সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সমালোচনা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সমালোচনায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সম্পর্কিত নৈতিকতা, নীতিশাস্ত্র, কার্যকারিতা, অর্থনীতি, এবং সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়গুলো উঠে আসে। এছাড়া এখানে এই শব্দটি নিয়েও সমালোচনা করা হয়, এবং একে নামের ভুল প্রয়োগ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। "সন্ত্রাসবাদের" বিরুদ্ধে "যুদ্ধ" ধারণাটি অত্যন্ত বিতর্কিত বলে প্রমাণিত হয়েছে, অংশগ্রহণকারী সরকারগুলোর দীর্ঘকাল ধরে চলা নীতি বা সামরিক উদ্দেশ্যগুলো[১] পুরণ করার লক্ষ্যে, নাগরিক স্বাধীনতাকে[২] খর্ব করতে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করার জন্য এই ধারণাটি ব্যবহার করে বলে সমালোচকগণ অভিযোগ করে। অনেকে বলেন, "যুদ্ধ" শব্দটি এই প্রসঙ্গে উপযুক্ত নয় (যেমন মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ), কারণ এক্ষেত্রে কোন সনাক্তকরণযোগ্য শত্রু নেই এবং সামরিক উপায়ে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসকে বিলুপ্ত করার সম্ভাবনাও কম বলে মনে হয়।[৩]

অন্যান্য সমালোচকগণ, যেমন ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা মনে করেন যে "সন্ত্রাসবাদ" একটি শত্রু নয়, বরং একটি কৌশল: একে "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ" বলাটা দুর্নীতির-বিরোধী বিদ্রোহ এবং আন্তর্জাতিক মুজাহিদীন এর মত সংঘাতগুলোর মধ্যকার পার্থক্যকে অস্পষ্ট করে দেয়। শার্লি উইলিয়ামস মনে করেন, ইরাকআফগানিস্তানে সামরিক উপস্থিতি এবং এর সাথে সম্পর্কিত সমপার্শ্বিক ক্ষতির কারণে এই পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও জঙ্গিবাদী হুমকি বৃদ্ধি পায়।[৪] অন্যান্য সমালোচনার মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভণ্ডামি,[৫] মিডিয়া প্ররোচিত গণ-হিস্টেরিয়া,[৬] এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক ও নিরাপত্তা নীতির পরিবর্তনগুলো যা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী মতামত তৈরি করেছে।[৭]

নাম[সম্পাদনা]

বিভিন্ন সমালোচকগ্ণ "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ" শব্দটিকে অর্থহীন বলে অভিহিত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, কোটিপতি এক্টিভিস্ট ও বিনিয়োগকারী জর্জ সোরোস "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ" শব্দটিকে একটি "মিথ্যা রূপক" হিসাবে সমালোচনা করেছিলেন।[৮] রক্রিজ ইনস্টিটিউটের ভাষাবিদ জর্জ লেকফ যুক্তি দেন যে আক্ষরিকভাবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হতে পারে না, কারণ সন্ত্রাস একটি বিমূর্ত বিশেষ্য। "সন্ত্রাসকে অস্ত্র দ্বারা বা শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করানো যায় না। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কখনও শেষ হবে না।"[৯]

মৌলবাদী ইসলামী সক্রিয়তা বিষয়ক সাংবাদিক জেসন বার্ক "সন্ত্রাসবাদ" এবং "সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ" - এই শব্দগুলোর বিষয়ে বলেন:

