। Teaching General Chemistry: A Materials Science Companion (3rd সংস্করণ)। Washington, DC: American Chemical Society। আইএসবিএন 084122725X 
  11. Kallay, Nikola (২০০০)। Interfacial Dynamics। CRC Press। আইএসবিএন 978-0824700065 
  12. Hogan, C. M. (১৯৬৯)। "Density of States of an Insulating Ferromagnetic Alloy"। Physical Review188 (2): 870–874। ডিওআই:10.1103/PhysRev.188.870বিবকোড:1969PhRv..188..870H 
  13. Zhang, X. Y.; Suhl, H (১৯৮৫)। "Spin-wave-related period doublings and chaos under transverse pumping"। Physical Review A32 (4): 2530–2533। ডিওআই:10.1103/PhysRevA.32.2530পিএমআইডি 9896377বিবকোড:1985PhRvA..32.2530Z 
  14. Courtney, Thomas (২০০০)। Mechanical Behavior of Materials। Long Grove, IL: Waveland Press। পৃষ্ঠা 85। আইএসবিএন 978-1-57766-425-3 
  15. L. Pauling (১৯২৯)। "The principles determining the structure of complex ionic crystals"। J. Am. Chem. Soc.51 (4): 1010–1026। ডিওআই:10.1021/ja01379a006বিবকোড:1929JAChS..51.1010P 
  16. Pauling, Linus (১৯৩৮)। "The Nature of the Interatomic Forces in Metals"Physical Review54 (11): 899–904। ডিওআই:10.1103/PhysRev.54.899বিবকোড:1938PhRv...54..899P 
  17. Pauling, Linus (১৯৪৭)। "Atomic Radii and Interatomic Distances in Metals"। Journal of the American Chemical Society69 (3): 542–553। ডিওআই:10.1021/ja01195a024বিবকোড:1947JAChS..69..542P 
  18. Pauling, L. (১৯৪৯)। "A Resonating-Valence-Bond Theory of Metals and Intermetallic Compounds"। Proceedings of the Royal Society A196 (1046): 343–362। ডিওআই:10.1098/rspa.1949.0032অবাধে প্রবেশযোগ্যবিবকোড:1949RSPSA.196..343P 
  19. Hume-rothery, W.; Irving, H. M.; Williams, R. J. P. (১৯৫১)। "The Valencies of the Transition Elements in the Metallic State"। Proceedings of the Royal Society A208 (1095): 431। এসটুসিআইডি 95981632ডিওআই:10.1098/rspa.1951.0172বিবকোড:1951RSPSA.208..431H 
  20. Altmann, S. L.; Coulson, C. A.; Hume-Rothery, W. (১৯৫৭)। "On the Relation between Bond Hybrids and the Metallic Structures"। Proceedings of the Royal Society A240 (1221): 145। এসটুসিআইডি 94113118ডিওআই:10.1098/rspa.1957.0073বিবকোড:1957RSPSA.240..145A 
  21. Liu, Gang (২০১৫)। "Dynamical equations for the period vectors in a periodic system under constant external stress"। Can. J. Phys.93 (9): 974–978। arXiv:cond-mat/0209372অবাধে প্রবেশযোগ্যএসটুসিআইডি 54966950ডিওআই:10.1139/cjp-2014-0518বিবকোড:2015CaJPh..93..974L 
  22. Hanaor, Dorian A. H.; Sorrell, Charles C. (২০১১)। "Review of the anatase to rutile phase transformation"। Journal of Materials Science46 (4): 855–874। ডিওআই:10.1007/s10853-010-5113-0অবাধে প্রবেশযোগ্যবিবকোড:2011JMatS..46..855H 
  23. Molodets, A. M.; Nabatov, S. S. (২০০০)। "Thermodynamic Potentials, Diagram of State, and Phase Transitions of Tin on Shock Compression"। High Temperature38 (5): 715–721। এসটুসিআইডি 120417927ডিওআই:10.1007/BF02755923বিবকোড:2000HTemp..38..715M 
  24. Holleman, Arnold F.; Wiberg, Egon; Wiberg, Nils (১৯৮৫)। "Tin"। Lehrbuch der Anorganischen Chemie (জার্মান ভাষায়) (91–100 সংস্করণ)। Walter de Gruyter। পৃষ্ঠা 793–800। আইএসবিএন 978-3-11-007511-3 
  25. Schwartz, Mel (২০০২)। "Tin and Alloys, Properties"। Encyclopedia of Materials, Parts and Finishes (2nd সংস্করণ)। CRC Press। আইএসবিএন 978-1-56676-661-6 

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]

উইকিমিডিয়া কমন্সে Crystal structures সম্পর্কিত মিডিয়া দেখুন।

টেমপ্লেট:Crystallography টেমপ্লেট:Crystal systems