শিশু আইন ২০১৩
শিশু আইন ২০১৩[১] বাংলাদেশ সরকারের ২০১৩ সালের প্রণীত একটি আইন, যার উদ্দেশ্য শিশুদের অধিকার সুরক্ষা, তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং সকল প্রকার সহিংসতা, শোষণ ও অবহেলা প্রতিরোধ করা। এই আইনটি জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ (ইউএনসিআরসি)-এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা শিশুদের সর্বোত্তম স্বার্থ, সমতা, সুরক্ষা, এবং উন্নয়ন নিশ্চিত করতে প্রণীত হয়েছে। বাংলাদেশ ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী প্রথম দেশগুলির মধ্যে একটি এবং এ আইন তার প্রতিফলন হিসেবে কাজ করে। শিশু আইন ২০১৩-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ শিশুদের জন্য একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামো নিশ্চিত করেছে, যা শিশুদের প্রতি সকল প্রকার বৈষম্যহীনতা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করে। পূর্বে, শিশু আইন, ১৯৭৪[২] আইনটি রদ করে, জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে এই আইনটি প্রণীত হয়।
শিশু আইন ২০১৩ মোট ১১টি অধ্যায়ে বিভক্ত, যা শিশুদের অধিকার, সুরক্ষা, বিচার ও পুনর্বাসন ব্যবস্থা নিয়ে গঠিত। প্রথম অধ্যায় প্রারম্ভিক বিষয় এবং সংজ্ঞা নির্ধারণ করে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে শিশুদের অধিকার ও সুরক্ষার ব্যাপারে বিধান দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায় শিশুদের প্রতি নির্যাতন, শোষণ ও অবহেলা প্রতিরোধ এবং পুনর্বাসন ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেয়। পঞ্চম থেকে অষ্টম অধ্যায় পর্যন্ত শিশুদের জন্য পৃথক বিচার ব্যবস্থা, শিশু আদালত[note ১]-এর ক্ষমতা, এবং তার কার্যক্রমের বিধান রয়েছে। নবম ও দশম অধ্যায় শিশুদের জন্য সহায়ক ব্যবস্থা, সংশোধনমূলক কার্যক্রম, এবং শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ ও শাস্তির কথা উল্লেখ করেছে। একাদশ অধ্যায়ে শিশু সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের ভূমিকা এবং অন্যান্য বিধানাবলী নির্ধারিত হয়েছে।
অধ্যায় ১: প্রারম্ভিক
[সম্পাদনা]শিশু আইন ২০১৩-এর প্রথম অধ্যায়টি মূলত সংজ্ঞা এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদবী ও ভূমিকার ব্যাখ্যা প্রদান করে। এখানে শিশু কারা, তা স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এই অধ্যায়ে উল্লেখযোগ্য কিছু মূল পদ হল সামাজিক কর্মী এবং প্রবেশন অফিসার[note ২]। সামাজিক কর্মীদের দায়িত্ব হলো শিশুদের সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং তাদের উন্নয়নে সহায়তা করা। প্রবেশন অফিসাররা শিশুদের পুনর্বাসন এবং সংশোধনের জন্য আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে। এছাড়াও, শিশু সুরক্ষার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের ভূমিকা এবং দায়িত্ব উল্লেখ করা হয়েছে।
অধ্যায় ২: প্রবেশন কর্মকর্তা নিয়োগ এবং তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য
[সম্পাদনা]এই অধ্যায়টি প্রবেশন কর্মকর্তাদের নিয়োগ এবং তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণ করে। প্রবেশন কর্মকর্তারা শিশুর সাথে সংশ্লিষ্ট আইনি প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সরকার প্রতিটি জেলা, উপজেলা, এবং মেট্রোপলিটন এলাকায় এক বা একাধিক প্রবেশন কর্মকর্তা নিয়োগ করতে পারে। কোনো এলাকায় প্রবেশন কর্মকর্তা না থাকলে, সমাজসেবা কর্মকর্তারা সেই দায়িত্ব পালন করতে পারেন। প্রবেশন কর্মকর্তারা শিশুদের আইনি প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে এবং তাদের সুরক্ষা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করে। এই প্রবেশন কর্মকর্তা বা সমাজসেবা কর্মকর্তা, সমাজসেবা অধিদফতর, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় দ্বারা নিয়োজিত হয়ে থাকেন।
প্রবেশন কর্মকর্তাদের মূল দায়িত্বগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুদের[note ৩] সুরক্ষা: থানা বা আদালতে শিশুদের আগমন হলে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করা, তাদের সুরক্ষার বিষয়ে আশ্বস্ত করা এবং সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও অভিভাবকের সাথে যোগাযোগ করা।
- আদালতে শিশুদের সহায়তা: শিশুদের আদালতে উপস্থাপন এবং তাদের পক্ষে আইনগত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।
- শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র[note ৪][৩] তদারকি: শিশুর জন্য পৃথক নথি প্রস্তুত, সঠিক পরিচর্যা নিশ্চিতকরণ, এবং শিশুদের নিয়মিত তত্ত্বাবধান করা।
- সামাজিক অনুসন্ধান প্রতিবেদন[note ৫]: সরেজমিনে অনুসন্ধান করে শিশু ও তাহার পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিশ্লেশন করে সামাজিক অনুসন্ধান প্রতিবেদন প্রস্তুত করে আদালতে দাখিল করা।
