মাহলাবিয়া
প্রকার | পুডিং |
---|---|
উৎপত্তিস্থল | ইরান (প্রাচীন পারস্য) |
অঞ্চল বা রাজ্য | মধ্যপ্রাচ্য |
সংশ্লিষ্ট জাতীয় রন্ধনশৈলী | ইরানি রন্ধনশৈলী, ঐতিহাসিক পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় রন্ধনশৈলী |
পরিবেশন | শীতল অবস্থায় |
প্রধান উপকরণ | চালের গুড়া, দুধ অথবা বাদাম দুধ, চিনি |
মাহলাবিয়া বা মহলাবিয়া (ফার্সি: مهلبی، محالبی, আরবি: مهلبية, ফরাসি: mouhallabié) হলো মধ্যপ্রাচ্যের একটি জনপ্রিয় মিষ্টান্ন। পুডিং-জাতীয় এই মিষ্টান্নটি সাধারণত চাল, চিনি, দুধ এবং চালের গুড়া অথবা স্টার্চ বা সুজি দিয়ে তৈরি করা হয়।[১] তুরস্ক ও ইরাকে এটি “মুহাল্লাবি” নামে জনপ্রিয় হলেও পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে (সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান ও ফিলিস্তিন) একে “মাহালাবিয়াহ” বা “মাহালাবিয়া” নামে ডাকা হয়।
ইতিহাস
[সম্পাদনা]কিংবদন্তি অনুযায়ী সাসানীয় সাম্রাজ্যের সময়ে (২২৪–৬৫১) আরব সেনাপতি আল মুহাল্লাব ইবনে আবু সুফরার অধীনে নিযুক্ত পারস্য বাবুর্চির হাত ধরে আরব রন্ধনশৈলীতে “মুহাল্লাবি”-এর (আরবি: مهلبية) পরিচয় ঘটে।[২] আরব সেনাপতি আল মুহাল্লাব মিষ্টান্নটি এটি পছন্দ করেন যে, নিজের নামে এর নামকরণ করেন “মুহাল্লাবিয়া”। এখন পর্যন্ত সন্ধান পাওয়া সবচেয়ে পুরনো, দশম শতাব্দীর রন্ধনপ্রণালীর তিনটি প্রকরণ বিদ্যমান: চালের গুড়া মিশিয়ে ঘন করা দুধ দিয়ে, চালের গুড়া ও মুরগির মাংসের সাথে দুধ এবং চালের গুড়া ছাড়া ডিম দিয়ে তৈরি করার প্রণালী।[২] মাহলাবিয়ার পুরনো রন্ধনপ্রণালীগুলোর একটি পাওয়া যায় বাগদাদের ইবনে সাইয়ার আল ওয়ারাকের থেকে[৩] এবং বাকি দুইটি পাওয়া যায় ত্রয়োদশ শতকের দুইটি আরব রান্নার বই থেকে। বই দুইটির একটি আল-বাগদাদি এবং অপর একটি আল আন্দালুসের রচনা করা। শেষোক্ত বইটিতে মুরগির মাংসের স্থলে ছাগলের মাংস দিয়েও মাহলাবিয়া রান্না করার একটি প্রক্রিয়া উল্লেখ করা ছিল। আল আন্দালুসের বইটি থেকেই মাহলাবিয়ার সম্ভাব্য পারস্য উৎস সম্পর্কে কিংবদন্তি ছড়িয়ে পড়ে।[২][৩]
মধ্যযুগে মাহলাবিয়া ও এর ইউরোপীয় প্রতিরূপ ব্লেমাঞ্জ ছেঁড়া মুরগির মাংস দিয়ে তৈরি করা হতো। উসমানীয় সাম্রাজ্যের সময়ে মাহলাবিয়ার মাহলাবিয়ার দুইটি প্রকরণ সম্পর্কে জানা যায়। একটিতে ছেঁড়া মুরগির মাংস ব্যবহার করে তৈরি করা হয় (টাভুকজ্যাসি)। এটি সম্রাট মুহাম্মাদ ফাতিহের সময়ে পরিবেশন করা হয়। পরবর্তীতে ১৫৩০ সালে আরেক ধরনের প্রণালীর সন্ধান পাওয়া যায়, যাতে কোনো মাংস ছাড়া রান্নার পর সুগন্ধি হিসেবে গোলাপ জল ব্যবহার করা হয়।[২]
১৯শ শতাব্দীর একটি রান্নার বইয়ে মাহলাবিয়ার একটি প্রণালী পাওয়া যায়। বইটিকে খাবারের পদটিকে “রমজানের কেক” নামে নামকৃত করা হয়। প্রণালীতে ঘন হওয়ার আগ পর্যন্ত চালের গুড়া ও চিনি দিয়ে দুধ জ্বাল দিতে হয়। এতে সুগন্ধি হিসেবে গোলাপ ও জুঁই ফুলের সুগন্ধি এবং ঠান্ডা হওয়ার পর গুড়া চিনি ছিটিয়ে দেওয়া হয়।[২]
