সিরিয়ায় ইসলাম

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
দামেস্কর উমাইয়া মসজিদ।

সিরিয়ার প্রধান ধর্ম হলো ইসলাম। এখানকার প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। দেশটির সকল জেলাতে এই ধর্মের মানুষের সংখ্যা বেশি।[১] এখানকার মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা নানান ভাগে বিভক্ত এবং জাতিগতভাবে ভিন্ন।

সিরিয়ায় মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সুন্নি মুসলমানদের সংখ্যা বেশি (দেশটির প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ[২])। বাকি শতাংশগুলো শিয়া মুসলিমদের দখলে। (১১.৫ শতাংশ মানুষ)। আবার, শিয়াদের মধ্যে আলাউয়িদের প্রাধান্যই বেশি (মোট জনগোষ্ঠীর ১০ শতাংশ)[২]। এরপরেই রয়েছে ইসমাঈলি (১%[৩]) এবং দ্বাদশবাদি (.৫%[৩])। আবার, সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে কুর্দি ও তুর্কমেন আলেভি'রা বাস করে।[৪]

দেশটির সুন্নিরা শাফিঈ মাযহাবের অনুসারী, যা হানাফি এবং হানবালির সাথে সম্পৃক্ত। কিছু বড় বড় সুফি নিয়মকানুন দেশটির পুরোটা জুড়ে কার্যকর রয়েছে। যেমন নাথিং, নকশবন্দি তরিকা এবং কাদেরিয়া তরিকাদ্রুজদের যদিও মুসলিম বলা হয় না, তবুও ওরা পুরো দেশটির ৩% দখল করে আছে।[৫]

ইতিহাস[সম্পাদনা]

৬৩৪-৬৪০ সালে, মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশগুলোতে ইসলামী বিজয়ের সময়ে, আরব মুসলিম অর্থাৎ রাশিদুন সেনাবাহিনী সিরিয়া দখল করে নেয়। আবু বকরের হয়ে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন খালিদ বিন ওয়ালিদ। এর ফল হিসেবে সিরিয়া ইসলামী সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ৬৩৫ সালে, দামেস্ক নগরী আত্নসমর্পণ করে। এই নগরীর জনগোষ্ঠীদের জীবনের নিরাপত্তা, সম্পদ এবং চার্চ একটি নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে খুলাফায়ে রাশেদীনের হাতে চলে যায়। ফলে মুসলিম রাশিদুন পুরো মধ্যপ্রাচ্যের কর্তৃত্ব নিজেদের করে নেয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে এবং এখনও এর প্রভাব রয়ে গেছে।[৬] ইসলামী সম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত সিরিয়া ছিল গোড়া খ্রিস্টান ধর্ম চর্চার প্রধান কেন্দ্র। ঐ অঞ্চলের মানুষের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ, খুব ধীরে ধীরে ঘটেছিল। কিন্তু ঘাসান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ছিল বিপরীত। শুরুতেই এরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নেয়। মুসলিম শাসকরা খুবই দয়ালু ছিল। ফলে অতিরিক্ত করারোপ বা অত্যাচার থেকে শাসকরা বিরত ছিল এবং এটিই ছিল সিরিয়াতে ইসলামের সম্প্রসারণের মূল কারণ।[৭] সপ্তম শতকের মাঝামাঝি সময়ে, উমায়েদ বংশ, সেই সময়ের ইসলামী সম্রাজ্যের শাসক, দামেস্ককে সম্রাজ্যের রাজধানী বানান।

যেহেতু অন্যান্য জায়গাও আরবদের দ্বারা দখল হয়েছিল, তাই ইসলামের সম্প্রসারণ ইসলামী শিল্পকেও চারিদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছিল। যা মধ্যপ্রাচ্যে আরবদের দখল এবং আরবির সাথে আরামীয় মিশ্রণকে খুব দ্রুত ছড়িয়ে দেয়।[৮]