সন্ত্রাসবাদকে সংজ্ঞায়িত করার একাধিক উপায় আছে এবং এগুলোর সবই বিষয়ীগত। বেশিরভাগই কোন 'উদ্দেশ্য'-কে পুরণ করার জন্য 'গুরুতর সহিংসতার ব্যবহার বা হুমকি'-কে সন্ত্রাসবাদকে হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। কিছু রাষ্ট্র স্পষ্টভাবে গোষ্ঠীর ('উপ-জাতীয়', 'অ-রাষ্ট্র') বা উদ্দেশ্যকে (রাজনৈতিক, মতাদর্শিক, ধর্মীয়) সন্ত্রাসবাদ বলে উল্লেখ করেন। অন্যেরা এক্ষেত্রে নিছকই বেশিরভাগ ব্যক্তির ধারণার উপরেই নির্ভর করেন, যেখানে বিস্ফোরক, আগ্নেয়াস্ত্র বা অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত ব্যক্তির দ্বারা নির্দোষ বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা বা আহত করার কোন ঘটনাই হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ। এগুলোর কোনটাই সন্তোষজনক সংজ্ঞা নয় এবং এই শব্দ নিয়ে সমস্যাটি থেকেই যায়। সর্বোপরি সন্ত্রাসবাদ একটি কৌশল। 'সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' শব্দটি তাই কার্যগতভাবে অর্থহীন। আর এখানে যেহেতু কিছুর অন্বেষণ করার এবং কঠিন আলোচনার কোন স্থান নেই, তাই আমার পছন্দটি হচ্ছে এক্ষেত্রে কম ভরারোপিত শব্দ "মিলিট্যান্সি" ব্যবহার করা। এটা জঙ্গিবাদকে ক্ষমা করার কোন প্রচেষ্টা নয়, বরং নিছকই একে স্পষ্টভাবে বিশ্লেষণ করার একটি প্রচেষ্টা।[১০]

স্থায়ী যুদ্ধ[সম্পাদনা]

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ. বুশ তার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০০১ সালের ভাষণে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের লক্ষ্য তুলে ধরেছিলেন, যেখানে তিনি বলেন, "বিশ্বব্যাপী প্রতিটি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী খুঁজে পাওয়া, তাদের থামানো এবং পরাজিত না করা পর্যন্ত এটি শেষ হবে না।"[১১] একই ভাষণে, তিনি যুদ্ধকে "না শেষ হওয়া কাজ" বলে অভিহিত করেন, একটি যুক্তি তিনি ২০০৬ সালের স্টেট অফ দ্য ইউনিয়ন-এও পুনরাবৃত্তি করেন।

প্রতিরোধী যুদ্ধ[সম্পাদনা]

ইরাক আক্রমণের জন্য একটি ন্যায্যতা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য দেশগুলিতে ইরাকের সন্ত্রাসবাদী, বা অন্যান্য হামলা প্রতিরোধ করা। একে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ক্ষেত্রে প্রচলিত যুদ্ধবিগ্রহের উপলব্ধি হিসাবে দেখা যেতে পারে।

এই ন্যায্যতা প্রতিপাদনের ক্ষেত্রে একটি বড় সমালোচনা হচ্ছে এটি ন্যায় যুদ্ধের শর্তগুলোকে অনুসরণ করেনি, এবং যুক্তরাষ্ট্র স্বপ্রণোদিতভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘ, বিশেষ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কর্তৃত্বকে কমিয়ে দেয়। এই কারণে, জাতিসংঘের সমর্থন ছাড়াই কোন আসন্ন হুমকি দিচ্ছে না এরকম একটি রাষ্ট্রকে আক্রমণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের চার্টার এবং নুরেমবার্গ নীতিমালা সহ আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে। এর ফলে তাদের যুদ্ধ আগ্রাসনের যুদ্ধে পরিণত হয়, যা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত। অতিরিক্ত সমালোচনা হিসেবে এটাও বলা যায় যে, এই আক্রমণের দ্বারা যুক্তরাষ্ট্র একটি উদাহরণ স্থাপন করে থাকতে পারে, যাকে পূর্বনির্ণয় মনে করে অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোও অন্যান্য রাষ্ট্রের উপর আক্রমণকে ন্যায্যতা দিতে পারে।

