রাতি বিহু
| ||
---|---|---|
তিনি বিহু নৃত্য গীত অন্যান্য |
||
রাতি বিহু মরাণ উপজাতির ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক পরিক্রমার বাহক স্বরূপ। রাতি বিহুই মরাণ সংস্কৃতির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য এবং ঐতিহ্য আসামের জনমানসে তুলে ধরেছে এবং জাতীয় পরিচয় প্রতিফলিত করেছে। রাতি বিহু হল – গাঁয়ের পুরুষদের সাজিয়ে নেওয়া দুই কোঠালিযুক্ত ঐতিহ্যমন্ডিত বিহুঘরে রাতে কটকটীয়া বাঁধার মাঝে ডেকা-গাভরুদের একসাথে মরা বিহু। প্রকৃতির নিরিবিলি পরিবেশের মধ্যে কয়েকটি নীতি-নিয়মের মধ্যে করা রং-রহইচহ্ যেখানে বিহুর প্রকৃত নিভাঁজ রূপটি পরিস্ফুট হয়। এই বিহুর গীত-মাতগুলি মার্জিত। নাচের-ভঙ্গীতে শালীনতাবোধ আছে। বিহুমেলাটি কেবল রং-রহইচের স্থলই নয়, এটি ডেকা-গাভরুর মহামিলনের স্থল বলা যায়[১]।
বিহুঘর
[সম্পাদনা]“গেরগুবা পাতেরে অ’ হই রাম
বিহুঘর সাজিলোং অ’ হই রাম
মারলি নেখালে জোড়া;
গোপাল গোবিন্দাই রাম....”
এই বিহুপদ ফাঁকি দুই কোঠালীয়া বিহুঘরটিকে র্বণনা করেছে। রঙালী বিহুতে দিনচারেক থাকাতেই গাঁয়ের শিশুবয়স্করা বাঁশ-কাঠে গেরগুবা পাত/ জেঙুপাত/ টকৌপাে ইত্যাদি দিয়ে একটি ছাউনি করে একটা বেড়াহীন দুই কোঠাযুক্ত ঘর সাজায়। মধ্যে একটা বান্দর চোতি দিয়ে তার ওপরে বহিখোয়া বা চমলায় কোঠা দুটি বিভক্ত করা হয়। মাটিতে কোরে দিন একদিক দেওয়া হয়। তার বাম কোঠাটিতে বালকরা এবং ডানদিকের কোঠাটিতে পুরুষরা বিহু করে। বিনা অনুমতিতে পরস্পরে পরস্পরের কোঠায় প্রবেশ করা নিষেধ। এই নিয়ম যদি কেউ উল্লঙ্ঘন করে সে সামাজিকভাবে দন্ডনীয় হবে[১]।
ছোয়ালী গোনোয়া (খোঁজা পর্ব)
[সম্পাদনা]বিহুর শুরুর দিন সত্র/গাঁয়ের নামঘরে নাগরিকগণ শ্রী শ্রীচর্তুভূজ গুরু তিথি করেন। উক্ত তিথিতে ডেকা সমাজ জনদি আদশীয়া ভকতদের মাধ্যমে যথারীতিতে বিহু গাইতে অনুমতি চান। আদশীয়াদের অনুমতি সাপেক্ষে বুঢ়া ভকতগণ চিরাচরিত রীতিমতে রাতি বিহু গাইতে মঞ্জুর করেন। পরদিন অর্থাৎ বুধবারের গরুবিহুর দিন সন্ধ্যায় ডেকাগণ আলোচনাভিত্তিতে কয়েক দলে বিভক্ত হয়ে দলপতি (নূন্যতম একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি)কে সঙ্গে নিয়ে কুমারীর বাড়ি গিয়ে পিতা-মাতা অভিভাবকের ধর্মীয় পদমর্যাদা এবং পর্যায়ভেদে তামোল-পাণের টিপোলা, খুম দিতেই রাতি বিহু গাইতে মাইকী ছেলে (ছোয়ালী) খোঁজে। সেখানে বাবা/অভিভাবক দলটিকে প্রশ্ন করে- “পাখী সাথো মইনা চরাইক বাঁধে রাখা যায়বি জানো?” ডেকাগণ যায়ম বলে কথা দেওয়ায় পিতা পুনরায় প্রশ্ন করেন, ”যদি নোয়াবার তেন্তে?” সেখানে ডেকাগণ বলেন- “সেইয়ে নিচিন্ত থাকক। কিবা হরণ-ভগন হলে মাটিরে হলেও আপোনার জীক বানিয়ে দিম।