মুহাম্মাদের শৈশব ও কৈশোরকাল

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

ইসলামের ও পুরো বিশ্বের নবী হযরত মুহাম্মদ এর শৈশব বয়স থেকেই ছিলেন চিন্তাশীল । তিনি তার শৈশব ও কৈশরকাল থেকেই সমাজের ও মানুষের বিভিন্ন বিষয় দুঃখ,কস্ট,ক্লেশ নিয়ে চিন্তা করতেন। এই চিন্তাধারাই তাকে পরবর্তীতে মহামানব হতে সাহায্য করেছিলো।তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নবি ও রাসুল। তিনি ছিলন আল্লাহর প্রিয় বান্দা। তিনিই একমাত্র মানব যে কখনো মিথ্যা কথা বলেনি।

বনি সা'দ গোত্রে অবস্থান[সম্পাদনা]

তৎকালীন আরবের রীতি ছিল যে তারা মরুভূমির মুক্ত আবহাওয়ায় বেড়ে উঠার মাধ্যমে সন্তানদের সুস্থ দেহ এবং সুঠাম গড়ন তৈরির জন্য জন্মের পরপরই দুধ পান করানোর কাজে নিয়োজিত বেদুইন মহিলাদের কাছে দিয়ে দিতেন এবং নির্দিষ্ট সময় পর আবার ফেরত নিতেন। এর আরেকটি কারণ ছিল বিশুদ্ধ আরবি ভাষা শিক্ষা করা। এই রীতি অনুসারে মোহাম্মদকেও হালিমা বিনতে আবু জুয়াইবের (অপর নাম হালিমা সাদিয়া) হাতে দিয়ে দেয়া হয়। এই নারী ছিলেন বনু সা'দ ইবনে বকর গোত্রের (হাওয়াযেন গোত্র) অন্তর্ভুক্ত। তার স্বামীর নাম ছিলো হারেস ইবনে আবদুল ওযযা আর ডাক নাম আবু কাবশা, যিনি একই গোত্রের লোক ছিলেন। মুহাম্মাদের নবুয়্যত লাভের পর তিনি মক্কায় এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। হালিমার এক পু্ত্র এবং তিন কন্যা ছিল। পুত্রের নাম ছিল আবদুল্লাহ। আর কন্যা তিনজনের নাম ছিল যথাক্রমে আনিসা, হোযায়ফা এবং শায়মা। এদের মাঝে আবদুল্লাহ্ এবং শায়মার ইসলাম গ্রহণের কথা জানা যায়। বাকীদের ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি অজ্ঞাত। এছাড়া হালিমা নবীর বড় চাচা হারিসের পুত্র আবু সুফিয়ানকেও দুধ পান করিয়েছেন। তাই হালিমার সূত্রে আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস ইবনে আবদুল মোত্তালেবও (যে সম্পর্কে নবীর চাচাতো ভাই ছিলো) নবীর দুধ ভাই ছিল।[১]

মোহাম্মদ এতিম বিধায় প্রথমে কোন নারী তাকে দুধ খাওয়ানোর জন্য নিতে চায়নি। কিন্তু হালিমা অন্য কোন শিশু সন্তান না পাওয়ায় এই এতিম শিশুটিকেই গ্রহণ করেন। কিন্তু এই শিশুকে ঘরে আনার পর দেখা যায় হালিমার সচ্ছলতা ফিরে আসে এবং তারা শিশুপুত্রকে সঠিকভাবে লালনপালন করতে সমর্থ হন। তখনকার একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য - শিশু মোহাম্মদ কেবল হালিমার একটি স্তনই পান করতেন এবং অপরটি তার অপর দুধভাইয়ের জন্য রেখে দিতেন। দুই বছর লালনপালনের পর হালিমা শিশু মোহাম্মদকে আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু এর পরপরই মক্কায় মহামারী দেখা দেয় এবং শিশু মুহাম্মদকে হালিমার কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। হালিমাও চাচ্ছিলেন শিশুটিকে ফিরে পেতে। এতে তার আশা পূর্ণ হল।

ইসলামী বিশ্বাসমতে এর কয়েকদিন পরই একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে - একদিন শিশু নবীর বুক চিরে কলিজার একটি অংশ বের করে তা জমজম কূপের পানিতে ধুয়ে আবার যথাস্থানে স্থাপন করে দেয়া হয়। মুসলমানদের বিশ্বস্ত হাদিস গ্রন্থ মুসলিম শরীফের বর্ণনাসূত্রে এই তথ্য পাওয়া যায়। মুসলমানদের বিশ্বাসমতে এর মাধ্যমে মুহাম্মদের দেহ থেকে অপবিত্র সব কিছু ধুয়ে ফেলা হয়েছিল। ইবনে খালদুনের বর্ণনামতে তার অন্তরে নূর ভরে দেয়া হয়। এই ঘটনাটি কারণেই গুরুত্বপূর্ণ যে এতে ইসলামে অলৌকিকতার স্বরুপ বুঝা যায়। অবশ্য ধর্ম বিশ্বাসীদের কাছে এটি অলৌকিক নয়; কারণ ধর্মীয় মতে এই ঘটনাটি ফেরেশতাদের দ্বারা সম্পন্ন হয় এবং এই ফেরেশতা হলেন জীবরাইল। এই ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে সিনা চাকের ঘটনা হিসেবে খ্যাত।

