শ্রীঅঙ্গন গণহত্যা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
শ্রীঅঙ্গন হত্যাকাণ্ড
শ্রীঅঙ্গন গণহত্যা বাংলাদেশ-এ অবস্থিত
শ্রীঅঙ্গন গণহত্যা
স্থানফরিদপুর, বাংলাদেশ
তারিখ২১ এপ্রিল ১৯৭১ (ইউটিসি +৬:০০)
লক্ষ্যবাঙালি হিন্দু
ব্যবহৃত অস্ত্রহালকা মেশিসগান, অর্ধ-সয়ংক্রিয় বন্দুক
নিহত
হামলাকারী দলপাকিস্তান সেনাবাহিনী

শ্রীঅঙ্গন গণহত্যা ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল ফরিদপুরের শ্রীঅঙ্গন মঠের বাংলা হিন্দু সন্ন্যাসীদের গণহত্যার কথা উল্লেখ করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক গণহত্যার শিকারে আট জন সন্ন্যাসী নিহত হন।[১]

পটভূমি[সম্পাদনা]

শ্রীঅঙ্গন

ফরিদপুর শহরের গোলেখামত এলাকার বৈষ্ণবধর্মের মহানাম সম্প্রদায়ের শ্রীঅঙ্গন হল একটি হিন্দু আশ্রম।

হত্যা[সম্পাদনা]

২১ এপ্রিল তারিখে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ফরিদপুরে অবতরণ করে। ঢাকা থেকে তারা গোয়ালন্দ ঘাটে পদ্মা পার করে ফরিদপুরের দিকে অগ্রসর হয়।[২][৩] সন্ধ্যায় তারা ফরিদপুরে প্রবেশ করে গালচমেন্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এই সময়ে, তাদের বিহারী সহযোগী শ্রী অঙ্গন আশ্রমে তাদের থামিয়ে দিল । পাকিস্তান সেনাবাহিনী আশ্রম ঘেরাও করে এবং বিহারি সহযোগীদের সহযোগিতায় যৌথভাবে সেখানে প্রবেশ করে। তাদের আগমনের সংবাদে, কিছু আবাসিক সন্ন্যাসী মঠ থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু নয় জন সন্ন্যাসী আশ্রম ছেড়ে যেতে অস্বীকার করে। সেই সময়ে সন্ন্যাসীরা মন্দিরের প্রার্থনা সভায় কীর্ত্তন গান গাইছিলেন।কীর্ত্তন গান হচ্ছিল জয় জগৎবন্ধু হরি! জয় জয় জগৎবন্ধু হরি । বিহারি সহযোগীরা কীর্তনের মানে হিসেবে বলে সন্নাসীরা বলছে জয় বঙ্গবন্ধু। তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বলে সন্ন্যাসীরা শেখ মুজিবুর রহমানের জয়ের আশায় চিৎকার করছে [১]

পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রার্থনা সভায় প্রবেশ করে এবং মন্দিরের পাশে চালতা গাছের নিচে মন্দিরের সামনে সন্নাসীদের উন্মুক্ত স্থানে টেনে নিয়ে যায়।[২] এক সন্ন্যাসী, নবকুমার ব্রহ্মচারী পালিয়ে গিয়ে সিঁড়ির নিচে রুমের কাছে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। বাকি ৮ জন পাকিস্তানি সৈন্যদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সাক্ষী অনুযায়ী, বারো রাউন্ড গুলি চালানো হয় এক এক সন্নাসীর উপর। সন্ন্যাসীরা জয় জগৎবন্ধু হরি গাইতে গাইতে বীরগতি প্রাপ্ত হন।[১]

সৈন্যরা এবং বিহারী সহযোগীরা আশ্রম থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র এবং নগদ লুট করে।[৪] পরদিন সকালে সন্ন্যাসীদের মৃতদেহ ফরিদপুর পৌরসভার একটি ট্রাক নিয়ে যায়।[৪] ২৬ শে এপ্রিল, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ডায়নামাইট ব্যবহার করে মন্দিরের শিখর ধ্বংস করে দেয়।[৪]

