মামলুক সালতানাত (দিল্লি)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
মামলুক সালতানাত

১২০৬–১২৯০
দিল্লির মামলুক সালতানাতের শাসন অঞ্চল[১]
দিল্লির মামলুক সালতানাতের শাসন অঞ্চল[১]
রাজধানী
[২]
প্রচলিত ভাষাফারসি (সরকারি)[৩]
ধর্ম
সুন্নি ইসলাম
সরকারসালতানাত
সুলতান 
• ১২০৬–১২১০
কুতুবুদ্দিন আইবেক
• ১২৮৭–১২৯০
মুইজউদ্দিন কায়কোবাদ
ইতিহাস 
• প্রতিষ্ঠা
১২০৬
• বিলুপ্ত
১২৯০
পূর্বসূরী
উত্তরসূরী
চৌহান
তোমর রাজবংশ
ঘুরি সালতানাত
সেন সাম্রাজ্য
খিলজি রাজবংশ

মামলুক সালতানাত ১২০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। মধ্য এশিয়ার তুর্কি সেনাপতি কুতুবুদ্দিন আইবেক মামলুকদের উত্তর ভারতে নিয়ে আসেন। দিল্লি সালতানাত শাসনকারী পাঁচটি রাজবংশের মধ্যে মামলুক রাজবংশ প্রথম।[৪][৫][৬] এর শাসনকাল ছিল ১২০৬ থেকে ১২৯০ সাল পর্যন্ত। ঘুরি রাজবংশের প্রতিনিধি শাসক হিসেবে কুতুবুদ্দিন আইবেক ১১৯২ থেকে ১২০৬ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। এসময় তিনি গাঙ্গেয় অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করেন এবং নতুন অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

মামলুক দ্বারা অধিকৃত বোঝানো হয়। মামলুকরা ছিল ইসলাম গ্রহণকারী দাস বংশোদ্ভূত সৈনিক। ৯ম শতাব্দী থেকে এই ধারা শুরু হয়ে মামলুকরা ধীরে ধীরে শক্তিশালী সামরিক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। বিশেষত মিশর এবং এর পাশাপাশি লেভান্ট, ইরাকভারতে মামলুকরা রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ছিল।

১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মদ ঘুরি নিহত হন।[৭] তার কোনো সন্তান না থাকায় তার সাম্রাজ্য বিভিন্ন সালতানাতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তার প্রাক্তন মামলুক সেনাপতিরা এসব সালতানাতের নেতৃত্ব লাভ করেন। তাজউদ্দিন ইলদিজ, ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি, নাসিরউদ্দিন কাবাচাকুতুবউদ্দিন আইবেক যথাক্রমে গজনি, বাংলা, মুলতানদিল্লির শাসক হন। এর মাধ্যমে মামলুকদের শাসন শুরু হয়।

তার উচ্চপদস্থ মুইজউদ্দিন মুহাম্মদ নিহত হওয়ার পর আইবেক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন।[৪] আইবেকের শাসন স্বল্পস্থায়ী ছিল। ১২১০ সালে তিনি মারা যান। তার ছেলে আরাম শাহ ক্ষমতা লাভ করেন। ১২১১ সালে তিনি ইলতুতমিশের হাতে নিহত হন।

ইলতুতমিশ তার সালতানাতের সাথে আব্বাসীয় খিলাফতের ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি চেঙ্গিস খান ও তার বংশধরদের আক্রমণ থেকে ভারতকে রক্ষা করতে সফল হয়েছিলেন।[৫] গিয়াসউদ্দিন বলবন চাগতাই খানাত ও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহীদের থেকে সালতানাতকে সুরক্ষিত করতে সফল হন।[৪][৫] জালালউদ্দিন ফিরোজ খিলজি কর্তৃক সর্বশেষ মামলুক শাসক ও বলবনের নাতি মুইজউদিন কায়কোবাদ ক্ষমতাচ্যুত হলে খিলজি রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়।[৮]

সুলতানগণ[সম্পাদনা]

