রামরহস্যোপনিষদ্‌

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
রামরহস্যোপনিষদ্‌
দেবনাগরীराम रहस्य
IASTRāma Rahasya
নামের অর্থরামের রহস্য
রচনাকালখ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দী[১]
উপনিষদের
ধরন
বৈষ্ণব[২]
সম্পর্কিত বেদঅথর্ববেদ[৩]
অধ্যায়ের সংখ্যা
মূল দর্শনবৈষ্ণবধর্ম, বেদান্ত[৪]

রাম রহস্য উপনিষদ্ (সংস্কৃত: राम रहस्य उपनिषत्) বা রামরহস্যোপনিষদ্ হল হিন্দুধর্মের একটি অপ্রধান উপনিষদ্‌। এটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত। যে ৩১টি উপনিষদ্‌ অথর্ববেদের সঙ্গে যুক্ত, এই উপনিষদ্‌টি তার অন্যতম।[৩] এটি ১৪টি বৈষ্ণব উপনিষদের অন্যতমও বটে।[২]

রামরহস্যোপনিষদ্ পরবর্তীকালে (আধুনিক যুগে[১]) রচিত একটি উপনিষদ্। এটি হিন্দু দেবতা রামের প্রতি উৎসর্গিত।[৫] উপনিষদ্‌টি হনুমানের মুখের কথায় উল্লিখিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছেন রাম ও সর্বোচ্চ অপরিবর্তনীয় সত্য ব্রহ্ম একই এবং তিনিই সকল প্রধান দেবদেবী হয়েছেন। রামই সচ্চিদানন্দমোক্ষ লাভের উপায়।[৬][৭] এই উপনিষদে একটি তান্ত্রিক অংশও রয়েছে। এই অংশে রামের বীজ মন্ত্র আলোচিত হয়েছে।[৬]

ইতিহাস[সম্পাদনা]

রামরহস্যোপনিষদ্ গ্রন্থের রচনাকাল ও রচয়িতার নাম জানা যায় না। মরিজ উইন্টারনিজ বলেছেন যে, এটি অন্যান্য রাম-কেন্দ্রিক উপনিষদের সমসাময়িককালে রচিত হয়েছিল।[৬] স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্যাথরিন ডুডভিক মনে করেন, রামরহস্যোপনিষদ্ গ্রন্থটি খ্রিস্টীয় ১৭শ শতাব্দীতে রচিত হয়েছিল।[১]

রামদাস ল্যাম্বের মতে, এই গ্রন্থটি সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। এটি অন্যান্য রাম-কেন্দ্রিক উপনিষদ্‌গুলির থেকে অনেকটাই আলাদা।[৮] রামরহস্যোপনিষদ্রামতাপনীয়োপনিষদ্ গ্রন্থদুটিতে বিষ্ণুর অবতার রামের কথা আলোচনা করা হয়েছে। তাই এই দুটিকে বৈষ্ণব উপনিষদ্‌ বলা হয়।[৯] ব্রিটিশ ভারতে খ্রিস্টান মিশনারি জে. এন. ফারকাহার ১২৩টি উপনিষদের তালিকায় এই উপনিষদ্‌টিকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।[৬] রামরহস্যোপনিষদ্‌, অন্যান্য রাম-কেন্দ্রিক উপনিষদ্‌ এবং খ্রিস্টীয় ১২শ শতাব্দীতে রচিত রাম-কেন্দ্রিক পঞ্চরাত্র শাস্ত্র অগস্ত্য সংহিতা বেদান্ত দর্শন দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত।[৬]

তেলুগু ভাষায় প্রকাশিত মুক্তিকোপনিষদ্‌ গ্রন্থে হনুমানের প্রতি রামের উপদেশের আকারে যে ১০৮টি উপনিষদের তালিকা পাওয়া যায়, তাতে এই উপনিষদের ক্রমসংখ্যা ৫৪।[১০] কোলব্রুক উত্তর ভারতে জনপ্রিয় ৫২টি উপনিষদের যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে এই উপনিষদের নাম নেই। নারায়ণ বিবলিওথিকা ইন্ডিকা গ্রন্থে দক্ষিণ ভারতে জনপ্রিয় উপনিষদ্‌গুলির যে সংকলন প্রকাশ করেছিলেন, তাতেও এই উপনিষদ্‌টি অনুপস্থিত।[১১]

পল ডুসেন বলেছেন, এই উপনিষদের প্রথম অধ্যায়টি হনুমদুক্ত-রামোপনিষদ্‌ নামেও পরিচিত।রামের ।[১০]

বিষয়বস্তু[সম্পাদনা]

রাম কে?

