রুবিক’স কিউব

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(রুবিক্স কিউব থেকে পুনর্নির্দেশিত)
রুবিক’স কিউব
অন্য নামম্যাজিক কিউব
ধরনকম্বিনেশন পাজল
উদ্ভাবকএর্নো রুবিক
কোম্পানিরুবিক'স ব্র্যান্ড লিঃ
দেশহাঙ্গেরি
উপলব্ধতা১৯৭৭ (হাঙ্গেরিয়ান ম্যাজিক কিউব); ১৯৮০ (রুবিক’স কিউব, সারা বিশ্ব জুড়ে)–বর্তমান
দাপ্তরিক ওয়েবসাইট
বিভিন্ন ধরনের রুবিক্‌স কিউব [রুবিক্স রিভেঞ্জ (৪x৪x৪), প্রফেসরস কিউব (৫x৫x৫), পকেট কিউব (২x২x২), রুবিক্স কিউব (৩x৩x৩)]

রুবিক’‌স কিউব (ইংরেজি: Rubik's Cube) একটি ঘনাকার যান্ত্রিক ধাঁধা। ১৯৭৪ সালে হাঙ্গেরীয় ভাস্কর ও স্থাপত্যের অধ্যাপক এর্নো রুবিক এটি উদ্ভাবন করেন। রুবিক নিজে এর নাম দিয়েছিলেন ম্যাজিক কিউব (Magic Cube), কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে Ideal Toys নামের এক খেলনা প্রস্তুতকারী কোম্পানী এর নাম দেয় রুবিক্‌স কিউব অর্থাৎ রুবিকের ঘনক।

রুবিক্‌স কিউব সাধারণত ৩x৩x৩ মাত্রাবিশিষ্ট ঘনকাকৃতির হয়ে থাকে। ঘনকের প্রতিটি তল আবার ৯টি করে বর্গক্ষেত্রে বিভক্ত থাকে। এই ছোট বর্গক্ষেত্রগুলি ৬টি ভিন্ন রঙের যেকোন একটি রঙে রাঙানো থাকে। রুবিক্‌স কিউবের যান্ত্রিক কৌশল এমন হয় যে, ঘনকের যেকোন একটি তলের সবগুলো বর্গকে তাদের আপেক্ষিক অবস্থান পরিবর্তন না করেই একত্রে ঘোরানো সম্ভব। এভাবে ঘুরিয়ে রুবিকস্‌ কিউবকে বিভিন্ন রকম অবস্থা বা কনফিগারেশনে (configuration) নিয়ে যাওয়া সম্ভব। রুবিকস্‌ কিউবের বিভিন্ন রকম সংষ্করণ আছে, তার মধ্যে ২x২x২ মাত্রার পকেট কিউব, ৪x৪x৪ মাত্রার রুবিক্‌স রিভেঞ্জ (Rubik's Revenge) এবং ৫x৫x৫ মাত্রার প্রফেসর্‌স কিউব (Professor's cube) উল্লেখযোগ্য।

সমাধানকৃত অবস্থায় রুবিক্‌স কিউবের একটি তলে সবগুলো বর্গ একই রঙের হয়। ঘনকের ৬টি তলের প্রত্যেকটিতে একটি করে ভিন্ন রঙ থাকে। মজার ব্যাপার হলো এর একসাথে ৩টি তলের বেশি দেখা যায় না । সমাধানকৃত একটি রুবিকস্‌ কিউবের বিভিন্ন তলকে ইচ্ছামত ঘুরিয়ে এলোমেলো করা যায়। এরকম এলোমেলো অবস্থা বা কনফিগারেশন থেকে সমাধানকৃত অবস্থায় নিয়ে আসাই এই যান্ত্রিক ধাঁধাঁটির লক্ষ্য।

ধারণা এবং উন্নয়ন[সম্পাদনা]

