বিষয়বস্তুতে চলুন

শরভ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
শরভ
নৃসিংহকে বশীভূত করার জন্য শরভ রূপে শিব, শ্রীলঙ্কার মুন্নেশ্বরম মন্দির থেকে প্যানেল দৃশ্য।
অন্তর্ভুক্তিশৈবধর্ম
সঙ্গীপার্বতী প্রত্যঙ্গীরা হিসেবে

শরভ (সংস্কৃত: शरभ, আইএএসটি : Śarabhaī, তামিল: ஸரபா, কন্নড়: ಶರಭ, তেলুগু: శరభ) বা সরভ হল হিন্দু ধর্মে একটি আট-পায়ের আংশিক-সিংহ এবং আংশিক-পাখিরূপী পশু, যাকে সিংহ বা হাতির চেয়েও শক্তিশালী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সংস্কৃত সাহিত্য অনুযায়ী এর এক লাফে উপত্যকা অতিক্রম করার ক্ষমতা রয়েছে। পরবর্তী সাহিত্যকর্মে শরভকে আট-পা বিশিষ্ট হরিণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।[][]

শৈব ধর্মগ্রন্থগুলো বর্ণনা করে যে, বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের দ্বারা উপাসিত বিষ্ণুর উগ্র মানব-সিংহ অবতার নৃসিংহকে শান্ত করার জন্য দেবতা শিব শরভের রূপ ধারণ করেছিলেন। এই রূপটি জনপ্রিয়ভাবে শরবেশ্বর (“ভগবান শরভ”) বা শরবেশ্বরমূর্তি নামে পরিচিত।[] বৈষ্ণবরা নৃসিংহের প্রতিকৃতিকে শিব-শরভ দ্বারা ধ্বংস করাকে স্বীকার করেনা এবং শরভকে বিষ্ণুর নাম বলে মনে করে। কিছু বৈষ্ণব ধর্মগ্রন্থ থেকে জানা যায় যে বিষ্ণু শরভের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য হিংস্র গণ্ডভেরুণ্ড পাখি-প্রাণীর রূপ ধারণ করেছিলেন।

বৌদ্ধধর্মের জাতক কাহিনীতে শরভকে বুদ্ধের পূর্বজন্ম হিসাবে দেখানো হয়েছে। এটি তিব্বতি বৌদ্ধ শিল্পেও দেখা গেছে, যা প্রচেষ্টার পরিপূর্ণতার প্রতীক। শক্তি এবং মহিমার একটি চিত্র হিসাবে, শরভ অসংখ্য প্রতীকে আবির্ভূত হয়েছেন।

উন্নয়ন এবং প্রতিকৃতির সংগ্রহ

[সম্পাদনা]

প্রারম্ভিক সংস্কৃত সাহিত্যে, শরভকে প্রাথমিকভাবে একটি আক্রমণাত্মক পশু হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যে গর্জন ক'রে পাহাড় ও বনাঞ্চলের অন্যান্য প্রাণীদের ভয় দেখায়। পরবর্তী হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতে, শরভকে সিংহ-নিধনকারী দানব হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল, যার আটটি পা, চোখ শীর্ষে; যে বনে বসবাস করে এবং কাঁচা মাংস খায়। একে ক্রৌঞ্চ পর্বতে বসবাসকারী হিসাবেও উল্লেখ করা হয়েছে তবে দানব হিসাবে নয়। অন্য একটি বিবরণে, শরভ হল গন্ধমাদন পর্বতে সিংহ এবং বাঘের সাথে বসবাসকারী একটি সাধারণ প্রাণী। মহাকাব্যটি ভোজ্য প্রাণীর তালিকায় শরভকেও অন্তর্ভুক্ত করেছে — একে মৃগজাতীয় বলা হয়েছে — কৃষ্ণসারমৃগ, হরিণ, খরগোশ, ভালুক, রুরু হরিণ, সাম্বার, গয়াল, শুয়োর এবং মহিষগোত্রীয় — যাকে অতিথিদের রাতের খাবারের অংশ হিসাবে দেওয়া হয়। শরভ প্রধানত দেবতা শিবের অবতার হিসেবেই উল্লিখিত, মহাকাব্য রামায়ণে একে একজন বানর-রাজা বলা হয়েছে, এছাড়াও একে বীর ও সর্প নাগদের নাম হিসেবে এবং দেবতা বিষ্ণুর পাশাপাশি বুদ্ধের একটি নাম হিসেবেও বলা হয়। সংস্কৃত সাহিত্যে যোদ্ধাদের তুলনা শরভার সাথে হয়েছে।[][] হিন্দু চিকিৎসায় জঙ্গল এবং মাংসের সুগন্ধ সম্পর্কিত পরিবেশগত বিষয়বস্তুকে সংজ্ঞায়িত করতে, সুশ্রুত সংহিতার ১২ শতকের ডালহানের ভাষ্যে, কাশ্মীরের হরিণদের মধ্যে শরভকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু, এর সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করা বৈশিষ্ট্যগুলি হল উটের আকারের একটি আট পায়ের প্রাণী, যার বিশাল শিং আছে এবং একে একটি বড় হিমালয় ছাগল হিসেবে অনুমান করা হয়েছে।[]