কাউন্সিল ফর ফরেইন রিলেশনের সভাপতি রিচার্ড এন. হাস বলেন যে, ২০০৩ সালে মার্কিন হস্তক্ষেপের প্রাক্কালে ইরাক হুমকির প্রতিনিধিত্ব করা, বড়জোড় সেই সময় হুমকিগুলো একত্রিত হতে শুরু করে, কিন্তু সেখানকার হুমকি আসন্ন ছিল না।[১২] আক্রমণের পরে বোঝা যায় ইরাক কোনরকম হুমকির প্রতিনিধিত্বও করেনি। "২০০৩ সালের মার্চ মাসে ইরাকের ওপর হামলা করার সিদ্ধান্তটি বিবেচনামূলক ছিল: এটি ছিল ইচ্ছাসূচক যুদ্ধ। আসন্ন বিপদের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনও গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ ছিল না, এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সামরিক বাহিনী ব্যবহার করারও বিকল্প ছিল, যেমন ইরাকের উপর বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞাকে শক্তিশালী করা।"[১৩] যাইহোক, হাস এও বলেন, ২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন হস্তক্ষেপ প্রয়োজনীয়তার যুদ্ধ হিসাবে শুরু হয়েছিল। অতীব গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থগুলি সংকটাপন্ন অবস্থায় ছিল। কিন্তু পরবর্তিতে এটি "পরিবর্তিত হয়ে অন্য কিছু হয়ে যায়, এবং ২০০৯ সালে এটি সীমারেখা অতিক্রম করে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সেখানে মার্কিন সৈন্যদের মাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ঘোষণা করেন যে, 'রাষ্ট্রটির দক্ষিণ ও পূর্বে তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা' মার্কিন নীতির মধ্যে পড়ে।"[১৩] হাসের মতে আফগানিস্তানের যুদ্ধও পরিশেষে প্রয়োজনের যুদ্ধ থেকে ইচ্ছাসূচক যুদ্ধে পরিণত হয়ে যায়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. George Monbiot, "A Wilful Blindness" ("Those who support the coming war with Iraq refuse to see that it has anything to do with US global domination"), monbiot.com (author's website archives), reposted from The Guardian, March 11, 2003, accessed May 28, 2007.
  2. Singel, Ryan (মার্চ ১৩, ২০০৮)। "FBI Tried to Cover Patriot Act Abuses With Flawed, Retroactive Subpoenas, Audit Finds"Wired.com। Wired.com। সংগ্রহের তারিখ ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১২ 
  3. Richissin, Todd (২০০৪-০৯-০২)। ""War on terror" difficult to define"The Baltimore Sun। জানুয়ারি ১৪, ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০১-২৮ 
  4. Williams, Shirley."The seeds of Iraq's future terror". The Guardian, 28 October 2003.
  5. American Hegemony: How to Use It, How to Lose It by Gen. William Odom
  6. Lustick, Ian S. (২০০৬-০৯-০১)। Trapped in the War on Terror। University of Pennsylvania Press। আইএসবিএন 0-8122-3983-0 
  7. "America's Image in the World: Findings from the Pew Global Attitudes Project"। Pew Research Center। মার্চ ১৪, ২০০৭। সংগ্রহের তারিখ ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১২ 
  8. Soros, George. "A Self-Defeating War ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৩ নভেম্বর ২০১৩ তারিখে". The Wall Street Journal, August 2006.
  9. Lakoff, George. "'War on Terror,' Rest In Peace ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে".Rockridge Institute, February 2006.
  10. Burke, Jason (২০০৩)। "2"। Al-Qaeda। I.B. Tauris। পৃষ্ঠা 22আইএসবিএন 978-1-85043-396-5 
  11. "Address to a Joint Session of Congress and the American People" (সংবাদ বিজ্ঞপ্তি)। The White House। সেপ্টেম্বর ২০, ২০০১। 
  12. Haas, Richard N. (মে–জুন ২০১৩)। "The Irony of American Strategy"Foreign Affairs92 (3): 57। সংগ্রহের তারিখ ২৬ জুন ২০১৩ 
  13. Haas, Richard N. (মে–জুন ২০১৩)। "The Irony of American Strategy"Foreign Affairs92 (3): 58। সংগ্রহের তারিখ ২৬ জুন ২০১৩