সূর্যঘড়ির ইতিহাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বিশ্বের সবথেকে পুরনো সূর্যঘড়ি। এটি মিশরীয় উপত্যকার রাজার (আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) তৈরী। কর্মঘণ্টা হিসাব করতে এটি ব্যবহার হতো।[১][২][৩]

সূর্যঘড়ি হচ্ছে এমন একটি যন্ত্র যা একটি রেফারেন্স স্কেলে সূর্যের অবস্থানের মাধ্যমে লাইট স্পট বা প্রক্ষেপিত ছায়া ব্যবহার করে সময় নির্দেশ করে।[৪] পৃথিবী যখন তার মেরু অক্ষের দিকে ঘুরে, তখন সূর্য পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমে আকাশ অতিক্রম করে। সূর্যোদয়ের সময় দিগন্তের অন্তরাল থেকে এটি উদিত হয়ে দুপুরে সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছায়। আবার সূর্যাস্তের সময় এটি দিগন্তের আড়ালে হারিয়ে যায়। আজিমুথ (দিক) কিংবা অল্টিচুট (উচ্চতা) সময় নির্ধারণ যন্ত্র তৈরীতে উভয় পরিমাপই ব্যবহার করা যায়। অধিকাংশ প্রধান সংস্কৃতিতেই সূর্যঘড়ি স্বাধীনভাবে আবিষ্কৃত হয়েছিল এবং সংস্কৃতির বিকাশের সাথে সাথে এটি আরো নিখুঁত এবং অত্যাধুনিক হয়ে উঠেছিল।[৫]

পরিচয়[সম্পাদনা]

একটি সূর্যঘড়ি স্থানীয় সৌর সময় ব্যবহার করে। ১৮৪০ সালে রেলওয়ে আসার আগে, স্থানীয় সময় একটি সৌরঘড়িতে প্রদর্শিত হত। তখন এটি সরকার এবং বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হয়। ঘড়ি আবিষ্কারের আগে সূর্যঘড়ি সময়ের একমাত্র উৎস ছিল। ঘড়ি আবিষ্কারের পর, সূর্যঘড়ি আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ আবিষ্কৃত ঘড়িটি একটি সূর্যঘড়ি থেকে নিয়মিত সময় ঠিক করে নেয়ার প্রয়োজন ছিল। কারণ এর নির্ভুলতা দুর্বল ছিল। দ্রাঘিমাংশ পরিমাপ করতে একটি ঘড়ি এবং একটি ডায়াল একসাথে ব্যবহার করা হত। ডায়ালটি সোজা প্রান্ত এবং কম্পাস ব্যবহার করে শায়িত থাকত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে সূর্যঘড়ি একাডেমিক আগ্রহের বস্তু হয়ে ওঠে। লগারিদমের ব্যবহার ডায়াল স্থাপন করার বীজগাণিতিক পদ্ধতি প্রয়োগ এবং অধ্যয়ন করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। সূর্যঘড়ি এখন আর ব্যবহার উপযোগী নয়, এখন এগুলো জনপ্রিয় অলঙ্কার হিসাবে রয়ে গেছে। বেশ কিছু জনপ্রিয় বই সেই আগ্রহ প্রচার করে এবং নির্মাণের পদ্ধতির বিবরণ প্রদান করে। সাশ্রয়ী মূল্যের বৈজ্ঞানিক ক্যালকুলেটর ব্যবহার বীজগাণিতিক পদ্ধতিকে জ্যামিতিক গঠনের মত সহজলভ্য করে তুলেছে এবং কম্পিউটারের ব্যবহার ডায়াল প্লেট নকশাকে সহজ করে তুলেছে। সূর্যঘড়ির ঐতিহ্য স্বীকৃত হযয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী সানডায়াল সোসাইটি স্থাপন করা হয়েছে। এবং কিছু আইন বিভিন্ন দেশের জাতীয় বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে সূর্যঘড়ি অধ্যয়নের সুযোগ করে দিয়েছে।[৫]

ইতিহাস[সম্পাদনা]

প্রাচীন সূর্যঘড়ি[সম্পাদনা]

