বিষয়বস্তুতে চলুন

যাইনুদ্দিন মাখদুম রহ.

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
শায়খ আহমাদ যাইনুদ্দিন মাখদুম ইবনে শায়খ মোহাম্মদ গাজালি
জন্ম৯৩৮ হিজরি (১৫৩১ খ্রিষ্টাব্দ)
চম্বল, মাহে’র নিকটবর্তী, কেরালা, ভারত
মৃত্যু১৫৮৩
জাতীয়তাভারতীয়
অন্যান্য নামচালিলাকাথ
পরিচিতির কারণইসলামি আইন বিশেষজ্ঞ, ফাতহুল মুঈন ও তুহফাতুল মুজাহিদিন গ্রন্থের লেখক

শায়েখ আহমাদ যাইনুদ্দিন ইবনে শায়েখ মোহাম্মদ গাজালি মাখদুম রহ. (আরবি:شيخ احمد زين الدين بن شيخ محمد غزالي , মালায়লাম: ശൈഖ് അഹ്മദ് സൈനുദ്ദീന് ബിന് ശൈഖ് മുഹമ്മദ് ഗസ്സാലി അല് മഅ്ബരി) ছিলেন শায়েখ মাখদুম প্রথম-এর পৌত্র। তিনি বিশেষভাবে পরিচিত যাইনুদ্দিন মাখদুম দ্বিতীয় বা যাইনুদ্দিন মাখদুম সাগির (ছোট মাখদুম) নামে। একাধারে তিনি ছিলেন ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞ, লেখক, ইতিহাসবিদ এবং ষোড়শ শতকে মালাবার (কেরালা) অঞ্চলের আধ্যাত্মিক ধর্মীয় নেতা। তিনি তার পিতামহ থেকে ইসলামি চিন্তায় দীক্ষিত হন এবং পরবর্তীতে ভারতের কেরালার পুন্নানি এলাকার প্র্রধান মুফতি হিসেবে দীর্ঘদিন সেবা প্রদান করেন। একই সঙ্গে তিনি মসজিদ সংলগ্ন পুন্নানি দরসগাহেও শায়খুল হাদিস হিসেবে হাদিসের শিক্ষা প্রদান করেন।

তার পরবর্তী বংশধরদের অনেকেই বর্তমান কেরালার নানা স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করছেন, বিশেষত মালাপ্পরাম, কোঝিকোড়ে, মাহে, মান্নারকাড়, ওট্টাপ্পালাম এবং আন্দামানের নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের গুদাল্লুর ও লক্ষ্যাদ্বীপে। সময়ের বিবর্তনে তাদের বংশীয় নামের পদবীও পরিবর্তন হয়েছে যেমন, নালাকাথ, ওট্টাকাথ এবং মুসলিয়ারাকাথ।

শিক্ষাজীবন

[সম্পাদনা]

তিনি ১৫৩১ খ্রিষ্টাব্দে (৯৩৮ হিজরি) কেরালার মাহে নগরের নিকটবর্তী চম্বল এলাকার মাখদুম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তার দাদার তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষালাভ করেন। ধর্মীয় কিতাবাদির শিক্ষা গ্রহণ করেন তার পিতা মোহাম্মদ গাজালি এবং চাচা আবদুল আজিজের কাছে। উচ্চরতর শিক্ষালাভের জন্য ধর্মীয় জ্ঞানের অন্যতম বিদ্যানগরী মক্কায় গমন করেন এবং সেখানে হজ সমাপনের পর একাধারে ১০ বছর ধর্মীয় জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। বিশেষত তিনি হাদিস, ইসলামি আইনশাস্ত্র (ফিকহ), তাফসির এবং অন্যান্য বিষয়ে মক্কার বিভিন্ন শায়েখের তত্ত্বাবধানে জ্ঞানলাভে সক্ষম হন। তার ধর্মীয় শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন হারমাইন শরিফের প্রধান মুফতি আল-হাফিজ শিহাবুদ্দিন ইবনে আল-হাজার হাইসামি, ইজ্জুদ্দিন ইবনে আবদুল আজিজ আল-জমজমি, শায়খ আবদুর রহমান ইবনে জিয়াদ এবং সাইয়েদ আবদুর রহমান আস-সাফাবি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি আধ্যাত্মিক বিষয়ে দীক্ষা লাভ করেন কুতুবুজ জমান যাইনুল আরিফিন মোহাম্মদ ইবনে শায়খুল আরিফ আবুল হাসান আল-বকরির একান্ত সাহচর্যে। তার সান্নিধ্যে তিনি কাদেরিয়া তরিকার একাদশ ‘খিরকাহ’ লাভে সম্মানিত হন।