প্রকরণ
[সম্পাদনা]বর্তমানে তুরস্ক ছাড়া ঐতিহ্যবাহী টাভুকজ্যাসি আর কোথাও তেমন একটা পাওয়া যায় না। এই মিষ্টান্নটি খেতে মুরগির মাংসের স্বাদ না লাগলেও, এতে মাংসের ব্যবহার এক অনন্য স্বাদ-গন্ধ প্রদান করে। জর্জ কোলম্যান ডি কায় বলেন, “মুরগির মাংসের উপস্থিতিতেই খাবারটি তার অদ্ভুত অসাধারণ স্বাদ-গন্ধ পায়, কিন্তু তা মিষ্টান্নের সাথে এমন সুন্দরভাবে, অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশ্রিত থাকে যে মাংসকে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় না।”[২][৪] কাজানডিবি হলো ঐতিহ্যবাহী টাভুকজ্যাসি-এর একটি সংস্করণ। এতে মিষ্টির নিচে একটি পাতলা স্তরকে ক্যারামেলে পরিণত করা হয় এবং এই ক্যারামেলের স্তরটি উপরে দিয়ে পরিবেশন করা হয়।[২] এছাড়াও ইস্তাম্বুলের মুহাল্লেবিজি দোকানে পাওয়া যায় বাদামযুক্ত কেশকুল, আশুরে এবং সিদ্ধ চালের পুডিং ফিরিন সুতলাজ বা ফিরিনডা সুতলাজ।[৫]
সিরিয়াতেও মাহলাবিয়ার বিভিন্ন প্রকারের প্রস্তুতপ্রণালী দেখা যায়। বালুজা (بالوظة) নামে পরিচিত একটি মিষ্টান্নে চিরাচরিত মাহলাবিয়ার উপরে কমলার জেলি দিয়ে পরিবেশন করা হয়। তবে অনেক সময় কমলার জেলির স্থলে গোলাপের সিরাপও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। সিরিয়ার দোকানে বিক্রি করা মাহালাইয়েহ-তে প্রায়শই তিনস্তরে কাটা কাঠবাদাম, চেরা পেস্তাবাদাম ও মারাস্কিনো চেরি ব্যবহার করা হয়। দামেস্কের বিখ্যাত বুজা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বাকদাশ বুজা নামক মিষ্টান্নের পাশাপাশি মাহলাবিয়াও বিক্রি করে।
ইসরায়েলে পরিবেশনকৃত মালাবি-তে (מלבי) সাধারণ দুধের বদলে অনেক সময় বাদামের দুধ ব্যবহার করা হয়, যাতে ইহুদিদের খাদ্যাভ্যাসের রীতি কাশরুত ভঙ্গ না হয়।
সাইপ্রাসে দুধ ছাড়া মাহলাবিয়ার একটি প্রণালীর (সাইপ্রাসীয় গ্রিক ভাষায় μαχαλλεπί, আ-ধ্ব-ব: [maxalːe'pi]) পাশাপাশি দুধসহ আরেকটি প্রণালী (μαχαλλεπίν του γαλάτου; আ-ধ্ব-ব: [maxalːe'pin du ɣa'latu]) দেখা যায়। সাইপ্রাসের দুধ ছাড়া মাহলাবিয়াতে পানি, চিনি ও কর্নস্টার্চ ব্যবহার করা হয়। কেউ কেউ এতে পছন্দমতো গোলাপ জল ব্যবহার করেন। মাহলাবিয়া জমে যাওয়ার পর তারা এর উপরে “ট্রিয়ান্টাফিলো” (τριαντάφυλλο) নামের গোলাপের স্কোয়াশ/কর্ডিয়াল/সিরাপ ব্যবহার করেন।
মাহলাবিয়ায় বিশেষ স্বাদ-গন্ধ যুক্ত করার জন্য মাস্টিক নামের বিশেষ ধরনের রজনও ব্যবহার করা হতে পারে।[৬]
পরিবেশনগত ঐতিহ্য
