বিষয়বস্তুতে চলুন

সাওরি (মাযহাব)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

সাওরি মাযহাব (আরবি: الثورية) হল ইসলামি ফিকহ বা ইসলামি আইনের একটি স্বল্পকালীন বিদ্যমান থাকা মাযহাব বা মতবাদ। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মহান ইমাম সুফিয়ান সাওরি, যিনি ৮ম শতকের একজন খ্যাতনামা ইসলামি পণ্ডিড, ফকিহ (আইনজ্ঞ) ও হাদীস সংগ্রাহক ছিলেন। [] ইমাম সুফিয়ান সাওরি কুফায় জন্ম গ্রহণ করেন এবং সেখানকার একজন ফকিহ ছিলেন। পরে তিনি বসরায় চলে গেলে তার এই মতবাদটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং এটি মূলত উমাইয়া শাসকদের দ্বারা গৃহীত হয়েছিল। এই মাযহাবের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, ইমাম সাওরি যুদ্ধের সময় আত্মত্যাগকে ফরজ হিসেবে বিবেচনা করতেন। তার শিষ্যদের মধ্যে বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ইয়াহইয়া আল-কাত্তান উল্লেখযোগ্য ছিলেন। তাঁর এই মাযহাব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি; বরং লাইসি মাযহাবের মত এটিও বিলুপ্ত হয়ে যায়। []

ইতিহাস

[সম্পাদনা]

সুফিয়ান সাওরি ৭১৯ খ্রিস্টাব্দে কুফা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কুফার হাদীস শিক্ষার কেন্দ্রের প্রধান ফিকহবিদ হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন। ফিকহের ব্যাপারে তাঁর মতামত অনেকাংশে তাঁর সমসাময়িক ইমাম আবু হানিফার মত ছিল। তবে তিনি আবু হানিফার কিয়াস (তুলনামূলক সিদ্ধান্ত) ও ইস্তিহসানের ব্যবহার সমর্থন করতেন না। []

জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি বসরায় স্থানান্তরিত হন। সেখানে তাঁর ফিকহ সম্পর্কিত চিন্তাধারা ও 'উসূল' বা মৌলনীতি অধিকাংশ ক্ষেত্রে উমাইয়া শাসকগোষ্ঠী ও ইমাম আওজাঈর মতবাদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।[]

জীবনের শেষ সময়গুলি ইমাম সাওরি আত্মগোপনে কাটান। কারণ তাঁর সাথে আব্বাসীয় খলিফা মুহাম্মদ ইবনে মনসুর আল-মাহদির মধ্যে মতবিরোধ হয়। খলিফা তাঁকে কুফার কাজীর (বিচারকের) পদ গ্রহণ করতে একটি চিঠি পাঠান, যেখানে শর্ত ছিল যো, তিনি যেন কোনো রায় বা সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রীয় নীতির বিরোধিতা করে না দেন। কিন্তু ইমাম সাওরি সেই চিঠিটি ছিঁড়ে ফেলে দজলা নদীতে ছুঁড়ে দেন এবং বার্তাবাহকের সামনে ক্ষোভ প্রকাশ করে। এর ফলে খলিফা তার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে গ্রেফতারের আদেশ দেয়। কিন্তু তিনি এর আগেই আত্মগোপনে চলে যান। []

ইন্তেকালের পর তাঁর ছাত্ররা—বিশেষ করে ইয়াহইয়া আল-কাত্তান—তাঁর এই ফিকহি ধারা অবলম্বন করতে চেষ্টা করেন। তবে এই মাযহাব স্বতন্ত্র ও সংগঠিত ধারা হিসেবে টিকে থাকতে পারেনি। যদিও ইমাম সুফিয়ান সাওরির পুরো ফিকহি মাজহাব বিলুপ্ত হয়ে যায়, তবে তাঁর ফিকহি দৃষ্টিভঙ্গি এবং হাদীস সংকলন ইসলামি ঐতিহ্যে অত্যন্ত সম্মানিত। তাঁর মতামত পরবর্তী সব বড় বড় মাযহাবের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। []

বিলুপ্তি

[সম্পাদনা]

সুফিয়ান সাওরির মাযহাব বিলুপ্ত হওয়ার পেছনে দুটি প্রধান কারণ ছিল বলে উল্লেখ করা হয়:

১. রাজনৈতিক নিপীড়নের কারণে আত্মগোপন: তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় খলিফার হাত থেকে বাঁচার জন্য আত্মগোপনে ছিলেন। ফলে বড় পরিসরে তাঁর অনুসারী গড়ে ওঠেনি, যারা তাঁর কাজ চালিয়ে নিয়ে যেতে পারত এবং তার সকল মতামত সংরক্ষণ ও প্রচার করত।

২. নিজের লেখা নষ্ট করার নির্দেশ: যদিও তিনি হাদিস ও এর ব্যাখ্যার বিশদ সংগ্রহ করেছিলেন, তবে তিনি তাঁর প্রধান ছাত্র আম্মার ইবনে সাইফকে নির্দেশ দেন যে, যেন তাঁর সমস্ত লিখিত কাজ পুড়িয়ে ফেলা হয়। আম্মার সেই নির্দেশ পালন করে লেখাগুলো ধ্বংস করে দেন। ফলে তার যা সামান্য লিখিত দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তাও বিলুপ্ত হয়ে যায়।

তবে অন্যান্য ইমামদের ছাত্ররা ইমাম সাওরির অনেক মত ও দৃষ্টিভঙ্গি সংরক্ষণ করে রাখেন। এজন্য তাঁর অনেক চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামি জ্ঞানভাণ্ডারে বর্তমানও সংরক্ষিত আছে; যদিও তা কোনো সংগঠিত মাজহাবের রূপ লাভ করেনি। [][][]

আরো দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Steven C. Judd, “Competitive hagiography in biographies of al-Awzaʿi and Sufyan al-Thawri”, Journal of the American Oriental Society 122:1 (Jan–March, 2002).
  2. Angeliki E. Laiou, et al. (2001). The Crusades from the Perspective of Byzantium and the Muslim World. p. 23.
  3. Philips, Bilal (১৯৯০)। The Evolution of Fiqh। International Islamic Publishing House। পৃষ্ঠা 87–88। আইএসবিএন 8172313551। সংগ্রহের তারিখ ২৩ ডিসেম্বর ২০২১ 
  4. Cook, Michael (১৯৯৭)। "The Opponents of the Writing of Tradition in Early Islam"Arabica44 (Fasc. 4): 480। জেস্টোর 4057289ডিওআই:10.1163/1570058972582317। সংগ্রহের তারিখ জুন ৮, ২০২২ 
  5. Melchert, Christopher (২০১৪)। "The Destruction of Books by Traditionists / La destrucción de libros por los tradicionistas"Al-Qanṭara35 (1): 213–231। ডিওআই:10.3989/alqantara.2014.009অবাধে প্রবেশযোগ্য। সংগ্রহের তারিখ জুন ৮, ২০২২