বিষয়বস্তুতে চলুন

লুইস জ্যাকবস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
লুইস জ্যাকবস

চিত্র:Rabbijacobs.jpg
ব্যক্তিগত তথ্য
জন্ম১৭ জুলাই ১৯২০
ম্যানচেস্টার, ইংল্যান্ড
মৃত্যু১ জুলাই ২০০৬ (বয়স ৮৫)
লন্ডন, ইংল্যান্ড
দাম্পত্য সঙ্গীসোফি (শুলামিত) (১৯২১–২০০৫)
আখ্যাসংরক্ষণশীল ইহুদি মতবাদ
যেখানের শিক্ষার্থীGateshead Yeshiva
কাজরাব্বি, লেখক ও ধর্মতত্ত্ববিদ
ঊর্ধ্বতন পদ
ওয়েবসাইটwww.louisjacobs.org

লুইস জ্যাকবস সিবিই (১৭ জুলাই ১৯২০ – ১ জুলাই ২০০৬)[] ছিলেন যুক্তরাজ্যের একজন বিশিষ্ট রাব্বি, ধর্মতত্ত্ববিদ এবং লেখক। তিনি নিউ লন্ডন সিনাগগের রাব্বি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে তিনি ব্রিটিশ ইহুদি সমাজে "জ্যাকবস বিতর্ক" নামে পরিচিত একটি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন।[]

প্রারম্ভিক জীবন

[সম্পাদনা]

লুইস জ্যাকবস ১৯২০ সালের ১৭ জুলাই ম্যানচেস্টারে জন্মগ্রহণ করেন।[][][]

তিনি ম্যানচেস্টার ইয়েশিভায় পড়াশোনা করেন এবং পরে গেটসহেড কোলেলে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন। সেখানে তাঁর শিক্ষক ছিলেন প্রখ্যাত রাব্বি এলিয়াহু ডেসলার। ম্যানচেস্টার ইয়েশিভা থেকেই তিনি রাব্বি হিসেবে অভিষিক্ত হন।

পরবর্তীতে, তিনি ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে পড়াশোনা করেন এবং The Business Life of the Jews in Babylon, 200–500 CE শীর্ষক গবেষণার উপর পিএইচডি অর্জন করেন।

১৯৪৮ সালে জ্যাকবসকে ম্যানচেস্টার সেন্ট্রাল সিনাগগে রাব্বি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৫৪ সালে তিনি নিউ ওয়েস্ট এন্ড সিনাগগে স্থানান্তরিত হন।

এরপর তিনি Jews' College, লন্ডনে "নৈতিক উপদেশদাতা" (Moral Tutor) হিসেবে নিযুক্ত হন, যেখানে তিনি রাব্বি ড. ইসিডোর এপস্টাইন-এর অধীনে শেষ কয়েক বছর তালমুদধর্মীয় বক্তৃতা-শাস্ত্র পড়ান।

এই সময়ের মধ্যেই জ্যাকবস ধীরে ধীরে তার শৈশবের রূঢ় ধর্মীয় মতবাদ থেকে সরে আসেন এবং আধুনিক বাইবেলের সমালোচনামূলক বিশ্লেষণরূঢ় মতবাদের মধ্যে একটি সমন্বয় খুঁজতে থাকেন।

বিশেষ করে ডকুমেন্টারি হাইপোথেসিস নিয়ে তিনি গভীরভাবে চিন্তা করতেন এবং আধুনিক চিন্তাধারার সঙ্গে প্রথাগত বিশ্বাসের সামঞ্জস্য সাধনের উপায় খুঁজতেন।

এই বিষয়ে তাঁর ভাবনার সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয় We Have Reason to Believe (১৯৫৭) গ্রন্থে। এটি মূলত নিউ ওয়েস্ট এন্ড সিনাগগে তাঁর সাপ্তাহিক পাঠচক্রের আলোচনার ভিত্তিতে রচিত হয়। বইটি প্রকাশের সময় কিছু হালকা সমালোচনা হলেও, কোনো গুরুতর বিরোধিতার সম্মুখীন হয়নি।

