মসজিদে লাউডস্পিকার ব্যবহার
লাউডস্পিকার ২০শ শতকের গোড়ার দিকে উদ্ভাবিত হলেও, ১৯৩০-এর দশকে তা মসজিদে ব্যবহার শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে এগুলো আযান[১] দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো। মুয়াজ্জিনরা আযানের সময় তাদের কণ্ঠস্বর দূরত্বে পৌঁছাতে লাউডস্পিকারের সাহায্য নিতে শুরু করেন[২][৩]। ১৯৩৬ সালে সিঙ্গাপুরের সুলতান মসজিদে প্রথম মাইক্রোফোন-লাউডস্পিকার সংযোগ স্থাপন করা হয়, যা প্রমাণ করে যে এই প্রযুক্তি শহুরে মসজিদগুলোতে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।[৪]
তখনকার সময়ে কিছু মানুষ এই প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। তারা ভাবতেন, এটি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে আধুনিকতার অনুপ্রবেশ। তবে শহরের কোলাহল ও ব্যস্ত জীবনের মাঝে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠস্বর যেন শ্রোতার কাছে পৌঁছায়, সেই প্রয়োজন থেকেই অধিকাংশ মসজিদ কর্তৃপক্ষ এটি গ্রহণ করে।
ব্যবহার
[সম্পাদনা]মসজিদে লাউডস্পিকার মূলত আযান সম্প্রচারের জন্য ব্যবহৃত হয়। সাধারণত দিনে পাঁচবার আযান দেওয়ার সময় মিনারে স্থাপিত বাইরের লাউডস্পিকার চালু করা হয়। অনেক দেশে মসজিদের ভিতরে খুতবা বা জামাআতের নামাজের সময় ইমামের বক্তব্য শ্রোতাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য অভ্যন্তরীণ লাউডস্পিকার ব্যবহৃত হয়।
তুরস্ক, মরক্কো ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশে বৈদ্যুতিকভাবে বর্ধিত আযান এখন খুব সাধারণ একটি প্রথা। অন্যদিকে নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলোতে শুধুমাত্র ৭–৮ শতাংশ মসজিদে আযানের জন্য লাউডস্পিকার ব্যবহার করা হয়। কিছু দেশে যেমন তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাত, লাউডস্পিকার নাগরিক সতর্কতা সিস্টেম হিসেবেও কাজ করে, যা দুর্যোগ বা জরুরি অবস্থার সময় সতর্কতামূলক সংকেত হিসেবে ব্যবহৃত হয়।[৫][৬]
শব্দ দূষণ ও বিধিনিষেধ
[সম্পাদনা]লাউডস্পিকারের ব্যাপক ব্যবহার শব্দ দূষণের আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। ২০২১ সালের মে মাসে সৌদি আরবের ইসলামিক বিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি নির্দেশনা জারি করে, যেখানে বলা হয়, মসজিদের লাউডস্পিকারের শব্দমাত্রা সর্বোচ্চ এক-তৃতীয়াংশে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে[৭]। একই নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়, লাউডস্পিকার কেবলমাত্র আযানের সময় ব্যবহৃত হতে পারবে।
বিশেষ করে এমন এলাকায় যেখানে একাধিক মসজিদ ঘনভাবে অবস্থান করছে, সেখানকার আযান একযোগে প্রচারিত হলে শব্দের অভিঘাত একটির ওপর আরেকটি পড়ে, যা স্থানীয়দের জন্য বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে মালয়েশিয়ায় একটি রাজকীয় আদেশে নির্দিষ্ট করা হয় যে আযান ছাড়া অন্য কোনো ধর্মীয় কর্মকাণ্ড (যেমন: কুরআন তেলাওয়াত, খুতবা, প্রার্থনা) বাহ্যিক লাউডস্পিকারে সম্প্রচার করা যাবে না। এসব শুধুমাত্র মসজিদের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ
[সম্পাদনা]মসজিদে লাউডস্পিকারের ব্যবহার নিয়ে বৈশ্বিকভাবে নানা দেশে ভিন্নমুখী নীতিমালা প্রচলিত রয়েছে:
ইউরোপ: কানাডা, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রিয়া, নরওয়ে এবং বেলজিয়াম-এর মতো দেশগুলোতে আযান সম্প্রচারে আইনগতভাবে বিভিন্ন মাত্রায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
নিউজিল্যান্ড: এখানে কোনও নির্দিষ্ট ধর্মীয় বিধিনিষেধ নেই, তবে সাধারণ শব্দ নিয়ন্ত্রণ আইন অনুসরণ করতে হয়। ওয়েলিংটন শহর একটি মসজিদকে বিশেষ ছাড় দেওয়ার কথা বিবেচনা করছে।
নাইজেরিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: লাগোস শহর ও মিশিগান অঙ্গরাজ্যের কিছু সম্প্রদায় স্থানীয়ভাবে মসজিদে বাহ্যিক লাউডস্পিকারের ব্যবহার সীমিত বা নিষিদ্ধ করেছে। হ্যামট্রামক শহরের আল-ইসলাহ মসজিদ ২০০৪ সালে আযান সম্প্রচারের অনুমতি চাইলে তা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
বিরোধিতা
[সম্পাদনা]কোলোন শহরে কোলোন কেন্দ্রীয় মসজিদ নির্মাণের সময় স্থানীয় জনগণের তীব্র আপত্তির মুখে পড়তে হয়। তাদের মূল আপত্তির একটি ছিল, মসজিদ থেকে বাহ্যিকভাবে আযান সম্প্রচার। পরে এই আযান নিষিদ্ধ রাখার শর্তে নির্মাণ অনুমোদন দেওয়া হয়।
ভারতে শব্দ দূষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত সংগঠন ও ব্যক্তিরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও শব্দের মাত্রা সীমিত রাখার দাবি করেছেন। ১৯৯৯ সালে মহারাষ্ট্র রাজ্যের নন্দুরবার এলাকায় মসজিদে আযান সম্প্রচারের পর দাঙ্গা শুরু হয় বলে অভিযোগ ওঠে।
ইন্দোনেশিয়া সরকার বিভিন্ন সময়ে নির্দেশনা জারি করে যাতে মসজিদে লাউডস্পিকারের শব্দ সীমিত থাকে। ২০১৮ সালে এক নারী আযানের শব্দ নিয়ে অভিযোগ করলে তাকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ১৮ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই ঘটনার পরে সরকার ২০২২ সালে নতুন একটি নির্দেশনায় আযানের শব্দমাত্রা ১০০ ডেসিবেলের মধ্যে রাখার আদেশ দেয় এবং খুতবার সময়সীমা ১৫ মিনিট থেকে কমিয়ে ১০ মিনিট করা হয়।
২০২০ সালে লন্ডনের ওয়ালথাম ফরেস্ট ও নিউহ্যাম কাউন্সিল রমজান মাসে সীমিত সময়ের জন্য বাহ্যিকভাবে আযান সম্প্রচারের অনুমতি দেয়। তবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে স্থানীয় জনগণের একাংশ আপত্তি জানায় এবং সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলকে চিঠি লেখে। হ্যারো কাউন্সিল ও মেইডেনহেড-এও একই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
২০০৪ সালে মিশিগানের হ্যামট্রামক শহরে আল-ইসলাহ মসজিদ আযান সম্প্রচারের অনুমতি চাইলে তা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। বিরোধীরা উল্লেখ করেন, লাউডস্পিকারে আযান সম্প্রচারে ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকলেও শব্দদূষণের বিষয়ে সবার প্রতি সম্মান দেখানো উচিত।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "Adhan And Iqamat (Iqamah)"। Hizmetbooks.org। ২০১১-০৭-১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০১-১৫।
- ↑ Riyadh (Afp) (২০০৯-০৪-২৫)। "Variety News | Saudi cracks down on blaring mosque speakers"। Alarabiya.net। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০১-১৫।
- ↑ "'Installing loudspeakers inside mosques not fundamental right': Allahabad HC"। Zee Media Corporation। ৫ মে ২০২২। সংগ্রহের তারিখ ১৮ মে ২০২২।
- ↑ Winters, Bryan (২০১৫)। The Bishop, the Mullah, and the Smartphone: The Journey of Two Religions into the Digital Age। Eugene, Oregon: Wipf and Stock Publishers। পৃষ্ঠা 318। আইএসবিএন 9781498217934। সংগ্রহের তারিখ ১২ অক্টোবর ২০১৯।
- ↑ "New announcement system to be used in earthquake drill"। Hurriyet Daily News। ৯ নভেম্বর ২০২২।
- ↑ "National early warning system"। National Emergency Crisis and Disaster Management Authority (NCEMA)। সংগ্রহের তারিখ ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩।
- ↑ "Saudi Arabia: Authorities defend mosque speaker restriction"। BBC News। ১ জুন ২০২১। সংগ্রহের তারিখ ১ জুন ২০২১।