রজ (উৎসব)

রজ পর্ব ( ওড়িয়া: ରଜ ପର୍ବ ,উচ্চারণ [ɾɔdʒɔ pɔɾbɔ] ), যা মিথুন সংক্রান্তি নামেও পরিচিত, ভারতের ওড়িশায় পালিত এক তিন দিনব্যাপী নারীত্বের উৎসব। উৎসবের দ্বিতীয় দিনটি সৌর মাসের মিথুনের সূচনাকে নির্দেশ করে, যেদিন থেকে বর্ষাকাল শুরু হয়। [১]
পুরাণ
[সম্পাদনা]
প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে হিন্দুপুরানে বর্নিত ভূমি দেবী (পৃথিবীর দেবী) যিনি দেবতা বিষ্ণুর অন্যতম পত্নী, তিনি রজ উৎসব শুরুর প্রথম তিন দিন ঋতুমতী থাকেন। উতসবের চতুর্থ দিনটি বাসুমতী স্নান হিসাবে পরিচিত। এই দিন ভূমি দেবীর আনুষ্ঠানিক স্নান সম্পন্ন হয়। রজ শব্দটি সংস্কৃত শব্দ রজস্ থেকে এসেছে, যার অর্থ ঋতুস্রাব, ঋতুস্রাবরতা মহিলাকে রজস্বলা বলা হয়। মধ্যযুগে, এই উৎসবটি কৃষি উৎসব হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যা ভূমির পূজার গুরুত্ব চিহ্নিত করে। ভূমি দেবীকে ভগবান বিষ্ণুর আঞ্চলিক রূপ জগন্নাথের সহধর্মিণী হিসেবে সম্মান করা হয়। পুরীর মন্দিরে জগন্নাথের পাশে একটি রূপালী ভূমি মূর্তি রয়েছে।
রজপর্ব
[সম্পাদনা]জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে এই উতসবের সূচনা হয়। [২] উতসবের প্রথম দিনটিকে বলা হয় পহিলি রজ,[৩] দ্বিতীয় দিনকে মিথুন সংক্রান্তি, তৃতীয় দিনকে ভূদাহ বা বাসি রজ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। শেষ বা চতুর্থ দিনটিকে বলা হয় বসুমতী স্নান, যেখানে মহিলারা ভূমির প্রতীক হিসেবে পেঁয়াজ, পাথর ইত্যাদিকে হলুদ মাখিয়ে দিয়ে স্নান করান এবং ফুল, সিঁদুর ইত্যাদি দিয়ে পূজা করেন। মা ভূমিকে সকল ধরণের মৌসুমি ফল নিবেদন করা হয়। রজ উতসব শুরুর আগের দিনকে সাজবাজা বা প্রস্তুতিমূলক দিন বলা হয়, যেদিন ঘর, রান্নাঘর পরিষ্কার করা হয় এবং পেষণকারী পাথর দিয়ে তিন দিন ধরে মশলা গুঁড়ো করা হয়। এই তিন দিনে মহিলা এবং মেয়েরা তাদের দৈন্যন্দিন কাজ থেকে বিরতি নেয় এবং নতুন শাড়ি, আলতা এবং অলংকার পরে সাজসজ্জা করেন। এই উতসবের সাথে অম্বুবাচী মেলার অনেক মিল আছে। ওড়িশার অসংখ্য উৎসবের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় উতসব হল রজ [৪] যা টানা তিন দিন ধরে পালিত হয়। যেমন পৃথিবী আসন্ন বর্ষায় তার তৃষ্ণা নিবারণের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে, তেমনি এই উৎসবের মাধ্যমে পরিবারের অবিবাহিত মেয়েরা আসন্ন বিবাহের জন্য প্রস্তুত হয়। তারা এই তিন দিন আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে কাটায় এবং কেবল কাঁচা এবং পুষ্টিকর খাবার, বিশেষ করে পোড়াপিঠা খাবার গ্রহন করে। তারা এই সময় স্নান করেননা বা লবণ গ্রহন করেননা এবং খালি পায়ে হাঁটেননা। এই সময় তারা ভবিষ্যতে সুস্থ সন্তান জন্ম দেওয়ার শপথ নেন এবং তার জন্য উপযুক্ত রীতিনীতি পালন করে। রজ উৎসবের সবচেয়ে প্রাণবন্ত এবং উপভোগ্য বিশেষত্ব হল বটবৃক্ষে দড়ির দোলনা জুড়ে তাতে রমনীদের দোল খাওয়া এবং দোল খাওয়ার সময় গীতিকবিতাপূর্ণ লোকসঙ্গীত গাওয়া হয়। [৫]
বর্ষার আগমন উদযাপনের জন্য, গ্রামবাসীরা পাঁচ দিন ধরে এই আনন্দ উৎসবের আয়োজন করে। যদিও সমগ্র ওড়িশায় এই উতসব উৎসাহের সাথে পালন করা হয় তবে উপকূলীয় জেলাগুলিতে এর প্রচলন অনেক বেশি। রজ উতসবের প্রথম দিন সাজা বাজা , দ্বিতীয় দিন পহিলি রাজা , তৃতীয় দিন রজসংক্রান্তি [৬] এবং চতুর্থ দিন ভূমি দহন বা বাসি রজ হিসাবে অভিহিত। পঞ্চম হল বসুমতী স্নান।