- শিশুদের পুনর্বাসন পর্যবেক্ষণ: বিকল্পপন্থা[note ৬] বা পুনর্বাসনের শর্তাবলী পর্যবেক্ষণ করা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রদান করা।
অধ্যায় ৩: শিশুকল্যাণ বোর্ড এবং উহার কার্যাবলি
[সম্পাদনা]এই অধ্যায়ে জাতীয় শিশুকল্যাণ বোর্ড, জেলা শিশুকল্যাণ বোর্ড, এবং উপজেলা শিশুকল্যাণ বোর্ড গঠনের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। বোর্ডগুলো শিশুর অধিকার, সুরক্ষা এবং পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। বোর্ডগুলোর নেতৃত্বে থাকবেন সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধিরা।
জাতীয় শিশুকল্যাণ বোর্ডের সভাপতি হবেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী, এবং এতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অন্যূন যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা সদস্য হিসেবে থাকবেন। বোর্ডটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর কার্যক্রম তদারকি, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, এবং পুনর্বাসনের জন্য নীতিমালা ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে।
জেলা শিশুকল্যাণ বোর্ড জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে গঠিত হয় এবং এর মূল কাজ হলো, জেলায় বিদ্যমান শিশু সুরক্ষা কার্যক্রম তদারকি করা, বিকল্প পরিচর্যার পন্থা[note ৭] নির্ধারণ করা, এবং জাতীয় বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করা।
উপজেলা শিশুকল্যাণ বোর্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত হয় এবং এর কার্যাবলি হলো, শিশুদের জন্য স্থানীয়ভাবে যত্ন ও সুরক্ষার ব্যবস্থা তদারকি করা, বিকল্প পরিচর্যার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া এবং জেলা ও জাতীয় বোর্ডের সঙ্গে সমন্বয় করা।
এই বোর্ডগুলো শিশুদের সুরক্ষা, পুনর্বাসন, এবং বিকল্প পরিচর্যা নিশ্চিত করতে পারস্পরিক সমন্বয়ের ভিত্তিতে কাজ করে। তারা সময়ে সময়ে সভা করে শিশু কল্যাণের জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মূল্যায়ন করে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়।
অধ্যায় ৪: শিশুবিষয়ক ডেস্ক, শিশুবিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তা, ইত্যাদি
[সম্পাদনা]এই অধ্যায়টি থানায় শিশুবিষয়ক ডেস্ক গঠনের নির্দেশনা দেয়, যেখানে সাব-ইন্সপেক্টর পর্যায়ের বা তার উপরের একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে এই ডেস্কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। যদি কোন থানায় মহিলা সাব-ইন্সপেক্টর থাকেন, তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এই কর্মকর্তাকে শিশুবিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে গণ্য করা হয়, এবং তিনি শিশুদের সুরক্ষার জন্য একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই অধ্যায়টি শিশুদের সুরক্ষা ও বিচার প্রক্রিয়ায় তাদের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে আলাদা ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্বারোপ করে, যাতে তারা যথাযথ সুরক্ষা ও সহায়তা পায়।
শিশুবিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্ব:
- নথি ও রেজিস্টার সংরক্ষণ: শিশুবিষয়ক মামলাগুলোর জন্য পৃথক নথি ও রেজিস্টার রাখা, যেখানে শিশুর সাথে সংক্রান্ত সকল তথ্য থাকবে।
- প্রবেশন কর্মকর্তার সাথে সমন্বয়: থানায় শিশু এলে প্রবেশন কর্মকর্তাকে অবহিত করা এবং শিশুদের অভিভাবক বা তত্ত্বাবধায়কদের দ্রুত জানানো।
- শিশুর প্রাথমিক যত্ন ও সুরক্ষা: শিশুদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার দিকে নজর রাখা। প্রয়োজনে প্রাথমিক চিকিৎসা ও মানসিক সেবা প্রদান করা এবং শিশুদের ক্লিনিক বা হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা।
- শিশুর বয়স নির্ধারণ: শিশুর সঠিক বয়স নির্ধারণের জন্য জন্ম নিবন্ধন সনদ বা অন্যান্য নথি যাচাই করা।
- অভিযোগ মূল্যায়ন ও জামিন: প্রবেশন কর্মকর্তার সঙ্গে যৌথভাবে শিশুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পর্যালোচনা এবং বিকল্পপন্থা অবলম্বন করে জামিনের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করা। যদি বিকল্পপন্থা অবলম্বন করা সম্ভব না হয়, তাহলে শিশুকে আদালতে প্রথম হাজিরার আগে নিরাপদ স্থানে পাঠানোর ব্যবস্থা করা। প্রতি মাসে শিশুদের মামলার তথ্য প্রতিবেদন আকারে পুলিশ সদর দপ্তর ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠানো।
- প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুদের ক্ষেত্রে পৃথক তদন্ত প্রতিবেদন: যদি একই অপরাধে প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশু উভয়ই জড়িত থাকে, তবে তাদের জন্য পৃথক তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে হয়। শিশুদের মামলাগুলো শিশু আদালতে পাঠানো হয়, এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মামলাগুলো সংশ্লিষ্ট এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতে বিচার করা হয়।
অধ্যায় ৫: শিশু-আদালত এবং উহার কার্যপ্রণালী
[সম্পাদনা]এই অধ্যায়ে শিশু-আদালত প্রতিষ্ঠা ও কার্যপ্রণালী সম্পর্কিত বিধান রয়েছে। শিশু-আদালত গঠন করা হবে প্রতিটি জেলা সদরে, যেখানে আইনের সংঘাতে আসা শিশুদের[note ৮] বিরুদ্ধে মামলা পরিচালিত হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা না থাকলে, জেলা ও দায়রা জজ আদালত শিশু-আদালত হিসেবে কাজ করবে। এই অধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য বিষয় গুলো হল:
- শিশু-আদালতের কার্যপ্রণালী: শিশু-আদালত নির্ধারিত সময়, দিন ও পদ্ধতিতে অধিবেশন পরিচালনা করবে। আদালতের কক্ষ সাজানোর ক্ষেত্রে শিশুদের মানসিক ও শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, যাতে তাদের অভিভাবক ও আইনজীবী তাদের পাশে বসতে পারেন। আদালত পরিচালনার সময় পুলিশ বা অন্যান্য কর্মকর্তাদের পেশাগত ইউনিফর্ম পরিধান করবেন না, যাতে শিশুরা আদালতে আরও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এই অধ্যায়ে শিশুদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনা, তাদের সুরক্ষা, এবং বিচার প্রক্রিয়ায় তাদের সর্বোত্তম স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই অধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হল:
- শিশুর বয়স নির্ধারণ: আদালতে হাজির শিশুর বয়স নির্ধারণে প্রাসঙ্গিক তারিখ হিসেবে অপরাধ সংঘটনের তারিখকেই গণ্য করা হবে। আদালত যদি শিশুর বয়স নিয়ে সন্দিহান হয়, তবে আদালত প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান করে তার বয়স নির্ধারণ করবে।
- শিশুর উপস্থিতি: বিচার প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিগতভাবে অংশগ্রহণ শিশুর অধিকার হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে, আদালত শিশুদের সুরক্ষার স্বার্থে, প্রয়োজন অনুযায়ী, শিশুকে ব্যক্তিগতভাবে হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিতে পারবে।
- গোপনীয়তা: শিশু-আদালতের বিচারাধীন কোন শিশুর ছবি, তথ্য বা বিবরণ প্রকাশ করা নিষিদ্ধ, যাতে শিশুর সুরক্ষা ক্ষুণ্ণ না হয়। তবে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে প্রকাশ করা যেতে পারে যদি তা শিশুর স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর না হয়।
- জামিন ও বিকল্প ব্যবস্থা: শিশু-আদালত জামানতসহ বা জামানত ছাড়াই শিশুকে মুক্তি দিতে পারবে। যদি জামিন দেওয়া সম্ভব না হয়, তবে শিশুকে নিরাপদ স্থানে প্রেরণের ব্যবস্থা করা হবে।
- শিশুদের শাস্তি: শিশুর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা যাবে না। তবে গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে আদালত প্রয়োজনীয় বিবেচনায় অন্যান্য শাস্তি দিতে পারে, যেখানে শিশুকে প্রাপ্তবয়স্ক আসামীদের থেকে পৃথক রাখা হবে।
অধ্যায় ৬: গ্রেফতার, তদন্ত, বিকল্প পন্থা (ডাইভার্শন), এবং জামিন
[সম্পাদনা]এই অধ্যায়টি শিশুদের গ্রেফতার, তদন্ত, বিকল্প পন্থা (ডাইভার্শন), এবং জামিন সম্পর্কিত নিয়মাবলি নির্ধারণ করে।
- গ্রেফতার: ৯ বছরের নিচে কোনো শিশুকে কোনো অবস্থাতেই গ্রেফতার করা যাবে না, এবং শিশুকে কোনো নিবর্তনমূলক আইন অনুযায়ী আটক করা যাবে না। গ্রেফতার হলে পুলিশ কর্মকর্তাকে তাৎক্ষণিকভাবে শিশুবিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তাকে অবহিত করতে হবে এবং শিশুর বয়স প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করে নথিতে লিপিবদ্ধ করতে হবে। গ্রেফতার করার সময় শিশুর হাতকড়া বা রশি ব্যবহার করা যাবে না। যদি থানায় শিশুর জন্য উপযুক্ত নিরাপদ স্থান না থাকে, তাহলে তাকে নিরাপদ স্থানে আটক রাখতে হবে, প্রাপ্তবয়স্ক আসামীদের থেকে পৃথক রাখতে হবে।
- মাতা-পিতা ও প্রবেশন কর্মকর্তাকে অবহিতকরণ: শিশুকে গ্রেফতারের পর পুলিশ কর্মকর্তা শিশুর মাতা-পিতা বা অভিভাবক এবং প্রবেশন কর্মকর্তাকে অবহিত করবেন। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে প্রথম আদালতে হাজিরার সময় পুলিশ কর্মকর্তা আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবেন।
- তদন্ত: তদন্তের ক্ষেত্রে, ফৌজদারি কার্যবিধির[note ৯][৪] বিধানাবলি যতদূর সম্ভব অনুসরণ করা হবে।
- বিকল্প পন্থা (ডাইভার্শন): শিশুর গ্রেফতার বা বিচার কার্যক্রমের যেকোনো পর্যায়ে বিকল্প পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে, যেখানে শিশুর পারিবারিক, সামাজিক, আর্থিক এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে বিরোধ নিষ্পত্তি করা হবে। বিকল্প পন্থার শর্ত ভঙ্গ করলে প্রবেশন কর্মকর্তা তা লিখিতভাবে আদালত বা শিশুবিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তাকে অবহিত করবেন।
- জামিন: শিশুকে গ্রেফতারের পর শিশুবিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তা তাকে জামিনে মুক্তি দিতে পারেন, শর্ত ও জামানতসহ বা ছাড়াই। যদি জামিন প্রদান করা না হয়, শিশুকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে। আদালতে হাজির করার পর, আদালত শিশুকে জামিন দেবে বা নিরাপদ স্থানে প্রেরণের আদেশ প্রদান করবে।
- আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুদের সুরক্ষা: শিশুদের সাক্ষ্য গ্রহণ বা তদন্তের সময় তাদের সুরক্ষা এবং গোপনীয়তা নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আদালত শিশুদের সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষার্থে তাদের সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া পরিচালনা করবে, যা শিশুর জন্য কম চাপপূর্ণ হবে এবং তাদের গোপনীয়তা রক্ষা করবে। এই অধ্যায়টি শিশুদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য গ্রেফতার ও তদন্ত প্রক্রিয়ায় বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের উপর গুরুত্বারোপ করে, যেখানে বিকল্প পন্থার মাধ্যমে তাদের পুনর্বাসন এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হয়।
অধ্যায় ৭: আইনগত প্রতিনিধিত্ব ও সহায়তা
[সম্পাদনা]এই অধ্যায়ে আইনের সাথে সংঘাতে জড়িত এবং আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুদের জন্য বাধ্যতামূলক আইনগত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। কোনো শিশু তার আইনগত প্রতিনিধির উপস্থিতি ছাড়া বিচার প্রক্রিয়ার সম্মুখীন হতে পারবে না। যদি শিশুর পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো আইনজীবী নিয়োগ করা না হয়, তাহলে আদালত জেলা আইনগত সহায়তা কমিটির[note ১০] মাধ্যমে শিশুর জন্য একজন আইনজীবী নিয়োগ করবে।
নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবীর শুনানিতে উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক এবং গাফিলতি হলে তাকে মামলার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া, আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুদের সুরক্ষার জন্য আদালত বিশেষ সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে, যেমন অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ এড়ানো এবং নিরাপত্তা প্রদান। এই অধ্যায় শিশুদের ন্যায়বিচার এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য আইনগত সহায়তার গুরুত্বকে নির্দেশ করে।
অধ্যায় ৮: শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র এবং প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠান
[সম্পাদনা]এই অধ্যায়ে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র এবং প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা, রক্ষণাবেক্ষণ, এবং পরিচালনার নীতিমালা নির্ধারণ করা হয়েছে।
- শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও প্রত্যয়ন: সরকার শিশুদের সংশোধন ও উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যা অনুযায়ী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র স্থাপন করবে। প্রয়োজনে, সরকার তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের যে কোনো ইনস্টিটিউটকে প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠান হিসাবে ঘোষণা করতে পারে। প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশুদের বাসস্থান, রক্ষণাবেক্ষণ, এবং উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য ন্যূনতম মানদণ্ড নির্ধারণ করা হবে।
- বেসরকারি উদ্যোগে প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠান: সরকার নির্ধারিত নীতিমালা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি বা সংস্থাকে বেসরকারিভাবে শিশুদের জন্য প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অনুমতি প্রদান করতে পারবে। বৈধ প্রত্যয়নপত্র ছাড়া প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে।
- প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠানে শিশুদের পরিচর্যা: প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশুদের সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষা, সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ, এবং মানসম্মত শিক্ষা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। শিশুদের বয়স, অপরাধের ধরণ অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করে রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
- প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠানের পরিদর্শন: সরকার বা অধিদপ্তরের অনুমতিপ্রাপ্ত প্রতিনিধি প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করতে পারবেন এবং প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সুপারিশ করবেন।
- প্রতিষ্ঠান স্থানান্তর ও প্রত্যয়ন প্রত্যাহার: বিশেষ প্রয়োজনে, অধিদপ্তর কোনো শিশুকে এক প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তরের আদেশ দিতে পারবে। যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রত্যয়ন বাতিল হয়, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানের শিশুদের অন্য প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করা হবে।