শিবের অবতার

[সম্পাদনা]

পুরাণ সাহিত্য অনুসারে শরভ যুক্ত দেবতা শিবের সাথে এবং বিষ্ণুর উগ্র প্রকাশকে বশ করার জন্য তিনি অবতরণ করেন। কিংবদন্তিতে শরভ ও বিষ্ণুর পুরুষ-সিংহ রূপ নৃসিংহের যুদ্ধ, বিষ্ণু (বৈষ্ণব সম্প্রদায়) এবং শিবের (শৈব সম্প্রদায়) ভক্তদের মধ্যে প্রকাশ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে সামনে নিয়ে আসে, যা ভয়ানক বিতর্কের দিকটি প্রকাশ করে।[][][] শিব পুরাণ শরভকে সিংহমুখী, জটা ও ডানাধারী এবং আট পা ও এক হাজার বাহু বিশিষ্ট বলে বর্ণনা করেছে।[][] শরভ উপনিষদে দেখানো হয়েছে শরভের দুটি মাথা, দুটি ডানা, তীক্ষ্ণ নখর সহ সিংহের আটটি পা এবং একটি লম্বা লেজ আছে।[১০] কালিকা পুরাণে শরভকে বর্ণনা করা হয়েছে একটি বিশাল শরীরের অধিকারী কালো বর্ণধারী হিসেবে, যার চার পা নিচের দিকে এবং চার পা উঁচুতে। এটির একটি দীর্ঘ মুখ ও নাক, নখ, আটটি পা, আটটি দাঁত, এক গুচ্ছ কেশর এবং একটি দীর্ঘ লেজ রয়েছে। এটা বারবার উঁচুতে লাফিয়ে জোরে গর্জন করে।[][১১]

চার পা বিশিষ্ট দুই মাথার শরভ

শরবেশ্বরমূর্তির (শরভ হিসাবে শিব) প্রতিকৃতি কামিকাগামা এবং শ্রীতত্ত্বনিধির মতো গ্রন্থে বিশেষভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। কামিকাগামায়, শরভকে সোনালি রঙের একটি পাখির আকারে বর্ণনা করা হয়েছে, যার দুটি উত্থিত ডানা, দুটি লাল চোখ, চারটি পা মাটিতে স্পর্শ করা সিংহের আকারে, নখ সহ চারটি পা উপরের দিকে এবং একটি পশুর লেজ রয়েছে। শরীরের উপরের অংশটি মানুষের মতো, কিন্তু মুখটি একটি অলঙ্কৃত মুকুট সহ একটি সিংহের মুখের মতো দেখানো হয়েছে; পাশের দিকে বের হওয়া লম্বা দাঁত একটি সামগ্রিক ভীতিকর আবহ প্রদান করে। এখানে নৃসিংহকে শরভের পায়ের নীচে অঞ্জলি (হাত ভাঁজ করা প্রার্থনার অঙ্গভঙ্গি) বদ্ধ অবস্থায় সিংহমুখী মানব হিসাবেও দেখায়।[১২] (তথ্যবক্স ছবি দেখুন)