সিরিয়ার ইতিহাসজুড়ে দেখা যায়, এই অঞ্চলটি বিভিন্ন ইসলামিক শাসকদের একটি প্রদেশ ছিল, জাতিগত ভিন্নতা ও নানান ইসলামী সংস্কৃতির পরিবর্তনে যাদের অবদান ছিল। প্রথম দিকের শাসক ছিলেন উমাইয়া খিলাফত। যারা সুন্নি ধর্মাবলী। এরপরে ইরাক কেন্দ্রীয় আব্বাসীয় আব্বাসীরাও ছিলেন সুন্নি ধর্মাবলম্বী। এরপরেই শাসকরা ছিলেন ফাতেমী, যারা শিয়া ধর্মাবলম্বী। এছাড়াও কিছু মুসলিম শাসক সিরিয়া শাসন করেছে যারা অনারব। যাদের শাসনের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল মিশরের কায়রো। এদের মধ্যে আয়ুবিয় অন্যতম। এরা কুর্দিস বংশ সুন্নি ধর্মাবলম্বী ছিলেন এবং মামলুকরাও ছিলেন অনারবীয়। যারা সুন্নি-শিয়া উভয় ধর্মেরই শাসক ছিলেন। তারা তুর্কি ও সারকাসন বংশের ছিলেন। সিরিয়ার শেষ ইসলামিক শাসকরা ইরানেই তাদের বসতি স্থাপন করেছিল। তাদেরকে বলা হয় সেলজুকস। এই শাসকরা তুর্কির সুন্নি ধর্মাবলম্বী ছিলেন এবং এরপরেই আসে উসমানরা। এরাও তুর্কির সুন্নি ধর্মাবলম্বী। বর্তমানে ইস্তানবুলকে তারা শাসনের কেন্দ্রবিন্দু বানিয়েছিল। এবং এশিয়া, ইউরোপ, উভয় জায়গাতেই এই উসমানদের প্রভাব ছিল।

সরকারি আদমসুমারী[সম্পাদনা]

অংশসমূহ[সম্পাদনা]

১৯৪৩ সালে, আলবার্ট হুরানি সিরিয়ার সমগ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন মুসলিমদের একটি পরিসংখ্যান দেন। এবং তাদের বৃদ্ধির হার সম্পর্কেও তথ্য দেনঃ

১৯৪৩ এর আদমসুমারী[৯][১০] ১৯৫৩ এর আদমসুমারী[৯] বৃদ্ধির হার[৯]
সুন্নি ১,৯৭১,০৫৩ (৬৮.৯১%) ২,৫৭৮,৮১০ (৭০.৫৪%) ৩১%
শিয়া ১২,৭৪২ (.৪৫%) ১৪,৮৮৭ (.৪১%) ১৭%
আলাউয়ি (দ্বাদশবাদি) ৩২৫,৩১১ (১১.৩৭%) ৩৯৮,৪৪৫ (১০.৯০%) ২২%
ইসমাইলি ২৮,৫২৭ (১.০০%) ৩৬,৭৪৫ (১.০১%) ২৯%
দ্রুজ ৮৭,১৮৪ (৩.০৫%) ১১৩,৩১৮ (৩.১০%) ৩০%
ইয়াজিদি ২,৭৮৮ (০.১০%) ৩,০৮২ (০.০৮%) ১১%
সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠী ২,৪২৭,৬০৫ (৮৪.৮৭%) ৩,১৪৫,২৮৭ (৮৬.০৩%) ৩০%

সুন্নি ইসলাম[সম্পাদনা]

আলেপ্পোর গ্রেট মসজিদ উমাইয়ারা তৈরি করেছিল
মহররত আল নোমানের গ্রেট মসজিদটি ১২শ শতকে আয়ুবীরা তৈরি করেছিল

সিরিয়ার সবচেয়ে বেশি ইসলাম ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী হল সুন্নি ইসলাম। যাদের বেশিরভাগই অনেক আগ থেকে সিরিয়ায় বসবাস করছে। তবে সুন্নিদের মধ্যে তুর্কমেন/কুর্দি/তুর্কমান জনগোষ্ঠীর লোকও রয়েছে। এছাড়া সুন্নি মুসলিমদের মধ্যে রয়েছে উদ্বাস্তু যারা ফিলিস্তিন ও ইরাক থেকে সিরিয়ায় আশ্রয় নিয়েছে। সুন্নিরাই দেশটির সকল অংশে কাজ করছে, বিশেষ করে সব সামাজিক সংগঠনে কিংবা একটি রাজনৈতিক দলে, সব ক্ষেত্রেই সুন্নিদের প্রাধান্য রয়েছে। সিরিয়ার সবগুলো শহরে এবং প্রদেশে সুন্নিদের সংখ্যা বেশি। শুধু শুয়ায়দায় সুন্নিদের সংখ্যা কম।[২]

