ভূমি জাদুঘর

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ভূমি জাদুঘর
ভূমি জাদুঘর
সাধারণ তথ্য
শহরনেত্রকোণা জেলা
দেশবাংলাদেশ
ভূমি জাদুঘর

ভূমি জাদুঘর বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলা শহরে অবস্থিত বাংলাদেশের প্রথম ভূমি জাদুঘর। এটি নেত্রকোণা সদর উপজেলায় শহরের প্রাণকেন্দ্র মেছুয়া বাজার বা ছোটবাজার এলাকায় অবস্থিত। বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা দূর করতে ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার জন্য ভূমি যাদুঘর স্থাপন করা হয়।[১]

ভূমি জাদুঘর ধারণা[সম্পাদনা]

ভূমি হতে আমরা উদ্ভুত এবং একদিন আমরা ভূমিতেই মিশে যাবো। ভূমি হচ্ছে আমাদের আমৃত্যু সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। ভূমিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও জীবন ব্যবস্থা। যুগ যুগ ধরে ভূমি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটে আসছে। এই ব্যবস্থাপনায় যারা জড়িত তারা রাষ্ট্র ও প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্ট প্লে করে। এদের কর্মকান্ডের সাথে জনগণের একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নেওয়ার আগে মানুষকে ভূমি অফিস থেকে সেবা গ্রহণ করতে হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাপনা বিষয়টি আধুনিক ও যুগোপযোগী করার জন্য ব্যপক গবেষণা দাবী রাখে। সরকারের কৃষি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের মতো ভূমি ব্যবস্থাপনা খাত সেবা খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। এ দেশের অনেক মানুষ না জানার কারণে অনেক ক্ষেত্রে ঠকে যায়। অজ্ঞতা দূর করতে পারলে মানুষ তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারবে। ভূমি ব্যবস্থাপনা ও ভূমি সেবা নিয়ে গবেষণা করতে আমাদের দেশে ভূমি শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হলে মানুষের অজ্ঞতা দূর হওয়ার সাথে সাথে একটি দক্ষ জনবল তৈরি হতে পারে এবং মানুষ তার প্রাপ্য সঠিক সেবা পেয়ে যাবে। সেই লক্ষে প্রতি জেলায় একটি ভূমি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা গেলে ভূমি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত আইন ও পদ্ধতির বিষয়ে মানুষের অজ্ঞতা ও ভীতি দূর হবে।[২] এই ধারণার উপর ভিত্তি করে নেত্রকোণা জেলায় মেছুয়া বাজার সংলগ্ন জমিদার আমলের পুরাতন কাচাড়ি বাড়িটিকে ভূমি জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়।

গৌরীপুর কাচারিকে ভূমি জাদুঘর ঘোষণার প্রেক্ষাপট[সম্পাদনা]

