ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়
আচার্য্য ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়
আচার্য্য ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়
প্রাথমিক তথ্য
জন্ম(১৯০৯-১১-০৮)৮ নভেম্বর ১৯০৯
সরাই গ্রাম,পাণ্ডুয়া হুগলি, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ , ভারত
মৃত্যু৮ আগস্ট ১৯৭৭(1977-08-08) (বয়স ৬৭) কলকাতা,পশ্চিমবঙ্গ
ধরনভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত
পেশাকন্ঠশিল্পী,সুরকার সঙ্গীত পরিচালক

ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় ( ৮ নভেম্বর, ১৯০৯ – ৮ আগস্ট ১৯৭৭ [১] ) ছিলেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অন্যতম কন্ঠশিল্পী। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দিল্লি ঘরানার গুরু বা আচার্য হিসাবে পরিচিত হয়েও বাংলা চলচ্চিত্র জগতের শুরুর দিকের সঙ্গীত পরিচালকও ছিলেন তিনি। [২] বাংলা রাগসঙ্গীতেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন।

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন[সম্পাদনা]

ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ৮ ই নভেম্বর বৃটিশ ভারতের অধুনা পশ্চিমবঙ্গের  হুগলি জেলার পাণ্ডুয়া স্টেশনের কাছে সরাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আশুতোষ চট্টোপাধ্যায় ও মাতা প্রভাবতী দেবী। তাদের পরিবার সাধক গঙ্গাধর স্বামীর বংশধর ও গদাধর চট্টোপাধ্যায় তথা শ্রীরামকৃষ্ণ -এর পরিবারের  সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে তার মধ্যেও আধ্যাত্মিক প্রবণতা লক্ষিত হয়। [৩] এগারো বৎসর বয়সে উপনয়নের সময় যে গেরুয়া বসন পরে ব্রহ্মচর্য নিয়েছিলেন তার প্রভাব বহুদিন স্থায়ী হয়েছিল। [৪]

শিক্ষা ও সঙ্গীতচর্চা[সম্পাদনা]

শৈশবেই ভীষ্মদেবের মধ্যে সঙ্গীতের প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল। অল্প বয়সেই সংগীতের বিভিন্ন দিকে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন। তিনি কলকাতার সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা করেন এর পর ক্যালকাটা ট্রেনিং অ্যাকাডেমিতে ভরতি হয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বিদ্যাসাগর কলেজে ভরতির পর ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে পড়াশোনা করতে পারেন নি। [৫]

প্রাথমিক পাঠ -

স্কুলে পড়ার সময়ই ভীষ্মদেব শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাঠ নেন নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ও তার শিষ্য হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। এর পর চৌদ্দ বছর তালিম নেন দিল্লি ঘরানার খালিফা বাদল খানের কাছে। ভীষ্মদেবের ডাকনাম ছিল 'কালো'। বাদল খান সাহেব তাঁকে 'কাল্লু' বলে ডাকতেন। ভীষ্মদেব আগ্রা ঘরানার বন্দিশ সংগ্রহ করেন উস্তাদ ফৈয়াজ খানের থেকে। সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্রাবস্থায় ১৩ বৎসর বয়সে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে তার প্রথম দুখানিনিধুবাবুর টপ্পা ― রাগ খাম্বাজে  'এত কি চাতুরী সহে প্রাণ' ও 'সখি কি করে লোকের কথায়' গ্রামোফোন কোম্পানি হতে প্রকাশিত হয়। (রেকর্ড নম্বর - পি৭৪০২) এবং ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের  জুলাই মাসে  মেগাফোন কোম্পানি হতে একই গান দিয়ে শেষ রেকর্ড  প্রকাশিত হয়।(রেকর্ড নম্বর জেএনজি ৬২৩৭)[২][৫] তিনি হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের খেয়াল পরিবেশনার জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি মেগাফোন কোম্পানিতে সঙ্গীত পরিচালক ও প্রশিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন।[৬]

