বিষয়বস্তুতে চলুন

ভাগ করো ও শাসন করো

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী এই স্লোগানের কৃতিত্ব ম্যাসিডনের দ্বিতীয় ফিলিপকে দেওয়া হয়: প্রাচীন গ্রিক: διαίρει καὶ βασίλευε (ডিয়েইরি কাই বাসিলেভে), যার অর্থ "ভাগ করো ও শাসন করো"।

ভাগ করো ও শাসন করো নীতি (লাতিন: divide et impera), বা বিভক্ত করো ও জয় করো, রাজনীতিসমাজবিজ্ঞানে ক্ষমতা দখল ও তা রক্ষা করার একটি কূটকৌশল, যেখানে কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান বিভাজনকে কাজে লাগানো হয় এবং ইচ্ছাকৃতভাবে এমন বিভাজন সৃষ্টি ও গভীর করা হয়। এর মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে শাসনকারীর অবস্থান মজবুত করা হয়।[]

প্রাচীনকালে এই শব্দগুচ্ছ প্রচলিত না হলেও, এই কৌশল বহু ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। অউলাস গাবিনিয়াসের ক্ষেত্রে এর একটি উদাহরণ পাওয়া যায়, যিনি ইহুদি জাতিকে পাঁচটি পৃথক অংশে বিভক্ত করেন। এ ঘটনাটি ফ্লাভিয়াস জোসেফাস তার "দ্য জিউইশ ওয়ার" (De Bello Judaico) গ্রন্থের প্রথম বইয়ের ১৬৯-১৭০ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেছেন।[]

স্ট্রাবো তার ভূগোলবিষয়ক গ্রন্থ 'জিওগ্রাফিকা'র অষ্টম খণ্ডে উল্লেখ করেন যে, আখাইয়ন লীগ রোমান প্রদেশ মেসিডোনিয়ার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। রোমানরা বিভিন্ন রাজ্যের প্রতি ভিন্ন আচরণ করত; তারা কিছু রাজ্যকে বজায় রাখতো, আবার কিছু রাজ্যকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল।[]

এই অপকৌশল বাস্তবায়নে ব্যবহৃত উপাদানসমূহ:

  • শাসকের বিরুদ্ধে জোট গঠনের সম্ভাবনা দূর করার জন্য, জনগণকে বিভক্ত করার চেষ্টা করা হয়। এছাড়া, একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শক্তি বিতরণ করা হয়, যাতে তারা একে অপরকে পরাস্ত করে।
  • যারা শাসকের সঙ্গে সহযোগিতা করতে আগ্রহী, তাদের সহায়তা ও সমর্থন করা।
  • স্থানীয় শাসকদের মধ্যে অবিশ্বাস ও শত্রুতা উসকে দেওয়া।
  • অপ্রয়োজনীয় ব্যয়কে উৎসাহিত করা, যা রাজনৈতিক ও সামরিক খাতে ব্যয়ের সক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

কৌশলগত ও ব্যবহারিক প্রয়োগ

[সম্পাদনা]

একজন শাসক এই অপকৌশল এর দ্বারা বিভিন্ন স্বার্থের মানুষের দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে বিভক্ত করে তাদের ওপর নিজের শাসন আরও দৃঢ় করতে পারে। নিক্কোলো মাকিয়াভেল্লি এই ধরনের সামরিক কৌশলের কথা তার দ্য আর্ট অফ ওয়ার বইয়ের ষষ্ঠ খণ্ডে উল্লেখ করেন যে একজন অধিনায়কের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত শত্রুর বাহিনীকে ভাগ করে ফেলা। শত্রুর বিশ্বাসযোগ্য সৈন্যদের প্রতি সন্দেহ প্রবণ করে তুলে অথবা শত্রুকে তার বাহিনী থেকে আলাদা করার মতো পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়ে এটা করা যায়, যাতে শত্রু দুর্বল হয়ে পড়ে।[]

ভাগ করো ও শাসন করো (divide et impera) নীতিটির জন্য ম্যাসিডনের দ্বিতীয় ফিলিপকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়। রোমান শাসক জুলিয়াস সিজার এবং ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এই কৌশল ব্যবহার করেছিলেন (এর সাথে "বিভক্ত কর এবং রাজ কর" নীতিটিও)।