ময়মনসিংহ পরগনার জমিদারি কর্তৃত্ব ঈশা খাঁর পরে টাঙ্গাইলের তথা আটিয়া পরগনার অন্তর্গত টিকরার জমিদারদের কর্তৃত্বাধীন হয়। এরপর সতেরো শ আঠারো সালে নবাব মুর্শীদ কূলী খাঁর আস্থাভাজন কানুনগো কৃষ্ণ রায় হালদার ময়মনসিংহ পরগনার জমিদারি কর্তৃত্ব অর্জন করেন । তিনি সতেরো শ চুয়ান্ন সালে মৃত্যুবরণ করলে তাঁর চার পুত্র এই পরগনার জমিদারি স্বত্ব পান এবং তাঁরা পৈতৃক বাসস্থান জামালপুরের নিকটবর্তী মহিরামকূল ছেড়ে গৌরীপুরে এসে নতুন বাসস্থান গড়ে তোলেন । তাঁদের মৃত্যুর পর সতেরো শ চুয়াত্তর সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সরকার পরগনাটির জমিদারি চার চার ভাগ করে তাঁদের চারজনের উত্তরাধিকারীদেরকে আলাদা আলাদা জমিদারি সনদ দেয়। তাঁদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত পরাক্রমশালী যুগল কিশোর রায় চৌধুরী (কথিত আছে তিনি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ্দৌলার পুত্র এবং মোহনলালের ভাগ্নে যাকে দত্তক নেয়া হয়েছিল।) গৌরীপুরে জমিদারি প্রাপ্ত হয়ে এজমালিতে শহরের মেছুয়া বাজার সংলগ্ন গৌরীপুর রাজবাড়ির কাচারি স্থাপন করেন। বর্তমানে কাচারির বড় চৌচালা ঘরটি জমিদার রাজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর সময়ের হলেও এর ইতিহাস অনেক প্রাচীন। নেত্রকোনায় সব চেয়ে বড় সঙ্গীত শিল্পী সমাবেশটি ঘটেছিল বৃটিশ যুগে। গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন এই সমাবেশের উদ্যোক্তা, আয়োজক ও পৃষ্ঠপোষক। নেত্রকোণা শহরের মাছ বাজার সংলগ্ন কাচারি থেকেই এর আয়োজন করা হয়েছিল এবং কাচারির মাঠেই তা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। এ সঙ্গীত শিল্পী সমাবেশটি ব্রজেন্দ্র সঙ্গীত সম্মেলন নামেই খ্যাত। বিশ শতকের তিরিশের দশকের মাঝামাঝি নেত্রকোনা শহরে এই ব্রজেন্দ্র সঙ্গীত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সঙ্গীত শাস্ত্রে বাংলাদেশের অহঙ্কার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভূমিপুত্র মাইহার ঘরনার স্থপতিগুরু ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সহ দিল্লী,ইটাওয়া, লখনৌ,পূরী---ভারতের প্রভৃতি স্থানের আরো অনেক নামজাদা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পীর আগমন ঘটেছিল। বৃহত্তর ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, সুসং দুর্গাপুর এবং গৌরীপুরে কোনো ঘরানা অর্থাৎ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন রাগ রাগিণী গান-পরিবেশনায় কোনো স্বতন্ত্র সিদ্ধ স্টাইল বা রীতি গড়ে না উঠলেও একথা বলতেই হবে যে, এ তিনটি জমিদার বাড়িতে সঙ্গীত প্রশিক্ষণের আয়োজন-ব্যবস্থাটা ছিলো খুবই জমজমাট । এর কারণ তিনটি পরিবারেরই একাধিক সদস্য ছিলেন দক্ষ শিল্পী । তিরিশের দশকে গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী এবং তাঁর পুত্র বীরেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী উভয়েই ছিলেন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী । বিশ্ব সুর সঙ্গীতের অঙ্গনে অশেষ আবেদনময় এক জাদুকরী ফিউশনের স্রষ্টা খোদ রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের সন্ধানী নজরেও পড়েছিলেন গৌরীপুরের প্রখ্যাত যন্ত্রী বীরেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী । জানা গেছে, "মেছুয়া বাজারে অবস্থিত গৌরীপুরের কাছারি ছিল মহকুমার এক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃতি কেন্দ্র। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত,কবিগান, বাউলগান ইত্যাদি অনেক কিছুই হয়েছে সেখানে ।" একটা সময় পর্যন্ত অর্থাৎ আশির দশকে মার্কেট স্থাপন করে কাচারি বাড়ির সামনের লম্বা চওড়া মাঠটা গায়েব করার আগে পর্যন্ত। আর সেই জমিদারি যুগ থেকেই কবিগান, বাউলগান সহ অসংখ্য নাটক বিচিত্রাও এখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে সেখানে। মাছ বাজার সংলগ্ন গৌরিপুর কাচারির মাঠেই বৃহত্তর ময়মনসিংহ-সিলেট অঞ্চলের গৃহী ও মালজোড়া বাউলিয়ানার উদ্ভাবক , ত্রাতা ও অবিসংবাদিত দুই দিকপাল বাউল কবি রশিদ উদ্দিন এবং জালাল উদ্দিন খাঁ সহ দীন শরৎ, মিরাজ আলী, তৈয়ব আলী প্রমুখ সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন । উকিল মুন্সী র লোকজধারাশ্রয়ী সুরেলা বিরহ গাথা বা কাব্যগীতের পরিবেশনা , এবং সেই জমিদারি যুগ থেকেই নেত্রকোনার ধীমান কবিয়ালদের সমাজ বাস্তবতার গহীনদর্শী কবিয়ালি আসরের স্মৃতিও এখনো মুছে যায়নি। সাধু শ্রুতিপরম্পরায় এখনো এ সবের বহু দূরঅতীত দৃশ্যমান হয়। গৌরিপুরের জমিদার এবং ঐ সময়ের ধনী কৃষিজীবীরাও কাচারি প্রাঙ্গণে বাউল ও কবিগানের আসর-উপস্থাপনের আয়োজন করেছেন সত্য, এমনকি আর্থিক দিক দিয়ে অভাবী বাউল কবিয়ালদের তাঁরা রুটি ও মাথা গোঁজারও ব্যবস্থা করেছেন, কিন্তু সমাজের ভবিষ্যত প্রজন্মের উদ্দেশ্যে তাঁদের সৃষ্টি ধরে রাখার জন্য স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা তাঁরা করেননি। এখান থেকেই পরবর্তী সময়ে নেত্রকোণার ভূমি রাজস্ব আদায় সহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কিৃতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়ে আসছে। কালের সাক্ষী এই গৌরীপুর কাচারি যেখানে নেত্রকোণা সদর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কর্মকান্ড পরিচালিত হতো। ওই কার্যালয়ের যাবতীয় কার্যক্রম পাশে অবস্থিত একটি নতুন ভবনে স্থানান্তর করা হয়। এরপর ঐতিহ্যবাহী ঘরটি অনেকটা অব্যবহৃত হয়ে পড়ে। ফলে ওই কার্যালয়ে কর্মরত সহকারী ভূমি কর্মকর্তা কবি এনামূল হক পলাশ এবং লোক গবেষক সঞ্জয় সরকার ঘরটিতে একটি ‘ভূমি জাদুঘর’ (ভূমি ও কৃষি উপকরণ প্রদর্শনশালা) প্রতিষ্ঠার জন্য দাবি জানান। এ নিয়ে ২০ জুলাই ২০২১ সঞ্জয় সরকার জেলা প্রশাসক কাজী মো. আবদুর রহমানের কাছে লিখিত প্রস্তাব দেন। গত ৪ আগস্ট ২০২১ জেলা প্রশাসক ঘরটি পরিদর্শনসহ ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবন করে ভূমি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন।[৩]