অধ্যায় ৯: শিশু সংক্রান্ত বিশেষ অপরাধসমূহের দণ্ড
[সম্পাদনা]এই অধ্যায়ে শিশুদের প্রতি বিভিন্ন ধরনের অপরাধের শাস্তির বিধান উল্লেখ করা হয়েছে, যা শিশুদের সুরক্ষা ও তাদের অধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতার দণ্ড: কোনো ব্যক্তির হেফাজতে থাকা শিশুর প্রতি আঘাত, অবহেলা বা অশালীন প্রদর্শনের কারণে শিশুর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি হলে, তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং এর জন্য সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।
- শিশুকে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োগের দণ্ড: যদি কোনো ব্যক্তি শিশুকে ভিক্ষা করার জন্য ব্যবহার করেন, তবে তিনি সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
- নেশাগ্রস্ত অবস্থায় শিশুর দায়িত্ব পালন: শিশু দেখাশোনার দায়িত্বে থাকাকালে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় পাওয়া গেলে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সর্বোচ্চ ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের শাস্তির বিধান রয়েছে।
- শিশুকে নেশাজাতীয় দ্রব্য প্রদান: শিশুকে অপ্রয়োজনে নেশাজাতীয় দ্রব্য বা বিপজ্জনক ওষুধ প্রদান করলে সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড বা ১ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডের শাস্তি হতে পারে।
- মাদকদ্রব্য বিক্রয়স্থলে শিশুর প্রবেশের অনুমতি: মাদক বিক্রয়স্থলে শিশুকে প্রবেশ করালে বা অনুমতি দিলে সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড বা ১ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
- শিশুকে বাজি বা ঋণ লেনদেনে উৎসাহ প্রদান: যদি কেউ শিশুকে বাজি ধরতে বা ঋণ লেনদেনে উৎসাহ দেয়, তবে তাকে ২ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হতে পারে।
- শিশুর কাছ থেকে দ্রব্য বন্ধক বা ক্রয়: শিশুর কাছ থেকে কোনো দ্রব্য বন্ধক রাখা বা ক্রয় করা অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে এবং এর জন্য সর্বোচ্চ ১ বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।
- শিশুকে যৌনপল্লীতে রাখার দণ্ড: ৪ বছরের অধিক বয়সের কোনো শিশুকে যৌনপল্লীতে থাকতে দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ২ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
- শিশুকে অসৎ পথে পরিচালিত করা: যদি কোনো ব্যক্তি শিশুকে অসৎ পথে পরিচালিত করে, তবে তার সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড হতে পারে।
- শিশুর দ্বারা অবৈধ কার্য সম্পাদন: যদি শিশুকে অবৈধ অস্ত্র বা নিষিদ্ধ দ্রব্য বহন করানো হয়, তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড বা ১ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হবে।
- শিশুর শ্রম শোষণ: যদি শিশুকে শোষণ করে কাজে ব্যবহার করা হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
অধ্যায় ১০: বিকল্প পরিচর্যা ও প্রাসঙ্গিক ব্যবস্থা
[সম্পাদনা]এই অধ্যায়টি সুবিধাবঞ্চিত এবং আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুদের জন্য বিকল্প পরিচর্যার ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করে, যেখানে শিশুর কল্যাণ এবং সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষা করা হয়।
- বিকল্প পরিচর্যা (অল্টারনেটিভ কেয়ার): সুবিধাবঞ্চিত বা আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুদের জন্য বিকল্প পরিচর্যার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, যেখানে তাদের পারিবারিক পুনঃএকীকরণ অগ্রাধিকার পায়। যদি তা সম্ভব না হয়, বর্ধিত পরিবার বা আইনানুগ অভিভাবকের কাছে শিশুকে পুনঃএকীকরণ করা হয়। বিশেষ পরিস্থিতিতে, যদি মাতা-পিতা শিশুকে অনৈতিক কাজে নিয়োজিত করতে পারেন, তখন শিশুকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দেখাশোনা করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
- প্রাতিষ্ঠানিক পরিচর্যা: যদি পারিবারিক পুনঃএকীকরণ সম্ভব না হয়, অধিদপ্তর নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রাতিষ্ঠানিক পরিচর্যা নিশ্চিত করে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশুর বাসস্থান, শিক্ষা, এবং উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়।
- পরিচর্যার মেয়াদ ও অনুসরণ: বিকল্প পরিচর্যার মেয়াদ দীর্ঘ বা স্বল্পমেয়াদি হতে পারে এবং প্রবেশন কর্মকর্তারা নিয়মিতভাবে এই পরিচর্যা পর্যবেক্ষণ করেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন।
- সুবিধাবঞ্চিত শিশু: এই আইনের অধীনে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা এমন শিশু হিসেবে গণ্য হবে যারা মা-বাবাহীন, গৃহহীন, যৌন হয়রানি বা শোষণের শিকার, অথবা অপরাধ জগতে প্রবেশের ঝুঁকিতে আছে।