চার স্তর বিশিষ্ট রুবিকস কিউব

১৯৭০ সালের মার্চ মাসে হ্যারি ডি. নিকোলাস ২x২x২ মাত্রার একটি ধাঁধা আবিষ্কার করেন, যার ক্ষুদ্র খণ্ডসমূহ একটি গ্রুপে ছিল এবং এগুলো ঘোরানো যেত। পরে তিনি কানাডীয় প্যাটেন্টের জন্য আবেদন করেন। নিকোলাসের কিউবের প্রতিটি খণ্ডচুম্বক দিয়ে একে অপরের সাথে আটাকানো ছিল। ১১ই এপ্রিল, ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাটেন্ট কর্তৃপক্ষ নিকোলাসকে প্যাটেন্ট প্রদান করে। এটি ছিল রুবিক এর উন্নত ঘনক আবিষ্কারের দু'বছর পূর্বের ঘটনা।

৯ই এপ্রিল, ১৯৭০ সালে ফ্রাঙ্ক ফক্স নামের আরেকজন একটি "৩x৩x৩ মাত্রার গোলক" ধাঁধাঁর জন্য প্যাটেন্ট এর আবেদন করেন এবং ১৬ই জানুয়ারি, ১৯৭৪ সালে ব্রিটিশ প্যাটেন্ট লাভ করেন।

রুবিক তার "ম্যাজিক কিউব" আবিষ্কার করেন ১৯৭৪ সালে এবং ১৯৭৫ সালে হাঙ্গেরীয় প্যাটেন্ট লাভ করেন কিন্তু তখন আন্তর্জাতিক প্যাটেন্টটি হয়নি। ১৯৭৭ সালের শেষদিকে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে রুবিক কিউব উৎপাদন করা হয় এবং বুদাপেস্ট এর খেলনার দোকানগুলোতে বিক্রয় করা হয়। ম্যাজিক কিউব তৈরি করা হত প্লাস্টিক দিয়ে এবং ছোট ছোট খণ্ডগুলো একে অপরের সাথে আটকে থাকতো যান্ত্রিক উপায়ে যা নিকোলাসের চুম্বক ডিজাইন হতে তুলনামূলক কম দাম ছিল। ম্যাজিক কিউব পশ্চিমা বিশ্বে বাজারজাত করার জন্য আইডিয়াল টয় চুক্তি করে এবং ১৯৮০ সালের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত এক খেলনা প্রদর্শনীতে ধাঁধাঁটির অভিষেক ঘটে পশ্চিমা বিশ্বে।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ম্যাজিক কিউবের পরিচয় ঘটার পর পশ্চিমের খেলনার দোকানসমূহে বিক্রয় সাময়িক স্থগিত করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমের নিরাপত্তা ও মোড়ক সম্পর্কিত বিধিনিষেধ অনুযায়ী ম্যাজিক কিউবকে নতুন আঙ্গিক দেওয়া। এতদসঙ্গে এটির ওজন হালকা করা হয় এবং আইডিয়েল টয় সিদ্ধান্ত নেয় নাম পরিবর্তনের। প্রথমে "দ্যা গোল্ডেন নট" এবং "ইনকা গোল্ড" নাম দু'টি প্রস্তাব করা হয়, কিন্তু কোম্পানির সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এর নাম হয় "Rubik's Cube" বা "রুবিক'স কিউব"। নতুন আঙ্গিকে নতুন নাম নিয়ে হাঙ্গেরী থেকে রুবিকের কিউবের প্রথম চালানটি রপ্তানি করা হয় ১৯৮০ সালের মে মাসে। এতদসময়ে বাজারে অপ্রতুলতার সুযোগে কিছু নিম্নমানের নকল কিউবের আবির্ভাব ঘটে।

নিকোলাস নিজের প্যাটেন্ট তার কর্মস্থল "মলিকিউলন রিসার্চ করপোরেশন" কে দিয়ে দেন। পরে তার কোম্পানি, আইডিয়েল টয়ের বিরুদ্ধে প্যাটেন্ট ভঙ্গের মামলা করে। ১৯৮৪ সালে আইডিয়েল টয় মামলায় হেরে যায় এবং আপিল করে। ১৯৮৭ আপিল কোর্ট নিশ্চিত করে রুবিক কিউবের ২x২x২ মাত্রার ধাঁধাঁটি নিকোলাসের প্যাটেন্ট ভঙ্গ করেছে, কিন্তু ৩x৩x৩ মাত্রার ধাঁধাঁর সংস্করণের আপিল রুবিক কিউবের অনুকূলে যায়।[১]

