লোকশিল্প

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
লোকশিল্প কোন সমাজের মৌলিক সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। এই লোকেশন এর মাধ্যমে একটি জাতির আচার-আচরণ মনোভাব প্রথা সম্পর্কে গভীরভাবে জানা যায়।

লোকশিল্প লোক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে তৈরি সমস্ত ধরনের চাক্ষুষ শিল্পকে অন্তর্ভুক্ত করে। লোকশিল্পের অনেক ধরনের সংজ্ঞা রয়েছে, তবে সাধারণত বস্তুগুলি কেবলমাত্র আলংকারিক হওয়ার পরিবর্তে কিছু ধরনের ব্যবহারিক উপযোগ থাকে। লোক শিল্পের নির্মাতারা সাধারণত সংস্কৃতির ললিতকলা ঐতিহ্যের পরিবর্তে একটি জনপ্রিয় ঐতিহ্যের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত হয়ে থাকেন। গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ যারা উন্নত সমাজের কাঠামোর মধ্যে বিরাজমান করে কিন্তু ভৌগোলিক অথবা সাংস্কৃতিক কারণে শিল্পের উন্নত ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তাদের নির্মিত এ শিল্পকে লোকশিল্প রূপে বিবেচনা করা হয়।

লোকশিল্প শব্দ দ্বারা যেসব বস্তুকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় সেগুলো বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয় এবং বিশেষ করে "সাংস্কৃতিক উৎপাদনের বিভিন্ন শ্রেণীগুলি ইউরোপে তার ব্যবহার দ্বারা বোঝা যায়, যেখানে শব্দটির উৎপত্তি ঘটে, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, যেখানে এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উন্নত হয়।

লোকশিল্প একটি সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক জীবনের শিকড় এবং জীবন ব্যবস্থা প্রতিফলিত হয়। তারা লোকশিল্প এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ক্ষেত্রের সাথে যুক্ত সুস্পষ্ট সংস্কৃতির চিরায়ত রূপকে ধারণ করে। দৃশ্যমান লোকশিল্প একটি ঐতিহ্যগত সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যবহারের জন্য ঐতিহাসিকভাবে তৈরি করা বস্তুসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করে। অদৃশ্য লোকশিল্প সঙ্গীত, নাচ এবং আখ্যান কাঠামোর মতো শিল্পসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করে। প্রকৃতপক্ষে দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য উভয়ই গড়ে উঠেছিল তখনকার প্রয়োজন মিটানোর জন্য। যখনই এর বাস্তবিক উদ্দেশ্য শেষ হয়ে যায় বা হারিয়ে যায়, তবে এর প্রাথমিক উদ্দেশ্যে বা যে কারণে এটি সৃষ্টি হয়েছিল তা প্রয়োজনীয়তা ছাড়া সেটির রুপান্তরের কোন কারণ অবশিষ্ট থাকে না।

নকশি ছাঁচ লোকশিল্পকলার একটি স্থায়ী ফর্ম। মাটি, পাথর অথবা কাঠ দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের ছাঁচ তৈরি করা হয়। এ ছাঁচে ফেলে বস্ত্তকে বিভিন্ন আকৃতিতে রূপদান করা হয়। কাঠের নকশা করা ছাঁচে রং লাগিয়ে কাপড় ও কাঁথা ছাপানো হয়। কাঠ, মাটি ও পাথরের ছাঁচে মিঠাই, ক্ষীর, আমসত্ত্ব, গুড়ের পাটালি ইত্যাদি তৈরি করা হয়।

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]

বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে কাঁসা ও পিতলের বাসনপত্র এককালে বেশ প্রচলিত ছিল। আজও শত শত গ্রাম্য কারিগর তৈরি করে বিচিত্র ধরনের তৈজসপত্র। প্রথমে মাটির ছাঁচ করে তার মধ্যে ঢেলে দেয় গলিত কাঁসা। ধীরে ধীরে এ গলিত ধাতু ঠান্ডা হয়ে আসে। তখন ওপর থেকে মাটির ছাঁচটি ভেঙে ফেললেই ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে বদনা, বাটি, গ্লাস, থালা ইত্যাদি। তারপর এগুলো পালিশ করা হয়। এ ধরনের বাসনে নানা রকম ফুল পাতার নকশা বা ফরমাশকারীর নাম খোদাই করা থাকে। এমনকি আজকাল অতি আধুনিক গৃহসজ্জার সামগ্রী হিসেবে তামা-পিতলের ঘড়া, থালা, ফুলদানি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।

পোড়ামাটির কাজের ঐতিহ্য এ দেশে বহু যুগের। মাটির কলস, হাঁড়ি, পাতিল, সানকি, ফুলদানি, দইয়ের ভাঁড়, রসের ঠিলা, সন্দেশ ও পিঠার ছাঁচ, টেপা পুতুল ইত্যাদি গড়বার কাজে বাংলাদেশের পালপাড়া ও কুমোরপাড়ার অধিবাসীরা সারা বছরই ব্যস্ত থাকে। আধুনিক রুচির ফুলদানি, ডাইদানি, চায়ের সেট, কৌটা, বাক্স বা ঘর সাজাবার নানা ধরনের শৌখিন সামগ্রী সব কিছুই মাটি দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়া পুরোনোকালের মসজিদ বা * মন্দিরের গায়ে যেসব নকশাদার ইট দেখা যায় তা এদেশের লোকশিল্পের এক অতুলনীয় নিদর্শন।

খুলনার মাদুর এবং সিলেটের শীতলপাটি সকলের কাছে পরিচিত। গ্রীষ্মকালে ব্যবহারে আরামদায়ক বলেই নয়, শীতলপাটির নকশা একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক। অতীতে শীতলপাটির বহু দক্ষ কারিগর ছিল। এ শিল্পীদের দিয়ে এককালে ঢাকার নবাব পরিবার হাতির দাঁতের শীতলপাটি তৈরি করিয়েছিলেন। ঢাকার জাদুঘরে তা সংরক্ষিত আছে। আমাদের গ্রামের ঘরে ঘরে যে শিকা, হাতপাখা, ফুলপিঠা তৈরি করা হয়, তা মোটেই অবহেলার জিনিস নয়। সাধারণ সামগ্রী হলেও যাঁরা এগুলো তৈরি করেন তাঁদের সৌন্দর্যপ্রিয়তার প্রকাশ ঘটে এসব জিনিসের মধ্য দিয়ে।

বাঁশের নানা রকম ব্যবহার ছাড়া আমাদের চলতেই পারি না ছোটোখাটো সামান্য হাতিয়ারের সাহায্যে আমাদের কারিগররা বাঁশ দিয়ে আজকাল আধুনিক রুচির নানা ব্যবহারিক সামগ্রী তৈরি করছে যা শুধু আমাদের নিজেদের দেশেই নয়, বিদেশেও বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া শোলাশিল্পের উৎকৃষ্ট সৃজনশীল নমুনা দেখা যায় পুতুল, টোপর ইত্যাদির মধ্যে।

কাপড়ের পুতুল তৈরি করা আমাদের দেশের মেয়েদের একটি সহজাত শিল্পগুণ। অনেকাংশে এসব পুতুল প্রতীকধর্মী। এগুলো যেমন আমাদের দেশের ঐতিহ্য ও জীবনের প্রতিনিধিত্ব করে, তেমনি বিদেশি পয়সাও উপার্জন করে।

লোকশিল্প সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের দায়িত্ব আমাদের সকলের। বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর, শহরগুলি এবং গ্রামের হাজার হাজার নারী-পুরুষ আছে, যারা কাজ করতে চায় অথচ কাজের অভাবে দিন দিন দারিদ্র্যের শিকার হচ্ছে। সুপরিকল্পিত উপায়ে এবং সুরুচিপূর্ণ লোকশিল্প প্রস্তুতির দিকে মনোযোগ দিলে তাদের সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে।

(পরিমার্জিত)

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]