নাম অলংকারিক উপাধি শাসনকাল টীকা
কুতুবউদ্দিন আইবেক
قطب الدین ایبک
সুলতান ১২০৬ - ১২১০ কুতুবউদ্দিন আইবেক মুলতানের নাসিরউদ্দিন কুবাচা এবং গজনির তাজউদ্দিন ইলদুজের বিদ্রোহ দমন করেন। তিনি লাহোরকে তার রাজধানী করেছিলেন। উত্তর ভারতে তিনি তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করেন। দিল্লির প্রাচীন মুসলিম স্মৃতিস্থাপনাগুলোর নির্মাণ তিনি শুরু করেন। এর মধ্যে রয়েছে কুয়াত-উল-ইসলাম মসজিদকুতুব মিনার। ১২১০ সালে তিনি পোলো খেলার সময় ঘোড়া থেকে পড়ে মারা যান। লাহোরের আনারকলি বাজারের কাছে তাকে দাফন করা হয়।
আরাম শাহ
آرام شاہ
সুলতান ১২১০ - ১২১১ চিহালগনি নামে পরিচিত ৪০ জন অভিজাত ব্যক্তির একটি দল আরামশাহর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে এবং তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বাদাউনের গভর্নর শামসউদ্দিন ইলতুতমিশকে আমন্ত্রণ জানায়। ১২১১ সালে ইলতুতমিশ আরামশাহকে দিল্লির নিকটে জুদের সমতল ভূমিতে পরাজিত করেন। আরাম শাহর পরবর্তীকালে কী হয়েছিল তা স্পষ্ট নয়।
শামসউদ্দিন ইলতুতমিশ
شمس الدین التتمش
নাসির আমিরুল মুমিনিন
ناصرامیر المؤمنین
১২১১-১২৩৬ ইলতুতমিশ লাহোর থেকে দিল্লিতে রাজধানী সরিয়ে আনেন। তিনি মুলতানের নাসিরউদ্দিন কাবাচা ও গজনির তাজউদ্দিন ইলদুজকে পরাজিত করে। এই দুজন দিল্লির প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। তার শাসনামলে মঙ্গোলরা জালালউদ্দিন খোয়ারিজম খোজে ভারত আক্রমণ করে। ১২২১ সালে সিন্ধুর যুদ্ধে চেঙ্গিস খান তাকে পরাজিত করেছিলেন। চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর পর ইলতুতমিশ হারানো এলাকা পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে উত্তর ভারতে তার নিয়ন্ত্রণ মজবুত করেন। ১২৩০ সালে তিনি মেহরাউলিতে হাউজ-ই-শামসি নামক জলাধার নির্মাণ করেন। ১২৩১ সালে তিনি দিল্লিতে প্রথম মুসলিম সমাধি সুলতান গারি নির্মাণ করেন।
রুকনউদ্দিন ফিরোজ
رکن الدین فیروز
সুলতান ১২৩৬ (এপ্রিল - নভেম্বর) রুকনউদ্দিন ফিরোজ মাত্র সাত মাস শাসন করেন। তার মা শাহ তুরকান প্রকৃতপক্ষে সরকার পরিচালনা করছিলেন। তার ব্যক্তিগত ভোগবিলাসের কারণে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠায় তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করেন। ১২৩৬ সালের ৯ নভেম্বর রুকনউদ্দিন ফিরোজ ও তার মা শাহ তুরকান উভয়ে চিহালগনিদের হাতে নিহত হন।
রাজিয়া সুলতানা
رضیہ الدین
জালালাতউদ্দিন রাজিয়া সুলতানা
جلالۃ الدین رضیہ سلطانہ
১২৩৬ - ১২৪০ রাজিয়া সুলতানা ছিলেন ভারতের প্রথম মুসলিম নারী শাসক। তিনি অভিজাত ব্যক্তিদের সাথে সমঝোতায় আসতে সক্ষম হন এবং সালতানাত পরিচালনায় সফল ছিলেন।আফ্রিকান বংশোদ্ভূত জামালউদ্দিন ইয়াকুতের সাথে তার সহযোগিতার কারণে মধ্য এশিয়ার তুর্কীয় বংশোদ্ভূত অভিজাতরা তার বিরূপ হয়ে পড়ে। এছাড়া নারী সম্রাজ্ঞীর শাসনকে তারা নেতিবাচক হিসেবে দেখতেন। ক্ষমতাশালী অভিজাত মালিক আলতুনিয়া তাকে পরাজিত করেছিলেন। রাজিয়া সুলতানা তাকে বিয়ে করতে সম্মত হয়েছিলেন। রাজিয়ার ভাই মুইজউদ্দিন বাহরাম চিহালগনিদের সহায়তায় সিংহাসন দখল করেন এবং রাজিয়া ও তার স্বামীর সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেন। পরাজিত হয়ে তারা কাইথাল পালিয়ে যান। তাদের সাথে থাকা অবশিষ্ট সৈনিকরা এরপর তাদের ত্যাগ করে। তারা দুজনেই জাটদের হাতে ধৃত হন। ১২৪০ সালের ১৪ অক্টোবর তাদের হত্যা করা হয়।
মুইজউদ্দিন বাহরাম
معز الدین بہرام
সুলতান ১২৪০ - ১২৪২ মুইজ বাহরামের শাসনামলে চিহালগনিরা বিশৃঙ্খল হয়ে পরে এবং একে অন্যের বিরুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই বিশৃঙ্খল অবস্থায় মঙ্গোলরা পাঞ্জাব আক্রমণ করে ও লাহোর ধ্বংস করে। দুর্বল মুইজউদ্দিন বাহরাম তাদের প্রতিহত করতে ব্যর্থ হন। চিহালগনিরা তাকে দিল্লিতে অবরুদ্ধ করে। ১২৪২ সালে তাকে হত্যা করা হয়।.
আলাউদ্দিন মাসুদ
علاءالدین مسعود
সুলতান ১২৪২ - ১২৪৬ আলাউদ্দিন মাসুদ চিহালগনিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিলেন। সরকারের উপর তার তেমন প্রভাব ছিল না। বিনোদন ও মদ্যপানের কারণে তিনি অজনপ্রিয় হয়ে পড়েন। ১২৪৬ সাল নাগাদ প্রধান ব্যক্তিরা তার অতিরিক্ত ক্ষমতালিপ্সার কারণে ক্ষিপ্ত হন এবং ইলতুতমিশের আরেক ছেলে নাসিরউদ্দিন মাহমুদকে ক্ষমতায় বসান।
নাসিরউদ্দিন মাহমুদ
نصیر الدین محمود
নাসিরউদ্দিন ফিরোজ শাহ
نصیر الدین فیروز شاہ
১২৪৬ - ১২৬৬ নাসিরউদ্দিন মাহমুদ ধার্মিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অধিকাংশ সময় তিনি নামাজ এবং দরিদ্র ও অসহায়দের সহায়তা করতেন। তার অধীনস্থ গিয়াসউদ্দিন বলবন রাষ্ট্রীয় বিষয় দেখাশোনা করতেন।
গিয়াসউদ্দিন বলবন
غیاث الدین بلبن
সুলতান ১২৬৬ - ১২৮৭ গিয়াসউদ্দিন বলবন কঠোর হস্তে শাসন পরিচালনা করেন। তিনি চিহালগনিদের প্রভাব খর্ব করেন। ভারতে তিনি শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ইচ্ছুক ছিলেন। বিশৃঙ্খল অঞ্চলগুলোতে তিনি অনেক চৌকি নির্মাণ ও সেনা মোতায়েন করেন। আনুগত্য নিশ্চিত করার জন্য তিনি সফল গোয়েন্দা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন।
মুইজউদ্দিন কায়কোবাদ
معز الدین قیق آباد
সুলতান ১২৮৭ - ১২৯০ মুইজউদ্দিন কায়কোবাদ অল্পবয়সে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। রাষ্ট্রীয় বিষয়ে তার তেমন মনোযোগ ছিল না। চার বছর পর তিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। ১২৯০ সালে এক খিলজি নেতার হাতে তিনি মারা যান। তার তিন বছর বয়সী ছেলে কায়ুমারস তার নামমাত্র উত্তরসুরি হয় তবে খিলজিদের উত্থানের সাথে সাথে মামলুকদের শাসনের সমাপ্তি ঘটে।