ধর্মীয় দীক্ষা প্রদান

[সম্পাদনা]

১০ বছর মক্কায় জ্ঞানলাভের পর তিনি কেরালায় ফিরে এসে পুন্নানি জামে মসজিদ এবং মসজিদ সংলগ্ন দরসগাহের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এ পদে তিনি দীর্ঘ ৩৬ বছর সুচারুরূপে দায়িত্ব পালন করেন।

শায়খ যাইনুদ্দিন মাখদুম তৎকালীন ইসলামি বিশ্বের বিভিন্ন প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে সচেষ্ট ছিলেন। তার অনুরোধে তার শিক্ষক তৎকালীন হারমাইন শরিফের প্রধান মুফতি আল-হাফিজ শিহাবুদ্দিন ইবনে আল-হাজার হাইসামি কেরালার পুন্নানি জামে মসজিদে আগমন করেন। প্রচলিত আছে যে, তার আগমন উপলক্ষে পাথরের আধারে একটি দৃষ্টিনন্দন বাতি জ্বালানো হয়। সেই প্রজ্জ্বলিত পাথরের বাতিটি আজ পর্যন্ত পুন্নানি জামে মসজিদে প্রজ্জ্বলন অবস্থায় রাখা হয়েছে, যা দর্শন করতে প্রতিদিন মুসলিমসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের আগমন ঘটে। এমনকি আল-হায়সামি পুন্নানিতে অবস্থানরত অবস্থায় যেসব ফতোয়া প্রদান করেছিলেন, সেগুলোও পুন্নানিতে সংরক্ষিত আছে।[] তৎকালীন ইসলামি বিশ্বের অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ইমাম মোহাম্মদ রমলি এবং ইমাম মোহাম্মদ খতিব আল-সারবিনির সঙ্গেও যাইনুদ্দিন মাখদুমের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।

পর্তুগিজ উপনিবেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা

[সম্পাদনা]

তিনি শুধু মাদরাসা-মসজিদকেন্দ্রিক একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বই ছিলেন না, তৎকালীন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তার সময়কালে দিল্লির মুঘল শাসক ছিলেন সম্রাট আকবর। আকবরের দরবারের অনেক সভাসদের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। এছাড়াও বিজাপুরের সুলতান আলি আদিল শাহ এবং কালিকটের জামুরিনদের সঙ্গেও তিনি রাজনৈতিক সখ্যতা গড়ে তুলেছিলেন।

তার জন্মের কিছুদিন পূর্বে (১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর্তুগিজরা ভারতবর্ষে আগমন করে এবং কিছুদিনের মধ্যে তারা ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলে নিজেদের প্রভুত্ব কায়েমে সচেষ্ট হয়। তার পিতামহ ও পিতা পর্তুগিজদের অবাধ প্রভুত্ব কায়েমে বাধা প্রদান করেন। সেই সূত্রে তিনিও তার জীবদ্দশায় পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের ডাক দেন। পর্তুগিজদের প্রতিহত করতে পুন্নানি ও এ অঞ্চলের যুবকদের নিয়ে তিনি একটি আলাদা সশস্ত্র সংগঠন গড়ার প্রতিও মনোনিবেশ করেন। শুধু তাই নয়, উপনিবেশবাদী পর্তুগিজদের তাড়াতে ভারতীয় শাসকদের অমনোযোগিতায় তিনি তুর্কি ও মিসরের তৎকালীন মুসলিম শাসকদের কাছে সাহায্য চেয়ে পত্রও লিখেন। এই উপনিবেশবিরোধী লড়াই নিয়েই তিনি রচনা করেন তার অমর গ্রন্থ তুহফাতুল মুজাহিদিন ফি বা‘জি আখবারিল বুরতুগালিন تحفة المجاهدين في بعض اخبارالبرتغالين , যা ‘তুহফাতুল মুজাহিদিন’ নামে সর্বাধিক পরিচিত। এ গ্রন্থ মালাবার অঞ্চলের প্রথম লিখিত ইতিহাস বলে স্বীকৃত।[] মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে এ গ্রন্থের প্রথম মুদ্রিত কপি এখনও সংরক্ষিত রয়েছে।