আরবিয় সুন্নি মুসলিম[সম্পাদনা]

আরবি ভাষায় কথা বলা সুন্নি মুসলিমরাই দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী।[৯] ১৯৯১ সালে, প্রফেসর অ্যালাসডেয়ার ড্রাইসডেল এবং প্রফেসর রেয়মন্ড হিননেবাস বলেন প্রায় দেশটির ৬০% জনগোষ্ঠী আরবী ভাষায় কথা বলেন।[১১] সম্প্রতি, ড. পিয়েরে বেকোওচি বলেছেন দেশটির ৬০% মানুষ আরব সুন্নি মুসলিম যাদের মধ্যে ৫০০,০০০ মানুষ ফিলিস্তিনের নাগরিক।[১২] পড়াশোনার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সুন্নিদের আরবীয় বলা হয়৷ কিন্তু তা আসলে কথা বলার সংখ্যা দিয়ে বলা হয়, জাতিগতভাবে নয়। উল্লেখ্য, কিছু ছোট ছোট মুসলিম সম্প্রদায়কেও সিরিয়াতে আরবীয় বলা হয়। বিশেষ করে আলবানিয়ানস, বসনিয়ানস, ক্রেতান মুসলিম, পশতুন, পারসিয়ান ইত্যাদি। এছাড়া বড় সম্প্রদায়গুলোকেও আরবিয় বলা হয় যেমন কুর্দি ও তুর্কমেন।[১]

কুর্দি[সম্পাদনা]

কুর্দি বংশীয়রা সিরিয়াতে দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। দেশটির প্রায় ১০% মানুষ এবং তদের মধ্যে বেশিরভাগই সুন্নি মুসলিম।[৯] উত্তর-পুর্বেই মূলত বেশিরভাগ কুর্দিদের বসবাস, অর্থাৎ ইরাক এবং তুরস্কের সীমান্তে। অবশ্য সিরিয়ার মধ্যখানেও কিছু ছোট ছোট গোত্রের কুর্দি সম্প্রদায়ের বসতি রয়েছে। কোবানি ও আফরিন অন্যতম। দামেস্কের মধ্যভাগের কুর্দিসরা আরবী ভাষায় কথা বলে এবং ভালোমতন কুর্দিতে কথা বলেনা।[১৩] ইয়াজেদি সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু মানুষ কুর্দিতে কথা বলে। এদের সংখ্যা ৪০,০০০ হাজারের কাছাকাছি কিন্তু এরা সুন্নি ইসলামী নয়।[১৩]

১৯৭৩ সালে প্রফেসর মশে মাহফুজ বলেন, কুর্দিদের মধ্যে বেশিরভাগই অনারবীয় ভাষায় কথা বলা সুন্নি মুসলিম। যারা দেশটির মোট জনসংখ্যার ৮.৩%।[১৪] আবার, ১৯৭৯ সালে, ড. নিকোলাস দাবি করেন দেশটির মোট জনসংখ্যার ৮.৫% কুর্দি বংশীয় সুন্নি মুসলিম।[১৫] ড. হেনরি মুনসনের মতে এ সংখ্যা ৯%।[১৬] কিন্তু ১৯৯১ সালে প্রফেসর অ্যালাসডেয়ার ড্রাইসডেল এবং প্রফেসর রেয়মন্ড হিনেসবাস বলেন, এ সংখ্যা ৮.৫%।[১১] সাম্প্রতিক দশকে, অন্যান্য ধর্মের (খ্রিস্টান ও ইহুদি) মানুষের সংখ্যা কমে গেছে। অর্থাৎ, সুন্নি কুর্দিদের সংখ্যা বেড়েছে। উদাহারণস্বরূপ, ড. পিয়েরে বেকোওচি বলেছেন, ২০১১ সালের আগে সুন্নদি কুর্দিদের সংখ্যা ছিল দেশটির মোট জনসংখ্যার ৯-১০%।[১২]