ভাগ করো ও শাসন করো এই কৌশলটি বিভিন্ন সম্রাটের আমলে আরোপিত হয়েছে, যেমন ফ্রান্সের একাদশ লুই এবং হাবসবুর্গ রাজতন্ত্র। এডওয়ার্ড কোক ইংরেজ আইনের গ্রন্থে এই কৌশলটিকে নিন্দা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, যখন লর্ড এবং কমন্সরা এই নীতিকে তাদের সাফল্যের মূল সঞ্চালক হিসেবে চেয়েছিল, তখন উত্তর দেওয়া হয়েছিল, "তোমরা অপরাজেয় হবে যদি তোমরা এক হও। 'ভাগ করো ও শাসন করো' এই নীতি বর্জন করা হয়েছে, কারণ শাসনের আগা ও গোড়া জনগণের সমর্থনের উপর নির্ভর করে।"

১৫ ফেব্রুয়ারি ১৬১৫ তারিখের একটি চিঠিতে স্যার ফ্রান্সিস বেকন রাজা প্রথম জেমসকে সামান্য পরিবর্তন করে সেপারা এট ইম্পেরা (পৃথক করো ও শাসন করো) এই বাক্যটি লিখেছিলেন। জেমস ম্যাডিসন ২৪ অক্টোবর ১৭৮৭ তারিখে টমাস জেফারসনকে একটি চিঠিতে এই কৌশলের পরামর্শ দিয়েছিলেন, যা দ্য ফেডারালিস্ট গ্রন্থের মূল তত্ত্বের একটি সারাংশ ছিল।[]


ইমানুয়েল কান্টের স্থায়ী শান্তি (১৭৯৫ ) রচনার প্রথম পরিশিষ্টে তিনটি রাজনৈতিক নীতির উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে তৃতীয় নীতি হল দিভাইড এট ইম্পেরা (ভাগ করো ও শাসন করো)। অন্য দুটি নীতি হল: ফ্যাক এট এক্সকুসা (আগে কাজ করো, পরে অজুহাত দাও) এবং সি ফেসিসটি, নেগা (যদি অপরাধ করে থাকো, তা অস্বীকার করো)। দিভাইড এট ইম্পেরা , যা সাধারণত অত্যাচারের নীতি হিসেবে সমালোচিত, এই নীতির মূলে রয়েছে বিভাজন সৃষ্টি করে শাসন করার এক অসৎ চেষ্টা, যা সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং একতা ধ্বংস করে দেয়।[]কান্ট এই কৌশলটি ব্যবহার করেছিলেন, যখন তিনি একজন 'রাজনৈতিক দার্শনিক'-এর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেন।

অর্থনীতিতে এই ধারণাটিকে বাজার বিভাজনের একটি কৌশল হিসেবে উল্লেখ করা হয়, যার মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অংশগ্রহণকারীদের থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করা সম্ভব হয়।[]

পররাষ্ট্র নীতি

[সম্পাদনা]

ভাগ করো ও শাসন করো নীতি অনুসরণ করে রাষ্ট্রগুলি প্রায়শই শত্রুপক্ষের সামরিক জোটকে দুর্বল করার চেষ্টা করতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় সাধারণত শত্রু রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে প্রোপাগান্ডা বা মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যার ফলে জোট সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টি হয়। যখন জোট দুর্বল হয়ে পড়ে অথবা ভেঙে গেলে, শূন্যস্থানটিতে শত্রু রাষ্ট্র সহজেই সামরিক শক্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

ভাগ করো ও শাসন করো কৌশলটি কূটনীতিতে ব্যবহৃত 'পার্থক্য সৃষ্টির কৌশল'-এর ধারণার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এর উদ্দেশ্য হলো কোনো একটা গোষ্ঠীকে ভেঙে ফেলা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

[সম্পাদনা]

কিছু বিশ্লেষক দাবি করেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একবিংশ শতাব্দীর মধ্যপ্রাচ্যে সুন্নি ও শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যকার বিরোধকে ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়িয়ে তুলে ভাগ করো ও শাসন করো নীতি অনুসরণ করে। ব্রিটিশ সাংবাদিক নাফিজ আহমেদ ২০০৮ সালে র‌্যান্ড কর্পোরেশন কর্তৃক প্রকাশিত একটি গবেষণায় উল্লেখ করেন যে, মার্কিন সেনাবাহিনীর জন্য তৈরি করা "দীর্ঘ যুদ্ধ" শীর্ষক এই গবেষণায় মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে "ভাগ করো ও শাসন করো" কৌশলকে একটি সম্ভাব্য উপায় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।[]