সেই রামের কথা চিন্তা করি,
যিনি অযোধ্যায় বাস করেন,
যিনি রত্নাভরণে শোভিত,
যিনি স্বর্ণ-চন্দ্রাতপের তলায় উপবিষ্ট,
যাঁর দ্বার মন্দন পুষ্পে খচিত।
যিনি সিংহাসনে উপবিষ্ট,
দিব্য বাহনের দ্বারা পরিবেষ্টিত,
ঋষিগণ যাঁকে বন্দনা করেন,
সীতা যাঁর বাম পার্শ্বে অবস্থান করেন,
লক্ষ্মণ যাঁর সেবা করেন;
যিনি নীলবর্ণ,
যাঁর মুখমণ্ডল প্রশান্ত,
তিনি অলংকারে শোভিত।

রামরহস্যোপনিষদ্.[১২]

‘রামপঞ্চায়ায়ণ’ (রাম-সীতা, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্নহনুমান)

রামরহস্যোপনিষদ্‌ গ্রন্থটি হনুমান ও ঋষিগণের কথোপকথনের আকারে রচিত। ঋষিগণ সত্য জ্ঞান অর্জনের জন্য হনুমানকে প্রশ্ন করছেন এবং হনুমান সেই প্রশ্নগুলির উত্তর দিচ্ছেন।[৬][১৩] হনুমান বলছেন, রাম হলেন সর্বোচ্চ সত্য ব্রহ্মআত্মা। তাঁর মাধ্যমেই মোক্ষ লাভ করা যায়।[৪] এই গ্রন্থ অনুসারে রামের পত্নী সীতা হলেন সৃষ্টির কারণ এবং হলেন সম্পূর্ণ আত্মসমাহিত অবস্থার উদাহরণ এবং রামের আদর্শ ভক্ত।[১৪] ল্যাম্বের অনুবাদ অনুসারে, রাম ও সীতা একযোগে সকল সৃষ্টির উৎস।[১৫]

এই গ্রন্থ অনুসারে, রাম ও সকল প্রধান হিন্দু দেবতা স্বরূপত এক।[৬] দালাল বলেছেন, এই গ্রন্থ মতে, অন্যান্য দেবতাদের রামের ‘অঙ্গ’ (অংশ) বলা হয়েছে। এঁরা হলেন গণেশ, সূর্য, চন্দ্র, ও বিষ্ণুর অন্যান্য অবতার (নারায়ণ, নৃসিংহ, বাসুদেব, বরাহ)।[১২] হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণের বিভিন্ন চরিত্রকেও (লক্ষ্মণ, শত্রুঘ্ন, ভরতবিভীষণ) রামের অঙ্গ বলা হয়েছে।[১২] এই উপনিষদে সরস্বতী (জ্ঞান ও শিল্পকলার দেবী) ও দুর্গাকে (মাতৃকা শক্তি পার্বতীর ভয়ংকর রূপ) রামের অবতার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রামকে বলা হয়েছে সর্বোচ্চ সত্য ও প্রণবের (ওঁ) প্রতীক।[১২]

হনুমান রামের ষড়ক্ষরী ‘রাং রামায় নমঃ’ মন্ত্র জপের গুরুত্বের কথা বলেছেন। ল্যাম্ব বলেছেন, ১ম অধ্যায়ের ১৩শ শ্লোকে হনুমান বিভীষণকে বলছেন যে, রামনাম মন্ত্র নিরন্তর জপ করলে পিতৃহত্যা, মাতৃহত্যা, গুরুহত্যা বা ব্রহ্মহত্যার পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।[৬] এই গ্রন্থে রামগীতা পাঠেরও উপদেশ দেওয়া হয়েছে।[১২]

