সৈয়দ কামরুল ইসলাম সালেহ উদ্দিন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ব্যারিস্টার
সৈয়দ কামরুল ইসলাম মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন
পাকিস্তান জাতীয় সংসদ সদস্য
কাজের মেয়াদ
৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ – ৫ মার্চ ১৯৭১
ফরিদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য
কাজের মেয়াদ
৭ মার্চ ১৯৭৩ – ৬ নভেম্বর ১৯৭৬
পূর্বসূরীআব্দুস সালাম খান
উত্তরসূরীসিরাজুল ইসলাম মৃধা
ব্যক্তিগত বিবরণ
জন্ম২ জুলাই ১৯৩৭
গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান বাংলাদেশ)
মৃত্যু২৪ মে ১৯৮৩
পিজি হাসপাতাল
রাজনৈতিক দলবাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশ জাস্টিস পার্টি

সৈয়দ কামরুল ইসলাম মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন (জংগু) (২ জুলাই ১৯৩৭-২৪ মে ১৯৮৩) ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন রাজনীতিবিদ, পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন এমএনএ, এমসিএ ও ফরিদপুর-৩ (বর্ত মান ফরিদপুর-১, মধুখালী-বোয়ালমারী-আলফাডাঙা) আসনের সাবেক সাংসদ। [১]

জন্ম ও প্রাথমিক জীবন[সম্পাদনা]

সৈয়দ কামরুল ইসলাম মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন (জংগু) ০২ জুলাই ১৯৩৭ সালে (ম্যাট্রিকুলেশন সনদ অনুযায়ী ৩রা সেপ্টেম্বর ১৯৩৯) গোপালগঞ্জের জেলার টিটা গ্রামের মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সৈয়দ মোহাম্মদ আব্দুল হালিম ও মাতা সালেহা খাতুন। সৈয়দ কামরুল ইসলাম মোহাম্মদ সালেহউদ্দিনের নিজ গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলার মধুখালী থানার বনমালিদিয়া গ্রামে।

সৈয়দ কামরুল ইসলাম মোহাম্মদ সালেহউদ্দিনের পিতা সৈয়দ মোহাম্মদ আব্দুল হালিম (ইপিসিএস, টিকিউএ) ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত উপসচিব। বাবা সৈয়দ মোহাম্মদ আব্দুল হালিম বংগীয় সরকারি প্রশাসনের অফিসার হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। ভাইবোনের মধ্যে সৈয়দ কামরুল ইসলাম মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন সবার বড়।

শিক্ষা, রাজনৈতিক ও কর্মজীবন[সম্পাদনা]

সৈয়দ কামরুল ইসলাম মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন বরিশাল বি.এম.ইন্সটিটিউটে ১৯৫২ সালের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষাথী ছিলেন কিন্তু, ছাত্র থাকাকালীন সময়ে ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়ে বরিশাল শহরের এক মিছিল থেকে গ্রেফতার হয়ে কারাগার থেকে ১৯৫৩ সালে বরিশাল বিএম ইনস্টিটিউট (বর্তমানে বিএম কলেজ) এর ছাত্র হিসাবে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন।

১৯৫৬ সালে তিনি বাগেরহাট পিসি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৫৯ সালে যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। এরপর তিনি পুরানো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কে,এল,জুবিলী স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। পরে তিনি চাঁদপুরে একটি বেসরকারি কলেজে কিছুদিন অধ্যাপনা করেন। তিনি বহুজাতিক কোম্পানি ফাইজারের মেডিকেল প্রতিনিধি হিসাবে কিছুকাল কাজ করেন।

১৯৬৩ সালে আইনশাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য তিনি ইংল্যান্ডে গিয়ে ১৯৬৮ সালে ইনার টেম্পল থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন। তিনি ব্রিটিশ হাইকোর্টের কুইন্স বেঞ্চ ডিভিশনে কিছুদিন প্রাক্টিস করেন। দেশে ফিরে তিনি ততকালীন ইস্ট পাকিস্তান হাইকোর্টে আইনজীবী হিসাবে কাজ শুরু করেন এবং ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী হিসাবে তালিকাভুক্ত হন।

তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসাবে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। বরিশালে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী নেত্রী মনোরমা বসু মাসিমার ছত্রচ্ছায়ায় তিনি রাজনীতির দীক্ষা নেন। তিনি ১৯৫৩-৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন বরিশাল শাখার কনভেনার ছিলেন। ১৯৫৩-৪ সালে বরিশাল শহর যুবলীগের সম্পাদকের দ্বায়িত্ব পালন করেন।

১৯৫৭-৫৮ সালে বাগেরহাট পিসি কলেজের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫৬-৫৮ সালে খুলনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতির দ্বায়িত্ব পালন করেন।

১৯৬৭ সালে লন্ডনে ৬ দফা আন্দোলন কমিটির চেয়ারম্যানের দ্বায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৮-৬৯ সালে শেখ মুজিব ডিফেন্স তহবিলের লন্ডনস্থ কনভেনরের দ্বায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে যুক্তরাজ্যে পুর্ববাংলার ছাত্রদের সাথে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নেন। প্রবাসী বাঙ্গালি ছাত্র সংগঠন পাকিস্তান ইউথ ফেডারেশন গঠন করেন।

১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত আসামি শেখ মুজিবুর রহমানকে আইনি সহায়তা দানের জন্য তিনি দি রাইটস অব ইস্ট পাকিস্তান ডিফেন্স ফ্রন্ট গঠন করে ব্রিটিশ এমপি ও কুইন্স কাউন্সিলর স্যার টমাস উইলিয়ামসকে পূর্ববাংলায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। দি রাইটস অব ইস্ট পাকিস্তান ডিফেন্স ফ্রন্টের চেয়ারম্যান হিসাবে তিনি ১৯৬৮ সালে লন্ডনের পাকিস্তান হাইকমিশন ভবন দখলে নেত্রীত দিয়েছিলেন।

১৯৬৯ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি শুরু করে ১৯৭০ পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে প্রার্থি হয়ে ফরিদপুর-২ (বালিয়াকান্দি, বোয়ালমারী,আলফাডাঙ্গা) আসন থেকে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী পরে পি.ডি.পির নেতা এডভোকেট আব্দুস সালাম খানকে পরাজিত করে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন। এই নিব্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ১,৯৮,৬১৩ জন। ১,২৭,২৬০ জন ভোটার উপস্থিত ছিলেন। ব্যারিস্টার সালেহউদ্দিন ভোট পান ১,০৬,৬৬৬।

১৯৭১ সালের ১৮ মাচ বোয়ালমারী ডাকবাংলো মাঠে তিনি লক্ষ লক্ষ ছাত্রজনতার সম্মুখে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং ঘোষণা করেন,"আজ থেকে আমরা এই পতাকাকে স্যালুট করবো "। তার নেত্তীতে ছাত্রজনতা ২৬ মাচ ফরিদপুর ডিসি ও এসপি অফিস থেকে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। তিনি প্রবাসী সরকারে গুরুত্বপূর্ণ দ্বায়িত্ব পালন করেন।

স্বাধীনতার পর তিনি ১৯৭২ সালে গণপরিষদের সদস্য (এমসিএ) হিসাবে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন এবং বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে নিজনাম স্বাক্ষর করেন।

১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না পেয়ে ফরিদপুর-৩ (বর্তমান ফরিদপুর-১,মধুখালি বোয়ালমারি আলফাডাংগা) থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে আওয়ামী লীগ নেতা ও যুক্তফ্রন্টের প্রাক্তন মন্ত্রী আ্যডভোকেট শ্রী গৌরচন্দ্র বালাকে পরাজিত করে প্রথম জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হয়ে প্রথম জাতীয় সংসদে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ভাসানী) প্রতিনিধিত্ব করেন।