“ – ডেকাদের তেমন দৃঢ়তায় পতিয়ন গিয়ে পিতা-মাতৃ/অভিভাবক দায়িত্বশীলজনকে সাক্ষী করে জীয়ারী/কুমারীকে রাতি বিহু করতে বিহুঘর নেওয়ার জন্য সম্মতি দেন। এমনভাবে ঘর ঘর গিয়ে প্রতিঘর থেকে সম্মতি আদায় করে ছোয়ালী নিয়ে এসে বিরতিতে রেখে আসা রীতি। এমনকি ছোয়ালী কি তৈরি-পার, আ-অলংকার পরিধান করেছেন তাও লিখে রাখতে হয়; যাতে কিছু হরণ-ভগন হলে নাগরিকরা ক্ষতিপূরণ দিতে পারে। বিহু করতে থাকা উক্ত দিনগুলিতে কুমারীর রক্ষণাবেক্ষণের সর্ম্পূণ দায়িত্ব উক্ত দলসমূহরে মাথা করে নেওয়া হয়। বিহু শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো ডেকাই কোনো কারণে কুমারীকে বিয়ে করা বা পালিয়ে যাওয়া নীতি-বিরুদ্ধ। এই সর্ম্পকে বিহু নামে এভাবে উল্লেখ আছে-
“কাে করেস মনে ঐ লাহরী
কাে করেস মন
বিহু মেরে থাকোতে
পনেওয়াই ঐ নিনিবি
ভরিব হয় ধন“
বিহু খোলায় কতগুলি কঠোর সামাজিক বাঁধন যে আছে ওপরোক্ত বিহু ফাঁকি তারই স্বাক্ষর বহন করে। এমন কঠোর নিয়মকে অমান্য করে কোনো যুবক পালিয়ে গিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে সমাজ যুবক-যুবতীকে দায়-জগর ধরে। দুই পক্ষ থেকে বর-কনেকে বিহু খোলায় নিয়ে ডাক-কুমারী সমাজকে জরিমানা সহ খুম-শরাই, হাঁসের ভার ইত্যাদি সোধিয়ে শরণাগত হয়ে দায়-জগর ভাঙতে হয়। অন্যথা সমাজের ধরন অনুযায়ী সামাজিকভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। সমাজের দায়-দোষ ভাঙার পরই মিতুর ইত্যাদি সম্পন্ন পথ প্রশস্ত হয়[১]।
বিহুর তৈরি-পার, আ-অলংকার
[সম্পাদনা]বিহু ডেকা তাঁতের শালে বোনা ন-চুরের এবং গা আবুরে রাখা কামিজ চোলা পরে। অতীতে এঙাচোলা পরত বলে শোনা যায়। মরাণ ডেকা মাথায় গামোচা অথবা কঁকালে টঙালি পরে না। ফুলাম গামোচাটি কাঁধ থেকে ওলমাই বুকুে সামান্য গাঁঠির পাক একটি মেরে ওলমাই রাখেন। কুমারীগুলি হস্ততাঁতে বোনা কপাহী ফুলাম রিহা-মেখেলা, মূগা রিহা মেখেলা, পাটর মেখেলা, মূগার মেখেলা, কলীয়া রিহা পরিধান করেছিলেন। ওঁঠে বরহমথুরি বোল, হাতে জেতুকা-এর বোল, লাহরী খোপাে কপৌফুল, নাহর ফুল ইত্যাদি বতরের ফুল গুজি নিয়েছিলেন। অলংকার মধ্যে মোটিখারু (গামখারু), গেজেরা, কানফুলি, ঢোলবিরি, জোনবিরি, মাদলি, দালমনি, ফুটিমনি ইত্যাদিয়েই প্রধান ছিলেন[১]।
বিহু নামানো পর্ব
[সম্পাদনা]মরাণগণ তাহানি শদিয়ার কেঁচাইখাতী গোঁসানীর ভক্ত থাকা কালে বুধবারে ‘বরবলি’ দিয়ে বিহু নামানো প্রথা ছিল। পরর্বতীকালে অনেক এরা-ধরা মাধ্যম দিয়ে মায়ামরা বৈষ্ণব ধর্মে শরণ নেওয়ার পরও পূর্বের সেই পরম্পরাকে অনুসরণ করে ব’হাগের প্রথম বুধবারের গরুবিহুর দিন সত্র বা নামঘর থেকে বিহু নামানো পরম্পরা রক্ষিত হল[১]। বিহুর ঘোষা পদেও এমনভাবে গাওয়া হয়-
“হাঁচতি ঐ চ'ত বিচতি অ-ই চ’ত
বুধে বিরচতি(বৃ্হস্পতি) মঙলে উরুকা
বিহু গিয়ে ছিলেনি ক’ত?”