পেশাগত সঙ্গীতচর্চা

ভীষ্মদেব খেয়াল, টপ্পা ও ঠুংরি ― তিন বিভাগেই দক্ষতা অর্জন করেন। বেতার জগতে ও ঘরোয়া আসরে গানের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। কাজী নজরুল ইসলাম নিজের গানে ('এ মোর শ্রাবণ নিশি কাটে কেমনে') তার সুর আরোপ করেন।১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে কাজী নজরুল ইসলামের আগ্রহেই তিনি মেগাফোন কোম্পানিতে সঙ্গীত পরিচালনা ও শিক্ষার ভার নেন। এখানে অনেক নামকরা গাইয়ে, থিয়েটারের অভিনেত্রী ― কানন দেবী, এমন কি বেগম আখতারও তার কাছে  তালিম নিতেন। তার খেয়াল গানের রেকর্ড নিয়মিত প্রকাশিত হত। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে বেনারসে অনুষ্ঠিত প্রথম অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে বাংলা থেকে আমন্ত্রিত হন। ওই বছরেই বিবাহ করে শৌখিন ও সংসারী হয়ে ওঠেন। সঙ্গীত জগতেও নাম ছড়িয়ে পড়ে। বারাণসী, ফৈজাবাদ, এলাহাবাদ, কানপুর, লখনউ, সিন্ধুদেশের বিভিন্ন আসরে তার সঙ্গীত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পেলব শান্ত ও মধুর কন্ঠের অধিকারী ছিলেন তিনি।[৪] ১৯৩৬  খ্রিস্টাব্দের কোন এক সময় মেগাফোন কোম্পানির স্বত্বাধিকারী জে এন ঘোষ এবং কবি ও গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য তাঁকে বাংলা গান গাইতে অনুরোধ করেন। রেকর্ডিং এর নির্দিষ্ট দিনেই গীতিকার অজয় ভট্টাচার্যর কথায় সুরারোপ করে রেকর্ডিং সম্পন্ন করতেন। সে রকম গানগুলি হল - ‘ফুলের দিন হল যে অবসান’ এবং ‘শেষের গানটি ছিল তোমার লাগি [১]

১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ভীষ্মদেব ফিল্ম কর্পোরেশনে সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে যোগদান করেন। তিনি ছয়টি বাংলা ও ছয়টি হিন্দি চলচ্চিত্রের  সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এগুলির চারটিতে শচীন দেব বর্মণ তার সহকারী হিসাবে কাজ করেন। [৭] এই সিরিজের প্রথম ছায়াছবি ছিল সুশীল মজুমদারের পরিচালনায়  ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত ছায়াছবি রিক্তা । ভারতীয় ছায়াছবিতে এই প্রথম প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের অপূর্ব মিশ্রণে চলচ্চিত্র জগতে মাইলফলক হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। [৮]

কিংবদন্তি রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় একটানা বারো বৎসরের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রশিক্ষণ নেন তার কাছে। শিক্ষক হিসাবে তিনি ছিলেন ছাত্রদরদী। তার অন্যান্য ছাত্র ও শিষ্যেরা ছিলেন ― শ্যামানন্দ সিংহ, শচীন মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ভবানী দাস, প্রকাশকালী ঘোষাল, যূথিকা রায় প্রমুখেরা।

ভীষ্মদেবের ব্যস্ত কর্মজীবনে কোনোভাবে তাঁকে অস্থিরতা গ্রাস করেছিল। প্রচুর যশ ও অর্থের অধিকারী হয়েও মানসিক শান্তিলাভের আশায় ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে পণ্ডিচেরি আশ্রমে চলে যান। এই সময়ে দীর্ঘ সাত বছর তার পরিবারের সঙ্গে কারও যোগাযোগ ছিল না। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে সেখান থেকে ফিরে আসেন। তবে তিনি গান গাওয়া থেকে শুনতেন অনেক বেশি।[৪]

পুরস্কার এবং সম্মাননা[সম্পাদনা]