শ্রীতত্ত্বনিধিতে শরবেশ্বরমূর্তি ত্রিশ বাহু বিশিষ্ট; ডানদিকের বাহুগুলিতে বজ্র, মুষ্টি, অভয়, চক্র , শক্তি, দণ্ড, অঙ্কুশ, তলোয়ার, খট্টাঙ্গ, কুঠার, অক্ষমালা, একটি অস্থি, ধনুক, মুষল এবং আগুন ধরা আছে; এবং বাম হাতগুলিতে ফাঁস, বরদা, গদা, তীর, পতাকা ও অন্য ধরনের তলোয়ার, একটি সাপ, একটি পদ্মফুল, মস্তক-পেয়ালা, পুস্তক, লাঙ্গল ও মৃদঙ্গ আছে এবং এক হাতে দুর্গাকে আলিঙ্গনে ঘিরে রাখা। এই রূপটি সৌভাগ্য নিয়ে আসা, সমস্ত রোগ নিরাময় এবং সমস্ত শত্রুদের ধ্বংস করার জন্য প্রশংসিত।[১৩]

তামিলনাড়ুর চোল রাজবংশ শৈব সম্প্রদায়ের বিশ্বাসের প্রতি বিশেষভাবে অনুকূল ছিল। কথিত আছে যে তাদের শাসনামলে সাম্প্রদায়িক দিকটি প্রাধান্য পেয়েছিল। এটি বিক্রম চোল (১১১৮-৩৫) কর্তৃক নির্মিত কুম্বাকোনামের কাছে বিক্রমসোলিশ্বরম মন্দিরের প্রথম দিকের চারটি শরভ চিত্র থেকে স্পষ্ট হয়। অন্যান্য ছবিগুলো আছে তিরুবুভানমের দারাসুরম এবং কামপাহাড়েশ্বর মন্দিরে, যেগুলি একজন চোল শাসক কুলোত্তুঙ্গা চোল তৃতীয় দ্বারা নির্মিত। শরভার ছবি একটি পৃথক মন্দিরে রাখা হয়েছে।[১৪]

তামিলনাড়ুর তাঞ্জোর জেলার একটি শিব মন্দির, ত্রিভুবনম মন্দিরে শরবেশ্বরমূর্তি একটি ভাস্কর্য দেখা যায়, যার তিনটি পা, একটি সিংহের শরীর ও মুখ এবং একটি লেজ আছে। এর চারটি মানব বাহু রয়েছে, যার উপরের ডান হাতে কুড়াল, নীচের ডান হাতে ফাঁস, উপরের বাম হাতে হরিণ এবং নীচের বাম হাতে আগুন। শরবেশ্বরমূর্তির পায়ের নিচে আটটি বাহুসহ নৃসিংহকে ঝাঁপিয়ে পড়া এবং সংগ্রাম করতে দেখানো হয়েছে।[১৫] দারাসুরমের ঐরাবতেশ্বর মন্দিরে চোল যুগের কালো বেসল্টপাথরে নির্মিত একটি বিরল চিত্র আছে। সেখানে শিবকে শরভরূপে চিত্রিত করা হয়েছে। একটি বিশেষ ছোট মন্দিরে, আংশিক মানুষ, পশু এবং পাখি হিসাবে একে দেবত্বারোপণ করা হয়েছে, এটি বিষ্ণুর সিংহ অবতার, নৃসিংহকে ধ্বংস করে। এটি শৈব ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈরিতাকে তুলে ধরে।[১৬] ১১১৩ সালে নির্মিত কর্ণাটকের বেলুরুর চেন্নাকেশব মন্দিরে, বিষ্ণুর অবতার হিসেবে দুই মুখের পাখি গণ্ডবেরুণ্ডকে দেখা যায়, যে একটি প্রাণীর অঙ্গচ্ছেদরত অবস্থায় খোদিত আছে। প্রথমে, একটি বড় অজগর একটি হরিণকে শিকার করে, অজগরটিকে পরে একটি হাতি তুলে নেয় এবং একটি সিংহ হাতিটিকে আক্রমণ করে। তারপর দেখানো আছে শরভ সিংহটিকে গ্রাস করছে, শেষ দৃশ্যে গণ্ডভেরুণ্ড শরভকে ধ্বংস করছে।[১৬]

বিষ্ণুর সাথে শিবের পৌরাণিক কাহিনীর মূর্তিগত উপস্থাপনায়, শরভ রূপটি নৃসিংহের চারপাশে নির্মিত হয়েছে তবে শিবের নারী শক্তি (শক্তি) বোঝাতে কালী ও দুর্গার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ডানা দিয়ে অলঙ্কৃত করা হয়েছে; শরভের একটি পাখির মাথা এবং তার চঞ্চুতে একটি সর্পও দেখানো হয়েছে। [১৭]