We Have Reason to Believe

[সম্পাদনা]

লুইস জ্যাকবসের We Have Reason to Believe শীর্ষক বইটির বেশিরভাগ অংশে এমন বিষয় আলোচনা করা হয়েছে, যেমন ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ, মানবজীবনের কষ্ট, অলৌকিক ঘটনা, পরকাল এবং ইহুদিদের নির্বাচিত জাতি হিসেবে গ্রহণ—যেগুলো মূলত বিতর্কিত নয়।

তবে বইটির বিতর্ক কেন্দ্রীভূত হয় ৬ষ্ঠ, ৭ম এবং ৮ম অধ্যায়ে—The Torah and Modern Criticism, A Synthesis of the Traditional and Critical Views এবং Bible Difficulties

এই অধ্যায়গুলোতে জ্যাকবস বাইবেল সমালোচনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তিনি বিশেষভাবে সূত্র সমালোচনা এবং ডকুমেন্টারি হাইপোথেসিস নিয়ে আলোচনা করেন। এই হাইপোথেসিস অনুযায়ী, তোরাহ একক উৎস থেকে উদ্ভূত নয়; বরং এটি একাধিক উৎস থেকে এসেছে। এটি ঈশ্বর কর্তৃক মোশিকে সম্পূর্ণরূপে প্রদান করা হয়েছে—এই রাব্বিনিক বিশ্বাসের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি করে।

জ্যাকবস বলেন, “ইহুদি ধর্ম প্রত্যাদেশের (revelation) বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে, তবে ঈশ্বর কীভাবে মানুষকে কথা বলেছেন সে বিষয়ে কোনো 'আধিকারিক' ব্যাখ্যা নেই।”[] তিনি উল্লেখ করেন, “কিছু রাব্বির মতে, [তোরাহ] মরুভূমিতে ভ্রমণের সময়কাল জুড়ে ধাপে ধাপে মোশিকে প্রদান করা হয়েছিল।” পাশাপাশি, পাঠ সমালোচনার (textual criticism) আলোচনার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ইহুদি আত্মপক্ষ সমর্থনের (apologetics) কোনো কাজই এই সমস্যাকে এড়িয়ে যেতে পারে না।”[]

এখানে তিনি ইঙ্গিত করেন যে, সমকালীন অনেক ইহুদি নেতৃবৃন্দ আধুনিক সমালোচকদের ভাবনা এড়িয়ে চলার প্রবণতা দেখিয়েছেন, যা একপ্রকার পরোক্ষ ভর্ৎসনারূপ।

তিনি উপসংহারে বলেন, “বিশ্বস্ত ইহুদি পাঠকের জন্য পাঠ সমালোচনার মূলনীতি গ্রহণে কোনো বাধা নেই।”[] যদিও তিনি স্বীকার করেন, “মাইমোনিদিয়ান ভাবনার সঙ্গে ডকুমেন্টারি হাইপোথেসিসকে ‘মিলিয়ে’ ফেলা অর্থহীন, কারণ এই দুটি তত্ত্ব পরস্পরবিরোধী। তবে এর অর্থ এই নয় যে পুরোনো জ্ঞান ও নতুন জ্ঞানের মধ্যে একটি 'সমন্বয়' (synthesis) সম্ভব নয়।”[]

জ্যাকবস তালমুদ এবং অন্যান্য রাব্বিনিক রচনা থেকে বহু উদাহরণ তুলে ধরেন, যেখানে বলা হয়েছে ঈশ্বর কেবল মানুষের *জন্য* নয়, মানুষের *মাধ্যমেও* তাঁর ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

তিনি উপসংহারে বলেন, এমনকি যদি ডকুমেন্টারি হাইপোথেসিস আংশিক বা পুরোপুরি সত্যও হয়,

