মরিশাসে ইসলাম
ইসলাম মরিশাসের তৃতীয় বৃহত্তম ধর্ম। একটি রিপোর্ট অনুযায়ী মরিশাসের জনসংখ্যার ১৮.২৪ শতাংশেরও বেশি ইসলাম ধর্মের অনুসারী। [১][২] অনেক মরিশাসী মুসলিম ভারতীয় বংশোদ্ভূত, যারা উপনিবেশিক ব্রিটিশ আমলে ভারত থেকে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক হিসেবে এখানে আসেন। তাদের অভিবাসন ১৮৩৪ সালে শুরু হয়েছিল এবং ১৯ শতক ও ২০ শতকের গোড়ার দিকে অব্যাহত ছিল। [৩]:১২৩–১২৪ ১৯৬৮ সালে মরিশাস স্বাধীনতা লাভ করে এবং সংবিধানে কোনো সরকারী ধর্ম সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। [৪] দেশটির জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক হিন্দু; প্রায় এক তৃতীয়াংশ খ্রিস্টান ও বাকিদের অধিকাংশই মুসলিম। মরিশাসে মুসলিমসহ বেশ কয়েকটি ধর্মীয় গোষ্ঠী সংসদীয় আইন দ্বারা স্বীকৃত, যারা নিজেদের জনসংখ্যার শতাংশ অনুসারে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি পায়।
ইতিহাস
[সম্পাদনা]

কিছু ঐতিহাসিক বিশ্বাস করতেন যে, মুসলমানরা ডাচদের সাথে দাস হিসেবে আরব থেকে মরিশাসে এসেছিল। তবে এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে; কারণ ডাচদের সাথে থাকা আরবরা মূলত ব্যবসায়ী ছিল। মুসলমানরা মরিশাসে ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮১০ সাল থেকে আসতে শুরু করে। ১৮৩৫ থেকে ১৯০৭ সালের মধ্যে প্রায় ৪,৫০,০০০ অভিবাসী ভারত থেকে মরিশাসে আসেন; বিশেষ করে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা, বঙ্গ, কলকাতা এবং মুম্বাই থেকে। ১৯০৯ সালের পর এই অভিবাসন বন্ধ হয়ে যায়। তাদের পাঁচ বছরের জন্য আনা হতো এবং এরপর ফেরত পাঠানো হতো। তবে ১৯২২ সালের মধ্যে মাত্র ১,৬০,০০০ জন ভারত ফিরে গিয়েছিল। বাকিরা মরিশাসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে দেয়। কিছু ধনী মুসলিম ব্যবসায়ী গুজরাত থেকে এলেও অভিবাসীদের বেশিরভাগ দরিদ্র শ্রমিক শ্রেণির ছিল। অনুমান করা হয়, ১৮৩৫ সালে এখানে মুসলিম জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৩৩% ছিল (তথ্যসূত্র নেই); ১৮৬১ সালে এটি ৬৪% এ পৌঁছেছিল (তথ্যসূত্র নেই)। তবে ১৯০৯ সালের মধ্যে তাদের সংখ্যা ২৫%-এর কমে নেমে আসে। ঐতিহ্যগতভাবে সুন্নিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ; তবে শিয়া ও বোহরাসহ অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠী মোট মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় ২০% গঠন করেছিল। [৫]
ককনি, কোজাস, বোহরা ও আগা-খানির অনুসারীরা ১৯১০ সালে পূর্ব আফ্রিকা থেকে মরিশাসে আসে বলে ধারণা করা হয়। মরিশাসে প্রচলিত তাওহীদি মতবাদ ধীরে ধীরে বিভিন্ন ইসলামি ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, যারা ভারতীয় মুসলমানদের ধর্মীয় অনুশীলন থেকে একধরনের আলাদা ধর্মীয় সংস্কৃতি গড়ে তোলে। তবে ১৯৭০-এর দশকে তেল-সমৃদ্ধ আরব দেশগুলোর উত্থানের পর এই প্রবণতায় পরিবর্তন আসে। [৬]:১৪২
সম্প্রদায়
[সম্পাদনা]মরিশাসে বসবাসকারী মুসলিমদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সুন্নি, যাদের সংখ্যা মোট মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ। সুন্নি মুসলিমরা আবার বিভিন্ন উপ-গোষ্ঠীতে বিভক্ত, যার মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ সালাফি মতবাদ অনুসরণ করে। যদিও অধিকাংশ সুন্নি হানাফি মাজহাব অনুসরণ করে থাকেন, তবে তাদের একটি অংশ শাফেঈ মাজহাব অনুসরণ করে। মরিশাসে কিছুসংখ্যক শিয়া মুসলমানও বাস করেন। এছাড়া মেইমন নামে একটি ছোট অথচ প্রভাবশালী অভিজাত মুসলিম গোষ্ঠীও রয়েছে, যারা রাজধানী পোর্ট লুইসের বিখ্যাত জুম্মা মসজিদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। [৭] [৮]