যখন রুবিকের প্যাটেন্ট আবেদন প্রক্রিয়াধীন ছিল, তখন টোকিওর নিকট একজন স্বশিক্ষিত প্রকৌশলী এবং কামারশালার মালিক টেরুটোশি ইসিগি জাপানে প্যাটেন্টের জন্য আবেদন করেন। তিনি ১৯৭৬ সালে জাপানি প্যাটেন্ট লাভ করেন। যদিও তার আবিষ্কারটি প্রায় রুবিকের কৌশলের কাছাকাছি ছিল, তবুও তাকে রুবিক কিউবের একজন স্বাধীন পুনরাবিষ্কারক হিসাবে গণ্য করা হয়।[২][৩]

রুবিক পুনরায় ২৮ অক্টোবর ১৯৮০ সালে হাঙ্গেরীয় প্যাটেন্ট এবং অন্যান্য প্যাটেন্ট আবেদন করেন। ১৯৮৩ সালে ২৯ মার্চ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্যাটেন্ট লাভ করেন। রুবিক আরও বেশ কিছু নতুন ধাঁধাঁ আবিষ্কার করেছিলেন এবং এগুলোর বেশকিছু প্যাটেন্টও তিনি পেয়েছিলেন; কিন্তু সেগুলো রুবিক কিউবের মত জনপ্রিয় হয়নি।

জনপ্রিয়তা এবং পপ সংস্কৃতি[সম্পাদনা]

১৯৮০ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ১০০ মিলিয়নের বেশি রুবিক্স কিউব বিক্রি হয়।[৪] ১৯৮০ এবং ১৯৮১ সালে দুই দফায় এটি বিএটিআর টয় অব দ্যা ইয়ার (British Association of Toy Retailers) পুরস্কার জয় করে নেয়। আইডিয়া টয় ১৯৮২ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত রুবিক্স কিউব নিউজলেটার নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে।

১৯৮৩ সালে শনিবার সকালে রুবিক, দ্যা আমেইজিং কিউব (Rubik, the Amazing Cube) নামে রুবিক্স কিউবের উপরে ভিত্তি করে একটি কার্টুন সিরিজ প্রচারিত হত। এ সিরিজটি এক মৌসুম প্রচারিত হয়েছিল।

রুবিক্স কিউবের কিছুদিনের মধ্যেই রুবিক এবং অন্যান্য জায়গা থেকে একই রকমের আরও কিছু ধাঁধা বের হয়। যেমন রুবিক্স রিভেঞ্জ (Rubik's Revenge), রুবিক্স কিউবের একটি ৪x৪x৪ সংস্করণ। আরও ছিল ২x২x২, ৫x৫x৫ কিউব (যাদের নাম যথাক্রমে পকেট কিউব এবং প্রফেসরস্‌ কিউব) এবং অন্য আকারের ধাঁধা যেমন পাইরামিংক্স (Pyraminx), একটি টেট্রাহেড্রোন।