ইসরায়েল

[সম্পাদনা]

ইসরায়েলি ধর্মীয় বিষয়ক কর্মকর্তা প্রফেসর আভনার কোহেন, প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন যে, হামাস ছিল " ইসরায়েলের সৃষ্টি"।[] একই ধরনের মন্তব্য ইয়াসির আরাফাতও করেছেন।[১০]

ইসরায়েলের হামাসকে সমর্থনের অভিযোগগুলি ১৯৭০ ও ১৯৮০ সালের শুরুর দিকের ইঙ্গিত বহন করে, যখন মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজমান ছিল। প্রাক্তন ইসরায়েলি কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন যে, ইসরায়েল হামাসকে অর্থ ও সাহায্য প্রদান করেছে, মূলত প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) এর মতো সেক্যুলার প্যালেস্টাইনীয় সংগঠনগুলিকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইৎসাখ সেগেভ, যিনি ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গাজার ইসরায়েলি সামরিক গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, স্বীকার করেছেন যে, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডকে অর্থ সাহায্য দিয়েছিলেন, যা পরবর্তীতে হামাসে পরিণত হয়। এই সহায়তার উদ্দেশ্য ছিল বামপন্থী ও সেক্যুলার প্যালেস্টাইনীয় সংগঠনগুলিকে দুর্বল করা।[১১]

রাশিয়া

[সম্পাদনা]

আধুনিক রাশিয়ার কর্মকাণ্ডে "ভাগ করো ও শাসন করো" কৌশলের বৈশিষ্ট্যও পরিলক্ষিত হয়। এটি অভ্যন্তরীণভাবে ভ্লাদিমির পুতিনের ক্ষমতা রক্ষা করতে ব্যবহৃত হয়[১২] এবং আন্তর্জাতিকভাবে রাশিয়ার মিথ্যা তথ্য প্রচারের মাধ্যমে "শাসন নিরাপত্তা, রাশিয়ার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রাধান্য, এবং বিশ্বশক্তির অবস্থান" অর্জনের জন্য প্রয়োগ করা হয়।[১৩]

আরোও দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Spritzler, John (২০১৭-০৬-১৯)। Divide and Rule: The Left Vs. Right Trap (ইংরেজি ভাষায়)। Independently Published। আইএসবিএন 978-1-5215-4368-9 
  2. "Flavius Josephus, The Wars of the Jews, Book I, section 159"www.perseus.tufts.edu। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৯-০৫ 
  3. "Strabo, Geography, BOOK VIII., CHAPTER VII., section 1"www.perseus.tufts.edu। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৯-০৫ 
  4. Machiavelli, Niccolo (২০০৩)। Thomas, Steve, সম্পাদক। The Art of War6। The University of Adelaide Library। ২০০৭-০৬-২৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  5. "The Federalist #10"constitution.org 
  6. "Immanuel Kant: Perpetual Peace: Appendix I"Online Library of Liberty। ১৮ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ অক্টোবর ২০২১ 
  7. Webber, Harry (১৯৯৮-০৬-১৯)। Divide and Conquer: Target Your Customers Through Market Segmentation (ইংরেজি ভাষায়)। John Wiley & Sons। আইএসবিএন 978-0-471-17633-6 
  8. "The Pentagon plan to 'divide and rule' the Muslim world"Middle East Eye (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৬-২৯ 
  9. Higgins, Andrew (২৪ জানুয়ারি ২০০৯)। "How Israel Helped to Spawn Hamas - WSJ"WSJ। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ মে ২০২৪ 
  10. "How Israel went from helping 'create' Hamas to bombing it"The Business Standard (ইংরেজি ভাষায়)। ১৪ অক্টোবর ২০২৩। ১ মে ২০২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ মে ২০২৪ 
  11. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; blowback নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  12. Reddaway, Peter (২০১৮)। Russia's domestic security wars: Putin's use of divide and rule against his hardline allies। Palgrave Pivot। আইএসবিএন 978-3319773919 
  13. Karlsen, Geir Hågen (২০১৯-০২-০৮)। "Divide and rule: ten lessons about Russian political influence activities in Europe"। Palgrave Communications (ইংরেজি ভাষায়)। 5 (1): 1–14। আইএসএসএন 2055-1045ডিওআই:10.1057/s41599-019-0227-8অবাধে প্রবেশযোগ্য