বাংলাদেশের প্রথম ভূমি জাদুঘরের পথচলা[সম্পাদনা]

৪ আগস্ট ২০২১ তারিখে নেত্রকোণা সদর ইউনিয়ন ভূমি অফিস পুরাতন টিনের চৌচালা ঘর থেকে নতুন ভবনে স্থানান্তর হওয়ায় ঐতিহ্যবাহী ঘরটি সংরক্ষণের জন্য এটিকে ভূমি জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করা হয়।[৪]

ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন[সম্পাদনা]

২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখ ময়মনসিংহ বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার জনাব জনাব মোঃ শফিকুর রেজা বিশ্বাস নেত্রকোণা জেলায় ভূমি জাদুঘরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।

ভূমি জাদুঘরে প্রদর্শনযোগ্য বিষয়/বস্তু সমূহ[সম্পাদনা]

ভূমি জাদুঘরে দুইটি কর্ণার রাখা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে অ্যানালগ কর্ণার এবং অপরটি ডিজিটাল কর্ণার।

অ্যানালগ কর্ণারে সংরক্ষিত বিষয়/ বস্তু সমূহঃ আতশী কাঁচ, পাওয়ার গ্লাস, চেইন, গুনিয়া, কম্পাস, ট্রেসিং টেবিল, চেইন, সিন্ধুক, পুরাতন দলিল নমুনা, পুরাতন নক্সা নমুনা, পাট্টা চেক নমুনা, নিলাম, ইশতেহার, ৭ ধারা, ৪৬ ধারা সহ চেক, নিলামের বয়ানামা নমুনা, পুরাতন মিসকেসের আদেশের নমুনা, P/O, ৯৮/৭২, ভিপি সেন্সাস তালিকা, খতিয়ান ফরম নমুনা, মাঠ পর্চা নমুনা, সিএস মাঠ পর্চা নমুনা, এস এ মাঠ পর্চা নমুনা, মহালের প্রস্তাব, পাশ বহি নমুনা, ক্যাশ বহি নমুনা, সার্টিফিকেট রেজিস্টার নমুনা, পূর্বে কাচারিতে ব্যবহ্রত বন্দুক/বল্লম, চেইন, গুনিয়া, কম্পাস, ট্রেসিং টেবিল, টাইপ মেশিন ইত্যাদি।

অ্যানালগ কর্ণারে সংরক্ষিত বিষয়/ বস্তু সমূহঃ বড় টিভি/ কিয়স্ক, কম্পিউটার/ল্যাপটপ/প্রিন্টার , ভূমি সংক্রান্ত সকল বই, নামজারি, ভূমিহীন বন্দোবস্ত, একসনা নবায়ন ও লীজ, ভিপি লীজ, ভূমি উন্নয়ন কর সংক্রান্ত বিভিন্ন ধাপসমূহ/ব্যানার, গুচ্ছ গ্রাম/আশ্রয়ন প্রকল্পের ছবি, ভূমির সাথে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক ছবি, সকল মৌজার ম্যাপ ইত্যাদি।[৫]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "নেত্রকোনার 'গৌরীপুর কাচারি ভবন'কে 'ভূমি জাদুঘর' ঘোষণা"https://www.ntvbd.com/bangladesh। ২০২১-০৮-০৫। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৭-২৬  |work= এ বহিঃসংযোগ দেয়া (সাহায্য)
  2. পলাশ, এনামূল হক (ফেব্রুয়ারি ২০২০)। ভূমি ব্যবস্থাপনার সরল পাঠ (প্রথম সংস্করণ)। ঢাকা: নৈঋতা ক্যাফে। পৃষ্ঠা ১২৬। আইএসবিএন 978-9848124093 
  3. "গৌরীপুরের কাছারি ঘরটি এখন ভূমি জাদুঘর"প্রথম আলো। ২০২১-০৯-২৭। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৭-২৬ 
  4. "নেত্রকোনায় ভূমি জাদুঘর উদ্বোধন"যায়যায়দিন। ২০২১-০৯-২৯। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৭-২৬ 
  5. "নীরবে হারিয়ে গেলেন কবি সৈয়দ নাজমুল করিম আজাদ"https://www.bd-journal.com/। ২০২২-০৩-১৬। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৭-২৬  |work= এ বহিঃসংযোগ দেয়া (সাহায্য)