হিন্দু শাস্ত্রে

[সম্পাদনা]

মহাভারতে

[সম্পাদনা]

হিন্দু মহাকাব্য মহাভারত বর্ণনা করে: একজন ঋষির (মুনি) সাহায্যে একটি কুকুর বিভিন্ন প্রাণীর রূপ ধারণ করে - একটি কুকুর থেকে শুরু করে সে একটি বাঘ, তারপর একটি হাতি এবং একটি সিংহ এবং একটি শরভ হ'য়ে আশ্রমের প্রত্যেককে আতঙ্কিত করেছিল। অবশেষে, শরভ আরও উগ্র রূপ ধারণ করে। এই উগ্র রূপে সে ঋষিকেও গ্রাস করতে চায়। ঋষি তখন তাঁর কল্যাণের ফলস্বরূপ শরভের বিকাশের পরিবর্তন প্রক্রিয়া বর্ণনা করেন, শেষে শরভকে কুকুরের মতো তার আসল রূপে ফিরে যাওয়ার অভিশাপ দেন।[১৮] মহাকাব্যটিতে শিবের সাথে শরভের সম্পর্ক দেখায় না।

শৈব দৃষ্টিভঙ্গি

[সম্পাদনা]
শরভ (ডানে) নৃসিংহের সাথে হিরণ্যকশিপুকে হত্যা করছে, প্রহ্লাদ ও তার মা প্রত্যক্ষ করছেন।

শিবের অবতার হিসাবে শরভ-এর কিংবদন্তি অনেক হিন্দু ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে এবং প্রত্যেকটিই একজনের ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে মানানসই ভিন্ন সংস্করণ উপস্থাপন করে। কিন্তু এই সমস্ত বর্ণনার মধ্যে একটি সাধারণ বিবৃতি হল যে শরভ হল একটি বিশাল পশু-পাখি জন্তুর সংমিশ্রণ, যার বিপুল শক্তি অভিব্যক্ত হয়েছে বিষ্ণুর অনুরূপ হিংস্র অবতার যেমন নরসিংহকে (মানুষ-সিংহ) প্রশমিত করার উদ্দেশ্যে।

নরসিংহ-শরভ কিংবদন্তি সেইসব দেবতাদের সাথে যুক্ত যারা পৌরাণিক প্রাণীর রূপ ধরে একে অপরকে হত্যা বা বশীভূত করেন। অসুর (দানব) রাজা হিরণ্যকশিপু, যিনি মহাবিশ্বকে আতঙ্কিত করেছিলেন এবং শিবের ভক্ত ছিলেন, তাঁকে বধ করার জন্য বিষ্ণু নরসিংহের রূপ ধারণ করেছিলেন,।[][]

শিব পুরাণ উল্লেখ করেছে: হিরণ্যকশিপুকে বধ করার পর, নরসিংহের ক্রোধ বিশ্বকে হুমকির মুখে ফেলেছিল। দেবতাদের আদেশে শিব বীরভদ্রকে পাঠান নরসিংহের মোকাবেলা করতে। তা ব্যর্থ হলে শিব শরভ রূপে আবির্ভূত হন। শিব পুরাণ এবং কিছু পুরাণে শরভ নরসিংহকে আক্রমণ করে তাকে অচল করার উল্লেখ আছে। এইভাবে তিনি নরসিংহের ভয়ঙ্কর ক্রোধ প্রশমিত করেন।[১৯][২০] এটাও বলা হয় যে শরভ তখন নরসিংহের শিরশ্ছেদ করেছিলেন এবং চামড়া ছাড়িয়েছিলেন যাতে শিব তা পোশাক এবং সিংহ-মস্তক অলংকার হিসেবে পরতে পারেন।[][][২১] লিঙ্গ পুরাণ এবং শরব উপনিষদেও নরসিংহের অঙ্গচ্ছেদ ও হত্যার উল্লেখ রয়েছে। অঙ্গচ্ছেদের পর, বিষ্ণু তার স্বাভাবিক রূপ ধারণ করেন এবং শিবের যথাযথ প্রশংসা করার পর নিজ আবাসে বিশ্রাম গ্রহণ করেন। এখান থেকেই শিব "শরবেশ্বরমূর্তি" বা "সিংহজ্ঞামূর্তি" নামে পরিচিত হন।[১০][২১]