স্থাপত্য[সম্পাদনা]

মামলুক রাজবংশের স্থাপত্য নিদর্শন কুতুব মিনার

রাজবংশের স্থাপত্য উত্তরাধিকারের মধ্যে রয়েছে মেহরাউলির কুতব উদ-দিন আইবাকের কুতুব মিনার, ইলতুমিশ-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রিন্স নাসিরু'দ-দিন মাহমুদের সমাধিসৌধ, বসন্ত কুঞ্জের কাছে সুলতান ঘারি নামে পরিচিত, ১২৩১ সালে নির্মিত প্রথম ইসলামিক সমাধিসৌধ (সমাধি) এবং মেহরাউলি প্রত্নতাত্ত্বিক উদ্যানে বলবানের সমাধি।

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Schwartzberg, Joseph E. (১৯৭৮)। A Historical atlas of South Asia। Chicago: University of Chicago Press। পৃষ্ঠা 147, map XIV.3 (h)। আইএসবিএন 0226742210 
  2. Vincent A Smith, গুগল বইয়ে The Oxford History of India: From the Earliest Times to the End of 1911, Chapter 2, Oxford University Press
  3. "Arabic and Persian Epigraphical Studies - Archaeological Survey of India"। Asi.nic.in। ২০১১-০৯-২৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-১১-১৪ 
  4. Walsh, J. E. (২০০৬)। A Brief History of India। Facts on File। পৃষ্ঠা ৬৮–৭০। আইএসবিএন 0-8160-5658-7 
  5. Anzalone, Christopher (২০০৮)। "Delhi Sultanate"। Ackermann, M. E.। Encyclopedia of World History2। Facts on File। পৃষ্ঠা ১০০–১০১। আইএসবিএন 978-0-8160-6386-4 
  6. Sen, Sailendra (২০১৩)। A Textbook of Medieval Indian History। Primus Books। পৃষ্ঠা ৭২–৮০। আইএসবিএন 978-9-38060-734-4 
  7. Nafziger, George F. (২০০৩)। Islam at war : a history। Westport, Conn. : Praeger। পৃষ্ঠা ৫৬আইএসবিএন 978-0-275-98101-3 
  8. Anzalone, p. 101

উৎস[সম্পাদনা]

  • Anzalone, Christopher (২০০৮)। "Delhi Sultanate"। Ackermann, M. E. etc। Encyclopedia of World History2। Facts on File। পৃষ্ঠা 100–101। আইএসবিএন 978-0-8160-6386-4 
  • Walsh, J. E. (২০০৬)। A Brief History of Indiaবিনামূল্যে নিবন্ধন প্রয়োজন। Facts on File। আইএসবিএন 0-8160-5658-7 

আরও পড়ুন[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]