মুকের উপজাতি
মুকের হল একটি মুসলিম উপজাতি সম্প্রদায়, যারা উত্তর ভারত ও নেপালে বসবাস করে। তারা মুকেরি, মেকরানি, মাকরানি, বারমাকি, রাঙ্কি ও মুকরি নামেও পরিচিত।[১] ঐতিহাসিকভাবে তারা বানজারা মুসলিম জাতির সাথে সম্পর্কযুক্ত।[২] মুকেরদের অনেক সদস্য ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পাকিস্তানে চলে যায় এবং তারা করাচি এবং সিন্ধুতে বসতি স্থাপন করেছে। ঐতিহাসিকরা বানজারা মুসলিম ও মুকেরদের একই সম্প্রদায়ভুক্ত বলে মতামত দিয়েছেন। তবে মুকেররা অনেক দিন পূর্বেই বানজারাদের থেকে পৃথক হয়ে স্বতন্ত্র জাতিধারা চালু করে।[৩] মুকেরা জাতিগতভাবে প্রধানত ব্যবসায়ী; তবে এখন তাদের অনেকেই কৃষি কাজে যুক্ত আছে।[৩]
মোট জনসংখ্যা | |
---|---|
৩০,০০০+ ( আনুমানিক) | |
উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যার অঞ্চল | |
নেপাল (সারলাহি, বলকাওয়া, লাহান, গোয়াল বাজার, কাটারি বাজার, লাদকানহা, কামাল পুর, দেবীপুর, সিরহা বাজার), ভারত | |
ভাষা | |
উর্দু, আঙ্গিলা, ইংরেজি | |
ধর্ম | |
সুন্নি ইসলাম (১০০%) | |
সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী | |
বানজারা (মুসলিম), বানজারা |
ইতিহাস
[সম্পাদনা]বানজারা একটি যাযাবর সম্প্রদায়। উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের আওধ ও আগ্রায় ( বর্তমান উত্তর প্রদেশ) বসবাসকারী তাদের পাঁচটি প্রধান শ্রেণির মধ্যে দুটি শ্রেণী মুসলমান। একটি হল তুর্কিয়া বানজার অপরটি মুকেরি। মূলত ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বানজারাদের থেকে মুসলিম বানাজারাদের পৃথক পরিচয় প্রদানের লক্ষ্যে তাদের তুর্কিয়া বানাজারা বলা হয়। তুর্কি বানজারারা ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকলে তাদের তাদের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু ছিল মূলত সাহারানপুর জেলা, মোরাদাবাদ, রামপুর, বেরেলি, পিলিভীত ও গোরখপুর জেলা। তবে মুকেররা নেপালে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং ভারতের উত্তর প্রদেশেও তাদের কিছু সদস্য বাস করে।[৪][৫][৬]
একটি ঐতিহ্য অনুসারে, তাদের নাম বান (বন) ও জরা (জ্বলন্ত) শব্দের সমন্বয়ে গঠিত গঠিত। কারণ তারা বন পুড়িয়ে জীবনযাপন করত। অন্য একটি ঐতিহ্য মতে, নামটি সংস্কৃত শব্দ ভ্যানিজিয়া বা বানিয়া-করা থেকে এসেছে, যার অর্থ বণিক। মুসলিম বানজারারা হলো ভারতের বৃহত্তর বানজারা সম্প্রদায়ের ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী সদস্যরা। সম্প্রদায়টি মোট বারোটি গোত্র নিয়ে গঠিত, যাদের মধ্যে বনেল, চারুনা, তিখন্ড, নৌনি, ওমরাহা, কালিসিংহ এবং কাকরি প্রধান। মধ্য প্রদেশে থাকাকালীন তাদের দুটি উপ-বিভাগ ছিল: ল্যান্ডে এবং হুন্ডে। তারা প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ বছর ধরে রাজস্থান থেকে অভিবাসিত হয়েছে বলে জানা যায় এবং তারা এখনো রাজস্থানী ভাষায় কথা বলে। গুজরাত প্রদেশে বানজাররা নিজেদেরকে ছকদা ও ছকোদা বানজারা বলে। ছকদা নামটি ছকদা গারি শব্দ থেকে এসেছে, যা হ্যাকনি গাড়ির গুজরাতি শব্দ। এই সম্প্রদায়টি উত্তর ভারতের বানজারাদের মতো ঐতিহ্যগতভাবে গাড়ি চালকের পাশাপাশি ঘোড়ার রক্ষক হিসাবেও নিযুক্ত ছিল। গুজরাতের বানজারারা দাবি করে যে, তারা মূলত রাজস্থানের জয়সলমের থেকে এসেছে। তারা এখনেো নিজেদের মধ্যে মাড়োয়ারি ভাষায় কথা এবং বহিরাগতদের সাথে গুজরাতিতে।[৫][৬][৭]
