শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ
সুলতান হাজী শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ شمس الدین الیاس شاه | |
---|---|
শাহ-ই-বাঙ্গালা শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান[১] সুলতান-ই-বাঙ্গালা দ্বিতীয় আলেক্সান্ডার শামসুদ্দুনিয়া ওয়াদ্দীন আবুল মুজফ্ফর ইলিয়াস শাহ[২] | |
সপ্তগ্রামের শাসক | |
রাজত্ব | ১৩৪২–১৩৫২ |
পূর্বসূরি | ইজ্জউদ্দীন ইয়াহিয়া |
বাংলার সুলতান | |
রাজত্ব | ১৩৫২–১৩৫৮ |
উত্তরসূরি | সিকন্দর শাহ |
জন্ম | অজানা |
মৃত্যু | ১৩৫৮ |
সমাধি | |
দাম্পত্য সঙ্গী | ফুলোয়ারা বেগম |
বংশধর | সিকন্দর শাহ |
রাজবংশ | ইলিয়াস শাহী রাজবংশ |
ধর্ম | সুন্নি ইসলাম |
সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ (ফার্সি: شمس الدین الیاس شاہ, প্রতিবর্ণীকৃত: Shams al-Dīn Ilyās Shāh; ১৩৪২–১৩৫৮) ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম স্বাধীন মুসলিম শাসক। তিনি ১৩৪২ সালে সোনারগাঁও বিজয়ের পর লখনৌতির সুলতান হন। শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুসলিম স্বাধীন সুলতান ছিলেন এবং ইলিয়াস শাহী বংশের সূচনা করেন, যা ১৫২ বছর ক্ষমতায় ছিল।[৩] ইলিয়াস শাহী বংশ ১৩৪২ সাল থেকে ১৪১৫ সাল পর্যন্ত একটানা ৭৩ বছর অবিভক্ত বাংলা শাসন করে এবং এরপর প্রায় ২০ বছর বিরতি দিয়ে আরো ৫২ বছর তাদের শাসন চলেছিল। সুলতান ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র সুলতান সিকান্দার শাহ ক্ষমতায় আসেন।[৪] বাংলার ইতিহাসে তাকে মহাবীর আলেক্সান্ডারের সাথে তুলনা করা হয়।[৫]
প্রথম জীবন
[সম্পাদনা]তিনি সিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন এবং সিস্তানি মানুষ জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।[৬]
শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ তার জীবনের শুরুতে দিল্লি সালতানতের অধীনে কর্মরত ছিলেন।[৩] কিন্তু কিছু সমস্যার কারণে তিনি বাংলা অঞ্চলে পালিয়ে আসেন এবং তৎকালীন বাংলায় দিল্লির প্রাদেশিক গভর্নর ইজাজউদ্দীন ইয়াহিয়ার অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। ১৩৩৮ সালে ইজাজউদ্দীন ইয়াহিয়ার মৃত্যুর পর শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ সাতগাঁওয়ের শাসনভার গ্রহণ করেন এবং অঞ্চলটিকে দিল্লির কর্তৃত্ব থেকে স্বাধীন ঘোষণা করেন।
১৩৪২ সালে প্রায় দুই বছরব্যাপী যুদ্ধের পর তিনি লখনৌতির সুলতান আলাউদ্দীন আলী শাহকে পরাজিত করে লখনৌতির সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ইলিয়াস শাহী বংশের প্রতিষ্ঠা করেন।
সমগ্র বাংলা একত্রীকরণ
[সম্পাদনা]১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে, ফখরউদ্দিনের পুত্র ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহ যখন পূর্ব বাংলার রাজধানী সোনারগাঁও-এর শাসক ছিলেন, তখন ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁও আক্রমণ করে তাকে বিতাড়িত করেন এবং অঞ্চলটি নিজের দখলে নেন। এইভাবে তিনি বাংলার তিনটি প্রদেশ—সোনারগাঁও, লখনৌতি ও সাতগাঁও—একত্রিত করে সমগ্র বাংলার অধিপতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।[৭]
ইলিয়াস শাহের রাজ্য যে কামরূপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, তা তার পুত্র সিকান্দার শাহের রাজত্বের প্রথম বছরে কামরূপের টাকশালে উৎকীর্ণ একটি মুদ্রা থেকে প্রতীয়মান হয়। এর ফলে বোঝা যায়, ইলিয়াস শাহের সাম্রাজ্য আসাম থেকে বারাণসী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।[৭]
