বিষয়বস্তুতে চলুন

মজলিস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
১১৮৭ সালে ইরানের সেলজুক সাম্রাজ্যে আবু জায়েদ আল-কাশানীর স্বাক্ষরিত একটি পুকুরের ধারে মজলিসের দৃশ্য সহ বাটি। []

মজলিস ( আরবি: المجلس , pl. مجالس Majālis ) একটি আরবি শব্দ যার অর্থ 'বসার ঘর'। মজলিসে প্রশাসনিক, সামাজিক বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধরনের বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই ধরনের সভাগুলি সাধারণত মুসলিম বিশ্বের ভাষাগত বা সাংস্কৃতিক সংযোগ যুক্ত দেশগুলোতে হয়ে থাকে। মজলিস বলতে আইনসভাকেও বোঝানো যেতে পারে এবং কিছু রাজ্যে আইনসভা বা সমাবেশের নামে এটি ব্যবহৃত হয়।[][][]

ব্যুৎপত্তি

[সম্পাদনা]

মজলিস একটি আরবি শব্দ যার অর্থ বসার ঘর। [] এর সেমিটিক মূল হল ক্রিয়াপদ جَلَس জলাস অর্থ 'বসা',( সরকারের আসন)।[]

ইতিহাস

[সম্পাদনা]

ইসলাম-পূর্ব আরবে, মজলিস আরব উপজাতিদের পরিষদ ছিল। এখানে পুরুষ সদস্যরা সাধারণ স্বার্থের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ করতেন।[] পরিষদের সভাপতিত্ব করতেন প্রধান (শেখ)।[] রাশিদুন খিলাফতের সময়কালে, নতুন খলিফা নির্বাচনের জন্য মজলিস আশ-শুরা গঠিত হয়েছিল। আল-মাওয়ারদী লিখেছেন যে মজলিসের সদস্যদের তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে। প্রথমত, তাদের ন্যায়পরায়ণ হতে হবে। দ্বিতীয়ত, তাদের এত জ্ঞান থাকতে হবে যে তারা ভালো খলিফা আর খারাপ খলিফার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারেন। তৃতীয়ত, তাদের যথেষ্ট বিচক্ষণতা ও বিচারবুদ্ধি থাকতে হবে যাতে তারা সেরা খলিফা বেছে নিতে পারেন।

আবাসিক

[সম্পাদনা]
সংযুক্ত আরব আমিরাতের শেখ জায়েদ প্রাসাদ জাদুঘরের গ্র্যান্ড মজলিস
সানায় একটি মজলিস, ২০১৩

"মজলিস" শব্দটি ব্যক্তিগত স্থানকেও বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। সেখানে অতিথিদের গ্রহণ এবং আপ্যায়ন করা হয়।[] ঘরে দেয়ালের চারপাশে কুশন থাকে। অতিথিরা এখানে বসে। কুশন মেঝেতে বা উঁচু তাকের উপর রাখা হয়। যেহেতু আতিথেয়তাকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয়, তাই অনেক পরিবার তাদের অতিথিদের আরামদায়ক করে তুলতে গর্বিত।

অনেক আরব বাড়িতে, মজলিস হল সভাকক্ষ বা সামনের কক্ষ যা দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য ব্যবহৃত হয়। সৌদি আরবে, ঘরের মজলিস সাজানোর দায়িত্ব সাধারণত বাড়ির মহিলারা পালন করে। তারা নিজেরাই এই ঘর সাজান অথবা অন্য নারীদের সাথে বিনিময় করে কাজটি করিয়ে নেন। আসির প্রদেশ এবং ইয়েমেনের পার্শ্ববর্তী সাদা প্রদেশে, মজলিস রঙ করার জন্য আল-কাত্ত আল-আসিরি নামে এক ধরনের শিল্পশৈলী ব্যবহার হয়। মজলিসে জ্যামিতিক নকশা এবং উজ্জ্বল রং দিয়ে সাজানো হয়।[]

কখনো কখনো জনসাধারণের অপেক্ষার কক্ষকেও মজলিস বলা হয়। কারণ, এখানে মানুষ মিলিত হয় ও কথা বলে। এখানে ঘরের অভ্যন্তরীণ নকশায় ঐতিহ্যবাহী আল-কাত আল-আসিরি ব্যবহার করা হয়। আভায় অবস্থিত প্রাদেশিক বিমানবন্দরটি এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করার জন্য নকশা করা হয়েছে। বিমানবন্দরের একজন কর্মকর্তা বলেন, "আভা সৌদি আরবের প্রথম শহর যেখানে বিমানবন্দর স্থানীয় ঐতিহ্য শৈলীতে সজ্জিত হয়েছে।" প্রাদেশিক বিমানবন্দরের পরিচালক আব্দুল আজিজ আবু হারবা বলেন, "বিমানবন্দরের লাউঞ্জে বসার জায়গা ঐতিহ্যবাহী মজলিসের আদলে তৈরি করা হয়েছে। দেয়ালে বিভিন্ন রং দিয়ে আসিরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।"