শিব পুরাণ এবং লিঙ্গ পুরাণে যা বলা হয়েছিল তার বিপরীতে, স্কন্দ পুরাণ নরসিংহকে বিশ্বের জন্য হুমকি না ভেবে নিছক উপদ্রব হিসাবে বিবেচনা করে। ধারণা ছিল যে বিষ্ণু স্থায়ীভাবে নরসিংহের উগ্র রূপ গ্রহণ করতে পারেন, যা তার ঐশ্বরিক ভূমিকার জন্য ক্ষতিকর হবে। তাই, শিব-শরভের উদ্দেশ্য ছিল বিষ্ণু যেন তার সিংহের দেহ পরিত্যাগ করে তার আসল ঐশ্বরিক রূপে ফিরে আসেন। নরসিংহ নিজের শরীর দিয়ে শরভকে আঘাত করলেও বিষ্ণুই বেদনায় কাতরাচ্ছিলেন শরভ নন, তাঁর "অটল শরীর" ছিল। তখনই বিষ্ণু বুঝতে পারলেন যে শরভ আসলে শিব এবং তাঁকে প্রণাম করলেন, তাঁর প্রশংসাও করলেন। শিব তখন বিষ্ণুকে আশীর্বাদ করেন এবং তাকে রাক্ষস বধ করার বর দেন।[২১] একটি পুরাণ-এ গল্পটি শেষ হয় এইভাবে- দেবতারা ভয় পেয়েছিলেন যে শরভ নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবেন না। তাই তাঁরা শিবকে শরভ রূপ ত্যাগ করার জন্য অনুরোধ করেন। অতঃপর, শিব শরভের রূপ খণ্ডিত করেছিলেন; তার অঙ্গ বিসর্জন দেওয়া হয় এবং তার ধড় কাপালিকে পরিণত হয়।[২২] বামন পুরাণও গল্পটি নিয়ে আলোচনা করে, শেষে নরসিংহ আবার প্রশান্ত বিষ্ণু হয়ে ওঠেন এবং শরভ শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ হয়ে ওঠেন।[২১] একটি সংস্করণে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে শরভ নরসিংহকে বশীভূত করার পরে তার আসল রূপ দেবী দুর্গার বাহন সিংহের রূপ ধারণ করেছিলেন এবং তার পায়ের কাছে ফিরে এসেছিলেন।[১৯]

কালিকা পুরাণে বিষ্ণুর শূকর অবতার বরাহের পৃথিবী দেবীর সাথে প্রেমময় মৈত্রী ছিল। তিনি এবং তার তিন শূকর পুত্র পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিলেন, যার জন্য শিবকে শরভ রূপ ধারণ করে বরাহ রূপকে হত্যা করতে হয়েছিল। এখানে দেখা যায় নরসিংহ বরাহকে সাহায্য করছে। শরভ প্রথমে নরসিংহকে এবং তারপর বরাহকে হত্যা করে, বিষ্ণু তার উভয় রূপের শক্তি পুনরায় শোষণ করে নেন।[][১১][২৩] অবশেষে শরভ বিষ্ণুকে পরাজিত করেন।[][১১][২৩]

বৈষ্ণব দৃষ্টিভঙ্গি

[সম্পাদনা]
শরভের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নরসিংহ গণ্ডভেরুণ্ডায় রূপান্তরিত হন। চিত্রানুযায়ী অষ্টমুখ গণ্ডভেরুণ্ড-নরসিংহ শরভ ও হিরণ্যকশিপুকে নিজের অঙ্কদেশে বধ করছেন।

বিজয়েন্দ্র তীর্থের (১৫১৪-৯৩) মতো দ্বৈত পণ্ডিত সহ বৈষ্ণব অনুসারীরা নরসিংহের রূপকে শরভ কর্তৃক ধ্বংস করাকে খণ্ডন করেন কারণ তারা মনে করেন শৈব পুরাণ তামসিক এবং তাই প্রামাণিক নয়। অন্যান্য দশটি শৈব কিংবদন্তির সাথে শরভ কিংবদন্তির খণ্ডনটি বিজয়েন্দ্র তীর্থের শৈবসর্বস্বখণ্ডনম নামে একটি পাঠে আলোচনা করা হয়েছে।[২৪]