তুর্কমেন/তুর্কমান[সম্পাদনা]

নবী হাবিল মসজিদ ষোল শতকের উসমানীয় সম্রাজ্যের মসজিদ

তুর্কিতে কথা বলা তুর্কমেন/তুর্কমান জনগোষ্ঠী দেশটির তৃতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী, যা দেশটির জনসংখ্যার ৪-৫%।[১৩] এদের বসবাস বিভিন্ন শহরের কেন্দ্রস্থলে এবং গ্রামাঞ্চলে। ছয়টি অঞ্চলের গ্রামে এদের বেশি দেখা যায়: আলেপ্পো প্রদেশ, দামেস্ক প্রদেশ, হোমস প্রদেশ, হামা প্রদেশ লাতাকিয়া প্রদেশ এবং কুনেইত্রা প্রদেশে।[১৩]

আল-আদিলিয়া মসজিদ ষোল শতকের আরেকটি উসমানীয় সম্রাজ্যের মসজিদ

১৯৭৩ সালে প্রফেসর মশে মাজফুজ বলেন অনারবীয় সুন্নী মুসলিমদের মধ্যে তুর্কমেন সম্প্রদায়ের লোকরা দেশটির জনসংখ্যার ৩%।[১৪] ড. নিকোলাস,[১৫] ১৯৮৮ সালে মুনসুন,[১৬] ড. হেনরি, প্রফেসর আলাসদাইর দ্রিসদালে এবং প্রফেসর রেউমন্ড হিননেবাসও[১১] একই কথা বলেছেন। সম্প্রতি, ইহুদি, খ্রিস্টানদের সংখ্যা কমেছে। অর্থাৎ তুর্কমেনদের সংখ্যা তাহলে বেড়েছে। উদাহারণস্বরূপ ড. পিয়েরে বেকোওচির মতে ২০১১ সালের আগে তুর্কমেনদের সংখ্যা ছিল দেশটির মোট জনসংখ্যার ৪%।[১২]

যাহোক, সুন্নি তুর্কমেনদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি ধরা যায় যদি আরবীয় হয়ে যাওয়া তুর্কমেনদের সংখ্যাও এতে ধরা হয়৷ এই আরবীয় ভাষায় কথা বলা তুর্কমেনরা নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলে না। আবার কিছু পরিসংখ্যানে দেখা যায় তুর্কমেনরাই দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী, কুর্দিরা নয়।[১৩]

সারকাসিয়ানস[সম্পাদনা]

বেশিরভাগ সারকাসিয়ানরাই সুন্নি মুসলিম।[১] তারা দেশটির পঞ্চম বৃহত্তম সম্প্রদায়। সুন্নি মুসলিমদের মধ্যে চতুর্থ। মূলত তিনটি প্রদেশে এরা বসবাস করে: হামা প্রদেশ, হোমস প্রদেশ এবং কুনেইত্রা প্রদেশে।[১৩]

১৯৯১ সালে, প্রফেসর অ্যালাসডেয়ার ড্রাইসডেল এবং প্রফেসর রেয়মন্ড হিননেসবাস বলেন ১%-এরও কম মানুষ সুন্নি সারকাসিয়ানস।[১১] ধারণা করা হয়, সাম্প্রতিককালে খ্রিস্টান ও ইহুদিদের সংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে দেশটিতে সুন্নি সারকাসিয়ানসদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১.৫%।[১৩]

শিয়া ইসলাম[সম্পাদনা]

সুন্নির পরেই দেশটিতে শিয়া ধর্মাবলম্বী মুসলমানের সংখ্যা বেশি। ২০১১ সালের আগ পর্যন্ত তারা মোট জনসংখ্যার ১৬% দখল করে রেখেছিল এবং তাদের বেশিরভাগই আলাওতিস (১১%) এবং অন্যান্য শিয়া সম্প্রদায় (যেমন ইসমাঈলী)।[১২] এই মুসলিম সম্প্রদায়ের আবার ভিন্নতা রয়েছে: যেমন আরব, কুর্দি, তুর্কমেন/তুর্কমান এবং আরো ক্ষুদ্র কিছু সম্প্রদায়।