২০০৫ এর মে মাসে গ্রিক আবিষ্কারক প্যানাগিওটিস ভার্দেস ৬x৬x৬ রুবিক্স কিউব তৈরি করেন; মে ২৩ ২০০৬ সালে রুবিক্স কিউব সমাধানের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রাঙ্ক মরিস এই সংস্করণটি পরীক্ষা করেন। তিনি পূর্বে ৩x৩x৩ সমাধান করেছেন ১৫ সেকেন্ডে, ৪x৪x৪ সমাধান করেছেন ১ মিনিট ১০সেকেন্ডে এবং ৫x৫x৫ সমাধান করেছেন ১ মিনিট ৪৬.১ সেকেন্ডে। ৬x৬x৬ সমাধান করতে তিনি সময় নেন ৫ মিনিট ৩৭ সেকেন্ড। মরিস নিজে আবিষ্কারককে ধন্যবাদ জানান এবং উৎসাহের সাথে জানান যে যত বেশি বড় (সংখ্যা) কিউব তত বেশি আনন্দ। জুলাই ২০০৬ সালে ভার্দের সফলভাবে ৭x৭x৭ তৈরি করেন এবং অক্টোবর ২৭ ২০০৬ সালে মরিসের এ সংস্করণটি পরীক্ষা করার একটি ভিডিও চিত্র প্রকাশ হয়। তিনি এ কিউব সমাধান করেন ৬ মিনিট ২৯.৩১ সেকেন্ড। পরীক্ষার ভিডিওটি দেখতে পারবেন এখানে http://www.v-cubes.com।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]

১৯৮১ সালে প্যাট্রিক বোজার্ট নামের ইংল্যান্ডের বার বছরের এক স্কুল বালক ইউ ক্যান ডু দ্যা কিউব (You Can Do the Cube (আইএসবিএন ০-১৪-০৩১ ১৪৮৩-0)) নামক এক বইতে কিউব সমাধানের জন্য তার নিজস্ব এক সমাধানের কথা প্রকাশ করে। ঐ বই সতের টি সংস্করণ বিশ্ব ব্যপী ১.৫ মিলিওনেরও বেশি কপি বিক্রি হয় এবং বইটি দ্যা টাইমস্‌ (The Times) এ এক নম্বর বইয়ে পরিণত হয়।

ধাঁধার জনপ্রিয়তা সাথে সাথে কিউবের জন্য বিভিন্ন রঙের শীটের স্টিকারও বিক্রি হতে থাকে যাতে কিউবের মালিকগণ তাদের কিউবের চেহারা ঠিক নতুনের মত রাখতে পারেন।[৫]

হিব্রু, চাইনিজ, হাঙ্গেরীয়, জার্মান, পর্তুগীজ ভাষা ছাড়া বেশির ভাগ ভাষায় এটি "রুবিক্স কিউব" নামে পরিচিত। হিব্রু ভাষায় এটি "হাঙ্গেরিয়ান কিউব" নামে পরিচিত। অন্যান্য ভাষায় এটি কে "ম্যাজিক কিউব" বা "যাদুর ঘনক" নামেও ডাকা হয় ( চাইনিজ ভাষায় "魔方" , হাঙ্গেরীয় ভাষায় Bűvös kocka , জার্মান ভাষায় Zauberwürfel এবং পর্তুগিজ ভাষায় Cubo Mágico ).।

১৯৮০ সালে রুবিক্স কিউব এর শুরু থেকে এটি বিভিন্ন চলচ্চিত্রে এবং টিভিতে আসা শুরু করে, সাম্প্রতিক কিছু চলচ্চিত্র হল স্ক্রাবস (Scrubs), হেলবয় (Hellboy) এবং দ্যা পারসুইট অফ হ্যাপিনেস (The Pursuit of Happyness)।

গঠন ও কার্যপদ্ধতি[সম্পাদনা]

Rubik's Cube partially disassembled.

প্রমাণ আকারের একটি রুবিকস কিউব দৈর্ঘ্য, প্রস্থ্য এবং উচ্চতায় প্রায় ৫.৭ সেন্টিমিটার বা ২.৫ ইঞ্চি হয়ে থাকে । যান্ত্রিক এই ধাঁধাটিতে ২৬টি ক্ষুদ্রাকৃতি ঘনকাকার খণ্ড নিয়ে গঠিত । ছয়টি তলের প্রত্যেকটির মাঝের ক্ষুদ্রতর ঘনকটি আসলে একটি বর্গাকার তল মাত্র । এই ছয়টি খণ্ডের প্রত্যেকটিই কেন্দ্রে অবস্থানকারী মূল যন্ত্রাংশ কাঠামোর সাথে দৃঢ় ভাবে আটকানো । এই মূল যন্ত্রাংশটি অন্যান্য খণ্ড গুলোর জন্য স্থান সংকুলান করে এবং ঘূর্ণন পদ্ধতিটি কার্যকর করে । এই হিসেবে একটি রুবিকস কিউবে মোট একুশটি যন্ত্রাংশ বিদ্যমান । তিনটি পরস্পরছেদী অক্ষসমেত কেন্দ্রীয় মূল কাঠামো যা ছয়টি তলের মাঝের বর্গটিকে ধারণ করে ও ঘূর্ণন কার্যকারিতা দেয় এবং এর সাথে যুক্ত হওয়ার মত করে তৈরি করা বিশটি প্লাস্টিকের যন্ত্রাংশ । একসাথে যুক্ত করার পর সবগুলো মিলে একটি সুসজ্জিত ঘনকের আকার ধারণ করে ।