শিয়া মুসলমানদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩%। এদের একটি উপগোষ্ঠী হল "ককনি", যাদের ব্যাপারে ধারণা করা হয় যে, তারা মূলত ভারতের কুচিন শহর থেকে জাহাজ নির্মাণের কাজে এখানে আসে। ক্রেওল লাসকার হলো একটি নতুন গোষ্ঠী, যারা ককনি কিংবা অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে আন্তঃবিবাহের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। [৯] [১০]
মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মোট তিনটি প্রধান জাতিগত গোষ্ঠী রয়েছে—মেইমন ও সূরতি ( ভারতের গুজরাত রাজ্যের কচ্ছ ও সুরাত এলাকা থেকে আগত ব্যবসায়ী মুসলিম) ও হিন্দি ক্যালকাটিয়া নামের একটি গোষ্ঠী, যারা বিহার রাজ্য থেকে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক হিসেবে মরিশাসে এসেছিল। মুসলমানদের মধ্যে আরবি ও উর্দু ভাষার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ভাষা হলো ক্রেওল। এছাড়া আরও যেসব ভাষা মুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত, তার মধ্যে রয়েছে ভোজপুরি ও গুজরাতি। [১১] [১২]
সরকারি ধর্মীয় নীতি
[সম্পাদনা]
১৯৬৮ সালে মরিশাস স্বাধীনতা লাভ করে এবং তাদের সংবিধানে কোনো রাষ্ট্রধর্ম নির্ধারিত হয়নি। মরিশাসে আদিবাসী জনগোষ্ঠী বা কোন আদিম ধর্মবিশ্বাস ছিল না। স্বাধীনতার সময় যে সকল ধর্মীয় গোষ্ঠী বিদ্যমান ছিল, তাদেরকে সরকার সংসদীয় নির্দেশনার মাধ্যমে স্বীকৃতি দিয়েছে; যেমন: রোমান ক্যাথলিক চার্চ, চার্চ অব ইংল্যান্ড, প্রেসবিটারিয়ান চার্চ, সেভেন্থ ডে এডভান্টিস্ট, মুসলিম ও হিন্দু। [১৩]
সংবিধান ও অন্যান্য স্থানীয় আইন ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা করে। স্বাধীনতার আগে যে সকল ধর্মীয় গোষ্ঠী স্বীকৃতি পেয়েছিল, তারা এখনো বার্ষিক অর্থসাহায্য পায়। বিদেশি মিশনারি গোষ্ঠীগুলিকে ক্ষেত্রবিশেষে অনুমতি দেওয়া হয়, তবে ধর্মীয় প্রচারণার ওপর কোন কঠোর নিষেধাজ্ঞা নেই এবং মিশনারিদের জন্য তিন বছরের জন্য আবাসিক ও কাজ করার অনুমতিপত্র দেওয়া হয়; তবে তা নবায়নযোগ্য নয়। [১৩]
সরকারি ছুটির অধিকাংশই ধর্মীয় উৎসবভিত্তিক, যা মরিশাসের বহুধর্মীয় সমাজের প্রতিফলন। ২০১২ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর প্রকাশিত আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিবেদন অনুযায়ী, মরিশাসে কোনো ধর্মীয় নিপীড়নের ঘটনা ঘটেনি। তবে অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির মতে সরকারে হিন্দুদের আধিপত্য রয়েছে এবং তারা ধর্মান্তর-বিরোধী নীতি দাবি করেছে। [১৩]
মসজিদ ও প্রশাসন
[সম্পাদনা]১৯৬৫ সাল নাগাদ মরিশাসে ৬৫টি মসজিদ ছিল। [১৪] দেশের প্রথম নির্মিত মসজিদ হল ক্যাম্প দে লাসকার্স মসজিদ, যা আনুমানিক ১৮০৫ সালে নির্মিত হয় এবং বর্তমানে এটি “আল-আকসা মসজিদ” নামে পরিচিত। পোর্ট লুইস শহরে অবস্থিত জুম্মা মসজিদ ১৮৫০-এর দশকে নির্মিত হয় এবং মরিশাসের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশিকা বইয়ে এটিকে দেশের অন্যতম সুন্দর ধর্মীয় স্থাপনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। [১৫]
মরিশাসের প্রায় সকল মসজিদ একটি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যাকে ওয়াক্ফ বোর্ড বলা হয়। এটি একধরনের ধর্মীয় দাতব্য সংস্থা। মরিশাসে এই বোর্ড ১৯৪১ সালে গঠিত হয় এবং দেশের সকল মসজিদের প্রশাসন ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা তদারকি করে। প্রতিটি মসজিদে একজন করে মুতাওয়াল্লি নামের ব্যবস্থাপক থাকেন, যাকে সংশ্লিষ্ট মসজিদের মুসল্লিরা নির্বাচিত করে। ওয়াক্ফ বোর্ড জানাজার নামাজ, মাদ্রাসা শিক্ষা ও ইসলামি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনার কাজে সহায়তা করে। বড় বড় সব ধর্মীয় উৎসব, যেমন ঈদুল আজহা, ঈদুল ফিতর, ঈদে মিলাদুন্নবী, শবেবরাত, মেরাজ ও শিয়াদের জন্য মহররমের মত দিবসগুলিতে দেশের মসজিদগুলোতে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। [১৫]
বিশিষ্ট মুসলিম ব্যক্তিত্ব
[সম্পাদনা]- আবদুল লতিফ ওসমান – মরিশাসের প্রথম কৃষিমন্ত্রী।
