ভদ্রলোকদের চুক্তি
ভদ্রলোকের চুক্তি, বা ভদ্রলোকের চুক্তি, দুই বা ততোধিক পক্ষের মধ্যে একটি অনানুষ্ঠানিক এবং আইনত বাধ্যতামূলক নয় এমন চুক্তি । এই চুক্তি আইন দিয়ে বাধ্যতামূলক নয়, অর্থাৎ কেউ না মানলেও আইনের মাধ্যমে তাকে বাধ্য করা যায় না। এ ধরনের চুক্তি সাধারণত কথাবার্তার মাধ্যমে হয়, তবে কখনও কখনও লিখেও করা হতে পারে। আবার অনেক সময় এটা কিছু না বলেও রীতি বা শিষ্টাচার অনুযায়ী বোঝা যায়। একটা ভদ্রলোকের চুক্তির সারমর্ম হল এটি কোনওভাবেই বলবৎযোগ্য না হয়ে বরং তার পরিপূর্ণতার জন্য পক্ষগুলি সম্মানের উপর নির্ভর করে। এটি একটি আইনি চুক্তি বা চুক্তি থেকে আলাদা। এই চুক্তি আইনি চুক্তির মতো শক্তিশালী নয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে এর থেকে একটু বেশি আনুষ্ঠানিক রূপ হয়, যাকে বলা হয় সমঝোতা স্মারক তাও আইনত বাধ্যতামূলক নয় ।
ইতিহাস
[সম্পাদনা]শব্দটি প্রথম ব্যবহার হয় ১৮২১ সালে ব্রিটিশ সংসদীয় রেকর্ডে [১] এবং ১৮৩৫ সালে ম্যাসাচুসেটস পাবলিক রেকর্ডে দেখা যায়। [২] তবেঅক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধান অনুযায়ী, লেখক পি.জি. ওডহাউসের তাঁর ১৯২৯ সালের গল্প সংকলন মিস্টার মুলিনার স্পিকিং-এ প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
শিল্প
[সম্পাদনা]ভদ্রলোকের চুক্তি–কে ২০শ শতকের শুরুতে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল: "দুই বা একাধিক ভদ্রলোকের মধ্যে এমন একটি চুক্তি, যার উদ্দেশ্য দামের নিয়ন্ত্রণ করা।" একাধিক সূত্র অনুযায়ী, এই ধরনের চুক্তিকে একটি "পুল" ব্যবস্থার সবচেয়ে শিথিল বা অনানুষ্ঠানিক রূপ হিসেবে ধরা হতো। এই চুক্তি প্রায় সব ধরনের শিল্পে দেখা গেছে, তবে বিশেষ করে ২০শ শতকের শুরুর দিকে আমেরিকার লৌহ ও ইস্পাত শিল্পে এমন চুক্তির সংখ্যা ছিল বেশ উল্লেখযোগ্য। [৩]
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের একটি প্রতিবেদনে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইস্পাত কর্পোরেশনের তদন্তের বিশদ বিবরণ দেয়, দাবি করা হয়েছে যে ১৮৯০-এর দশকে ইস্পাত এবং লোহার স্বার্থের মধ্যে দুটি সাধারণ ধরণের আলগা সংযোগ বা একত্রীকরণ ছিল যেখানে ব্যক্তিগত স্বার্থ মালিকানা এবং বৃহৎ পরিমাণে স্বাধীনতা বজায় রেখেছিল: "পুল" এবং "ভদ্রলোকের চুক্তি"। ভদ্রলোকের চুক্তি এই ধরনের সমঝোতায় কোনো আনুষ্ঠানিক কাঠামো থাকত না, যা উৎপাদন বা দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারত, এবং কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও থাকত না নিয়ম ভঙ্গের ক্ষেত্রে। এই ধরনের চুক্তি পুরোপুরি নির্ভর করত সদস্যদের স্বেচ্ছা প্রতিশ্রুতি ও পারস্পরিক বিশ্বাসের ওপর। [৪]