১৯৭৪ সালে বংগবন্ধুর আগ্রহে তিনি আন্তর্জাতিক ইসলামি সম্মেলন সংস্থা ওআইসিতে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সমথর্ন জুগিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর তিনি আওয়ামী লীগ (মিজান)-এ যোগ দেন। ১৯৮০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশ জাস্টিস পার্টি প্রতিষ্ঠা করে এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকার বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল এন্ড কলেজ, নবারুন সংঘ, বনানী ক্লাব প্রতিষ্ঠায় তিনি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া ১৯৭৪ সালে সংসদ সদস্য থাকাকালীন সময়ে ফরিদপুরের মধুখালিতে ফরিদপুর সুগার মিল প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

পারিবারিক জীবন[সম্পাদনা]

সৈয়দ কামরুল ইসলাম মোহাম্মদ সালেহউদ্দিনের পিতা সৈয়দ মোহম্মদ আব্দুল হালিম ছিলেন বেঙল সিভিল সার্ভিসের সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা ও পূর্ব পুরুষ হজরত সৈয়দ শাহ হুসাইন তেগ বোরহান(র.) তার পুত্র হজরত শাহ সৈয়দ হাবিবউল্লাহ মদ্দানে খোদাকে সাথে নিয়ে ইরাকের বাগদাদ শহর থেকে দিল্লি হয়ে প্রথমে ফরিদপুর (সাবেক ফতেহাবাদ) জেলা শহরের কাছে গেদ্দা/ গেরদা আসেন ধর্ম প্রচারের জন্য। গেরদায় হজরত সৈয়দ শাহ হুসাইন তেগ বোরহান (র.) এর মাজার রয়েছে। উনার নিজপুত্র হজরত শাহ সৈয়দ হাবিবউল্লাহ বাবার আদেশে গেরদা থেকে ১৮ মাইল দূরে মধুখালী (সাবেক ভূষনা) উপজেলার বনমালিদিয়া গ্রামে ধরছি প্রচারের কাজে এসে সেখানে স্থায়ী বসতি গড়ে তুলেন, তিনি ছিলেন মিরপুরে অবস্থিত হজরত সৈয়দ শাহ আলী বোগদাদীর (র.)আপন ভাগিনা। হজরত শাহ সৈয়দ হাবিব উল্লাহর মাজার ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার বনমালিদিয়া গ্রামে আজতক বিদ্যমান। ব্যারিস্টার সালেহউদ্দিন এর সালেহা খাতুন ছিলেন গোপালগঞ্জের টিটার ক্ষয়িষ্ণু মুসলিম জমিদার ও ব্রিটিশ ভারতের পুলিশ কর্মকর্তা আহমেদ হোসেন খানের বড় কন্যা।

সৈয়দ কামরুল ইসলাম মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন ১৯৬৩ সালে বিয়ে করেন খুলনার বিভাগীয় খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা ও গোপালগঞ্জের বরফা জালালপুর গ্রামের সিরাজুল হকের বড়মেয়ে দিল আফরোজ বেগম ডলি'কে। তাদের একমাত্র পুত্র ডক্টর সৈয়দ জাভেদ মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন (জয়) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন, একমাত্র কন্যা সৈয়দা ফারজানা সালেহউদ্দিন (দীপা) ।

মৃত্যু[সম্পাদনা]

সৈয়দ কামরুল ইসলাম মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন ২৪ মে ১৯৮৩ সালে তৎকালিন পিজি হাসপাতাল চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তাকে বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। মরহুমের নামে তার নিজ গ্রাম ফরিদপুরের মধুখালি উপজেলার বনমালিদিয়ায় বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোডের আওতায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ব্যারিস্টার সৈয়দ কামরুল ইসলাম মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন টেকনিক্যাল কলেজ। এছাড়া, মরহুমের নামে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আওতায় গুলশানে একটি রাস্তার নামকরণের প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "১ম জাতীয় সংসদে নির্বাচিত মাননীয় সংসদ-সদস্যদের নামের তালিকা" (পিডিএফ)জাতীয় সংসদবাংলাদেশ সরকার। ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা।