রোহাল ফকির
সুফি রোহাল ফকির | |
---|---|
صوفي روحل فقير | |
জন্ম | ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দ (১১২৪ হিজরি) পদ্মা-ভিত, উমারকোট, সিন্ধ |
মৃত্যু | ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দ কান্দ্রি, সিন্ধ |
শ্রদ্ধাজ্ঞাপন | ইসলাম, হিন্দুধর্ম |
যার দ্বারা প্রভাবিত | শাহ ইনায়েত শাহিদ |
যাদের প্রভাবিত করেন | শাহু ফকির, গুলাম আলী ফকির, খুদা বক্স ফকির, দরিয়া খান ফকির |
ঐতিহ্য বা ধরন | কবিতা, সুফিবাদ এবং মিস্টিসিজম |
সুফি রোহাল ফকির (১৭৩৪-১৮০৪) ( সিন্ধি: صوفي روحل فقير ) ছিলেন একজন সাধু-কবি এবং রহস্যবাদী। তিনি জঙ্গেজা জাতের এবং সুন্নি কাদিরি মুসলিম ছিলেন। সুফি তরিকার সিন্ধুর মহান কবি কবীরের সাথে তার তুলনা করা হত। তিনি কান্দ্রি শরীফ উপজাতির পূর্বপুরুষ ছিলেন। বিখ্যাত শহীদ সুফি-ঋষি শাহ ইনায়েতের আশীর্বাদে তিনি সুফিবাদের উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন। তাঁর কবিতায় তিনি অহংকার ও ঘৃণা ত্যাগ করে ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে বলেছেন।[১] সুফি রোহালই প্রথম ব্যক্তি যিনি বেদান্তিক দর্শন ও মুসলিম সুফি তত্ত্ব ধারণার সাথে সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন।[২] এখন তাঁর মাজার কান্দ্রি শরীফ তালুকা রোহরি জেলা সুক্কুরে অবস্থিত।
জন্ম
[সম্পাদনা]সুফি রোহাল ১৭৩৪ সালে উমরকোটের কাছে পদ্মা ভিত্তে এলাকায় জন্মান। আরেক সূত্রমতে, তিনি ১১২৪ হিজরিতে রোহাল ওয়াই গ্রামে জন্মান। এই গ্রাম এখনো উমরকোটে আছে। সেই গ্রামের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সিন্ধি সংস্কৃতিবান ও দেশপ্রেমী কবি হলেন মুহাম্মদ জুমান দারবাদার ওরফে মামা জুমান সান্দ এবং আব্দুল হালিম বাঘি। তার দুই ভাইয়ের নাম সুলতান এবং মায়ভো।
দরবারের সঙ্গে সম্পৃক্ততা
[সম্পাদনা]সুফি রোহালের পিতা শাহো ফকির কালহোরা রাজবংশের শাসক মিয়াঁ দিন মুহাম্মদের (মৃত্যু ১১১১ হিজরি) দরবারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি মিয়াঁ দিন মুহাম্মদের উপদেষ্টাদের মধ্যে একজন ছিলেন। পিতার সেবার স্বীকৃতিস্বরূপ রোহালকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। সময়ের সঙ্গে তিনি কালহোরা শাসক মিয়াঁ গোলাম শাহ কালহোরোর রাজদরবারের কাছাকাছি পৌঁছান। ১৭৬২ সালে তাকে রাজকোষের মন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। ১৭৮২ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে নিযুক্ত ছিলেন।[৩]
তিনি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেন। ১৭৭২ সালে মিয়াঁ গোলাম আলী মারা গেলে তার ছেলে সরফরাজ ক্ষমতায় আসেন। তখন সুফি রোহেল এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার প্রকৃত রূপ উপলব্ধি করেন। তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। যদিও মিয়াঁ সরফরাজ তার অতুলনীয় ও নিষ্ঠাবান সেবার জন্য তাকে থাকতে অনুরোধ করেন। এই সময় সুফি রোহেল সত্যের পথে যাত্রা শুরু করার এবং প্রিয়তমের (আল্লাহর) সন্ধানে আত্মনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন।
আধ্যাত্মিক যাত্রা
[সম্পাদনা]তখন থেকে তিনি আধ্যাত্মিক গুরুর সন্ধান শুরু করেন। ্তিনি অনুসন্ধান করতে করতে ঝোক শরিফে (মিরানপুর) চলে যান। সেখানে তিনি সুফি ইজ্জতুল্লাহ শাহ সুফি-উল-কাদরির রূপে তার আধ্যাত্মিক গুরুকে খুঁজে পান। তিনি ধ্যানে মগ্ন হন। ফিরে আসার পর তার জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটে। তিনি তখন একজন খাঁটি সুফি হয়ে ওঠেন।
বিবাহ
[সম্পাদনা]সুফি রোহাল ফকির তার জীবনে দুইবার বিবাহ করেন। প্রথম বিবাহ থেকে তাঁর দুই পুত্রসন্তান হয়: (১) শাহু ফকির এবং (২) গুলাম আলি ফকির। তার নিকটাত্মীয় সুফি মুরাদ ফকিরের বোনের সাথে দ্বিতীয় বিবাহ করেন। এই বিয়ে থেকে তাঁর আরও দুই ছেলে হয়: (১) সুফি খুদা বক্স এবং (২) সুফি দরিয়া খান।
ভ্রমণ
[সম্পাদনা]সুফি রোহাল ফকির জীবনের বেশিরভাগ সময় ভ্রমণ করেছেন।[৪] অর্থ মন্ত্রণালয়ের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত হন। ভারতের জয়সলমির, জোধপুর, বিকানিরসহ বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন। তার মাতৃভাষা ছিল সেরাইকি। তবে থর মরুভূমিতে ভ্রমণকালে তিনি ধাতকি, মারোয়ারি ও হিন্দি ভাষা আয়ত্ত করেন।
মহারাজা বিজয় সিংহের সাথে সাক্ষাৎ
[সম্পাদনা]রাষ্ট্রদূত হিসেবে ভ্রমণের সময় তিনি হিন্দু রাজাদের এবং জনগণের কাছে রহস্যবাদের ঐশ্বরিক বার্তা প্রচার করেন। সুফি রোহাল ফকির যোধপুরে মহারাজা বিজয় সিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তিনি গুরু ও শিষ্যের কথোপকথনের আকারে হিন্দি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। তিনি যোধপুরে এক মাস সাত দিন অবস্থান করেন। এই সময়ে তিনি মহারাজার উপস্থিতিতে পণ্ডিতদের (হিন্দু পুরোহিত), কালো জাদুকরদের এবং যোধপুরের ঋষিদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন।
মহারাজা সুফি রোহাল ফকিরের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ও মর্যাদা পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। সুফি রোহালের জ্ঞানের ভাণ্ডার দেখে তিনি বিস্মিত হন। ফলে তিনি সুফি রোহালের শিষ্য হয়ে যান। তাকে রাজপ্রাসাদে রাজকীয় অতিথি হিসেবে যতদিন ইচ্ছা ততদিন থাকতে বলেন। সুফি রোহাল এই উদার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সিন্ধে ফিরে আসেন।
জগৎ ত্যাগ
[সম্পাদনা]খুব শীঘ্রই তিনি রাষ্ট্রদূতের চাকরি ছেড়ে দেন এবং প্রভুর সন্ধান শুরু করেন। তার স্রষ্টার প্রতি অপার ভালোবাসার কারণে পার্থিব জীবন ত্যাগ করেন। এর ফলে একজন সালিক (সুফি পথের পথিক) হিসেবে তিনি নিজেকে চিনতে পারেন এবং জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য খোঁজা শুরু করেন। ডঃ নবী বক্স বালুচের মতে, "রোহাল সিন্ধের প্রথম কবি হিসেবে হাম-ও-ওস্ত (সবই তিনি)" এর দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে "আমি একজন" স্লোগান তুলেছিলেন"।[৫]