এই গ্রন্থে বিভিন্ন মন্ত্রেরও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। এগুলির তান্ত্রিকী শক্তির কথা বলা হয়েছে এগুলির বীজ মন্ত্রের উল্লেখও করা হয়েছে।[৬] এই সকল মন্ত্র রাম সম্পর্কিত। কিন্তু প্রত্যেকটি মন্ত্রের ভূমিকা ভিন্ন ভিন্ন।[৬] মন্ত্রের অক্ষর সংখ্যা ১ থেকে ২৪-এর মধ্যে রয়েছে। এই রকম দুটি মন্ত্রের উদাহরণ হল ‘ওঁ রামায় হূঁ ফট্‌ স্বাহা’ ও ‘ওঁ শ্রীঁ রাং দাশরথায় সীতাবল্লভায় সর্বহিতদাতায় নমঃ’।[৬] ল্যাম্বের মতে, এই মন্ত্রগুলির মধ্যে দ্ব্যক্ষরী থেকে ষড়ক্ষরী মন্ত্রগুলি সর্বাপেক্ষা অধিক ফলপ্রদ।[৬] কিন্তু মাধবন বলেছেন ‘শ্রীরামঃ শরণং মম’ - এই অষ্টাক্ষরী মন্ত্রটির মাহাত্ম্য এই গ্রন্থে বলা হয়েছে।[১৬] এই গ্রন্থ অনুসারে, একাক্ষরী ‘রাং’ মন্ত্রটি হল সর্বোচ্চ সত্য ব্রহ্ম। অন্যদিকে দুই অক্ষরে বিভক্ত ‘রাম’ মন্ত্রটি মুক্তিদায়ী।[৬]

এই উপনিষদে রামের ধ্যান সংক্রান্ত কয়েকটি শ্লোক রয়েছে।[১২] দালাল বলেছেন, এই গ্রন্থে উল্লিখিত ‘রহস্য’ বা ন্যাসের গুপ্ত রহস্যটি হল দেহের বিভিন্ন অংশ স্পর্শ করে রাম মন্ত্র জপ করা।[১২]

দোদিয়ার মতে, এই গ্রন্থে ‘রাং’ বীজমন্ত্রটি ‘র’, ‘আ’ ও ‘ং’ – এই তিন অক্ষরের বীজ উল্লিখিত হয়েছে।[৭] মন্ত্রের বিবর্তনের সম্পর্কটি বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, ‘র’ অক্ষরটি সচ্চিদানন্দের অবতার। ‘র’ নিত্য, এবং সেই কারণেই মায়ার অতীত বা ‘মায়াতীত’। এটিই ব্রহ্মের অপরিবর্তনীয় সত্ত্বা।[৭] ‘আ’ অক্ষরটি হল স্বরূপ এবং এটি মায়ার দ্বারা প্রভাবিত বা ‘মায়াবিশিষ্ট’।[৭] ‘রাং’ হল রাম মন্ত্রের বীজ। সেই কারণে দোদিয়ার মতে, এটি মায়াবিশিষ্ট ব্রহ্ম।[৭]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Catherine Ludvik 1994, পৃ. 10।
  2. Tinoco 1997, পৃ. 87।
  3. Prasoon 2008, পৃ. 82।
  4. Lamb 2002, পৃ. 191–193।
  5. Dalal 2010, পৃ. 60।
  6. Lamb 2002, পৃ. 193।
  7. Dodiya 2001, পৃ. 118।
  8. Lamb 2002, পৃ. 191, 193।
  9. Lamb 2002, পৃ. 191–192।
  10. Deussen 1997, পৃ. 556–557 with footnote 5।
  11. Deussen 1997, পৃ. 561–564।
  12. Dalal 2010, পৃ. 61।
  13. Dalal 2010, পৃ. 60-61।
  14. Catherine Ludvik 1994, পৃ. 10, 13।
  15. Lamb 2002, পৃ. 191।
  16. Mahadevan 1975, পৃ. 220।

গ্রন্থপঞ্জি[সম্পাদনা]