সামুদ্রিক জীবন
সামুদ্রিক জীবন |
---|
বিষয়ক একটি সার-বিবরণীমূলক ধারাবাহিকের অংশ |
![]() |
|

সামুদ্রিক জীবন বলতে সামুদ্রিক আবাসস্থলের লবণাক্ত জলে বসবাসকারী সমস্ত জলজ প্রাণী, উদ্ভিদ, শৈবাল, ছত্রাক, আদ্যপ্রাণী, এককোষী অণুজীব এবং সংশ্লিষ্ট ভাইরাসকে দিয়ে গঠিত বাস্তু সম্প্রদায়গুলির সমষ্টিকে বোঝায়, যেগুলি প্রান্তিক সমুদ্র এবং মহাসাগরের সমুদ্রজলে, অথবা উপকূলীয় জলাভূমি, উপহ্রদ, মোহনা এবং অন্তর্দেশীয় সমুদ্রের ঈষৎলোনা জলে বসবাস করে। ২০২৩-এর হিসাব অনুযায়ী[হালনাগাদ] ২৪২ লক্ষেরও বেশি সামুদ্রিক প্রজাতি নথিভুক্ত করা হয়েছে, এবং সম্ভবত ২০ লক্ষ সামুদ্রিক প্রজাতি এখনও নথিভুক্ত করা হয়নি। প্রতি বছর গড়ে ২,৩৩২টি নতুন প্রজাতির বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে।[১][২] সামুদ্রিক জীববিজ্ঞান এবং জৈবিক সমুদ্রবিজ্ঞান জ্ঞানের দুইটি প্রধান শাখা ও উচ্চশিক্ষায়তনিক শাস্ত্র যেগুলিতে সামুদ্রিক জীবন বৈজ্ঞানিকভাবে অধ্যয়ন করা হয়।
আয়তনের দিক থেকে মহাসমুদ্রগুলি পৃথিবীর জীবসমূহের আবাসস্থলের প্রায় ৯০% গঠন করেছে।[৩] এগুলি পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস জুড়ে জীবনের আঁতুড়ঘর এবং গুরুত্বপূর্ণ জৈবিক অভয়ারণ্য হিসেবে কাজ করেছে। আর্কীয় যুগের মহাসাগরগুলিতে গভীর সমুদ্রের জলতাপীয় রন্ধ্রগুলির চারপাশে অবাত প্রাককেন্দ্রিক জীব (আর্কিয়া এবং ব্যাকটেরিয়া) হিসেবে জীবনের জ্ঞাত প্রাচীনতম রূপগুলি বিবর্তনের দ্বারা উৎপত্তিলাভ করেছিল। এর পরে সালোক-স্বভোজী জীবগুলির আবির্ভাব ঘটে এবং অগভীর জলের সামুদ্রিক পরিবেশে অণুজীবীয় বুনানিগুলি প্রসারিত হয়। প্রারম্ভিক প্রত্নজীবী যুগে (প্রোটেরোজোয়িক) সংঘটিত মহা জারণ ঘটনাটি সমুদ্রের রাসায়নিক পরিবেশের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধন করে। এর ফলে সম্ভবত অবাত জীবগুলির একটি ব্যাপক আকারে বিলুপ্তির ঘটনা সম্পাদিত হয়। কিন্তু এরপর টিকে যাওয়া অবাত জীব এবং সবাত জীবগুলির মধ্যে মিথোজনি সুকেন্দ্রিক জীবসমূহের বিবর্তন প্রক্রিয়াটি শুরু করে। নব-প্রত্নজীবী (নিওপ্রোটেরোজোয়িক) যুগে সামুদ্রিক সুকেন্দ্রিক জীব থেকে জটিল বহুকোষী জীবগুলির উদ্ভব ঘটে। অ্যাভালন বিস্ফোরণ নামে পরিচিত বেশিরভাগ নিশ্চল দৃশ্যমান প্রাণীগুলির একটি বৃহৎ আকারের বিবর্তনীয় বৈচিত্র্যায়ন ঘটে। এর পরে প্রারম্ভিক দৃশ্যজীবী যুগের (ফ্যানেরোজোয়িক) প্রথম দিকে ক্যামব্রীয় বিস্ফোরণ নামে পরিচিত একটি আরও বিশিষ্ট বৈচিত্র্যায়নের ঘটনা ঘটে, যেখানে সক্রিয়ভাবে চলনশীল সুগঠিত বহুস্তরী-বহুকোষীয় জীব (ইউমেটাজোয়া) বিরাজ করতে শুরু করে। এই সামুদ্রিক প্রাণীগুলি স্বাদু জলেও বিস্তার লাভ করে। অর্ডোভিশীয় যুগের শেষভাগে উপকূলে ভেসে আসা ছত্রাক এবং সবুজ শৈবালগুলি সিলুরীয় এবং ডেভোনীয় যুগের সময় স্থলভাগের অভ্যন্তরে দ্রুত বিস্তারলাভ করে। এভাবে স্থলজ বাস্তুতন্ত্রের বিকাশের পথ প্রশস্ত হয়।