খুব সহজেই ক্ষুদ্রতর ঘনক গুলো খুলে ফেলা যায়। এ জন্য একটি পাশকে ৪৫° কোণে ঘুরিয়ে কর্ণের একটি ঘনককে খুলে আসার আগ পর্যন্ত টানতে হবে। অবশ্য সীমান্তবর্তী কোন ঘনককে টান দিয়ে ছুটাতে গেলে অনেকক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় কাঠামো ভেঙে যায়। সবগুলো কিউবকে খুলে ফেলে আবার সমাধানকৃত অবস্থায় যুক্ত করা যেতে পারে ।

১২ টি সীমান্তবর্তী ক্ষূদ্রতর ঘনক রয়েছে যাতে দুটি ভিন্ন বর্ণ দেখা যায় এবং কর্ণে অবস্থিত ৮টি কিউবের প্রত্যেকটিতে দেখা যায় তিনটি ভিন্ন বর্ণ। প্রতিটি টুকরো একটি অনন্য বর্ণবিন্যাস প্রকাশ করে, তবে সকল বর্ণবিন্যাস এতে উপস্থিত থাকে না। উদাহরণস্বরূপ যদি সমাধানকৃত কোন ঘনকের দুইটি বিপরীত তলে লাল ও সবুজ বর্ণের হয় তবে লাল ও সবুজ উভয় বর্ণ আছে এমন কোন সীমান্তবর্তী টুকরো খুঁজে পাওয়া যাবে না। এরকম ক্ষুদ্রতর ঘনকগুলোর একটিকে অন্যটির সাথে পরিবর্তন করা যায়।

সমাধান[সম্পাদনা]

রুবিকস কিউবের সমাধানের একটি পদ্ধতি দুইটি ভিন্ন দিক থেকে বিচার করা সম্ভব । কত চালে সমাধান করা হল এবং কত দ্রুত সমাধান করা হল । রুবিকস্‌ কিউবের ক্ষেত্রে যেকোন তলের একবার ঘূর্ণনকে একটি চাল হিসেবে গণ্য করা হয় । একটি বিশেষ চাল মানুষের হাতে করতে অপর একটি চালের তুলনায় কম বা বেশি সময় লাগতেই পারে । সাধারণত প্রতিযোগীতায় সীমিত সময়ের মধ্যে সমাধান করতে হয়, সেক্ষেত্রে দ্রুত সমাধান করা প্রয়োজন ।

রুবিকস কিউবের সাধারণ সমাধান (general solution) এবং দ্রুত সমাধান করার জন্য বিভিন্ন অ্যালগোরিদম আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব অ্যালগোরিদম প্রধানত রুবিকস্‌ কিউব সমাধানের প্রতিযোগিতায় ব্যবহার করা হয়। জেসিকা ফ্রিডরিক, লারস পেত্রুস, রায়ান হেইস প্রমুখ এরকম একাধিক দ্রুত সমাধানের আবিষ্কারক। দ্রুত সমাধানের অ্যালগোরিদম বলতে সবসময় সেরা সমাধান (optimal solution) বোঝান হয় না, কারণ দ্রুত সমাধানের অ্যালগোরিদমগুলির লক্ষ্য হল এগুলি যাতে সহজেই মনে রাখা যায় এবং যত দ্রুত সম্ভব একটি কিউবের উপর তা প্রয়োগ করতে পারা যায়। কিন্তু সেরা সমাধান বলতে বোঝায় এমন সমাধান যা সবচেয়ে কম সংখ্যক 'চাল' বা move -এর মাধ্যমে সমাধানকৃত অবস্থায় পৌঁছাতে সক্ষম।