মুরাদ ফকিরের সাথে সাহচর্য
[সম্পাদনা]সুফি রোহাল ফকিরের নিকটাত্মীয় সুফি মুরাদ ফকির তার আধ্যাত্মিক শিক্ষায় প্রথম প্রভাবিত হন। মুরাদ ফকিরও একই পথ বেছে নেন এবং তার নামের সঙ্গে ‘ফকির’ যোগ করেন। মুরাদ ফকির রোহালের চেয়ে দশ বছরের ছোট ছিলেন। কালহোরা রাজবংশের শাসনের অবসানের পর তারা দুজন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খায়রপুর জেলার কোটলিতে চলে যান। এই পাহাড়ি এলাকায় তারা বাড়ি তৈরি করেন। সুফি মুরাদ ফকির ১৭৯৬ সালে কোটলিতে অসুস্থতায় মারা যান।
কান্দিরিতে আগমন
[সম্পাদনা]তার জীবনসঙ্গীনীর মৃত্যুর পর সুফি রোহাল কোটলিতে থাকতে আর ভালো লাগেনি। খুব শীঘ্রই তিনি সেখান থেকে পশ্চিম দিকে ভ্রমণ শুরু করেন। ভ্রমণের সময় একটি কাঁটাঝোপে তার কাপড় আটকে যায়। এটি ছিল একটি নির্জন স্থান। চারপাশে বুনো কাঁটাঝোপে ঘেরা। তখন তিনি তার আধ্যাত্মিক গুরু সুফি ইজ্জতুল্লাহ শাহের কথা স্মরণ করেন: "হাঁটতে থাকো যতক্ষণ না কিছু তোমাকে থামায়, আর যদি থামিয়ে দেয় সেটিই হবে তোমার বাসস্থান।" সুফি রোহাল তার পরিবারকে স্থায়ী বাসস্থান তৈরির ব্যবস্থা করতে বলেন। তখন থেকে সেই এলাকা "কান্দ্রি" নামে পরিচিত হয়। সুফি রোহাল তার জীবনের বাকি বছরগুলো কান্দ্রিতে কাটান।
মৃত্যু
[সম্পাদনা]রোহাল ১৮০৪ সালে ৭০ বছরে মারা যান। তাকে কান্দ্রিতে দাফন করা হয়।[৬]
উরস (বার্ষিক মেলা)
[সম্পাদনা]তার বার্ষিক উরসে (মেলা) থার, রহিম ইয়ার খান, বাহাওয়ালপুর এবং আশপাশের এলাকা থেকে হাজার হাজার ভক্ত এই মেলায় আসে। এই উৎসবের সময় মানুষ তাকে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। তাছাড়া, তার কবিতা ভক্তরা এই উৎসবে ভালোবাসা ও স্নেহের সঙ্গে গেয়ে থাকে। বর্তমানে গাদি নশিন (সুফি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী) হলেন সুফি গোলাম রসুল ফকির। তিনি সুফি রোহাল ফকিরের বংশের ষষ্ঠ ব্যক্তি।
কবিতা
[সম্পাদনা]সুফি রোহাল ফকির ছিলেন হিন্দি, সিন্ধি, ফার্সি ও সরাইকি ভাষার কবি। বর্তমানে শাহ আব্দুল লতিফ ভিত্তাইয়ের পর তাকে সিন্ধের অন্যতম মহান সুফি কবি হিসেবে গণ্য করা হয়।
- মন পরবোধ ( সিন্ধি: من پرٻوڌ )
- উদ্ভিত গ্রন্থ ( সিন্ধি: اُڌڀت گرنٿ )
- সুরভ গিয়ান ( সিন্ধি: سُورٻ گيان )
- আঘাম ওয়ার্তা ( সিন্ধি: آگم ورتا )
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Paniker, chief ed. K. Ayyappa (১৯৯৭)। Medieval Indian Literature: An Anthology, Volume 2 (1. publ. সংস্করণ)। Sahitya Akademi। পৃষ্ঠা 507। আইএসবিএন 8126003650।
- ↑ Saleem Akhtar, Muhammad (১৯৯৩)। Islam in South Asia। Historical and Cultural Research। পৃষ্ঠা 245।
- ↑ Muhammad, Sufi Taj (১৯৯৯)। Sartaj-e-Kandiri। Aijaz Publishers, Urdu Bazar।
- ↑ Hamayoni, Niaz (২০০৭)। Aao Kanga Kar Galh। Sindh Adabi Board।
- ↑ Baloch, N.B. (১৯৯২)। Kafiyoon-2। Sindh Adabi Board।
- ↑ Badwi, Lutfullah (২০০৬)। Kandiri Waran Jo Kalam। Sindh Adabi Board। পৃষ্ঠা 18।