- শিশুর যাচাই: আইনের সংস্পর্শে আসা বা সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে প্রথমে যাচাই করা হয়, এবং তাদের কল্যাণের জন্য সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
- শিশুকল্যাণ বোর্ড: প্রবেশন কর্মকর্তারা শিশুদের অবস্থা নিয়ে সংশ্লিষ্ট শিশুকল্যাণ বোর্ডকে নিয়মিতভাবে তথ্য সরবরাহ করে, যারা শিশুর কল্যাণ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করে।
এই অধ্যায়টি শিশুদের বিকল্প পরিচর্যা নিশ্চিত করে তাদের কল্যাণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সুরক্ষা প্রদান করে।
একাদশ অধ্যায়: বিবিধ বিধানাবলী
[সম্পাদনা]এই অধ্যায়ে সরকারকে আইনের সঠিক বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। সরকার, প্রয়োজনে, সরকারি গেজেটে প্রকাশের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় বিধি জারি করিতে পারিবে এবং আইন কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যদি আইনের কোনো বিধান বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা দেখা দেয়, তবে সরকার সরকারি প্রজ্ঞাপন দ্বারা সেই অস্পষ্টতা দূর করতে পারবে।
এই আইন বা এর অধীনে প্রণীত বিধির ভিত্তিতে সৎ বিশ্বাসে করা যে কোনো কাজের জন্য কারো বিরুদ্ধে কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা করা যাবে না। এছাড়া, সরকার প্রয়োজনে এই আইনের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করতে পারে, তবে বাংলা ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে বিরোধ থাকলে বাংলা পাঠকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।
এই আইনের কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১৯৭৪ সালের শিশু আইন রহিত হবে। তবে, পূর্ববর্তী আইনের অধীনে করা সব কাজ এবং গৃহীত ব্যবস্থা এই নতুন আইনের অধীনে করা হয়েছে বলে গণ্য হবে। চলমান মামলাগুলি পূর্বের মতোই শিশু আদালতে নিষ্পত্তি হবে, এবং শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নতুন আইনের অধীনে অব্যাহত থাকবে। মাতা-পিতার অবাধ্য শিশুদের যেসব শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে আটক রাখা হয়েছে, তাদের মেয়াদ পূর্ণ হলে তাদের অভিভাবকের কাছে ফেরত দিতে হবে।
টীকা
[সম্পাদনা]- ↑ শিশু আদালত হলো বিশেষায়িত আদালত, যা শিশুদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধ বা শিশু সম্পর্কিত বিষয়গুলো বিচার করে। বাংলাদেশ শিশু আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, প্রতিটি জেলায় শিশু আদালত গঠন করা হয়, যেখানে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের বিচার হয়। শিশু আদালতের বিচার প্রক্রিয়া শিশুদের মানসিক, শারীরিক ও সামাজিক স্বার্থ বিবেচনা করে পরিচালিত হয়, এবং আদালতের পরিবেশ শিশুদের জন্য সহানুভূতিশীল ও সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করা হয়।
- ↑ প্রবেশন কর্মকর্তার কাজ শিশুদের পুনর্বাসন ও সংশোধনের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই কর্মকর্তারা শিশু আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী শিশুদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করেন এবং তাদের সামাজিক ও মানসিক উন্নয়নে সহায়তা করেন। প্রবেশন কর্মকর্তা মূলত শিশুদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা তৈরি করেন এবং তাদের অগ্রগতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেন। যখন কোনো শিশু আইনের সংস্পর্শে আসে, তখন আদালত বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রবেশন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয় শিশু ও তার পরিবারের জন্য সঠিক পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান করার জন্য। এর মধ্যে শিশুকে মানসিক সহায়তা দেওয়া, আইনগত পরামর্শ দেওয়া, এবং আদালতের নির্দেশ অনুসারে বিকল্প পন্থায় শিশুর সমস্যার সমাধান করা অন্যতম কাজ। এছাড়া, এই কর্মকর্তারা শিশুদের পুনঃএকীকরণ নিশ্চিত করতে পরিবার ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করেন। তারা শিশুদের নিরাপদ ও সুস্থ পরিবেশে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করেন, যাতে তারা অপরাধমূলক কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকে এবং সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে।
- ↑ আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু বলতে এমন কোনো শিশুকে বোঝানো হয়, যাকে কোনো অপরাধমূলক ঘটনার শিকার বা প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কিংবা যাকে অপরাধমূলক কার্যকলাপের জন্য অভিযুক্ত করা হয়নি কিন্তু আইনগত প্রক্রিয়ায় তার জড়িত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এই ধরনের শিশুরা কোনো অপরাধের সাক্ষী, ভুক্তভোগী বা অপরাধমূলক ঘটনার সাথে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হতে পারে। আইন ও শিশু সংক্রান্ত সংবেদনশীলতার কারণে, তাদের জন্য বিশেষ সুরক্ষা এবং যত্নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, যাতে তাদের অধিকার সংরক্ষিত হয় এবং তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বিঘ্নিত না হয়।