আফগানিস্তানে আই খানুমের (খ্রিস্টপূর্ব ৩য় থেকে ২য় শতাব্দী) অর্ধগোলাকার গ্রীক সূর্যঘড়ি
২য় শতাব্দীতে চীনের পূর্ব হান সাম্রাজ্যের সূর্যঘড়ি
সূর্যঘড়ি পাথর, কিলমালকেদার, আয়ারল্যান্ড (খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক সপ্তম শতাব্দী)

প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার থেকে জানা যায়, প্রাচীনতম গৃহস্থালী ঘড়িগুলো প্রাচীন ব্যাবিলনীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের ছায়া ঘড়ি (১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ছিল। একই যুগের প্রাচীন অ্যানালেমাটিক সানডায়াল (প্রায় ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এবং তাদের প্রোটোটাইপ আধুনিক রাশিয়া অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়েছে।[৬][৭][৮][৯] অনেক আগে ওবেলিস্ক, একসময় সূর্যঘড়ি হিসেবেও ব্যবহৃত হত বলে ধারণা করা হত, যা ফারাওদের সম্মানে নির্মিত মন্দিরে স্থাপন করা হয়েছিল।[১০] এখন মনে করা হয় এগুলো শুধুমাত্র একটি স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। সম্ভবত, অনেক আগেকার মানুষ ছায়ার দৈর্ঘ্য দেখে সময় বলত, কিন্তু এটা যাচাই করা কঠিন। প্রায় ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ওল্ড টেস্টামেন্টে একটি সূর্যঘড়ির বর্ণনা করা হয়েছে- "আহজের ডায়াল" Isaiah এবং 2 Kings এ (সম্ভবত ইতিহাসের কোথাও পাওয়া যায় এমন একটি সূর্যঘড়ির প্রাচীনতম বিবরণ) - যা সম্ভবত মিশরীয় বা ব্যাবিলনীয় নকশার। এছাড়াও প্রাচীন কাল থেকে চীনে সূর্যঘড়ি বিদ্যমান ছিল, কিন্তু তাদের ইতিহাস খুব কমই জানা যায়। এটা জানা যায় যে, প্রাচীন চীনে সূর্যঘড়ির একটি রূপ বিকশিত হয়েছিল। এবং অবশেষে ১০০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সূর্যঘড়ি গুলি অত্যন্ত অত্যাধুনিক পানি ঘড়িতে বিকশিত হয়। সং রাজবংশ (১০০০-১৪০০ খ্রিস্টাব্দ) এ ঘড়িগুলোতে কখনও কখনও কম্পাসও যুক্ত করেছিল।[১১] ক্যালেন্ডার বিশেষজ্ঞদের একটি সমাবেশে ১০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে সূর্যঘড়ির প্রাথমিক রেফারেন্স পাওয়া যায়।[১২]

প্রাচীন গ্রীকরা সূর্যঘড়ির অনেক নীতি ও রূপ বিকশিত করে। ধারণা করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৫৬০ অব্দে গ্রীসে সূর্যঘড়ি চালু করেছিলেন মিলেটাসের অ্যানাক্সিমান্ডার। হেরোডোটাসের মতে, গ্রিক সূর্যঘড়ি প্রাথমিকভাবে তাদের ব্যাবিলনীয় সহযোগীদের কাছ থেকে এসেছিল। গ্রীকরা সূর্যঘড়ি বিজ্ঞানের বিকাশ, জ্যামিতিবিজ্ঞানের বিকাশ, এবং বিশেষ করে একটি সূর্যঘড়ি নোডাস দ্বারা চিহ্নিত কনিক বিভাগ আবিষ্কারে ভাল অবস্থানে ছিল। বিথিনিয়ার গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী থিওডোসিয়াস (খ্রিস্টপূর্ব ১৬০ অব্দ থেকে ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) একটি সার্বজনীন সূর্যঘড়ি আবিষ্কার করেন যা পৃথিবীর যে কোন স্থানে ব্যবহার করা যেতে পারে।