সৌদি আরবের নজদে, দেয়ালের আচ্ছাদনে তারার আকৃতি এবং অন্যান্য জ্যামিতিক নকশা খোদাই করা থাকে। উঠোন এবং উঁচু স্তম্ভযুক্ত পোর্টিকোগুলি হল সেরা নাদজদি স্থাপত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এছাড়া, সূক্ষ্মভাবে খোদাই করা প্লাস্টার কাঠ (জিস) এবং রঙিন জানালার পর্দা বৈঠকখানা সাজাতে ব্যবহার করা হয়। ভাঙা বাড়ির ধ্বংসস্তূপে প্লাস্টারের কারুকাজের চমৎকার নমুনা দেখা যায়। এটা দেখতে হালকা, সুন্দর আর খোলামেলা লাগে। এই কারুকাজগুলো সাধারণত মজলিসের চারপাশে, কফির চুলার আশপাশে, আর দেয়ালের অংশে দেখা যেত। এখানে অতিথিরা বালিশে হেলান দিয়ে গালিচায় বসতেন। ডাউটি ভাবতেন, এই "জিসের নকশা", ও "জিপসামের খোদাইকাজ" হয়তো ভারতের স্থাপত্যরীতি থেকে এসেছে। কিন্তু নজদের কারুকাজ পূর্বাঞ্চল বা ওমানের ভারতীয় স্থাপত্যশৈলী থেকে আলাদা। বরং, নজদের নকশাগুলো প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার মোটিফ ও নকশার সাথে বেশি মিল রয়েছে। ড্যাডোর গোলাপ, তারা, ত্রিভুজ এবং স্তর-বাঁধানো চূড়ার নকশা - এই সবই প্রাচীন নিদর্শন এবং প্রাচীনকালে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে পাওয়া যেত। আল-কাসিম অঞ্চলটি এই শিল্পের আবাসস্থল বলে মনে হয়, এবং সেখানে সাধারণত এটি শক্ত সাদা প্লাস্টারে কাজ করা হয়, যদিও আপনি যা দেখেন তা সাধারণত কফির চুলার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকে। রিয়াদে, অলংকরণহীন কাদামাটিতে এর উদাহরণ দেখা যায়।