  • ১৯৭২ : সাম্মানিকডি.লিট  রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় [৭]
  • ১৯৭৫: পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রযোজনায় আচার্য্য ভীষ্মদেব চট্টাপাধ্যায়ের জীবনের উপর নির্মিত তথ্যচিত্র [৭]
  • ১৯৭৬: চন্ডীগডের প্রাচীন কলা-কেন্দ্রের সংগীত নাটক পুরস্কার [৭]
  • ১৯৭৯: কলকাতা দূরদর্শনের প্রযোজনায় আচার্য্য ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের জীবনের উপর নির্মিত তথ্যচিত্র [৭]
  • ১৯৯১: কলকাতা দূরদর্শনের প্রযোজনায় আচার্য্য ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের জীবনের উপর নির্মিত তথ্যচিত্র [৭]
  • ২০০৬: স্বামী সন্তদাস ইন্সটিটিউট অব কালচার প্রদত্ত স্বামী সন্তদাস স্মারক সম্মান (মরণোত্তর ) [৭]
  • ২০০৬: কলকাতা দূরদর্শনের প্রযোজনায় আচার্য্য ভীষ্মদেব চট্টাপাধ্যায়ের জীবনীর উপর নির্মিত তথ্যচিত্র [৭]

সঙ্গীতাচার্য ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বি টি রোড ক্যাম্পাসে ২০২০ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কণ্ঠসঙ্গীত বিভাগে তৈরি হয়েছে এক সংগ্রহশালা। সেখানে কিংবদন্তি এই শিল্পীর তানপুরা, হারমোনিয়াম, গানের সিডি-‌রেকর্ড, বিভিন্ন মেডেল, পদক, ব্যবহৃত জিনিসপত্র রয়েছে। রয়েছে তার উপর লিখিত বইপত্র, সুরোরোপিত ছবির ক্যাটালগও।[৯][১০]

 

স্মৃতিকথা[সম্পাদনা]

সঙ্গীতজগতের অনেক ব্যক্তিত্ব সঙ্গীতাচার্য ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণা করছেন বহুভাবে। তার কয়েকটি সংযোজিত হল-

"ভীষ্মদেবের মধ্যে রয়েছে সুরের এমন আলোকভাণ্ডার যা ক্ষনেক ঝলমলিয়ে উঠে স্তিমিত হয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, ক্রমেই যেন এক অমল দীপ্তিতে দেদীপ্যমান হয়ে ওঠে।

"কথার সঙ্গে সুরের মেলবন্ধনে সংগীত নামক যে অপরূপ বস্তুটি সৃষ্টি হয় তার হদিশ ওঁর কাছ থেকেই পেয়েছিলাম।"

[১১]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "আমার গান শোনো, তোমার গান গাও"। সংগ্রহের তারিখ ১২ মার্চ ২০১৯ 
  2. "স্মৃতির আলোয় ভীষ্মদেব"। ১ অক্টোবর ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ৩১ অক্টোবর ২০১৮ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  3. "Interview of Sri Jayanta Chattopadhyay"। সংগ্রহের তারিখ ৩১ অক্টোবর ২০১৮ 
  4. সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট  ২০১৬, পৃষ্ঠা ৫১৮, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  5. "Vishmadev Chattopadhyay biography"। ১৬ এপ্রিল ২০০৩। ১৬ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ অক্টোবর ২০১৮ 
  6. "গানের যুগ-সারথি"। সংগ্রহের তারিখ ৩১ অক্টোবর ২০১৮ 
  7. "Vishmadev Chattopadhyay"। সংগ্রহের তারিখ ৩১ অক্টোবর ২০১৮ 
  8. "Rikta (1939)"। সংগ্রহের তারিখ ৩১ অক্টোবর ২০১৮ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  9. ""এই শ্রাবণেই নিভে গিয়েছিল রাগসঙ্গীতের অম্লান এই শিখা""। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১০ 
  10. "সঙ্গীতাচার্য সংগ্রহশালা"। ২০২১-০৬-২৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১০ 
  11. "গান শেষ আর জান শেষ তো একই কথা রাজামশাই"। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১০