রোমানরা গ্রীক সূর্যঘড়ি গ্রহণ করে। প্লিনি অনুসারে, রোমে প্রথম সূর্যঘড়ির অস্তিত্ব পাওয়া যায় ২৯৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।[১৩] খ্রিস্টপূর্ব ২৫ অব্দে রোমান লেখক ভিট্রুভিয়াস তার ডি আর্কিটেক্টুরা এর "বুক নাইন" এ গ্রিক আবিষ্কারকদের সকল পরিচিত সূর্যঘড়ি তালিকাভুক্ত করেন।[১৪] এগুলো ছিল সব নডুস ধরনের সূর্যঘড়ি, প্রধানত পৃষ্ঠের মধ্যে পার্থক্য যা নডুস ছায়া পায় বলে বিশ্বাস করা হয়।

মধ্যযুগীয় সূর্যঘড়ি[সম্পাদনা]

এই যুগে যখন টাইমকিপিং প্রযুক্তি ইউরোপে স্থবির বা বিস্মৃত হয়। তখন ইসলামী বিশ্ব এটি নিয়ে অনেক এগিয়ে যায়। তখন ইসলামী স্বর্ণযুগের চলায় তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে ছিল। এছাড়া নামাজের সময় নির্ধারণেও টাইমকিপিং প্রযুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।[১৫] তাদের উন্নতির কারণ ছিল বীজগণিত এবং ত্রিকোণমিতি (ফার্সি গণিতবিদ আল-খোয়ারিজমি দ্বারা আবিষ্কৃত পূর্বে আবিষ্কৃত) ব্যবহার করে এই প্রযুক্তির নির্ভুলতা বৃদ্ধি।

রেনেসাঁ যুগের সূর্যঘড়ি[সম্পাদনা]

ক্রুসেডের সময় ইসলামী বিশ্ব থেকে উন্নত প্রযুক্তি ও জ্ঞান নিয়ে ইউরোপ সূর্যঘড়ির উন্নয়নের চেষ্টা করে। ১২ শতকে ল্যাটিন অনুবাদের মাধ্যমে ইউরোপ রেনেসাঁ শুরু করে। এই অনুবাদের মধ্যে ছিল সূর্যঘড়ির উন্নত জ্ঞান। যার মধ্যে রয়েছে সমান আকারের সময়ের একক বের করার জন্য জন্য বিশেষভাবে বাঁকা সূর্যঘড়ির ব্যবহার সম্পর্কে আবু আলী আল-হাসান আল-মারাকুশির ১৩ শতকের লেখা। এই অগ্রগতির আগে, সময়ের এককের দৈর্ঘ্য বছরের সময় অনুযায়ী পরিবর্তিত হত। একটি "সৌর ঘণ্টা" গ্রীষ্ম বা শীতকালের উপর নির্ভর করে ৪০ থেকে ৮০ মিনিট পর্যন্ত হত।

আধুনিক যুগে[সম্পাদনা]

গ্রিক ডায়ালগুলি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়ে এবং ইসলামী খিলাফত সংস্কৃতি এবং রেনেসাঁ পরবর্তী যুগে ইউরোপীয়দের দ্বারা আরো বিকশিত হয়। গ্রীক ডায়াল সরাসরি ঘণ্টা-লাইনের সঙ্গে নডুস ভিত্তিক ছিল, এগুলো অসম ঘণ্টা নির্দেশ করে। এছাড়াও একে অস্থায়ী ঘণ্টাও বলা হয়- যা ঋতুর সাথে পরিবর্তিত হয়। যেহেতু প্রতিদিন বারোটি সমান ভাগে ভাগ করা হয়; এইভাবে, শীতকালে ঘণ্টা কম এবং গ্রীষ্মকালে দীর্ঘ সময় ছিল। মুহাম্মদ ইবনে জাবির আল-হারানি (আলবাতেগনি) এর ত্রিগোনোমেট্রির পূর্ববর্তী অগ্রগতির উপর ভিত্তি করে ১৩৭১ সালে আবুল-হাসান ইবনে আল-শাতির সারা বছর একই সময় দৈর্ঘ্যের ঘণ্টার ধারণা উদ্ভাবন করেন। ইবনে আল-শাতির জানতেন যে পৃথিবীর অক্ষের সমান্তরালে অবস্থিত একটি গনোমন ব্যবহার করলে সূর্যঘড়ি উৎপন্ন হবে যার ঘণ্টার রেখা বছরের যে কোন দিনে সমান ঘণ্টা নির্দেশ করবে। তার সূর্যঘড়ি প্রাচীনতম মেরু-অক্ষ সূর্যঘড়ি যা এখনও বিদ্যমান। এবং একটি প্রতিরূপ এখনও উমাইয়া মসজিদের একটি মিনার, মাধনাত উল-উরুসে দেখা যায়।[১৬] ধারণাটি পরে অন্তত ১৪৪৬ থেকে পাশ্চাত্য সূর্যঘড়িতে আবির্ভূত হয়।[১৭][৫]

বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীতে[সম্পাদনা]

তাইপেই ১০১ এর ডিজাইনাররা একবিংশ শতাব্দীর প্রথম রেকর্ড সৃষ্টিকারী আকাশচুম্বী ভবনে স্থাপন করে প্রাচীন ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে আসে। তাইওয়ানে টাওয়ারটি ২০০৪ সালে যখন প্রথম চালু করা হয় তখন এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা টাওয়ার, যার উচ্চতা আধা কিলোমিটারেরও বেশি।

ছবিঘর[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Preliminary Report on the Work carried out during the season 2013"। ২০১৬-১২-২৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-১২-২৮ 
  2. Bickel, S.; Gautschy, R. Eine ramessidische Sonnenuhr im Tal der Könige. Zeitschrift für Ägyptische Sprache und Altertumskunde 2014, Volume 96, Issue 1, pp. 3-14.
  3. Vodolazhskaya, L.N. Reconstruction of ancient Egyptian sundials. Archaeoastronomy and Ancient Technologies 2014, 2(2), 1-18.
  4. Jones 2005, পৃ. 1।
  5. Jones 2005
  6. Vodolazhskaya, L.N.; Larenok, P.A.; Nevsky, M.Yu. Ancient astronomical instrument from Srubna burial of kurgan field Tavriya-1 (Northern Black Sea Coast). Archaeoastronomy and Ancient Technologies 2014, 2(2), 31-53.
  7. Vodolazhskaya, L.N. Analemmatic and horizontal sundials of the Bronze Age (Northern Black Sea Coast). Archaeoastronomy and Ancient Technologies 2013, 1(1), 68-88.
  8. Vodolazhskaya L.N., Larenok P.A., Nevsky M.Yu. The prototype of ancient analemmatic sundials (Rostov Oblast, Russia). Archaeoastronomy and Ancient Technologies 2016, 4(1), 96-116.
  9. Vodolazhskaya, L.N.; Larenok, P.A.; Nevsky, M.Yu. Solnechnye chasy epokhi bronzy iz srubnogo pogrebeniya mogil'nika Tavriya-1. [Sundial of Bronze Age from the Srubna burial of kurgan field Tavriya-1]. Istoriko-arkheologicheskiy al'manakh. [Historical-Archaeological Almanac]. Vol. 13, Armavir, Krasnodar, Moscow, 2015, p. 4-14.
  10. "The oldest surviving sundial"। ১১ এপ্রিল ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ আগস্ট ২০২০ 
  11. "Sundials in China - A brief note"। The University of Hong Kong। ১৯৯৭-০৭-০১। ২০১০-০৩-১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০১-২০ 
  12. Joseph Needham (১৯৫৯)। Science and Civilisation in China3। C.U.P। পৃষ্ঠা 302। 
  13. Pliny (79ce): Natural History 7.213
  14. "Marcus Vitruvius Pollio:de Architectura, Book IX"। The Latin text is that of the Teubner edition of 1899 by Valentin Rose, transcribed by Bill Thayer। ২০০৭-০৭-০৭। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৯-০৭ 
  15. Encyclopedia Britannica: Sundial
  16. "ibn Shatir's Sundial at Umayyad Mosque"Madain Project। সংগ্রহের তারিখ ১২ মে ২০১৯ 
  17. "History of the sundial"National Maritime Museum। ২০০৭-১০-১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৭-০২ 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]