- ↑ শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র হলো একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, যেখানে বিচারাধীন বা অপরাধমূলক কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত শিশুদের আটক, সংশোধন এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। এই কেন্দ্রগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো সংশ্লিষ্ট শিশুদের আবাসন, শিক্ষা, মানসিক বিকাশ, এবং সংশোধনমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনা। শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে শিশুদের পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, শিক্ষা এবং মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা প্রদান করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো শিশুর শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক বিকাশে সহায়তা করে, যাতে তারা ভবিষ্যতে অপরাধমুক্ত একটি জীবন গড়ে তুলতে পারে। এছাড়াও, এসব কেন্দ্রে শিশুদের মৌলিক চাহিদা যেমন: খাদ্য, চিকিৎসা, নিরাপত্তা এবং শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। বাংলাদেশ ৩ টি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র আছে, ২টি বালক (টঙ্গী, গাজীপুর ও পুলেরহাট, যশোর), ১টি বালিকা (কোনাবাড়ী, গাজীপুর)
- ↑ সামাজিক অনুসন্ধান প্রতিবেদন হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ নথি, যা সংশ্লিষ্ট শিশুর সামগ্রিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে প্রস্তুত করা হয়। এ প্রতিবেদনে শিশুর পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত, এবং মানসিক পরিস্থিতির বিশদ বিবরণ প্রদান করা হয়। সরেজমিনে তদন্তের মাধ্যমে শিশু এবং তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রতিবেদনে শিশুর চলমান অবস্থান, তার ভবিষ্যৎ কল্যাণের সম্ভাবনা, এবং তার সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের সুপারিশ থাকে। আদালতে এই প্রতিবেদনটি দাখিল করা হয়, যাতে শিশু-আদালত শিশুর সুরক্ষা ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার জন্য সঠিক এবং যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
- ↑ বিকল্পপন্থা (ডাইভার্শন) হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে আইনের সহিত সংঘাতে জড়িত শিশুকে আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে এনে পুনর্বাসন, পরামর্শ এবং সমঝোতার মাধ্যমে তার পুনর্গঠন ও সংশোধনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এটি শিশুকে অপরাধমূলক বিচার প্রক্রিয়ার কঠোরতা থেকে রক্ষা করার একটি উপায়। বিকল্পপন্থার মূল লক্ষ্য হলো শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষা করা, অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ করা, এবং শিশুকে তার পরিবার ও সমাজের সঙ্গে পুনঃএকত্রীকরণ করা। এই প্রক্রিয়ায় শিশুর পারিবারিক, সামাজিক, মানসিক এবং শিক্ষাগত পরিস্থিতি বিবেচনা করে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিকল্প সমাধানের ব্যবস্থা করা হয়। বিচার প্রক্রিয়ার পরিবর্তে এই পদ্ধতি শিশুকে কাউন্সেলিং, পুনর্বাসন, এবং অপরাধমূলক কার্যকলাপ থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করে।
- ↑ বিকল্প পরিচর্যা বলতে এমন একটি প্রক্রিয়া বোঝায় যেখানে সুবিধাবঞ্চিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের সুরক্ষা, যত্ন এবং উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারিবারিক বা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার বাইরে বিশেষ পন্থা গ্রহণ করা হয়। এই প্রক্রিয়ার মূল লক্ষ্য হলো শিশুর সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং তার সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষা করা। বিকল্প পরিচর্যার প্রথম ধাপ হলো শিশুর পারিবারিক পরিবেশে পুনঃএকীকরণ করা। যদি কোনো শিশু তার পরিবারের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যায়, তবে তার পরিবারের সঙ্গে পুনঃসংযোগ স্থাপনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিশেষ করে যদি মাতা-পিতা আলাদা থাকেন, তবে শিশুর মতামত এবং কল্যাণকে প্রাধান্য দিয়ে পুনঃএকীকরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যদি পারিবারিক পুনঃএকীকরণ সম্ভব না হয়, তবে শিশুকে সম্প্রদায়ভিত্তিক পরিচর্যা বা বর্ধিত পরিবারের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে পাঠানো হয়। কিন্তু যদি এগুলোও কার্যকর না হয়, তবে শিশুদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পরিচর্যা গ্রহণ করা হয়, যা সরকারি শিশু পরিবার, ছোটমণি নিবাস, দুঃস্থ শিশুদের পুনর্বাসন কেন্দ্র ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করা হয়। বিকল্প পরিচর্যার সময় শিশুর মানসিক, সামাজিক, আর্থিক, এবং শিক্ষাগত প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে তাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা হয়। বিকল্প পরিচর্যার মাধ্যমে শিশুর দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা এবং বিকাশ নিশ্চিত করা হয়, যাতে সে একটি সুরক্ষিত, স্বাস্থ্যকর এবং নৈতিকভাবে উন্নত জীবনযাপন করতে পারে।