আইনসভা

[সম্পাদনা]
  • আজারবাইজান — জাতীয় পরিষদকে মিলি ম্যাক্লিস বলা হয়।
  • সার্কাসিয়ান মজলিস — সার্কাসিয়ার উপকূলীয় আদিঘে উপজাতিদের মধ্যে ঐক্যের জন্য মজলিস তৈরি হয়েছে।
  • ক্রিমিয়া ( ইউক্রেন -সংযুক্ত) — ক্রিমিয়ান তাতার জনগণের মজলিস
  • সাইপ্রাসটেমসিলসিলার মেকলিসি, সাইপ্রাস প্রজাতন্ত্রের প্রতিনিধি পরিষদ
    • উত্তর সাইপ্রাসকামহুরিয়েত মেকলিসি, উত্তর সাইপ্রাসের প্রজাতন্ত্রের পরিষদ
  • ইরাক — সংসদকে "মজলিস আন-নওয়াব" বলা হয়।
  • ইন্দোনেশিয়া — ইন্দোনেশিয়ার গণপরামর্শক পরিষদকে ইন্দোনেশিয়ান ভাষায়, মাজেলিস পারমুস্যাওয়ারাতান রাকয়াত (এমপিআর) বলা হয়।
  • ইরানইসলামী পরামর্শদাতা পরিষদ মজলেস-ই শোরা-ইয়ে ইসলামি নামে পরিচিত।
  • জর্ডানজর্ডানের সংসদ আরবিতে মজলিস আল-উম্মা নামে পরিচিত, এবং এর নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ মজলিস আল-নুয়াব নামেও পরিচিত।
  • কাজাখস্তান — মাজিলিস
  • কুয়েতকুয়েতের জাতীয় পরিষদ আরবিতে মজলিস-আল-উম্মা নামে পরিচিত।
  • মালয়েশিয়া - মালয়েশিয়ায় মজলিসের অনেক অর্থ রয়েছে কারণ মালয়েশিয়া একটি প্রভাবশালী মুসলিম বহুজাতিক দেশ। মালয়েশিয়ানরা জাতীয় মালয় ভাষায় "মজলিস" শব্দটি দিয়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কথা বোঝায়, যেমন টাউন কাউন্সিল (মজলিস পারবান্দারান) বা সিটি কাউন্সিল (মজলিস বান্দার রায়া)। এছাড়া, "মজলিস" শব্দটি সরকারি সংস্থার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়, যেমন স্থানীয় ও বুমিপুত্র মালয়দের জন্য পিপলস ট্রাস্ট কাউন্সিল (মজলিস আমানাহ রাকিয়াত), জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ (মজলিস কেসেলামাতান নেগারা), স্থানীয় ও বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য মালয়েশিয়ান পরীক্ষা পরিষদ (মজলিস পেপারিক্সান মালয়েশিয়া)। দেশের মুসলিমদের জন্য "মজলিস" প্রায়ই ইসলামী বিষয় এবং মালয়দের রীতিনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত (মজলিস হাল এহওয়াল আগামা ইসলাম দান আদাত ইস্তিয়াদাত), আর মালয়েশিয়ার নয়জন রাজার জন্য এটি রাজাদের পরিষদ (মজলিস রাজা-রাজা) বোঝায়।
  • মালদ্বীপগণ মজলিস
  • ওমান — ওমানের মজলিস
  • পাকিস্তানপাকিস্তানের সংসদ আনুষ্ঠানিকভাবে মজলিস-ই-শূরা নামে পরিচিত।
  • সৌদি আরবসৌদি আরবের মজলিস
  • তাজিকিস্তান - দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সুপ্রিম অ্যাসেম্বলি মজলিসি ওলি নামে পরিচিত। উচ্চকক্ষ জাতীয় অ্যাসেম্বলি মজলিস-ই মিলি নামে পরিচিত। অন্যদিকে প্রতিনিধি পরিষদ, নিম্নকক্ষ, মজলিস-ই নমোয়ন্দগন নামে পরিচিত।
  • তুরস্ক - তুরস্কের মহান জাতীয় সভা তুর্কিয়ে বুয়ুক মিলেট মেক্লিসি নামে পরিচিত
  • তুর্কমেনিস্তান - তুর্কমেনিস্তানের সমাবেশ তুর্কমেনিস্তান মেজলিসি নামে পরিচিত
  • উজবেকিস্তান - অলি মজলিস
  • সংযুক্ত আরব আমিরাতফেডারেল সুপ্রিম কাউন্সিল এবং ফেডারেল ন্যাশনাল কাউন্সিল, উভয়কেই আরবিতে "মজলিস" বলা হয়।
  • মজলিস ইদারা ছিল একটি সানজাকের প্রশাসনিক পরিষদের নাম, যা অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে এর সাধারণ প্রশাসনের জন্য দায়ী ছিল।
    • মজলিস 'উমুমি' ছিল উসমানীয় সাম্রাজ্যর জেরুজালেমের সানজাকের একটি সাধারণ পরিষদের নাম। এটি ১৯১৩ সালে জেরুজালেমে বিভিন্ন ক্বাযার প্রতিনিধিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং বছরে একবার সানজাকের বাজেট নির্ধারণের জন্য প্রধান সভা হত।

ইউনেস্কোর শিলালিপি

[সম্পাদনা]

৪ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে মজলিসকে ইউনেস্কোর অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান এবং কাতার এই উদ্যোগে একসঙ্গে অংশ নিয়েছিল।[] এই তালিকাভুক্তি মজলিসের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব এবং জীবন্ত ঐতিহ্যের প্রমাণ দেয়। এর ফলে মজলিসের সংরক্ষণ এবং ধারাবাহিকতা নিশ্চিত হয়। মজলিস ঐতিহাসিকভাবে পারিবারিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সভাগুলির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করেছে।

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. "Metropolitan Museum of Art"www.metmuseum.org 
  2. "عن المجلس"Federal National Council। ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ২৪ এপ্রিল ২০১৩ 
  3. Parliament of the Islamic Republic of Iran ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে.
  4. The Majlis Of The Future Today ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২২ জুলাই ২০১১ তারিখে — Leading UAE Interior Designers Set To Reveal Their Visions At Index, Dubai City Guide, 9 November 2009.
  5. "المجلس"। ১৯৯৮। 
  6. Prince Philip (consort of Elizabeth II, Queen of Great Britain) (৭ জুন ১৯৭৯)। Philosophy, Politics and Administration: The Rede Lecture, 1979 (ইংরেজি ভাষায়)। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 3। আইএসবিএন 978-0-521-22990-6 
  7. Meri, Josef (৩১ অক্টোবর ২০০৫)। Medieval Islamic civilization: an encyclopedia। Routledge। পৃষ্ঠা 171। আইএসবিএন 9780415966917 
  8. Adamec, Ludwig (২০০১)। Historical Dictionary of Islam। Rowman & Littlefield। পৃষ্ঠা 271। আইএসবিএন 9781442277243 
  9. "UNESCO - Majlis, a cultural and social space" 

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]