গ্রন্থ রচনা

[সম্পাদনা]

এছাড়াও তিনি ইসলামি বিভিন্ন বিষয়ে আরও বেশকিছু গ্রন্থ রচনা করেন। বিশেষত তার ফাতহুল মুইন فتح المعين شرح قرة العين গ্রন্থ সারা বিশ্বে শাফেঈ মাজহাবের অন্যতম ফিকহ গ্রন্থ হিসেবে পঠিত হয়ে আসছে। এ গ্রন্থ শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, মালয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিসরসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশের মাদরাসাসমূহে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে গৃহীত। তার রচিত উল্লেখযোগ্য কিছু গ্রন্থ:

নং গ্রন্থের নাম (বাংলা) মূল নাম শিরোনামের অর্থ গ্রন্থের বিষয়বস্তু
তুহফাতুল মুজাহিদিন ফি বা‘জি আখবারিল বুরতুগালিন تحفة المجاهدين في بعض اخبارالبرتغالين Presentation for warriors on some news related to the Portuguese History of Muslims in Kerala with special reference to the brutalities of the Portuguese invasion
ফাতহুল মুইন শরহে কুররাতুল আইন فتح المعين شرح قرة العين Fathul Mueen the annotation on Kurrathul Ain Exemplary text on Jurisprudence based on the Shafi school of thought; annotation on his own text Kurratul Ain
কুররাতুল আইন বিমুহিম্মাতিদ দীন قرة العين بمهمات الدين Special attention on the major religious issues Precise text on jurisprudence based on the Shafi school of thought
ইরশাদুল ইবাদ ইলা সাবিলির রিশাদ ارشاد العباد الى سبيل الرشاد Guidance for the slave to rectitude Spiritual text explaining the way to the Almighty
আহকামু আহকামিন নিকাহ احكام احكام النكاح Consolidation on the laws related to marriage Precise explanation of the laws relating to marriage
শরহুস সুদুর ফি আহওয়ালিল মাউতি شرح الصدور في احوال الموتى Widening of the chest in the context of the dead Spiritual text explaining the context of th afterworld; it was an annotation of the work done by Sooyoothi (السيوطي)
আজভিবাতুল আজিবাহ আনিল আসয়িলাতুল গারিবাহ الاجوبة العجيبة عن الاسئلة الغريبة Wonderful answers for rare questions Collection of decrees issued on various issues
8 আল-ফাতাওয়াল হিন্দিয়া الفتاوى الهندية Indian decree Decree issued on the special context of southern Indian state of Kerala
আল-জাওাহিরু ফি উকুবাতি আহলিল কাবায়ির الجواهر في عقوبة اهل الكبائر Gems on the consequence of the culprits Spiritual text explaining the consequences for criminals
১০ আল-মানহাজুল ওয়াজিহ المنهج الواضح The obvious pattern Text explaining laws relating to marriage

মৃত্যুবরণ

[সম্পাদনা]

নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, তিনি ১৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন এবং তাকে তার গ্রামের বাড়ি চম্বলের কুহ্নিপাল্লিতে সমাধিস্থ করা হয়। মৃত্যুর সময় তিনি আবু বকর, আবদুল আজিজ এবং ফাতেমা নামে তিন সন্তান রেখে যান।

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]