বর্তমান বানজারাদের, বার্ড, রাস্তার গায়ক, নর্তক এবং নিম্ন সামাজিক উত্সের মানুষ হিসেবে দেখা গেলেও প্রাক-ঔপনিবেশিক ভারতের তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সম্প্রদায় ছিল। তারা বিভিন্ন পেশা অনুসরণ করত। তবে প্রধানত খাদ্য-শস্যের বাণিজ্য ও খাদ্যপণ্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরবরাহের কাজ করত এবং তখন আধুনিক পরিবহনের সুবিধা ছিল না। ভিন্ন ভিন্ন উৎস, রীতিনীতি, ধর্ম ও বর্ণের মর্যাদাসহ শত শত উপজাতির সমন্বয়ে তারা ছিল ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় বা এক শ্রেণীর মানুষ। ইউরোপীয় পর্যটক এবং জেলা গেজেটার্সের রিপোর্ট অনুসারে, তারা এই জেলার শস্য বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত এবং তাদের অনেকে এখনো তাদের ঐতিহ্যগত পেশার সাথে যুক্ত রয়েছে।[৫]
বর্তমান তারা উত্তর ভারতে প্রধানত গবাদি পশুর ব্যবসা করে। কৃষি মৌসুম শুরুর আগেই তারা তাদের গবাদি পশু বিক্রি করে দেয়। কারণ তারা ভূমিহীন সম্প্রদায় এবং গবাদি পশু বিক্রির উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে। গুজরাতে থাকাকালীন তাদের অনেকে ছোট আকারের কৃষক ছিল। অল্প সংখ্যক মানুষ দুধ বিক্রির সঙ্গেও জড়িত ছিল। তবে বানজারা মুসলিমরা ধর্মের ব্যাপারে খুবই কঠোর হয়। তাদের বর্ণ পরিষদ (বিরদারি পঞ্চায়েত) আছে, যা ব্যভিচার এবং ধর্ষণের মতো ফৌজদারি অপরাধের নিষ্পত্তি করে। বর্ণ পরিষদের প্রধান একজন নায়েক এবং পনের জন সদস্য নিয়ে তা গঠিত হয়। তারা অল ইন্ডিয়া বানজারা মুসলিম ফেডারেশনও স্থাপন করেছে, যা ভারতব্যাপী একটি বর্ণ সমিতি। তাদের সবাই সুন্নি ইসলাম মেনে চলে।[৪]
মুকেররাও অধিকাংশ গবাদিপশুর ব্যবসায় জড়িত। উত্তরপ্রদেশের মুকেররা গবাদিপশুর ব্যবসায় জড়িত থাকার কারণে অনেক সময় গেরুয়া সন্ত্রাসের স্বীকার হয় বলে অভিযোগ করা হয়।[৮]
বর্তমান পরিস্থিতি
[সম্পাদনা]মুকের উপজাতিরা ঐতিহাসিকভাবে যাযাবর বণিক ও পরিবহনকারী বানজারা সম্প্রদায়ের একটি অংশ হিসেবে আজ তারা সেই ঐতিহ্য বজায় রেখেছে।[৭] পূর্বে বানজারা লোকেরা লাভবান হতে পারে এমন যেকোনো পণ্যের ব্যবসা করত। তবে মুকেরীরা কাঠের ব্যবসা ও কাঠ পরিবহনে বিশেষ পারদর্শী ছিল।[৭] এখন তাদের অনেকেই গবাদি পশুর ব্যবসার সাথে সাথে কৃষিকাজ করে। সম্প্রদায়টির সকল সদস্য সুন্নি ইসলামের অনুসারী। তাদের নিজস্ব উপজাতি সমিতি আছে। তার নাম: ইন্টারন্যাশানাল মুকেরী তানজিম (আন্তর্জাতিক মুকেরী তানজিম)। তবে তারা ভূমিহীন হওয়ার কারণে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়। সম্প্রতি একটি রিপোর্ট মতে, মৃত্যুর পর কোনো করবস্থান না পাওয়ার কারণে অনেক বানজারা হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়। [৯]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "Muker (tribe)"। Academic Dictionaries and Encyclopedias (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১৮।
- ↑ Project, Joshua। "Banjara (Muslim traditions) in India"। joshuaproject.net (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১৮।
- ↑ ক খ A Hasan & J C Das pages (edited) : People of India Uttar Pradesh, Volume XLII, P.P. 2/995-999।
- ↑ ক খ "Muslim Banjar's"।
- ↑ ক খ গ "History of Banjara" (পিডিএফ)।
- ↑ ক খ "BANJARA - The Tribe of India"। sites.google.com। ২০২৩-০২-১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১৮।
- ↑ ক খ গ Habib, Irfan (১৯৯০)। "Merchant Communities in Precolonial India"। The Rise of Merchant Empires: Long-Distance Trade in the Early Modern World, 1350-1750। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 371–99। আইএসবিএন 978-0-52145-735-4। ডিওআই:10.1017/CBO9780511563089।
- ↑ "ভারতে 'ধর্মীয় ঘৃণা' নিয়ে সাবেক শীর্ষ আমলাদের উদ্বেগ"। বিবিসি বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১৮।
- ↑ "No land to bury dead, 18 Muslim Banjaras from Uttar Pradesh 'reconvert' to Hinduism"। The Times of India। ২০২১-০৮-১৩। আইএসএসএন 0971-8257। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১৮।