অটোমোবাইল শিল্পে, জাপানি নির্মাতারা একসময় নিজেদের মধ্যে এক ধরনের ভদ্রলোকের চুক্তি করেন, যাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়—কোনো প্রোডাকশন কার (ব্যবসায়িকভাবে উৎপাদিত গাড়ি) ২৮০ পিএস (২৭৬ হর্সপাওয়ার বা ২০৬ কিলোওয়াট)–এর বেশি শক্তিশালী হবে না। এই অনানুষ্ঠানিক চুক্তি ২০০৫ সালে শেষ হয়। [৫][৬] অন্যদিকে, জার্মান নির্মাতারা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সেডান ও স্টেশন ওয়াগনের সর্বোচ্চ গতি সীমিত রাখেন ২৫০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা (১৫৫ মাইল প্রতি ঘণ্টা)–তে। [৭][৮] কিছু গাড়ি নির্মাতা, যেমন মার্সিডিজ-বেঞ্জ, অতিরিক্ত অর্থে গতি সীমাবদ্ধকারী সরানোর বা গতি বাড়ানোর অপশন দিয়ে থাকে।। [৯] ১৯৯৯ সালে সুজুকি হায়াবুসা মোটরসাইকেলটি যখন ৩১০ কিমি/ঘণ্টা (১৯০ মাইল/ঘণ্টা) গতির সীমা অতিক্রম করে, তখন ইউরোপে নিষেধাজ্ঞা বা কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের আশঙ্কা দেখা দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে, ১৯৯৯ সালের শেষ দিকে জাপানি ও ইউরোপীয় মোটরসাইকেল নির্মাতারা ভদ্রলোকের চুক্তির মাধ্যমে সর্বোচ্চ গতি ৩০০ কিমি/ঘণ্টা (১৮৬ মাইল/ঘণ্টা) সীমিত রাখার সিদ্ধান্ত নেন। [১০]
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
[সম্পাদনা]পশ্চিম উপকূলে যখন তীব্র জাপান-বিরোধী মনোভাব গড়ে ওঠে, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট জাপানের সঙ্গে বিরোধ তৈরি করতে চাননি, যেমনটি চীনা অভিবাসনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে করা হয়েছিল। তাই তিনি জাপানি অভিবাসন নিষিদ্ধ করার আইন সমর্থন না করে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মধ্যে একটি অনানুষ্ঠানিক “ভদ্রলোকের চুক্তি” (১৯০৭–০৮) এবং একটি অনুরূপ “লেডিস’ এগ্রিমেন্ট” গ্রহণ করেন। এই চুক্তির আওতায় জাপান নিশ্চিত করে যে, যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন খুব সামান্য বা একেবারে না হওয়ার মতো সীমিত থাকবে।
এই চুক্তিগুলো হয় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলাইহু রুট এবং জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাদাসু হায়াশি-এর মধ্যে। চুক্তি অনুযায়ী, জাপানি শ্রমিকদের যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নিষিদ্ধ করা হয় এবং ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকো স্কুল বোর্ড কর্তৃক জারি করা বর্ণভিত্তিক পৃথকীকরণ আদেশ প্রত্যাহার করা হয়, যা জাপানিদের অপমানিত করেছিল এবং ক্ষুব্ধ করেছিল।
এই চুক্তি হাওয়াইয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না। এই চুক্তিগুলো কার্যকর ছিল ১৯২৪ সাল পর্যন্ত, যখন মার্কিন কংগ্রেস জাপান থেকে সব ধরনের অভিবাসন নিষিদ্ধ করে দেয়। একই সময়ে কানাডায় একই রকম জাপান-বিরোধী মনোভাব হায়াশি-লেমিউক্স চুক্তির দিকে পরিচালিত করে, যাকে " ১৯০৮ সালের ভদ্রলোকের চুক্তি " নামেও উল্লেখ করা হয়, যার ধারা এবং প্রভাবগুলি প্রায় একই রকম ছিল। [১১]
বাণিজ্য নীতি