মাতৃবিয়োগ[সম্পাদনা]

এই ঘটনার পরই হালিমা মুহাম্মদকে মা আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। ছয় বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তিনি মায়ের সাথে কাটান। এই সময় একদিন আমিনার ইচ্ছা হয় ছেলেকে নিয়ে মদীনায় যাবেন। সম্ভবত কোন আত্মীয়ের সাথে দেখা করা এবং স্বামীর কবর জিয়ারত করাই এর কারণ ছিল। আমিনা ছেলে, শ্বশুর এবং দাসী উম্মে আয়মনকে নিয়ে ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মদীনায় পৌঁছেন। তিনি মদীনায় একমাস সময় অতিবাহিত করেন। একমাস পর মক্কায় ফেরার পথে আরওয়া নামক স্থানে এসে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।

দাদার মৃত্যু[সম্পাদনা]

মাতার মৃত্যুর পর দাদা আবদুল মোত্তালেব শিশু মুহাম্মদকে নিয়ে মক্কায় পৌঁছেন। এর পর থেকে দাদাই মুহাম্মদের দেখাশোনা করতে থাকেন। তিনি শিশু নবীকে নিজের সন্তানদের থেকেও অধিক ভালবাসতেন। ইবনে হিশাম তার সীরাত গ্রন্থে লিখেছেন "আবদুল মোত্তালেবের জন্য কাবাঘরের ছায়ায় বিছানা পেতে দেয়া হতো। তার সব সন্তান সেই বিছানার চারদিকে বসতো। কিন্তু মোহাম্মদ গেলে বিছানায়ই বসতেন। বালক মোহাম্মদের কাজকর্ম তাকে আনন্দ দিতো।" মোহাম্মদের বয়স যখন ৮ বছর ২ মাস ১০ দিন তখন তার দাদাও মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি তার পুত্র আবু তালিবকে মোহাম্মদের দায়িত্ব দিয়ে যান।

সিরিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা[সম্পাদনা]

আবু তালিবের বাড়িতে মুহাম্মদ বেড়ে উঠতে থাকেন। চাচা তাকে অসম্ভব আদর করতেন এবং মুহাম্মদও চাচাকে বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করতেন। যেমন তিনি অন্যান্য বালকদের মতই মাঠে আবু তালিবের ছাগল চড়াতেন। কিন্তু এ সময় থেকেই তাকে চিন্তাশীল মনে হত।
আবু তালিব ব্যবসায়ী ছিলেন এবং আরবদের নিয়ম অনুযায়ী বছরে একবার সিরিয়া সফরে যেতেন। মুহাম্মদের বয়স যখন ১২ ব্ছর তখন তিনি চাচার সাথে সিরিয়া যাওয়ার জন্য বায়না ধরলেন। প্রগাঢ় মমতার কারণে আবু তালিব আর নিষেধ করতে পারলেননা। যাত্রাপথে বসরা পৌঁছার পর কাফেলাসহ আবু তালিব তাঁবু ফেললেন। সে সময় আরব উপদ্বীপের রোম অধিকৃত রাজ্যের রাজধানী বসরা অনেক দিক দিয়ে সেরা ছিল। কথিত আছে, শহরটিতে জারজিস নামে এক ইয়াহুদী পাদ্রী ছিলেন যিনি বুহাইরা বা বহিরা নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি তার গির্জা হতে বাইরে এসে কাফেলার মুসাফিরদের মেহমানদারী করেন। এ সময় তিনি বালক মুহাম্মদকে দেখে শেষ নবী হিসেবে চিহ্নিত করেন। কারণ তিনি তার অন্তর দৃষ্টি দিয়ে লক্ষ্য করেন যে সব গাছপালা, পাথর এই বালকটিকে সেজদা করছে। তিনি স্বগতোক্তি করেন, "এতো সেই সাইয়েদুল মুরসালীন, অতীতের সমস্ত নবী যার আগমন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন।" তিনি আবু তালিবকে মুহাম্মদকে সিরিয়ায় নিয়ে যেতে নিষেধ করেন; কারণ সেখানকার ইহুদীরা তার ক্ষতি করতে পারে। পাদ্রীর কথা শুনে মুহাম্মদকে কয়েকজন ভৃত্যের মাধ্যমে মক্কায় পাঠিয়ে দেয়া হয়।

ফুজ্জারের যুদ্ধ[সম্পাদনা]

ফুজ্জারের যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন নবীর বয়স ১৫ বছর। এই যুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেননি। যুদ্ধের নির্মমতায় তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন। কিন্তু তার কিছু করার ছিলনা। সে সময় থেকেই তিনি কিছু একটি করার চিন্তাভাবনা শুরু করেন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. মুহাম্মদ তফাজ্জল হোছাইন (২০০২)। মুহাম্মাদ মুস্তফা (স): সমকালীন পরিবেশ ও জীবন। বাংলাদেশ: ইসলামিক রিসার্চ ইন্সটিটিউট। পৃষ্ঠা ১৭৩–১৭৮।