বর্তমানে সামুদ্রিক জীবের প্রজাতিগুলির আকার ০.০২ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক উদ্ভিদকণা (ফাইটোপ্ল্যাংকটন) থেকে শুরু করে নীল তিমির মতো বিশাল সিটাসীয় প্রাণী পর্যন্ত বিস্তৃত, যেটি ৩৩ মিটার (১০৮ ফুট) – পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে।[৪][৫] বিভিন্ন প্রাক্কলনে বেরিয়ে এসেছে যে সামুদ্রিক অণুজীবগুলি মোট সামুদ্রিক জৈবিক ভরের প্রায় ৭০% [৬] থেকে ৯০% [৭] গঠন করেছে। সামুদ্রিক প্রাথমিক উৎপাদক (মূলত সায়ানোব্যাকটেরিয়া এবং হরিৎকণাবিশিষ্ট শৈবাল) সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে অক্সিজেন উৎপন্ন করে ও কার্বন পৃথক করে, যা বিপুল পরিমাণে জৈববস্তু উৎপন্ন করে এবং বায়ুমণ্ডলীয় রসায়নকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে। অন্তঃসমুদ্র পরিযায়ী এবং মিঠাপানি থেকে সমুদ্রে পরিযায়ী মাছের মতো পরিযায়ী প্রাণী প্রজাতিগুলি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে জৈববস্তু এবং জৈবিক শক্তি স্থানান্তরিত করে। এগুলির অনেকগুলি বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রের বিষমানুপাতিকভাবে প্রভাবশালী প্রজাতি হিসেবে কাজ করে। সামুদ্রিক জীবন সমগ্র পৃথিবীর গ্রহীয় প্রকৃতিকে মৌলিকভাবে প্রভাবিত করে। একই সাথে এটি আংশিকভাবে তটরেখার গঠন ও সুরক্ষাদানে ভূমিকা রাখে। এমনকি কিছু সামুদ্রিক জীব (যেমন প্রবাল) সঞ্চিত সামুদ্রিক প্রাচীর নির্মাণের মাধ্যমে নতুন ভূমি সৃষ্টিতে সহায়তা করে।
খাদ্যজালের মধ্যে পালিত ভূমিকা অনুযায়ী সামুদ্রিক জীবনকে মোটামুটিভাবে স্বভোজী জীব এবং পরভোজী জীব - এই দুই দলে ভাগ করা যেতে পারে: প্রথমটির মধ্যে রয়েছে সালোকসংশ্লেষী এবং অতিবিরল রাসায়নিক-সংশ্লেষী জীব (কেমোসিন্থেটিক) (রাসায়নিক স্বভোজী জীব) যারা সূর্যালোক বা তাপোৎপাদী জারণ থেকে প্রাপ্ত শক্তি ব্যবহার করে অজৈব অণুগুলিকে জৈব যৌগে রূপান্তর করতে পারে, যেমন সায়ানোব্যাকটেরিয়া, লৌহ-জারণকারী ব্যাকটেরিয়া, শৈবাল ( সামুদ্রিক শৈবাল এবং বিভিন্ন অণুশৈবাল ) এবং সামুদ্রিক তৃণ; দ্বিতীয় দলটির মধ্যে রয়েছে বাকি সকল জীব যারা পুষ্টি উপাদান এবং শক্তি অর্জনের জন্য আবশ্যকীয়ভাবে অন্যান্য জীব খাদ্য হিসেবে ভক্ষণ করে; এদের মধ্যে রয়েছে প্রাণী, ছত্রাক, আদ্যপ্রাণী (প্রোটিস্ট) এবং অ-সালোকসংশ্লেষী অণুজীবাদি। সামুদ্রিক