ঈশ্বরের শক্তি একটুও কমে না যদি তিনি ‘বইয়ের বইটি’ রচনার কাজে তাঁর সৃষ্ট প্রাণীদের সঙ্গে সহযোগিতা করেই কাজটি সম্পন্ন করে থাকেন […] আমরা বাইবেলের পাতাগুলোর মাধ্যমে ঈশ্বরের প্রকৃত কণ্ঠস্বর শুনি […] এবং এই বার্তার গুণ ও শক্তি একটুও হ্রাস পায় না, যদিও এই কণ্ঠ আমরা মানুষের মাধ্যমেই শুনতে পাই।[১০]

“জ্যাকবস বিতর্ক”

[সম্পাদনা]

অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন যে Jews' College-এর প্রিন্সিপাল রাব্বি ড. ইসিডোর এপস্টাইনের অবসর গ্রহণের পর তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে লুইস জ্যাকবস নিয়োগ পাবেন। ১৯৬১ সালে কলেজের ট্রাস্টি বোর্ড এই অনুমানকে বাস্তবে রূপ দিয়ে জ্যাকবসকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানালে, তৎকালীন যুক্তরাজ্যের চিফ রাব্বি ইস্রায়েল ব্রডি এই নিয়োগে বাধা দেন। তিনি বলেন, জ্যাকবসের “প্রকাশিত মতামতের” জন্য তাঁকে এই পদে রাখা যাবে না। এই মন্তব্যের ইঙ্গিত ছিল We Have Reason to Believe বইটির দিকে।

ব্রিটিশ সংবাদপত্র The Jewish Chronicle বিষয়টি তুলে ধরে এটিকে একটি বড় বিতর্কে পরিণত করে, যা জাতীয় সংবাদমাধ্যমেও উঠে আসে, এমনকি The Times-এও রিপোর্ট হয়। এটি ছিল—

একটি ঘটনা যা অ্যাংলো-ইহুদি ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিভাজনে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছিল।

১৯৬৪ সালের ঘটনাগুলো, যা পরে “জ্যাকবস বিতর্ক” নামে পরিচিত হয়, শুধুমাত্র ইহুদি সংবাদমাধ্যমেই নয়, Fleet Street-এর প্রধান সংবাদপত্রগুলো ও BBC এবং ITN-এর নিউজরুমগুলোতেও আধিপত্য বিস্তার করে।

তবে এই বিতর্কে জ্যাকবস নিজে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন না; বরং তাঁকে সেই সময়কার ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ এই ঘটনার মধ্যে টেনে আনে।[১১]

যখন জ্যাকবস আবার নিউ ওয়েস্ট এন্ড সিনাগগে তাঁর পূর্বের পুলপিটে ফিরে যেতে চাইলেন,[১২] তখনও রাব্বি ব্রডি তাঁর নিয়োগে আপত্তি জানান।[১৩] এর ফলে নিউ ওয়েস্ট এন্ড সিনাগগের অনেক সদস্য পদত্যাগ করেন এবং তাঁরা মিলে নিউ লন্ডন সিনাগগ প্রতিষ্ঠা করেন।

এই বিতর্কে জনসাধারণের আগ্রহের একটি প্রমাণ ১৯৬৬ সালে ড. জ্যাকবসের সাথে বার্নার্ড লেভিনের টেলিভিশন সাক্ষাৎকার, যা সেই সময় বহুল আলোচিত হয়।

মৃত্যু ও উত্তরাধিকার

[সম্পাদনা]
রাব্বি লুইস জ্যাকবস ও তাঁর স্ত্রী সোফির সমাধি
রাব্বি লুইস জ্যাকবসের সমাধি

লুইস জ্যাকবস ২০০৬ সালের ১ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।[১৪] তিনি চেশান্টের ওয়েস্টার্ন কবরস্থানে তাঁর স্ত্রী সোফি (শুলামিত) (১৯২১–২০০৫)–এর পাশে সমাহিত হন।