জনপ্রিয় বিশ্বাস অনুসারে, নারীদের যেমন ঋতুস্রাব হয়, তেমনই পৃথিবী মাতারও ঋতুস্রাব হয় যা ভূমির উর্বরতার লক্ষণ। তাই উৎসবের তিন দিনই ভূমি দেবীর ঋতুস্রাবকাল হিসেবে বিবেচিত হয়। উৎসব চলাকালীন সকল কৃষি কার্যক্রম স্থগিত থাকে। ঋতুস্রাবের দিনগুলিতে পৃথিবীর প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে, উতসবের সমস্ত কৃষিকাজ বন্ধ থাকে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, এটি অবিবাহিত মেয়ে এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য মায়েদের একটি উৎসব। তারা সকলেই ঋতুস্রাবরত মহিলার জন্য নির্ধারিত বিধিনিষেধগুলি পালন করে। প্রথম দিন, তারা ভোর হওয়ার আগে ঘুম থেকে ওঠে, চুল আঁচড়ায়, হলুদ এবং তেল তাদের শরীরে মাখে এবং তারপর নদী বা পুকুরে শুদ্ধিকরণ স্নান করে। উতসবের বাকি দুই দিন মেয়েদের স্নান করা নিষিদ্ধ। উতসবের সময় অবিবাহিতা মহিলাদের খালি পায়ে হাঁটা, মাটি আঁচড়ানো ইত্যাদি নিষিদ্ধ। উতসবের টানা তিন দিনই মেয়েরা তাদের সেরা পোশাক এবং সাজসজ্জা ধারণ করে। বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে পোড়া পিঠা ইত্যাদি সুস্বাদু খাবার খায়। তারা দীর্ঘ সময় ধরে আনন্দে কাটায় এবং অস্থায়ী দোলনায় দোল খায় ও আনন্দময় তাৎক্ষণিক গান গেয়ে গ্রামের আকাশ-বাতাস মুখরিত করে।
রজ উতসবের দোলনাগুলো বিভিন্ন ধরণের, যেমন 'রাম ডোলি', 'চরকি ডোলি', 'পাটা ডোলি', 'ডান্ডি ডোলি' ইত্যাদি। উৎসবের জন্য বিশেষভাবে গান তৈরি হয় যাতে প্রেম, স্নেহ, শ্রদ্ধা, সামাজিক আচরণ এবং গায়কদের মনে আসা সামাজিক শৃঙ্খলার কথা বর্ননা করা হয়। এই গানগুলির বেশিরভাগই ওড়িশার লোক-কবিতার মূল ভিত্তি তৈরি হয়। উতসবের সময় সমস্ত কৃষিকাজ স্থগিত থাকায় গ্রামের যুবকরা বিভিন্ন ধরণের গ্রামীণ খেলায় নিজেদের ব্যস্ত রাখে, যার মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় হল হা ডু ডু। গ্রামের বিভিন্ন দলের মধ্যে প্রতিযোগিতাও অনুষ্ঠিত হয়। সারা রাত ধরে যাত্রাপালা পরিবেশনা করা হয় বা ' গোটিপুয়া ' নৃত্যের আয়োজন করা হয়। উৎসাহী অপেশাদারর শিল্পীরা নাটক এবং অন্যান্য ধরণের বিনোদনে অংশ নেয়। [৭]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "Four-day Festival of Odisha 'Raja Parba' is all about celebrating Womanhood"।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ Sen, Sushmita। "Raja Parba 2016: This 4-day Odiya festival honours womanhood [PICTURE GREETINGS]" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ৪ অক্টোবর ২০১৬।
- ↑ "CHECK: RAJA Sankaranti festival 2021 date, Pahili Raja Quotes,Wishes,Shayari Images Online"। Pixnama.com। ১৩ এপ্রিল ২০২১। সংগ্রহের তারিখ ১৪ জুন ২০২১।
- ↑ "'Raja Utsav' to be celebrated tomorrow"। The Hindu (ইংরেজি ভাষায়)। ১৪ জুন ২০০৭। সংগ্রহের তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬।
- ↑ "Raja Festival : Odisha's unique fest to raise toast to womanhood & Nature"। OdishaTv (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জুন ২০১৭।
- ↑ "CHECK: RAJA Sankranti Odisha 2021 date, Wishes, Images, Sms | Pahili Raja,Raja Sankaranti Images Online"। Odiasayari.com। ১২ জুন ২০২১। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জুন ২০২১।
- ↑ "Know more about Festivities of Odisha during days of Raja Parba - Bhubaneswar Buzz"। Bhubaneswarbuzz। ১৪ জুন ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ৪ অক্টোবর ২০১৬।