বথিস্তাভান পুরাণ, বিমথগিরা পুরাণ, প্রধান পুরাণ, প্রহ্লাধস্বয়ম পুরাণ, ভালুক্কা পুরাণ এবং অন্যান্য কিছু আঞ্চলিক দক্ষিণ-ভারতীয় ধর্মগ্রন্থ বর্ণনা করে যে নরসিংহ দুই মাথাযুক্ত আরও ভয়ংকর পাখি-প্রাণী গণ্ডভেরুণ্ড রূপ ধারণ করেছিলেন (আক্ষরিক অর্থে “শক্তিশালী দুই মুখবিশিষ্ট”), যে শিব-শরভের সাথে লড়াই করে এবং তাকে হত্যা করে।[১৬][২৫][২৬]

বিষ্ণু সহস্রনামেও শরভ-এর একটি উল্লেখ রয়েছে, আক্ষরিক অর্থে এটি শরভের (সিংহ-হত্যাকারী প্রাণী) প্রশংসা সূচক বলে মনে হয়।[২৭] আদি শঙ্করাচার্য বিষ্ণু সহস্রনামের এই ৩৫৬তম নামটিকে উল্লেখ করে বলেছেন এটি আদৌ সিংহ-হত্যাকারী প্রাণীর উল্লেখ করে না এবং এর পরিবর্তে তিনি নামটির অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন, "যেহেতু ভগবান স্বয়ং অধিষ্ঠাতারূপে দেহে আলোকিত হন, তাকে শরভ বলা হয়, এবং শরীর হল শর (পচনশীল)।"[২৮]

বিশিষ্টদ্বৈত দর্শনের একজন পণ্ডিত নরসিংহ কৃষ্ণমাচারী বলেছেন যে "শরভ" নামটি দুটি উপায়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে; প্রথম ব্যাখ্যার অর্থ হল "ধ্বংসকারী (যারা নীতিশাস্ত্রের সীমা লঙ্ঘন করে)," যেমনটি দিয়েছেন শ্রী বৈষ্ণব ভাষ্যকার পরাশর ভট্টর এবং দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি আদি শঙ্কর প্রদত্ত।[২৯] প্রাক্তনটি সংস্কৃত ক্রিয়াপদ এসআর এর উপর ভিত্তি করে যার অর্থ "ধ্বংস করতে আঘাত করা"।[২৯] সিভি রাধাকৃষ্ণ শাস্ত্রীর মতে, "শর একটি তীরকেও বোঝায়, এবং পচনশীল দেহ উজ্জ্বল ওঠে যদি তার লক্ষ্য ভগবানের দিকে থাকে, কারণ তিনি সেই দেহে আলোকিত হন।"[২৯]

বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে

[সম্পাদনা]
জাতক কাহিনীতে শরভকে একটি হরিণের অনুরূপ চিত্রিত করা হয়েছে।

জাতক কাহিনীতে, বুদ্ধের পূর্ববর্তী জীবনের বোধিসত্ত্ব একটি জঙ্গলে শরভ হিসাবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, আট পা বিশিষ্ট হরিণ হিসাবে তাঁর জন্মের বর্ণনা রয়েছে। এক রাজা হরিণ শিকার করতে গিয়ে তার ঘোড়াসহ খানাখন্দে পড়ে যান। রাজাকে তার ভাগ্যের কাছে পরিত্যাগ করার পরিবর্তে হরিণটি তাকে উদ্ধার করে। রাজা এই করুণাময় আচরণ দ্বারা গভীরভাবে আপ্লুত হয়েছিলেন এবং নিজের দেশে শিকার নিষিদ্ধ করেছিলেন।[৩০][৩১]

তিব্বতি বৌদ্ধধর্মে, শরভকে ছাগলের মাথা ও শিং, সিংহের কেশর এবং ঘোড়ার শরীর ও পা সহ একটি পশু হিসাবে উপস্থাপন করা হয়। এটি সংকল্প, শক্তি এবং গতির প্রতীক। কখনও কখনও অতিরিক্তভাবে, একে একটি অ্যান্টিলোপের শিং এবং একটি ঈগলের নখর দ্বারা উপস্থাপন করা হয়। কখনও কখনও, ছাগলের মাথা সিংহের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, ঘোড়ার পা সিংহের দ্বারা এবং শিং একটি মেষের হতে পারে। সমস্ত উপস্থাপনার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল ঘোড়ার শরীর। এটিকে প্রায়শই তোরণের ওপর যুবক দেবতা বা বামনদের বাহন হিসাবে চিত্রিত করা হয়। তোরণ হলো বুদ্ধ বা বোধিসত্ত্বের একটি আলোকিত সিংহাসনের পিছনে একটি ছয় স্তরের খিলানপথ। সাথে দেবগণকেও দেখা যায়, তারা প্রচেষ্টার পরিপূর্ণতার প্রতীক (বীর্য)।[৩২][৩৩]