সংকেতাবলি[সম্পাদনা]

এলোমেলো অবস্থায় রুবিক্‌স কিউব



সমাধানকৃত অবস্থায় রুবিক্‌স কিউব

দাবার মত রুবিকস্‌ কিউবের ক্ষেত্রেও চালগুলোকে প্রকাশ করার জন্য সংকেতাবলি উদ্ভাবিত হয়েছে। রুবিক্‌স কিউবের সংকেতগুলিকে কিউব সংকেত (cube notation) বলা হয়। কিউব সংকেত ব্যবহার করে রুবিকস্‌ কিউব সমাধানের অ্যালগোরিদমকে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব। কিউব সংকেতে ব্যবহৃত প্রতীক ও তাদের অর্থ নিম্নরূপ।

  • F: সম্মুখ তল অর্থাৎ বর্তমানে যেই তলটি সামনে রয়েছে
  • B: পশ্চাৎ তল
  • U: উপরি তল
  • D: নিম্ন তল
  • L: বাম দিকের তল
  • R: ডান দিকের তল
  • f (সামনের দুইটি তল): সম্মুখ তল এবং সংলগ্ন মাঝের তল
  • b (পেছনের দুইটি তল): পশ্চাৎ তল এবং সংলগ্ন মাঝের তল
  • u (উপরের দুইটি তল) : উপরি তল এবং সংলগ্ন মাঝের তল
  • d (নিচের দুইটি তল) : নিম্ন তল এবং তাকে সংলগ্ন মাঝের তল
  • l (বামের দুইটি তল) : বাম দিকের তল এবং সংলগ্ন মাঝের তল
  • r (ডানের দুইটি তল) : ডান দিকের তল এবং সংলগ্ন মাঝের তল
  • x: x অক্ষে ঘূর্ণন অর্থাৎ কিউবটিকে উপরের দিকে ঘুরিয়ে দেয়া
  • y: y অক্ষে ঘূর্ণন অর্থাৎ কিউবটিকে বাম দিকে ঘুরিয়ে দেয়া
  • z: z অক্ষে ঘূর্ণন অর্থাৎ কিউবটিকে ডানপাশের তলের উপর কাত করা

ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে ৯০° কোণে ঘূর্ণন বুঝাতে তল প্রকাশকারী ছয়টি প্রতীকের কোনটির উপর অ্যাপোস্ট্রফ চিহ্ন (Apostrophe) বসান হয় । Apostrophe না থাকলে ঘড়ির কাঁটার দিকে ৯০° ঘূর্ণন বুঝায়। প্রতীকের পর ২ থাকলে তা সেই তলকে ১৮০° ঘোরানো নির্দেশ করে।

উদাহরণ স্বরূপ, সোজা বাংলায় F2 U' R' L F2 R L' U' F2 -অ্যালগোরিদমটির অর্থ হবে,

  1. সামনের তলের ১৮০° ঘূর্ণন
  2. উপরের তলের ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ৯০° ঘূর্ণন
  3. ডানের তলের ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ৯০° ঘূর্ণন
  4. বামের তলের ঘড়ির কাঁটার দিকে ৯০° ঘূর্ণন
  5. সামনের তলের ১৮০° ঘূর্ণন
  6. ডানের তলের ঘড়ির কাঁটার দিকে ৯০° ঘূর্ণন
  7. বামের তলের ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ৯০° ঘূর্ণন
  8. উপরের তলের ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ৯০° ঘূর্ণন
  9. সামনের তলের ১৮০° ঘূর্ণন

সেরা সমাধান[সম্পাদনা]

