মুদ্গল পুরাণ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(মুদ্গলপুরাণ থেকে পুনর্নির্দেশিত)
মুদ্গলপুরাণ গ্রন্থটির মূল উপজীব্য বিষয় গণেশ-সংক্রান্ত পৌরাণিক উপাখ্যান ও দর্শনতত্ত্ব।

মুদ্গলপুরাণ (সংস্কৃত:मुद्गल पुराणम्) হল একটি হিন্দু ধর্মগ্রন্থ। এটি একটি উপপুরাণ। এই পুরাণে হিন্দু দেবতা গণেশকে কেন্দ্র করে প্রচলিত অনেক পৌরাণিক উপাখ্যান ও ক্রিয়াকাণ্ড-সংক্রান্ত বিষয় লিপিবদ্ধ রয়েছে। গণেশপুরাণমুদ্গলপুরাণ গ্রন্থদুটি হিন্দুধর্মের গাণ্যপত্য নামক গণেশ ভক্ত সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। এই দুটি পুরাণই কেবলমাত্র সম্পূর্ণ গণেশকে কেন্দ্র করে রচিত।[১]

রচনাকাল[সম্পাদনা]

মুদ্গলপুরাণ গ্রন্থের রচনাকাল নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতৈক্য খুবই কম। ফিলিপ গ্র্যানোফ এই পুরাণের অন্তর্বর্তী প্রমাণগুলি পরীক্ষা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, মুদ্গলপুরাণ গণেশ-সংক্রান্ত সর্বশেষ দর্শন শাস্ত্র।[২] আর. সি. হাজরার মতে, মুদ্গলপুরাণ গ্রন্থটি গণেশপুরাণ গ্রন্থের পূর্বে রচিত। উল্লেখ্য, তিনি বলেছেন খ্রিস্টীয় ১১০০ থেকে ১৪০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে গণেশপুরাণ রচিত হয়।[৩] গ্র্যানোফ এই আপেক্ষিক সময়-নির্ধারণের সমস্যাটির কথা তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, মুদ্গলপুরাণ গ্রন্থে গণেশ-সংক্রান্ত চারটি পুরাণের উল্লেখ রয়েছে। এগুলি হল: ব্রহ্মপুরাণ, ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ, গণেশপুরাণমুদ্গলপুরাণ। কোর্টরাইট বলেছেন, মুদ্গলপুরাণ গ্রন্থের রচনাকাল খ্রিস্টীয় ১৬শ থেকে ১৭শ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়। কিন্তু তিনি তাঁর এই তথ্যের সপক্ষে কোনো যুক্তি দেননি।[৪] থাপান গণেশপুরাণমুদ্গলপুরাণ গ্রন্থদ্বয়ের সময়-নিরূপণ নিয়ে বিভিন্ন মতামত পর্যালোচনা করে বলেছেন যে, অন্যান্য পুরাণগুলির মতো মুদ্গলপুরাণ গ্রন্থটিও একটি বহুস্তরবিশিষ্ট গ্রন্থ। তিনি বলেন, এই পুরাণের আদি অংশটি অবশ্যই প্রাচীন। ১৭শ ও ১৮শ শতাব্দীতে কোনো কোনো অঞ্চলে গণেশ পূজা অধিকতর গুরুত্ব অর্জন করা পর্যন্ত এই পুরাণে মধ্যে অনেকগুলি অংশ প্রক্ষিপ্ত রূপে সংযোজিত হয়েছিল।[১]

সংস্করণ[সম্পাদনা]