ভবিষ্যৎ ফল[সম্পাদনা]

পরে পাকিস্তানি দখলদারিত্বের প্রথম দিনে নির্মম হত্যাকাণ্ড হিন্দু নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।[২] তাদের মধ্যে অনেকেই গ্রামে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। দুজন জীবিত সন্ন্যাসী অমর বন্ধু এবং হরিপ্রিয় ব্রহ্মচারী প্রভু জগৎবন্ধুর পবিত্র দেহাবশেষ পুনরুদ্ধার করেন এবং ভারতে নিয়ে যান।[৩]

রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী মতে ক্যাপ্টেন জামশেদ এই হত্যাকাণ্ডের আদেশ দেন । তিনি পাক হানাদার দ্বারা মন্দিরকে পরবর্তী অপবিত্র করা ও মন্দিরে চালানো ধ্বংসযজ্ঞের কথা উল্লেখ করেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর আত্মসমর্পণের কয়েক দিনের আগেই তিনি জগৎবন্ধু সুন্দরয়ের বেদীর সামনে আত্মহত্যা করেছিলেন।[৫] শিব মন্দিরের পুকুরের নিকটবর্তী শ্রী অঙ্গন আঙিনায় তাকে তার সহযোগীরা সমাধি দেয়।[৫] মুক্তিযোদ্ধা প্রবোধ কুমার সরকারের সাক্ষ্য অনুযায়ী ক্যাপ্টেন জামশেদ তার মৃত্যুর আগে পাগল হয়ে গিয়েছিল।[৫] বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সন্ন্যাসীরা ফিরে আসেন।তারা প্রভু জগৎবন্ধুর পবিত্র দেহাবশেষ পুনরায় সেখানে স্থাপন করেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির পুনর্নির্মাণ করেন। এখানে ক্রমান্বয়ে নতুন সন্ন্যাসী তৈরি হতে শুরু করে।[৩]

স্মৃতিসৌধ[সম্পাদনা]

১৯৯৬ সালে আশ্রম কর্তৃপক্ষ কর্তৃক শ্রী অঙ্গন আশ্রমে একটি স্মারক নির্মিত হয়েছিল। আট জন মৃত সন্ন্যাসীদের জন্য আটটি কালো ফলক স্থাপিত হয়েছিল। ফলকগুলি দেখতে চকচকে পিরামিডের মতো । যার ভূমির আয়তন ৪০ বর্গ সেন্টিমিটার এবং উচ্চতা ৯৫ সেন্টিমিটার।[৬]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. খান, আবু সাইদ (২০১৩)। মুক্তিযুদ্ধে ফরিদপুর। ঢাকা: সাহিত্য বিকাশ। পৃষ্ঠা 149–150। আইএসবিএন 9848320857 
  2. "Innocent devotees could not escape the wrath of Pak army"। ঢাকা: বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা। ৬ ডিসেম্বর ২০০৯। ২০১৫-০২-০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ 
  3. "Innocent devotees could not escape wrath of Pak army"। ঢাকা: বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা। ২৯ নভেম্বর ২০১৪। ২০১৫-০২-০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ 
  4. "ফরিদপুর শ্রীঅঙ্গনের ৮ সাধু হত্যা দিবস সোমবার"sorejominbarta.com। ২১ এপ্রিল ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  5. Trivedi, Rabindranath (২৮ মে ২০০৭)। "April 1971: 'Recalling Massacres of Those Days in Faridpur'"Asian Tribune। Hallstavik: World Institute For Asian Studies। 12 (1017)। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ 
  6. খান, আবু সাইদ (২০১৩)। মুক্তিযুদ্ধে ফরিদপুর। ঢাকা: সাহিত্য বিকাশ। পৃষ্ঠা ১৮০। আইএসবিএন 9848320857