[সম্পাদনা]কিছু কিছু সেফার্ডীয় ইহুদি পরিবারে ইয়োম কিপুরের দিনে উপবাস ভঙ্গে দুধ, ক্রিম, স্টার্চ, চিনি ও পাতিত গোলাপ জল বা কমলা ফুলের জল দিয়ে তৈরি মালাবি পরিবেশন করা হয়। তুর্কি ইহুদিদের বিবাহ অনুষ্ঠানে সামনের দিনে মিষ্টি সময়ের প্রত্যাশায় এটি পরিবেশন করা হয়। সেফার্ডীয়রা শাভুতের দিনেও এটি পরিবেশন করে। এই দিনে দুগ্ধজাত খাদ্যসামগ্রী ভক্ষণের প্রথা প্রচলিত রয়েছে। তবে খাদ্যবিষয়ক ঐতিহাসিক গিল মার্কসের মতে এই উৎসবটি সম্প্রদায়ের মাঝে “গোলাপের ভোজনোৎসব” বলে পরিচিত এবং তাদের পরিবেশন করা মালাবিতে গোলাপের অনন্য সুবাসের কারণে এটি এই উৎসবের অংশ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।[৭]
নৈশকালীন মিষ্টান্ন হিসেবে ব্যবহার
[সম্পাদনা]মাহলাবিয়া বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্যবাহী নৈশকালীন মিষ্টান্ন বা ডেজার্টের উপাদান হিসেবে জনপ্রিয়।
ঐতিহাসিক সালোনিকা অঞ্চলের রন্ধনশৈলীর অনুসরণে সেলানিক টাটলিসি নামক মিষ্টান্নটি বেঁচে যাওয়া মাহলাবিয়াকে ডিমের সাথে জ্বাল দিয়ে এবং মিষ্টি পেস্ট্রির খামির দিয়ে বেক করে বানানো হয়। পরিবেশনের পূর্বে একে সাধারণ চিনির সিরাপে ডুবিয়ে রাখা হয়।[৮] এছাড়াও মুহাল্লাবি বাক্লাভা নামের মিষ্টিটিও ঐতিহাসিক সালোনিকা অঞ্চল থেকে আগত। এই পদটি গ্রিক পদ গালাক্টোবুরেকো-এর অনুরূপ।[৯]
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "İrmikli muhallebi tarifi"। হুররিয়েত (তুর্কি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ৭ সেপ্টেম্বর ২০২১।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ ইসিন, ম্যারি (৮ জানুয়ারি ২০১৩)। শরবত অ্যান্ড স্পাইস: দ্য কমপ্লিট স্টোরি অব টার্কিশ সুইটস অ্যান্ড ডেজার্টস (ইংরেজি ভাষায়)। আইবি টাউরিস। আইএসবিএন 978-1-84885-898-5। ১৯ জুলাই ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জুন ২০১৮।
- ↑ ক খ ইসিন, প্রিসিলা ম্যারি (২৩ জুলাই ২০১৫)। "Blancmange"। দি অক্সফোর্ড কম্পানিয়ন টু শ্যুগার অ্যান্ড সুইটস। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। আইএসবিএন 978-0-19-931339-6। সংগ্রহের তারিখ ১৯ জুলাই ২০১৮।
- ↑ সিডনি মিন্টজ (২০১৫)। দি অক্সফোর্ড কমপ্যানিয়ন টু শুগার অ্যান্ড সুইটস (ইংরেজি ভাষায়)। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস। পৃষ্ঠা ৭৪৬। আইএসবিএন 978-0-19-931339-6।
- ↑ লেজমি, ইসাবেল; রিয়েনারম্যান, লিসা; হেলভাসিয়োগলু, ভেরোনিকা (৫ ডিসেম্বর ২০১৭)। ইয়েমেক: রেসিপিজ ফ্রম ইস্তানবুল। আইএসবিএন 9781681883359। সংগ্রহের তারিখ ৮ সেপ্টেম্বর ২০২১।
- ↑ দ্য নিউইয়র্ক টাইমস। Turkish Burned Milk Pudding (ইংরেজি ভাষায়)। ২৬ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ জুলাই ২০১৮।
- ↑ "Malabi"। মাই জিউইশ লার্নিং (ইংরেজি ভাষায়)। ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮।
- ↑ "Selanik Tatlısı Tarifi"। র্যাডিক্যাল (ইংরেজি ভাষায়)।
- ↑ এডেন, এসিন; স্টাভরুলাকিস, নিকোলাস (১৯৯৭)। সালোনিকা: অ্যা ফ্যামিলি কুকবুক (ইংরেজি ভাষায়)। টালোস প্রেস। আইএসবিএন 9789607459053।