প্রতীক হিসেবে

[সম্পাদনা]
কর্ণাটক রাজ্যের প্রতীক, শরভ দ্বারা সংলগ্ন এবং গণ্ডভেরুণ্ডকে কেন্দ্র করে

কর্ণাটক সরকার, মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয় এবং কর্ণাটক সোপস অ্যান্ড ডিটারজেন্টস লিমিটেড তাদের প্রতীকে শরভের পরিবর্তিতরূপ গ্রহণ করেছে।[৩৪][৩৫]

কর্ণাটক সোপস অ্যান্ড ডিটারজেন্টস লিমিটেডের লোগোতে, শরভকে জ্ঞান, সাহস এবং শক্তির গুণাবলীর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য একটি হাতির মাথা সহ একটি সিংহের দেহের আকারে চিত্রিত করা হয়েছে।[৩৬]

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Pattanaik, Devdutt (২০০৬)। Shiva to Shankara decoding the phallic symbolSharabha (Shiva Purana)। Indus Source। পৃষ্ঠা 123–124। আইএসবিএন 978-81-88569-04-5। ২০২৩-১১-৩০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১১ 
  2. "शरभ"Monier Williams Sanskrit-English Dictionary। পৃষ্ঠা 1057। ২০১২-০২-২৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জানুয়ারি ২০১০ 
  3. Waradpande, N. R. (২০০০)। The mythical Aryans and their invasionSharabha। Books & Books। পৃষ্ঠা 43, 46। আইএসবিএন 978-81-85016-57-3। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০১-০৯ 
  4. Hopkins, E. Washburn (২০০৮)। Epic mythology। Encyclopedia of Indo-Aryan Research। পৃষ্ঠা 18–19। আইএসবিএন 978-1-4437-7716-2। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০১-১৫ 
  5. Mihira, Sree Varaha; Bangalore Venkata Raman (১৯৮৬)। Brihat Jataka of Varahamihira। Motilal Banarsidass Publishers। পৃষ্ঠা 583। আইএসবিএন 978-81-208-1396-0। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০১-১৫ 
  6. Zimmermann, Francis (১৯৯৯)। Volume 4 of Indian medical tradition Alternative Medicine Series। Motilal Banarsidass Publishers। পৃষ্ঠা 82। আইএসবিএন 978-81-208-1618-3। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০১-১৫ 
  7. Blurton, T. Richard (১৯৯৩)। Hindu artSharabha। Harvard University Press। পৃষ্ঠা 123। আইএসবিএন 978-0-674-39189-5। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০১-০৯ 
  8. Roy, Janmajit (২০০২)। Bhagavata Purana। Atlantic Publishers & Distributors। পৃষ্ঠা 93–95। আইএসবিএন 978-81-269-0169-2। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০১-১৫ 
  9. David Knipe, Alf (১৯৮৯)। Criminal gods and demon devotees essays on the guardians of popular Hinduism। SUNY Press। পৃষ্ঠা 153। আইএসবিএন 978-0-88706-981-9 
  10. Rao, T. A.Gopinatha (১৯৯৭)। Elements of Hindu iconography, Volume 2। Motilal Banarsidass Publishers। পৃষ্ঠা 171–173। আইএসবিএন 978-81-208-0878-2। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০১-১৫ 
  11. Shastri, Biswanarayan (১৯৯৪)। Kalika purana। Motilal Banarsidass Publ। পৃষ্ঠা 25–27। আইএসবিএন 978-81-208-1124-9। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০১-১৫ 
  12. Rao pp.172–173
  13. Rao p.173
  14. Smith, David (২০০৩)। The Dance of Siva Religion, Art and Poetry in South India Volume 7 of Cambridge Studies in Religious Traditions। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 193। আইএসবিএন 978-0-521-52865-8। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০১-১৫ 
  15. Rao p.174
  16. "Gandaberunda- The Two Headed Bird"। Kamat Potpourri। ২০১৪-০২-০২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০১-১০ 
  17. Kramrisch, Stella (১৯৯৪)। The Presence of Siva। Princeton University Press। পৃষ্ঠা 436। আইএসবিএন 978-0-691-01930-7। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০১-১৫ 