- আব্দুর রাহমান ওসমান – মরিশাসের প্রথম গভর্নর জেনারেল
- আমিনা গরিব–দেশের দ্বিতীয় মুসলিম রাষ্ট্রপতি।
- কাসাম উতিম–মরিশাসের প্রথম মুসলিম রাষ্ট্রপতি।
- রউফ বুন্ধুন –মরিশাসের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট।
- আবদুল রাজ্জাক মুহাম্মদ – গৃহ ও ভূমি মন্ত্রী।
- মুস্তাফা বিহারি – ইমাম, সমাজসেবক ও সংসদ সদস্য।
- কাসাম কুরিমান – মরিশাস লেবার কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। [১৬]
- পারওয়েজ কুরিমুন–বিশিষ্ট মুসলিম সমাজসেবক। [১৭][১৮]
আরো দেখুন
[সম্পাদনা]সূত্র
[সম্পাদনা]- Richards, Alexandra (২০১১)। Mauritius: Rodrigues. Reunion। Bradt Travel Guides। আইএসবিএন 9781841629247।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "2022 HOUSING AND POPULATION CENSUS" (পিডিএফ)। Republic of Mauritius। মে ২০২৪। পৃষ্ঠা 136–138। সংগ্রহের তারিখ ৫ জুন ২০২৪।
- ↑ "Resident population by religion and sex" (পিডিএফ)। Statistics Mauritius। পৃষ্ঠা 68। ১৪ নভেম্বর ২০১২ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ নভেম্বর ২০১২।
- ↑ Bal, Ellen (২০০৭), "When Muslims Leave…: Muslims In British India and their Migration to and Settlement in Mauritius and Surinam", Oonk, Gijsbert, Global Indian Diasporas: Exploring Trajectories of Migration and Theory, IIAS Publications Series, Netherlands: Amsterdam University Press, আইএসবিএন 9789053560358
- ↑ "Mauritius 2012 International religious freedom report" (পিডিএফ)। United States Department of State, Bureau of Democracy, Human Rights and Labor। ২০১২। পৃষ্ঠা 1–3। সংগ্রহের তারিখ ২৪ অক্টোবর ২০১৬।
- ↑ Bosworth, Clifford Edmund, সম্পাদক (১৯৮৯)। The Encyclopaedia of Islam: Fascicules 111-112 : Masrah Mawlid। BRILL। পৃষ্ঠা 849। আইএসবিএন 9789004092396।
- ↑ Bal, Ellen (২০০৭), "When Muslims Leave…: Muslims In British India and their Migration to and Settlement in Mauritius and Surinam", Oonk, Gijsbert, Global Indian Diasporas: Exploring Trajectories of Migration and Theory, IIAS Publications Series, Netherlands: Amsterdam University Press, আইএসবিএন 9789053560358
- ↑ "Islam in Mauritius"। Academia। ২০১১। ৯ জুলাই ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ অক্টোবর ২০১৬।টেমপ্লেট:Circular reference
- ↑ "Islam in Mauritius"। Academia। ২০১১। ৯ জুলাই ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ অক্টোবর ২০১৬।
- ↑ Richards 2011, p. 38
- ↑ Richards 2011, p. 38
- ↑ Richards 2011, p. 37
- ↑ Richards 2011, p. 37
- ↑ ক খ গ Juergensmeyer, Mark; Roof, Wade Clark, সম্পাদকগণ (২০১১)। Encyclopedia of Global Religion। SAGE Publications। পৃষ্ঠা 762। আইএসবিএন 9781452266565।
- ↑ Singh, Nagendra Kr; Khan, Abdul Mabud, সম্পাদকগণ (২০০১)। Encyclopaedia of the World Muslims: Tribes, Castes and Communities, Volume 1। Global Vision Publishing House। আইএসবিএন 9788187746072।
- ↑ ক খ Bosworth, Clifford Edmund, সম্পাদক (১৯৮৯)। The Encyclopaedia of Islam: Fascicules 111-112 : Masrah Mawlid। BRILL। পৃষ্ঠা 849। আইএসবিএন 9789004092396।
- ↑ "Adieu Camarade!! | 5Plus"। www.5plus.mu (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৫-০৩।
- ↑ "Parwez Kureemun n'est plus | Sunday Times"। www.sundaytimesmauritius.com (ইংরেজি ভাষায়)। ৬ নভেম্বর ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০২-০৮।
- ↑ "Décès de Parvez Kureemun : une lumière s'est éteinte • Star"। Star (ফরাসি ভাষায়)। ২০১৭-১১-০৭। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০২-০৮।