প্রাণীদেরকে এরপর অনানুষ্ঠানিকভাবে সামুদ্রিক মেরুদণ্ডী প্রাণী ও সামুদ্রিক অমেরুদণ্ডী প্রাণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। তবে উভয় দলই বহুপর্ববিশিষ্ট। সামুদ্রিক মেরুদণ্ডী প্রাণীগুলির মধ্যে রয়েছে সমস্ত নোনা পানির মাছ, সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী, সামুদ্রিক সরীসৃপ এবং সামুদ্রিক পাখি। দ্বিতীয় দলটিতে মেরুদণ্ডী প্রাণী হিসাবে বিবেচিত নয় এমন সমস্ত সামুদ্রিক প্রাণী অন্তর্ভুক্ত। সাধারণত সামুদ্রিক মেরুদণ্ডী প্রাণীরা অনেক বেশি সন্তরণশীল এবং এগুলির অক্সিজেন এবং পুষ্টির বিপাকীয় চাহিদা বেশি। প্রায়শই অক্সিজেন মন্দার ঘটনার সময় এগুলি কষ্টভোগ করে, এমনকি গণমৃত্যুর-ও শিকার হতে পারে (যাকে "মৎস্যহত্যা"-ও বলা হয়)। অন্যদিকে সামুদ্রিক অমেরুদণ্ডী প্রাণীগুলি অনেক বেশি মাত্রায় অক্সিজেনের স্বল্পতা সহ্য করতে পারে এবং স্বল্পমাত্রায় অক্সিজেনযুক্ত জলে বেঁচে থাকার জন্য বহু বিভিন্ন ধরনের অঙ্গসংস্থানিক ও শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের অধিকারী হয়ে থাকে।
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]- দ্য ব্লু প্ল্যানেট - ডেভিড অ্যাটেনবরো
- তালাসা - ফরাসি টেলিভিশন অনুষ্ঠান
- সামুদ্রিক জীবগণনা
- স্থল উপনিবেশায়ন
- সামুদ্রিক শূককীট বাস্তুতন্ত্র
টীকা
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Drogin, B (২ আগস্ট ২০০৯)। "Mapping an ocean of species"। Los Angeles Times। সংগ্রহের তারিখ ১৮ আগস্ট ২০০৯।
- ↑ Bouchet, Philippe; Decock, Wim (জুন ২০২৩)। "Marine biodiversity discovery: the metrics of new species descriptions"। ডিওআই:10.3389/fmars.2023.929989
– ResearchGate-এর মাধ্যমে।
- ↑ "National Oceanic and Atmospheric Administration – Ocean"। NOAA। সংগ্রহের তারিখ ২০ ফেব্রু ২০১৯।
- ↑ Paul, GS (২০১০)। "The Evolution of Dinosaurs and their World"। The Princeton Field Guide to Dinosaurs। Princeton University Press। পৃষ্ঠা 19। আইএসবিএন 978-0-691-13720-9।
- ↑ Bortolotti, Dan (২০০৮)। Wild blue: a natural history of the world's largest animal। Thomas Dunn Books। আইএসবিএন 978-0-312-38387-9। ওসিএলসি 213451450।
- ↑ Bar-On YM, Phillips R, Milo R (জুন ২০১৮)। "The biomass distribution on Earth": 6506–6511। ডিওআই:10.1073/pnas.1711842115
। পিএমআইডি 29784790। পিএমসি 6016768
।
- ↑ "Census Of Marine Life"। Smithsonian। ৩০ এপ্রিল ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ২৯ অক্টোবর ২০২০।