- ↑ আইনের সংঘাতে আসা শিশু বলতে সেই সব শিশুদের বোঝানো হয়, যাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে বা যারা অপরাধমূলক কার্যক্রমের সাথে জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এ ধরনের শিশুদের ক্ষেত্রে বিচার প্রক্রিয়া আলাদা, সহানুভূতিশীল, এবং তাদের সংশোধন ও পুনর্বাসনের দিকে বেশি মনোযোগ দেয়া হয়। শিশু আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, আইনের সংঘাতে আসা শিশুদের অপরাধী না ভেবে তাদের উন্নয়ন ও সংশোধনের সুযোগ দেয়া হয়, যাতে তারা সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
- ↑ ফৌজদারি কার্যবিধি হল এমন একটি আইনী কাঠামো যা অপরাধ সংঘটিত হলে বিচার প্রক্রিয়া পরিচালনার জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করে। এটি অপরাধের তদন্ত থেকে শুরু করে বিচার ও শাস্তি নির্ধারণ পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটিকে সংগঠিত করে। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য এই কার্যবিধি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে, কারণ এটি অপরাধের প্রতিকার এবং নৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার একটি পদ্ধতিগত উপায় প্রদান করে। প্রথমত, যখন একটি অপরাধ সংঘটিত হয়, তখন তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই পর্যায়ে পুলিশের কাজ অপরাধের প্রমাণ সংগ্রহ করা, সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা, এবং অপরাধের সাথে জড়িত সকল তথ্য সংগ্রহ করা। ফৌজদারি কার্যবিধির নির্দেশনা অনুযায়ী তদন্তের প্রতিটি ধাপ সম্পন্ন করতে হয়, যাতে আদালতে উপযুক্ত তথ্য প্রদান করা যায় এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তি তৈরি হয়। এরপর, বিচার পর্বে আদালতে মামলা উপস্থাপন করা হয়। এই পর্যায়ে আদালত মামলার সকল প্রমাণাদি, সাক্ষ্য, এবং যুক্তি পর্যালোচনা করে। বিচারক, আইনজীবী, এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট পক্ষের সমন্বয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির নির্দেশনা অনুযায়ী বিচারকাজ পরিচালিত হয়। বিচার চলাকালে সাক্ষীদের জবানবন্দী নেওয়া হয়, প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হয়, এবং অভিযুক্ত ও ভুক্তভোগীর পক্ষ থেকে আইনজীবীরা তাদের যুক্তি তুলে ধরেন। শেষ পর্যায়ে আসে সাজা। যদি আদালত অভিযুক্তকে দোষী প্রমাণিত করে, তবে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী তার শাস্তি নির্ধারণ করা হয়। এটি হতে পারে জেল, জরিমানা, বা অন্য কোনো শাস্তি। এই পুরো প্রক্রিয়াটি অপরাধীদের শাস্তি প্রদান এবং ভুক্তভোগীর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ফৌজদারি কার্যবিধি শুধু অপরাধ দমনের জন্য নয়, বরং সমাজে নৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
- ↑ জেলা লিগ্যাল এইড অফিস হলো এমন একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান যা দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা প্রদান করে, যা জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা এর অধীনে পরিষেবা প্রদান করে থাকে। এখানে আর্থিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিরা বিনামূল্যে আইনজীবী নিয়োগ, আইনি পরামর্শ, মামলা পরিচালনা, এবং বিরোধ মীমাংসার সুযোগ পান। অফিসটি সাধারণ মানুষের আইনগত অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করে এবং নারী, শিশু, প্রবীণসহ অসহায় ব্যক্তিদের সুরক্ষায় সহায়তা করে। এর মাধ্যমে সরকার নিশ্চিত করে যে আর্থিক বা সামাজিক কারণে কেউ যেন ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত না হয়।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ শিশু আইন ২০১৩, http://bdlaws.minlaw.gov.bd/act-details-1119.html
- ↑ শিশু আইন, ১৯৭৪, https://mohonpur.rajshahi.gov.bd/bn/site/page/3S5V-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%81-%E0%A6%86%E0%A6%87%E0%A6%A8-%E0%A7%A7%E0%A7%AF%E0%A7%AD%E0%A7%AA
- ↑ শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র, https://dss.gov.bd/site/page/db785fa0-761d-4684-8617-44b1cae9db2d/%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%81-%E0%A6%89%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A8%E0%A7%9F%E0%A6%A8-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0
- ↑ ফৌজদারী কার্যবিধি, http://bdlaws.minlaw.gov.bd/act-details-75.html