মৃত্যুর কয়েক মাস আগে, জ্যাকবস তাঁর বইয়ের সংগ্রহ অক্সফোর্ডের হিব্রু ও ইহুদি অধ্যয়ন কেন্দ্রের লিওপোল্ড মুলার স্মারক গ্রন্থাগারে দান করেন।

২০০৫ সালের ডিসেম্বরে, The Jewish Chronicle তার গ্রাহকদের মধ্যে একটি মতামত জরিপ চালায়, যেখানে ২,০০০ পাঠক মনোনয়ন প্রদান করেন। এই জরিপে লুইস জ্যাকবসকে ইংল্যান্ডে ইহুদি সম্প্রদায়ের ৩৫০ বছরের ইতিহাসে "সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রিটিশ ইহুদি" হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। এ প্রসঙ্গে জ্যাকবস মন্তব্য করেন, “আমি খুবই সম্মানিত বোধ করছি—এবং কিছুটা উদ্ভটও মনে হচ্ছে।”

তাঁকে “সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রিটিশ ইহুদি” মনোনীত করা হয়েছে—এই সংবাদটি যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পেয়েছিল।

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. তামুজ ৫৭৬৬ হিব্রু বর্ষ
  2. Latchman, David (২৮ মার্চ ২০২৩)। "The Jacobs Affair: A Theological Storm from Within"The Times of Israel। ২ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ এপ্রিল ২০২৪আমি যে ঘটনাটির কথা বলছি, তা হল তথাকথিত জ্যাকবস বিতর্ক—যা ঘিরে ছিলেন রাব্বি ড. লুইস জ্যাকবস (১৯২০–২০০৬)। [...] বিতর্কের আগে রাব্বি জ্যাকবস-কে চিফ রাব্বি ইস্রায়েল ব্রডি-এর উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিল। কল্পনা করা যায়, তিনি যদি We Have Reason to Believe গ্রন্থটি চিফ রাব্বি হওয়ার পরে প্রকাশ করতেন, তবে আজ ব্রিটিশ ইহুদি সমাজের চেহারাটি ভিন্ন হতে পারত। 
  3. "Rabbi Louis Jacobs"My Jewish Learning (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১২ 
  4. Council, Manchester City। "Manchester City Council - Tel: 0161 234 5000"www.manchester.gov.uk (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১২ 
  5. Goldman, Ari L (৯ জুলাই ২০০৬)। "Louis Jacobs Is Dead at 85; British Rabbi and Scholar"The New York Times। সংগ্রহের তারিখ ১২ আগস্ট ২০২০ 
  6. Jacobs (1965), পৃ. ৫৯
  7. Jacobs (1965), পৃ. ৬০; সূত্র: তালমুদ, হাগিগা ৬এ-বি, সোটাহ ৩৭বি, জেবাখিম ১১৫বি
  8. Jacobs (1965), পৃ. ৬৪
  9. Jacobs (1965), পৃ. ৬৮
  10. Jacobs (1965), পৃ. ৮০–৮১
  11. Freedland, Michael; Romain, Jonathan (৫ জুলাই ২০০৬)। "Obituary: Rabbi Dr Louis Jacobs"The Guardian। সংগ্রহের তারিখ ১১ আগস্ট ২০২০ 
  12. "NEW WEST END SYNAGOGUE, Non Civil Parish - 1264769"Historic England (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১২ 
  13. FREEDMAN, HARRY (নভেম্বর ১৯, ২০২০)। "Louis Jacobs: the rabbi who rethought British Jewish life"The Jewish Chronicle। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১২ 
  14. Goldman, Ari L. (২০০৬-০৭-০৯)। "Louis Jacobs Is Dead at 85; British Rabbi and Scholar"The New York Times (ইংরেজি ভাষায়)। আইএসএসএন 0362-4331। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১২