১৩৪৪ সালে তিনি ত্রিহুত অধিকার করেন। তখনকার ত্রিহুতের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত তাকে বিজয়ের জন্য উৎসাহিত করে।[৭] এছাড়া ১৩৫০ সালে তিনি নেপাল অভিযান পরিচালনা করেন। শম্ভুনাথের শিলালিপি ও নেপাল রাজবংশাবলিতে এই আক্রমণের উল্লেখ আছে, যা তার অসাধারণ সেনানায়কত্বের পরিচায়ক।[৭] পরবর্তীতে তিনি উড়িষ্যা, চম্পারণ ও গোরক্ষপুরও জয় করেন।[৭]
ইলিয়াস শাহকে মধ্যযুগীয় মুসলিম বাংলার ইতিহাসে প্রথম বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা বলা যায়। দিল্লির আধিপত্যের বিরুদ্ধে তিনি নিজেকে শক্তিশালী করতে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনি লখনৌতির শাসক হিসেবে বাংলা দখল করলেও বাংলা ভাষাভাষীদের একত্র করে একটি বৃহত্তর ভূখণ্ড ও একক জাতি গঠনের প্রচেষ্টা চালান। তার দূরদর্শিতার ফলেই এই ভৌগোলিক ও জাতিগত ঐক্য প্রতিষ্ঠা পায়।[৭]
তার শাসনামল থেকেই বাঙালিরা একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তখন থেকেই বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণ 'বাঙালি' নামে পরিচিত হতে থাকে, এবং বাংলার বাইরে থেকেও তাদেরকে বাঙালি বলে অভিহিত করা হয়। ইলিয়াস শাহ ‘শাহ-ই-বাঙ্গালাহ’ ও ‘শাহ-ই-বাঙালি’ উপাধি ধারণ করে বাঙালিদের জাতীয় নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই কারণে তাকে মধ্যযুগীয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের জনক বলা যায়।[৭]
দিল্লির সাথে সম্পর্কের টানাপোড়ন
[সম্পাদনা]নেপাল অভিযান
[সম্পাদনা]১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি নেপালের তরাই অঞ্চলে একটি দুঃসাহসিক সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। এর পূর্বে কোনো মুসলিম বাহিনী ওই অঞ্চলে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়নি। তিনি রাজধানী কাঠমান্ডু পর্যন্ত অগ্রসর হন এবং সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ নিয়ে প্রত্যাবর্তন করেন। তবে তিনি নেপালের কোনো অঞ্চল তার রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করেননি।
মৃত্যু
[সম্পাদনা]তিনি ৭৫৯ হিজরির শুরুতে, অর্থাৎ ১৩৫৭ খ্রিস্টাব্দের শেষ অথবা ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দের শুরুর দিকে মৃত্যুবরণ করেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর, সম্পাদকগণ (২০১২)। "ইলিয়াস শাহ"। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743।
- ↑ Ahmad Hasan Dani (১৯৫৭)। "Analysis of the Inscriptions"। Asiatic Society Of Pakistan Vol-ii। পৃষ্ঠা 10।
- ↑ ক খ Lewis, David (২০১১)। Bangladesh: Politics, Economy and Civil Society। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 44। আইএসবিএন 978-1-139-50257-3।
- ↑ Majumdar, R.C. (ed.) (2006). The Delhi Sultanate, Mumbai: Bharatiya Vidya Bhavan, pp.197-201
- ↑ Tim Steel (৮ অক্টো ২০১৬)। "The Alexander of Bangladesh"। ঢাকা ট্রিবিউন।
- ↑ Syed, Muzaffar Husain; Akhtar, Syed Saud; Usmani, B. D. (২০১১-০৯-১৪)। Concise History of Islam (ইসলামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস) (ইংরেজি ভাষায়)। Vij Books India Pvt Ltd (ভিজ বুকস ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড)। পৃষ্ঠা ২৭৬। আইএসবিএন 978-93-82573-47-0।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ ইলিয়াস শাহ - বাংলাপিডিয়া।
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]