আলাউয়ি[সম্পাদনা]

সায়িদা যায়নাব মসজিদ এ জায়নাবের কবর রয়েছে এবং শিয়া মুসলিমদের একটি তীর্থস্থান
সিরিয়ার বর্তমান রাষ্ট্রপতি বাশার আল-আসাদ একজন আলাউয়ি[২]

আলাউয়িরা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম সম্প্রদায় (প্রথমে সুন্নিরা)।[২] হাফেজ আল-আসাদ এবং তার ছেলে বাশার আল-আসাদ আলাউয়ি বংশের।[২]

আলাউয়িরা প্রধান দুইভাগে বিভক্ত: একটি ঐতিহ্যগতভাবে, এটির প্রাধান্যই বেশি এবং অন্যটি মুরশিদ আলাউয়ি যাদের প্রাধান্য কম। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এই আলাউয়িদের যাত্রা শুরু হয়।[২]

১৯৯১ সালে, প্রফেসর আলাসদাইর দ্রিসদালে এবং প্রফেসর রেয়মন্ড হিননেসবাস বলেন পুরো দেশটির জনসংখ্যার ১১.৫% হল আলাউয়ি। সম্প্রতি ড. পিয়েরে বেকোওচি বলেন ২০১১ সালের আগে দেশটিতে আলাউয়িদের সংখ্যা ছিল ১১%।[১১] আলাউয়িরা মূলত সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাস করে। বিশেষ করে লাতাকিয়া গ্রামাঞ্চলে, তারটাস প্রদেশের পাহাড়ের পশ্চিমে এবং হোমস ও হামা প্রদেশের পূর্বাঞ্চলীয় জায়গাগুলোতে।[২] লাতাকিয়া ও তারতাসে তাদের সংখ্যা ৬০%। হোমস এবং হামাতে তাদের সংখ্যা ১০% যেখানে তারা বাস করে তালকালাহ, আল-মুখাররম, আল-কাবা, শিন, আল-রিকামা, হোউলা প্লেইন, মারিয়ামিন, কারমাস, আল মুহানি এবং জাহরা ও নাজিহা জায়গাগুলোতে।[২]

ইসমাইলি[সম্পাদনা]

শিয়া ইসলামের মধ্যে ইসমাইলিরা দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। মোট জনসংখ্যার ১% এরও বেশি[৩]। ৭ ইমামের মেনে নেওয়া কিংবা না নেওয়া নিয়ে অন্যান্য গোষ্ঠীর সাথে এই গোষ্ঠী নিজেদের ভাগ করেছে। ইসমাইলিরা বিশ্বাস করে, ষষ্ঠ ইমাম, জাফর আল সাদিক ইসমাইলিকে সপ্তম ইমাম হিসেবে নিযুক্ত করে। এখনও যা প্রচলিত রয়েছে। আবার ইথনা আশারিয়া গোষ্ঠী (শিয়াদের মধ্যেই) বিশ্বাস করে, জাফর ইসমাইলির ভাই মুসা আল কাদিম কে সপ্তম ইমাম হিসেবে নিযুক্ত করেন। এই গোষ্ঠীর ইতিহাস সম্পর্কে খুব কমই জানা যায় এবং নবম শতাব্দীর শেষে এই গোষ্ঠী ভালোভাবে সুগঠিত হয়। ৯৬৯ থেকে ১১৭১ সাল পর্যন্ত, ইসমাঈলী বংশ মিশরে শাসন করে। সিরিয়াতেও এদের প্রভাব ছিল। কিন্তু সিরিয়াতে ইসমাঈলীদের এই প্রভাব মিশরের মুলুক বংশ কেড়ে নেয়।[১৭]

ইসমাইলিরা দুইভাগে বিভক্ত: মুস্তালি ও নিজারি।

সায়িদা রুকাইয়া মসজিদ ১৯৮৫ সালে তৈরি করা হয় এবং এটি ইরানীয় স্থাপত্যের আধুনিক রূপ