রুবিকস্‌ কিউব সমাধান করার বেশ কয়েকটি অ্যালগোরিদম রয়েছে। তার মধ্যে ডেভিড সিংমাস্টার উদ্ভাবিত অ্যালগোরিদমটি সর্বাধিক জনপ্রিয়। এই পদ্ধতিতে সবচেয়ে উপরের স্তর থেকে সমাধান করা শুরু হয়। একটি স্তর সমাধান করা হয়ে গেলে তার পরের স্তরের কাজ শুরু হয়, এরকম করে চলতে থাকে সর্বনিম্নের স্তরে পৌঁছান পর্যন্ত। এ ব্যাপারে সিংমাস্টারের লেখা ১৯৮০ সালে প্রকাশিত Notes on Rubik's Magic Cube বইতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। অপর একটি প্রচলিত পদ্ধতিতে কাজ শুরু হয় কোনা থেকে। যেকোন একটি কোনায় ২x২x২ আকারের অংশ সমাধান করা হয় প্রথমে। এই আংশিক সমাধানের উপর ভিত্তি করেই অবশিষ্টাংশ সমাধান করা হয়।

  • দ্রূত সমাধানের প্রতিযোগীতায় সাধারণত ব্যবহৃত হয় জেসিকা ফ্রিডরিখ আবিষ্কৃত একটি পদ্ধতি । এতে এক স্তরের পর আরেক স্তর সমাধান করা হয় এবং ব্যবহার করা হয় অনেকগুলো অ্যালগরিদম । প্রথম স্তর বা উপরের স্তরের কোনা গুলো দ্বিতীয় স্তরের সাথে একযোগে সমাধান করা হয় । ফ্রিডরিখের পদ্ধতিতে প্রায় ১২০ টি অ্যালগোরিদম শিখতে হয়, কিন্তু গড়ে ৫৫ টি চালেই সমাধানে পৌঁছে যাওয়া যায় ।
  • ফিলিপ মার্শালের "The Ultimate Solution to Rubik's Cube" হল ফ্রিডরিখের পদ্ধতিটির একটি উন্নত সংষ্করণ । এতে গড়ে ৬৫ টি চালে সমাধান করা যায়, তবে মনে রাখতে হয় মাত্র দুইটি অ্যালগোরিদম ।
  • রায়ান হেইস আবিষ্কৃত একটি সমাধানে এক সেট মূলনীতি তুলে ধরেছেন যার মাধ্যমে ৪০ বা তার কম চালে সমাধান করা সম্ভব ।
  • লার্স পেট্রুস একটি প্রচলিত সাধারণ সমাধানের আবিষ্কারক । এই পদ্ধতিতে একটি কোনার দিকে ২X২X২ আকারের অংশ প্রথমে সমাধান করা হয় । এর পর করা হয় ২X২X৩ আকারের অংশ সমাধান এবং তার পর ভুল অবস্থানে থাকা কিনারা গুলোকে জায়গামত আনা হয় তিন চালে । এর ফলে পরবর্তিতে ৩২ চালের অ্যালগোরিদমটি ব্যবহারের প্রয়োজন হয়না । পেট্রুসের এই পদ্ধতিটি অল্প সংখ্যক চালে সমাধানে পৌঁছে যায় বলে প্রতিযোগীদের মাঝে খুব জনপ্রিয় ।
  • ডেনি ডেডমোর ১৯৯৭ সালে একটি সমাধান প্রকাশ করেন যাতে প্রচলিত সঙ্কেতের পরিবর্তে প্রতীকি চিত্রের মাধ্যমে চাল গুলো দেখান হয় ।

প্রতিযোগিতা এবং সমাধানের রেকর্ডসমূহ[সম্পাদনা]

রুবিক্‌স কিউব “কে সবচেয়ে দ্রুত সমাধান করতে পারেন” তা জানার জন্য অনেক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রতিযোগিতার সংখ্যা প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০৩ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ৭২টি অফিসিয়াল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে, এর মধ্যে ৩৩টিই হয়েছে ২০০৬ সালে।