২০০৭ সাল পর্যন্ত মুদ্গলপুরাণ গ্রন্থের কোনো ‘সমালোচনামূলক সংস্করণ’ প্রকাশিত হয়নি। একটি পুরাণের ‘সমালোচনামূলক সংস্করণ’ হল গবেষণার মাধ্যমে বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি পর্যবেক্ষণ ও একত্র করে একটি সর্বজনগ্রাহ্য গ্রন্থ প্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রকাশিত একটি বিশেষ ধরনের গবেষণামূলক সংস্করণ। কোনো পুরাণের সমালোচনামূলক সংস্করণ না থাকার অর্থ, বিভিন্ন সংস্করণে বিষয়বস্তু ও শ্লোক সংখ্যায় গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য লক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। মুদ্গলপুরাণ গ্রন্থের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে। সেই কারণে এই পুরাণের বিভিন্ন সংস্করণই পর্যালোচনা করে দেখা হয়, কোন কোন ক্ষেত্রে এগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে।

এই পুরাণের বহুল-প্রচলিত সংস্করণটি সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষায় সম্পাদনা করেন অধ্যাপক সীতারাম গণেশ দেসাই। এটি মুম্বইয়ের দাদারের মুদ্গলপুরাণ প্রকাশন মণ্ডল থেকে প্রকাশিত। কর্ণাটকের গণেশযোগী মহারাজ কর্তৃক প্রকাশিত একটি সংস্কৃত সংস্করণও প্রকাশিত আছে।

গণেশের ৩২টি অবতার[সম্পাদনা]

গণেশপুরাণ গ্রন্থের মতো মুদ্গলপুরাণ গ্রন্থেও গণেশকে সর্বোচ্চ সত্য রূপে দর্শানো হয়েছে। এই পুরাণে বলা হয়েছে, গণেশের অসংখ্য রূপভেদ রয়েছে। তবে তাঁর আটটি অবতার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। এই পুরাণেই (১। ১৭। ২৪-২৮) এই আটটি অবতারের উল্লেখ আছে। অধিকন্তু গ্রন্থটি প্রত্যেকটি অবতাএর বিবরণের ভিত্তিতে বিভিন্ন অংশে বিন্যস্ত হয়েছে।[৫][৬] গণেশপুরাণ গ্রন্থে গণেশের যে চারটি অবতারের উল্লেখ করা হয়েছে, এগুলি তার অনুরূপ নয়।

পুরাণের বর্ণনা অনুসারে, গণেশ বিবিন্ন পৌরাণিক যুগে অবতীর্ণ করেছিলেন। এই পুরাণে জগৎ সৃষ্টি-সংক্রান্ত বিভিন্ন জটিল দার্শনিক তত্ত্ব উক্ত অবতারগুলি বর্ণনা করা হয়েছে। প্রত্যেকটি অবতার সর্বোচ্চ সত্যের এক একটি স্তর। এই স্তরগুলি সৃষ্টির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। গ্র্যানোফ এই পুরাণে বর্ণিত প্রত্যেকটি অবতারের দার্শনিক অর্থের একটি সারসংক্ষেপ বর্ণনা করেছেন। [২] দর্শনতত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গে দানবদের সঙ্গে যুদ্ধের উপাখ্যানগুলির মতো সাধারণ পৌরাণিক বৈশিষ্ট্যগুলিও এই পুরাণে লক্ষিত হয়েছে। মুদ্গলপুরাণ গ্রন্থে বর্ণিত গণেশের আটটি প্রধান অবতার হল:

  1. বক্রতুণ্ড (যাঁর শুঁড়টি বাঁকানো) হল গণেশের প্রথম অবতার। সকল দেহের সমষ্টি রূপে সর্বোচ্চ সত্যের রূপ এটি। এটি ব্রহ্মের একটি সাকার রূপ। এই অবতারের উদ্দেশ্য হল মাৎসর্যাসুরকে (ঈর্ষা) ধ্বংস করা। বক্রতুণ্ডের বাহন সিংহ।
  2. একদন্ত (যাঁর একটি দাঁত; এক্ষেত্রে হাতির দাঁতের কথা বলা হয়েছে) হলেন প্রত্যেক আত্মার সমষ্টি। এটি ব্রহ্মের মূল প্রকৃতির স্বরূপ। এই অবতারের উদ্দেশ্য হল মদাসুরকে (দম্ভ) ধ্বংস করা। একদন্তের বাহন মুষিক (ইঁদুর)।
  3. মহোদর (যাঁর উদরটি বিশাল) হলেন বক্রতুণ্ড ও একদন্তের সম্মিলিত রূপ। সৃষ্টিপ্রক্রিয়ায় প্রবেশরত সর্বোচ্চ সত্যের রূপ এটি। এই রূপ ব্রহ্মের প্রজ্ঞার প্রতীক। এই অবতারের উদ্দেশ্য মোহাসুরকে (মোহ) ধ্বংস করা। মহোদরের বাহন মুষিক।
  4. গজবক্ত্র বা গজানন (যাঁর মাথাটির হাতির) হলেন মহোদরের রূপান্তর। এই অবতারের উদ্দেশ্য লোভাসুরকে (লোভ) ধ্বংস করা। গজবক্ত্রের বাহন মুষিক।
  5. লম্বোদর (যাঁর স্ফীত উদর) হলেন যে স্তরে পৌরাণিক দেবদেবীদের সৃষ্টি সেই স্তরের চার অবতারের মধ্যে প্রথম। লম্বোচরের সঙ্গে ব্রহ্মের শুদ্ধাশক্তি বিরাজমান থাকেন। এই অবতারের উৎস ক্রোধাসুরকে (ক্রোধ) ধ্বংস করা। লম্বোদরের বাহন মুষিক।
  6. বিকট (‘অপ্রাকৃত রূপ’, ‘বিভৎস’) হলেন সূর্যের প্রতিরূপ। তিনি ব্রহ্মের উজ্জ্বল প্রকৃতির প্রতীক। এই অবতার উদ্দেশ্য কামাসুরকে (কামনা) ধ্বংস করা। বিকটের বাহন ময়ূর।
  7. বিঘ্নরাজ (বিঘ্নের প্রভু) হলেন বিষ্ণুর প্রতিরূপ। তিনি ব্রহ্মের পালনকারী সত্ত্বার প্রতীক। এই অবতারের উদ্দেশ্য মমাসুরকে (অধিকারবোধ) ধ্বংস করা। বিঘ্নরাহের বাহন শেষনাগ
  8. ধূম্রবর্ণ (যাঁর গাত্রবর্ণ ধূসর) হলেন শিবের প্রতিরূপ। তিনি ব্রহ্মের ধ্বংসাত্মিক সত্ত্বার প্রতীক। এই অবতারের উদ্দেশয় অভিমানাসুরকে (অহংকার, আসক্তি) ধ্বংস করা। ধূম্রবর্ণের বাহন মুষিক।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Thapan, Anita Raina (১৯৯৭)। Understanding Gaṇapati: Insights into the dynamics of a cult। Manohar Publishers। পৃষ্ঠা 304আইএসবিএন 81-7304-195-4 
  2. Phyllis Granoff, "Gaṇeśa as Metaphor," in Robert L. Brown (ed.) Ganesh: Studies of an Asian God, pp. 94-5, note 2. আইএসবিএন ০-৭৯১৪-০৬৫৭-১
  3. R. C. Hazra, "The Gaṇeśa Purāṇa," Journal of the Ganganatha Jha Research Institute (1951);79-99.
  4. Paul B. Courtright, p. 214, Gaṇeśa: Lord of Obstacles, Lord of Beginnings. (Oxford University Press: New York, 1985) আইএসবিএন ০-১৯-৫০৫৭৪২-২
  5. These eight incarnations are discussed by Grimes, who provides condensed versions of the stories of the battles with the demons. John A. Grimes, Ganapati: Song of the Self, pp. 105-110. (State University of New York Press: Albany, 1995) আইএসবিএন ০-৭৯১৪-২৪৪০-৫
  6. These eight incarnations are discussed by Sadguru Sant Keshavadas, who elaborates on the story of Vakratuṇḍa in some detail. cf. pp. 88-90, Sadguru Sant Keshavadas, Lord Ganesha. (Vishwa Dharma Publications: Oakland, 1988).

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]

  • "Mudgala Purana (Online Text)" (Sanskrit ভাষায়)।