[সম্পাদনা]ভদ্রলোকের চুক্তি এখন আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয়, যেমন অর্থনৈতিক নীতি বা বাণিজ্য নীতির সমন্বয়। [১২] এডমন্ড অসমানচিকের মতে, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক চুক্তি অভিধানে এটিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে “একটি আন্তর্জাতিক পরিভাষা, যা লিখিত নয় বরং মৌখিকভাবে গৃহীত চুক্তিকে বোঝায়, তবে যা সম্পূর্ণভাবে আইনগতভাবে বৈধ।” [১৩] এএই ধরনের চুক্তি একটি জাতিকে আনুষ্ঠানিক চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ আইনি শর্তাবলী এড়িয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে,[১২] অথবা যখন কোনো সরকার গোপন চুক্তি করতে চায় যা পরবর্তী প্রশাসনের জন্য বাধ্যতামূলক নয়, তখনও এটি কাজে লাগে। অন্য এক লেখকের মতে, সব আন্তর্জাতিক চুক্তিই ভদ্রলোকের চুক্তি, কারণ যুদ্ধের ব্যতীত সেগুলো বাস্তবায়নযোগ্য নয়। [১৪] ওসমানজিক উল্লেখ করেছেন যে খোলা ভদ্রলোকদের চুক্তি এবং গোপন কূটনৈতিক চুক্তির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ১৮৯০ সালে রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভদ্রলোকদের চুক্তির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল, কারণ এই ধরনের চুক্তির গোপনীয়তা কারও নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। [১৩]
ইংরেজি চুক্তি আইনে, একটি চুক্তি বাধ্যতামূলক হতে হলে পক্ষগুলোর মধ্যে আইনগত সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্য থাকতে হবে; তবে ব্যবসায়িক লেনদেনে (অর্থাৎ, পারিবারিক বা বন্ধুদের মধ্যে নয় এমন চুক্তিতে) “আইনগত সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্য” থাকার একটি আইনি অনুমান থাকে।
তবে, ১৯২৫ সালের 'রোজ অ্যান্ড ফ্রাঙ্ক কোম্পানি বনাম জেআর ক্রম্পটন অ্যান্ড ব্রোস লিমিটেড' মামলায় হাউস অব লর্ডস রায় দেয় যে, “এই ব্যবস্থাটি একটি আনুষ্ঠানিক বা আইনি চুক্তি নয় বরং কেবল পক্ষগুলোর অভিপ্রায়ের একটি নথি মাত্র” এই ধরনের একটি বাক্যই ওই অনুমানকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য যথেষ্ট।
বৈষম্যমূলক কৌশল হিসেবে
[সম্পাদনা]ভদ্রলোকের চুক্তি ছিল যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চবর্গীয় এলাকার ও উপশহরগুলোর একজাতীয়তা রক্ষায় ব্যবহৃত একটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত বৈষম্যমূলক কৌশল, যা প্রতিবন্ধক শর্তের চেয়ে বেশি প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন][১৫][১৬] এই চুক্তিগুলোর প্রকৃতির কারণে সেগুলো প্রমাণ করা বা অনুসরণ করা খুবই কঠিন ছিল, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের শেলি বনাম ক্রেমার এবং ব্যারোস বনাম জ্যাকসন মামলার রায়ের পরও এগুলো কার্যকর ছিল। ১৯৯৫ সালের এক সূত্রে বলা হয়, ভদ্রলোকের চুক্তি "নিঃসন্দেহে এখনও রয়েছে," তবে এর ব্যবহার অনেকটাই কমে গেছে। [১৭]
১৯৪৬ সালে জ্যাকি রবিনসনকে ব্রুকলিন ডজার্স কর্তৃক নিয়োগ না দেওয়া পর্যন্ত, একটি ভদ্রলোকের চুক্তি নিশ্চিত করেছিল যে আফ্রিকান আমেরিকান খেলোয়াড়দের সংগঠিত বেসবল থেকে বাদ দেওয়া হবে ।
আরো দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Great Britain. Parliament (১৮১২), Royal Commission of the Press, 2, G.E. Eyre and W. Spottiswoode, printers to the Queen's Most Excellent Majesty, পৃষ্ঠা 267
- ↑ Massachusetts (১৮৩৫), Public documents of Massachusetts, 4, পৃষ্ঠা 150