রুবিক্‌স কিউবের প্রথম বিশ্ব শিরোপা আয়োজন করে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস। প্রতিযোগিতাটি ১৯৮১ সালের ১৩ মার্চ মিউনিখে অনুষ্ঠিত হয়। সবগুলো কিউব ৪০বার সরানো হয়েছিল এবং এগুলোতে পেট্রোলিয়াম জেলি মেখে দেওয়া হয়েছিল। জোরি ফ্রসখেল জয়ী হন; তিনি সময় নিয়েছিলেন ৩৮ সেকেন্ড

প্রথম আন্তর্জাতিক বিশ্ব শিরোপা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮২ সালের ৫ জুন তারিখে। লস অ্যাঞ্জেলসবাসী মিনহ্‌ থাই নামের এক ভিয়েতনামী এই প্রতিযোগিতায় জয়ী হন; তিনি সময় নেন ২২.৯৫ সেকেন্ড।

২০০৩ সাল থেকে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতাগুলোতে সিদ্ধান্ত হয় সর্বোচ্চ গড়ের (তিন থেকে পাঁচ প্রচেষ্টা) ভিত্তিতে; কিন্তু একটি ভাল সময়ও রেকর্ড রাখা হয়। দ্য ওয়ার্ল্ড কিউব অ্যাসোসিয়েসন এই history of world records বিশ্ব রেকর্ডের ইতিহাস ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৭ জুন ২০১৯ তারিখে সংরক্ষণ করে। ২০০৪ সালে ডব্লুসিএ প্রতিযোগিতায় সময়ের হিসেব রাখার জন্য স্ট্যাকমেট টাইমার নামে বিশেষ ধরনের যন্ত্রের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে।

সেরা দশ সমাধান[সম্পাদনা]

নাম সময় প্রতিযোগিতা
ইউশেং ডু ৩.৪৭ সে. Wuhu ওপেন ২০১৮
ফেলিকস জেমডেগস ৪.২২ সে. কম্বোডিয়া জন্য ঘ কিউব ২০১৮
প্যাট্রিক Ponce ৪.২৪ সে. ইউএসএ উত্তর-পূর্ব চ্যাম্পিয়নশিপ ২০১৯
ম্যাক্স পার্ক ৪.৪০ সে. সাক্রামেন্টো কিউব ৫ ২০১৮
জুলিয়েট সেবাস্তিয়ান ৪.৪৪ সে. সেন্স ওপেন ২০১৯
টাইমন কোলাসিস্কি ৪.৫১ সে. ওয়ার্ম আপ সিডনি ২০১৯
সেউং বম চো ৪.৫৯ সে. শিকাগো ভূত ২০১৭
জ্যাকব Kipa ৪.৫৯ সে. পোলিশ চ্যাম্পিয়নশিপ ২০১৮
তানজার বালিমটাস ৪.৬৪ সে. পেনসিলভানিয়া ২০১৮
শু জিবো ৪.৭২ সে. কোয়ানিয়াজিয়াং সিটি গ্রীষ্ম ওপেন ২০১৮

বিভিন্ন সংস্করণ[সম্পাদনা]

বিভিন্ন ধরনের রুবিক্‌স কিউব

স্তরের সংখ্যার উপর ভিত্তির করে বিভিন্ন রুবিক্‌স কিউবের একাধিক সংস্করণ রয়েছে; দুই স্তর বিশিষ্ট (২X২X২ আকারের) পকেট কিউব থেকে শুরু করে সাত স্তর বিশিষ্ট যান্ত্রিক ধাঁধা বর্তমানে পাওয়া যায়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Moleculon Research Corporation v. CBS, Inc.
  2. Hofstadter, Douglas R. (১৯৮৫)। Metamagical Themas। Basic Books। Hofstadter gives the name as "Ishige".
  3. http://cubeman.org/cchrono.txt
  4. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২০ অক্টোবর ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ 
  5. Tim Walsh: "Timeless Toys: Classic Toys And the Playmakers Who Created Them" p233 ISBN 10: 0-7407-5571-4

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]