গরু বিহুর দিন পূর্বের পরম্পরাকে স্মরণ করে দিনের বেলায় ঢোল তাল, পেঁপা, টকা ইত্যাদি বাদ্য নিয়ে ডেকা-কুমারী বিহুঘরে পৃথকে পৃথকে চক্রাকারে ফিরে ফিরে বিহুপদ জোড়ে। বিহু একপদ গাওয়ার পর নিজ নিজ বৃত্তে কিছুসময় নাচ-বাগ চলে। পুনঃ পুনঃ পদ জুড়ে তিনপদ গাওয়ার পর কিছুসময় ডেকা-কুমারীগণ নিজের মধ্যে নাচ-বাগ করেন। বিহুর দিনগুলিতে ডেকা-কুমারীগণ মেনে চলা নীতি-নিয়ম, ধরন-ধারণসমূ্হ ঘোষণা করে সেইদিনে তেমনভাবে বিহু সমাপ্তি ঘটে। অন্যদিকে বুঢ়াগণ ঘর-নামঘর শ্রী শ্রীঅষ্টভূজ গুরুর তিথি এবং বিহু তিথি করেন। একেই 'বিহু নামানো পর্ব বলে[১]।
বিহুঘর বিহুজোড়া পর্ব
[সম্পাদনা]মানুষ বিহুর দিন দিনের বেলায় আই ভগবতীর বিহুঘর গাঁয়ের ডেকা-কুমারীরা সমবায়ে খায়। প্রকৃতি দেবী সন্তুষ্টির জন্য এবং সমস্ত মঙ্গল কামনায় গুয়াপান দিতেই তামোল কেটে খায় এবং বিহুর দিনগুলিতে ডেকা-কুমারীগণের মেনে চলা নীতি-নিয়ম, ধরন-ধারণসমূ্হ পুনরায় দেওয়া হয়। তার পর আরম্ভ হয় সাে বিহুর রং-রহইচের উৎসব। বিহু খোলাটি প্রকৃতার্থে রং-রহইচ, প্রেম-পিরিতির স্থল যদিও কমকরে তিনপদ ‘বিহুপদ জুরি’ বিহু গাওয়া নিয়ম। হুঁচরির পদ গাবাদি ডেকা ডেকা কোঠায় এবং কুমারী কুমারীর কোঠায় পৃথকে পৃথকে বিহুর পদ গেয়ে চক্রাকারে ফিরে ফিরে এক গাম্ভীর্যর্পূর্ণ অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন। অন্যথা ভকতসমাজে বিহু মরা বাতিল করা কর্তৃত্বও আছে। ডেকাগণ ঢোলের কোবনীতে ঢোলের মারিতে গিরিম গিরিম্ বলে আঘাে করে বাজানো বিলম্বিত লয় থেকে দ্রুত লয় ছন্দে ছন্দে তালে তালে বিহুপদ সমস্বরে গায়। দ্রুত লয়ের ছন্দে নাচ-গান পর্ব আরম্ভ হয়। প্রথমে নিজের দলের মধ্যে পুরুষে পুরুষভাগে এবং কুমারী কুমারীভাগে নাচ-বাগ করেন। এইমত পুনঃ পুনঃ বিহুপদ জুড়তে হয়। কুমারীরাও টকার চাপড়ে চাপড়ে চক্রকারে ফিরে ফিরে কুমারীদের গাওয়া বিহুপদ জোড়ে।
ডেকা ডেকার কোঠায় এবং কুমারী কুমারীর কোঠায় প্রতিদিন অতি কমকরেও তিনপদ বিহু গায়। তারপর প্রায় মধ্যরাত থেকে নাচ-বাগ পর্ব আরম্ভ হয়। সাধারণত নাচ-বাগ পর্বে অন্য গাঁও থেকে আসা ডেকাদের কুমারী না চাওয়ার সুধরন করে দেয়। ঢোল-তাল ইত্যাদি বাদ্য তাঁদের ছেড়ে দেয়। ঢোল, তাল, হুতুলে, টাকা, গগনা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র, বিহুনাম, জোড়া-নাম, জাে নামের সুরে সুরে বিহু খোলা রজন-জানি যায়। হৃদয় উজার করে গাওয়া জোড়া-নাম, বিহুনাম, জাতনামে প্রেম-প্রণয়ের মাথায় প্রকাশ ঘটে। স্ফুর্তি এবং রং-তামাসার মধ্যে এমনভাবে সাতদিন-সাতরাত পার হওয়ায় শেষ দিন সত্র / নামঘরের বাকরে বিহু উরুয়া পর্বে বিহু সমাপ্তি করা হয়[১]।