প্রফেসর অ্যালাসডেয়ার ড্রাইসডেল এবং প্রফেসর রেয়মন্ড হিননেবাসের মতে ১৯৯১ সালে ইসমাঈলীরা দেশটির মোট জনগোষ্ঠীর ১.৫% দখল করে ছিল।[১১] প্রধানত দুটি প্রদেশে ইসমাঈলীরা বসবাস করে। হামা প্রদেশ এর মধ্যে অন্যতম। এখানে তারা সালামিয়াহ শহরে বসবাস করে এবং এটিকে ইসমাঈলীদের শহর বলা হয়। এছাড়াও তারা মাসাফ শহরে বসবাস করে এবং এর আশপাশের গ্রামাঞ্চলে। আবার হামা প্রদেশে ইসমাঈলীদের কিছু ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ও বসবাস করে। দ্বিতীয় যে প্রদেশে ইসমাঈলীদের সংখ্যা বেশি তা হল তারটাস প্রদেশ। এই প্রদেশের কাদমুস শহর এবং এর আশপাশের গ্রামে। নাহর আল খাওয়াবি গ্রামেও তারা বসবাস করে।[৩]

দ্বাদশবাদি[সম্পাদনা]

দ্বাদশবাদীরা মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.৫%।[৩] রাজনীতিতে এদের ভূমিকা নেই বললেই চলে। তাদের শিয়া ধর্ম মূলত ইরাক ও ইরান কেন্দ্রীয়। যদিও, ইরানের ১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লবের সময় এবং ইরাকের সাথে ইরানের যুদ্ধের সময় ইরানের সাথে সিরিয়ার সম্পৃক্ততা দ্বাদশবাদীদের মর্যাদাকে আরেকটু বাড়িয়ে দেয়৷ প্রতি সপ্তাহে প্রায় অনেক ইরানি পর্যটক দামেস্কে বেড়াতে আসে, তারা শিয়া ধর্মাবলম্বী সায়েদা যায়নাবের মাজার ঘুরে যায়। যিনি ছিলেন মুহাম্মদ সাঃ-এর নাতনি। এটি দামেস্কের একটু বাইরেই অবস্থিত এবং ইসলামের অন্যতম তীর্থস্থান। ইরাকে এই স্থানগুলো ঘোরা কখনই সম্ভব নয় এবং সিরিয়ার দ্বাদশবাদীরা লেবাননের দ্বাদশবাদীদের সাথে তাদের সকল প্রকার যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে।[১৮]

আলেভি[সম্পাদনা]

সিরিয়ার পশ্চিমে কুর্দিস এবং তুর্কমেন আলেভিদের বসবাস। আফরিন জেলার মাবাতি শহরে বেশিরভাগ কুর্দিস আলেভিদের বাস।[৪] ২০১৪ সালে, কুর্দি নিয়ন্ত্রিত আফরিন জেলায় আলেভি সম্প্রদায়ের হেভি ইবরাহিম প্রধানমন্ত্রী হন। আলেপ্পোতে প্রায় হাজারখানেক তুর্কমেন আলেভিরা বসবাস করে। প্রকৃত অর্থে তাদের বেশিরভাগই তুরস্কে পালিয়ে গেছে।[১৯]

দ্রুজ[সম্পাদনা]

সিরিয়াতে দ্রুজরা তৃতীয় বৃহত্তম ইসলামী সম্প্রদায়। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৩%।[৫] তাদের বসবাস মূলত আল-সুয়ায়দা শহরে; এই প্রদেশের ছোট ছোট শহর ও গ্রামকে বলা হয় জাবাল-আল-দ্রুজ (দ্রুজদের পাহাড়)। এরপরে কুনেইত্রা প্রদেশে দ্রুজদের সংখ্যা বেশি। এছাড়াও রিফ দিমাস্ক প্রদেশ, ইদলিব প্রদেশেও দ্রুজরা বাস করে।[৫]

উল্লেখ্য কিছু দ্রুজ বিদেশেও বসবাস করে। লাতিন আমেরিকায় কিছু দ্রুজ বিগত কয়েক শতক ধরে বসবাস করে। ভেনিজুয়েলাতে প্রায় ৫ লক্ষ দ্রুজ বসবাস করে।[৫]