  18. Ganguli, Kisari Mohan (২০০৯)। The Mahabharata of Krishna-dwaipayana Vyasa, Book-12। BiblioBazaar, LLC। পৃষ্ঠা 347–348। আইএসবিএন 978-0-559-13713-6। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০১-১৫ 
  19. Woodroffe, Sir John। Hymns to the GoddessSaharab। Forgotten Books। পৃষ্ঠা 151। আইএসবিএন 978-1-60620-146-6 
  20. Soifer, Deborah A. (১৯৯১)। The myths of Narasiṁha and Vāmana two avatars in cosmological perspective। SUNY Press। পৃষ্ঠা 90–91। আইএসবিএন 978-0-7914-0799-8 
  21. Phyllis Granoff (২০০৪)। "Saving the Saviour"Origin and growth of the Purāṇic text corpus। Motilal Banarsidass Publishers। পৃষ্ঠা 116–131। আইএসবিএন 8120820495। ২০২৩-১১-৩০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০১-১৫ 
  22. O'Flaherty, Wendy Doniger (১৯৮১)। Śiva, the erotic ascetic। Oxford University Press US। পৃষ্ঠা 282–3। আইএসবিএন 978-0-19-520250-2। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০১-১৫ 
  23. Frederick M. Smith (২০০৬)। The self possessed: deity and spirit possession in South Asian literature। Columbia University Press। পৃষ্ঠা 223–4। আইএসবিএন 9780231137485। ৩০ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ অক্টোবর ২০২৩ 
  24. Sharma, B. N. Krishnamurti (২০০০)। A history of the Dvaita school of Vedānta and its literature from the earliest beginnings to our own times। Motilal Banarsidass Publishers। আইএসবিএন 978-81-208-1575-9। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০১-১৫ 
  25. "Nrsimhadev-Ganda Bherunada and Shiva Sarabha"The Sampradaya Sun। HareKrsna.com। ২৩ মে ২০০৫। ২০১২-০৪-০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ এপ্রিল ২০১০ 
  26. "One bird, two heads"। ২৯ নভেম্বর ২০১৮। ৬ জুলাই ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ অক্টোবর ২০২৩ 
  27. Swami Chinmayananda, Swami (২৫ আগস্ট ১৯৬৯)। VishnusahasranamaChinmaya Mission। পৃষ্ঠা 107। আইএসবিএন 978-81-7597-245-2 [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ] Stanza 37, line 1: "atulah sharabhah bheemah samayagno havirharih sarvalakshanalakshanyah lakshmeevaan samitinjayah."
  28. Tapasyananda, Swami, Sri Vishnu Sahasranama, pg. 91, Chennai: Sri Ramakrishna Math. Sanskrit and English, with an English translation of Sri Sankara Bhagavatpada's commentary.
  29. "Vishnusahsranamam, Volume II- Annotated Commentaries by Sri Narasimhan Krishnamachari" (পিডিএফ)। hobilavalli.org। ২০১০-০৬-২০ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০১-২১ 
  30. "Shakyamuni Buddha - Jataka (previous lives)"। ২০১৩-১০-৩১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০১-০৯ 
  31. Edward Byles Cowell; Sir Robert Chalmers (২০০০)। "Sarabha-Miga-Jataka"The Jātaka or stories of the Buddha's former births। Asian Educational Services। পৃষ্ঠা 166–74। আইএসবিএন 978-81-206-1469-7 
  32. Robert Beér (২০০৪)। The encyclopedia of Tibetan symbols and motifs। Serindia Publications, Inc.। পৃষ্ঠা 80, 90। আইএসবিএন 978-1-932476-10-1 
  33. Robert Beer (২০০৩)। The handbook of Tibetan Buddhist symbols। Serindia Publications, Inc.। পৃষ্ঠা 259। আইএসবিএন 978-1-932476-03-3 
  34. "Gandaberunda- The Two Headed Bird"। ২০১৪-০২-০২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৪-১২ 
  35. "The University Emblem"। University of Mysore। ২০১৩-১০-২৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০১-১০ 
  36. "Profile: Sharabha"। Karnataka Saops and Detergents Limited। ২০১০-০৬-১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০১-০৯