- ↑ Jones, Elio (১৯২১)। "II"। The Trust Problem in the United States। Macmillan Company। পৃষ্ঠা 7–8। সংগ্রহের তারিখ জুন ২৮, ২০১০।
- ↑ United States House of Representatives (১৯১২)। United States Steel Corporation: Hearings before the Committee on Investigation of United States Steel Corporation.। Government Printing Office। সংগ্রহের তারিখ জুন ২৮, ২০১০।
- ↑ Oagana, Alex (২০২৪-০২-২১)। "The Japanese Gentlemen's Agreement on Horsepower: A Failed Rule of Self-Restraint"। autoevolution। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৩-২৩।
- ↑ Biermann, Roger (২০২৫-০১-২৪)। "JDM Gentleman's Agreement: Why Iconic Japanese Cars Are Limited To 276 HP"। CarBuzz। সংগ্রহের তারিখ ২০২৫-০৩-২৩।
- ↑ Bogdan Popa (২৮ জুলাই ২০১২)। "Gentlemen's Agreement: Not So Fast, Sir!"। autoevolution। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫।
- ↑ van Gorp, Anke. "Ethical Issues in Engineering Design; Safety and Sustainability" page 16. Published by 3TU Ethics, 2005. আইএসবিএন ৯০৯০১৯৯০৭১, 9789090199078. ISSN 1574-941X
- ↑ Mike Spinelli (২০০৬-০২-১১)। "So Long Guv'nor: Mercedes Will Unlock Top Speed on AMG Models in the US, for a Price"। Jalopink। ২০১১-০৮-১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০৯-২৮।
- ↑ John Burns (এপ্রিল ২, ২০১২), "Fifty years of "Do you have any idea how fast you were going?": A brief history of Ludicrous Speed", Cycle World, এপ্রিল ৭, ২০১২ তারিখে আসল থেকে আর্কাইভকৃত
- ↑ "Gentlemen's Agreement, 1908 | Pier 21"। ২০২১-০৪-১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৫-২১।
- ↑ ক খ Kotera, Akira (১৯৯১)। "Western Export Controls Affecting the Eastern Bloc"। Law and Politics of West-East Technology Transfer। Martinus Nijhoff Publishers। পৃষ্ঠা 34–38। আইএসবিএন 9780792309901।
- ↑ ক খ Osmańczyk, Edmund Jan (২০০৩)। Encyclopedia of the United Nations and International Agreements: G to M (Third সংস্করণ)। Routledge। পৃষ্ঠা 792। আইএসবিএন 9780415939225। সংগ্রহের তারিখ জুন ২৮, ২০১০।
- ↑ Shafritz, Jay M. (২৭ আগস্ট ২০০৪)। The Dictionary of Public Policy and Administration। Westview Press। পৃষ্ঠা 131। আইএসবিএন 9780813342603।
- ↑ "Covenants & Conventions Richard R. W. Brooks∗ Northwestern University Law School" (পিডিএফ)। law.yale.edu। সংগ্রহের তারিখ ২১ মে ২০২৫।
- ↑ "Gentlemen's Agreement"। The Daily Omnivore (ইংরেজি ভাষায়)। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২। সংগ্রহের তারিখ ২১ মে ২০২৫।
- ↑ Higley, Stephen Richard (১৯৯৫)। Privilege, Power, and Place: The Geography of the American Upper Class। Rowman & Littlefield। পৃষ্ঠা 40–41, 61। আইএসবিএন 9780847680214। সংগ্রহের তারিখ জুন ২৮, ২০১০।