আহ্‌মদীয়া[সম্পাদনা]

আহ্‌মদীয়া হল ছোট ইসলামী সম্প্রদায়। ১৯২০ সালের শুরুতে এর বিকাশ শুরু হয়। সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় খলিফা মির্জা বাশির উদদীন মাহমুদ আহমাদ তার ইউরোপমধ্যপ্রাচ্য সফরের সুযোগে দামেস্ক বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি সায়িদ জায়িন আল আবিদিন ওয়ালিউল্লাহ শাহ এবং জালাল আল দিন শামসকে আহমাদিয়ার নিয়ম কানুন ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে নিযুক্ত করলেন। তাদের সাথে ছিলেন মোউলবী আবু আল আতা জালান্ধারি, যিনি জেরুজালেমে আহমাদিয়ার ধর্ম প্রচারে নিযুক্ত ছিলেন। এই তিনজন তাদের সময় ব্যয় করেছেন সিরিয়ার বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে হাইফা, বেইরুত, কায়রোতে, আহ্‌মদীয়ার নিয়ম কানুন মানুষের মাঝে পৌঁছে দেয়ার জন্য।[২০]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Khalifa, Mustafa (২০১৩), The impossible partition of Syria, Arab Reform Initiative, পৃষ্ঠা 5 
  2. Khalifa 2013, 6.
  3. Khalifa 2013, 7.
  4. https://mobil.derstandard.at/2000076385176/Angriff-auf-Afrin-Vertreibung-vom-Berg-der-Kurden
  5. Khalifa 2013, 6-7.
  6. John F. Devlin, Syria: modern state in an ancient land, Taylor & Francis, 1983, আইএসবিএন ৯৭৮-০-৮৬৫৩১-১৮৫-৫, p. 7].
  7. "Umar (634–644)", The Islamic World to 1600 Multimedia History Tutorials by the Applied History Group, University of Calgary. Last accessed March 2007 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৯ মার্চ ২০১২ তারিখে
  8. Marshall Cavendish, Peoples of Western Asia, Marshall Cavendish Corporation, 2007, আইএসবিএন ৯৭৮-০-৭৬১৪-৭৬৭৭-১, p. 432.
  9. Khalifa 2013, 3.
  10. Hourani, Albert (১৯৪৭), Minorities in the Arab World, Oxford University Press 
  11. Drysdale, Alasdair; Hinnebusch, Raymond A. (১৯৯১), Syria and the Middle East Peace Process, Council on Foreign Relations, পৃষ্ঠা 222, আইএসবিএন 0876091052 
  12. Pierre, Beckouche (২০১৭), "The Country Reports: Syria", Europe’s Mediterranean Neighbourhood, Edward Elgar Publishing, পৃষ্ঠা 178, আইএসবিএন 1786431491 
  13. Khalifa 2013, 4
  14. Ma'oz, Moshe (১৯৭৩), "Syria", Milson, Menahem, Society and Political Structure in the Arab World, Humanities Press, পৃষ্ঠা 89, আইএসবিএন 0391002589 
  15. Van Dam, Nikolaos (১৯৭৯), The Struggle for Power in Syria, Taylor & Francis, পৃষ্ঠা 1, আইএসবিএন 9780856647031 
  16. Munson, Henry (১৯৮৮), Islam and Revolution in the Middle East, Yale University Press, পৃষ্ঠা 85, আইএসবিএন 0300046049 
  17. Cyril Glassé (২০০৩)। The New Encyclopedia of Islam (illustrated, revised সংস্করণ)। Rowman Altamira। পৃষ্ঠা 226। আইএসবিএন 9780759101906 
  18. "Report: Hizbullah Training Shiite Syrians to Defend Villages against Rebels"Naharnet। সংগ্রহের তারিখ ২৯ নভেম্বর ২০১৫ 
  19. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২৭ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ নভেম্বর ২০১৮ 
  20. Khan, Adil Hussain (২০১৫)। From Sufism to Ahmadiyya: A Muslim Minority Movement in South Asia। Indiana University Press। পৃষ্ঠা 134। আইএসবিএন 978-0-253-01529-7 

গ্রন্থপঞ্জি[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]